Saturday, 25 May 2019

আলফ্রেড নোবেলের বিস্ফোরক ভালোবাসা - পর্ব-৩ (শেষ)


সোফির কথা রাশিয়ায় আলফ্রেডের বড়ভাই লুডভিগের কানেও গেছে। তিনি দেখলেন সোফির কারণে আলফ্রেড শুধু নয় পুরো নোবেল পরিবারেরই সামাজিক মর্যাদায় ধ্বস নামতে পারে। তিনি আলফ্রেডের অজান্তে সোফির সাথে দেখা করলেন। দেখলেন সোফির উচ্চাকাঙ্খা। সোফিকে তিনি কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে আলফ্রেডের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু সোফি ততদিনে ভালো করেই জেনে গেছেন যে আলফ্রেডের সাথে থেকে তিনি একদিন পুরো নোবেল সাম্রাজ্যের মালিক হতে পারবেন। তাঁর শুধু দরকার আলফ্রেডের ভালোবাসার স্বীকৃতি।

লুডভিগ সোফির পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে খবর নিলেন। সোফির আরো কয়েকটা বোন আছে - এবং তারাও সবাই সুন্দরী এবং সৌন্দর্যকে পুঁজি করে বাড়তে জানেন। লুডভিগ আলফ্রেডকে বোঝাতে চাইলেন যে সোফি এবং তার পরিবার আলফ্রেডকে ফাঁসাতে চাইবে। আলফ্রেড যদি কোনভাবে সোফিকে বিয়ে করে তাহলে ভীষণ বিপদে পড়বে। সোফির মত নিচুশ্রেণির মেয়েরা আলফ্রেডের মত মানুষের জীবনের অংশ হবার উপযুক্ত নয় কিছুতেই। আলফ্রেড এ ব্যাপারে কিছুই বললেন না তার বড়ভাইকে।

আলফ্রেড সোফিকে তাঁর মানসিক অবলম্বন ভাবতে চাইলেন। তিনি তাঁর কাজ, গবেষণা, কারখানা, ব্যবসা সবকিছু সম্পর্কেই সোফিকে বিস্তারিত লিখে জানান। কিন্তু সোফির সেসব প্রসঙ্গে কোন কিছু বলার মত যেটুকু পড়াশোনা দরকার বা বোঝার মত যেটুকু মানসিক ক্ষমতা দরকার তা নেই।

কয়েক বছরের মধ্যেই আলফ্রেড বুঝতে পারলেন - কোথায় যেন ভুল হয়ে গেছে। শারীরিক উত্তেজনার একটা জোয়ার তাঁর এসেছিল - কিন্তু তা চলে গেছে কয়েক বছরের মধ্যেই। সোফির লেখাপড়া খুবই সীমিত। একাধিক ভাষা জানা তো দূরের কথা, নিজের ভাষাতেও ঠিকমতো লিখতে পারে না। আলফ্রেড প্রায় প্রতিদিনই চিঠি লিখেন সোফিকে, কিন্তু সোফি চিঠি লিখেন শুধুমাত্র টাকাপয়সার দরকার হলে। আলফ্রেড চান সোফি লেখাপড়া করে নিজেকে তাঁর যোগ্য করে গড়ে তুলবেন। কিন্তু সোফির সেরকম কোন ইচ্ছেই নেই। তিনি আলফ্রেডের টাকা-পয়সা ঘরবাড়ি যখন যা দরকার তা তো এমনিতেই পাচ্ছেন।

সোফির খরচের নমুনা দেখলে বোঝা যায় তিনি কতটা বদলেছেন নিজেকে। আলফ্রেড নিজের হাতে তাঁর জমা-খরচের হিসেব রাখেন। সেখান থেকে দেখা যায় - যেখানে নোবেল নিজের জন্য একজোড়া হাতমোজা কিনছেন মাত্র ৩.৭৫ ফ্রাঙ্কে, সেখানে সোফির হ্যাটের দাম তিনশ’ ফ্রাঙ্ক। যেখানে নোবেল বেয়ারাকে টিপ্‌স দিচ্ছেন মাত্র ০.২৫ ফ্রাঙ্ক, সেখানে সোফির জন্য এক বোতল মদ কিনছেন ছয়শ’ ফ্রাঙ্ক দিয়ে।

আলফ্রেডের ব্যবসা আরো বাড়ছে। ১৮৭৯ সালে রাশিয়ায় আরেকটি কোম্পানি খুলে নাম দিয়েছেন ‘ব্রাদার্স নোবেল’ বা  ব্রানোবেল। রাশিয়াতে বড়ভাই রবার্ট ও লুডভিগ তার দেখাশোনা করছেন। ১৮৮৪ সালে আবিষ্কার করেছেন ধোঁয়াহীন গানপাউডার - ব্যালিসাইট। ব্যাপক চাহিদা এই ব্যালিসাইটের। ১৮৮৬ সালে ফরাসি অংশীদার পল বার্বির সাথে মিলে নোবেল তাঁর সব ডায়নামাইট ফ্যাক্টরিকে একটা ট্রাস্টের অধীনে নিয়ে আসেন।

ব্যবসা যত বাড়ছে গন্ডগোলও দেখা দিচ্ছে তত। নানারকম ব্যবসায়িক মামলা-মোকদ্দমাও হচ্ছে। সোফিকে নিয়েও মনের ভেতর নানারকম দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করেছে। আলফ্রেডের চিঠিতে বিরক্তি ঝরে পড়তে শুরু করেছে। সোফি নিজের শিক্ষা ও সংস্কৃতি উন্নত করার দিকে একটুও মনযোগ দিচ্ছে না তাতে ভীষণ বিরক্ত আলফ্রেড। তাঁর মনে হতে শুরু করেছে সোফি তাঁকে ভালোবাসেন না মোটেও, শুধু ভালবাসেন তাঁর টাকা-পয়সাকে।

নোবেল এই সন্দেহও করতে শুরু করেছেন যে সোফি তাঁকে ফাঁকি দিয়ে অন্য পুরুষের সাথে সময় কাটাচ্ছেন। সোফি যখন চিঠিতে নোবেলকে ‘ডার্লিং’ বলে সম্বোধন করেন - নোবেলের মনে হয় এই ইংরেজি শব্দ ‘ডার্লিং’ - কোত্থেকে শিখল সোফি? চিঠিতে তিনি বেশ কর্কশ ভাষাতেই জানতে চান সোফির কাছে। অনেকটা সরাসরিই বলে ফেলেন যে সোফিকেই হয়তো কেউ ‘ডার্লিং’ বলে ডাকতে শুরু করেছে ভিয়েনার বাংলোতে।

আলফ্রেডকে মুগ্ধ করার জন্য একবার ফরাসি ভাষায় একটা টেলিগ্রাম করেন সোফি। টেলিগ্রাম পেয়ে খুশি হওয়াতো দূরের কথা, আলফ্রেড সন্দেহ করেন যে কোন ফরাসি যুবকের সাথে সোফির অন্তরঙ্গতা শুরু হয়েছে। তিনি চিঠিতে সরাসরি সোফিকে আক্রমণ করেন এ ব্যাপারে। সোফি পরের চিঠিতে ব্যাখ্যা করে বলেন যে যিনি টেলিগ্রামটি লিখেছিলেন তিনি পুরুষ ছিলেন না। তিনি একজন বয়স্কা রমণী। কিন্তু আলফ্রেড বিশ্বাস করেন নি সোফির কথা।

আলফ্রেড তাঁর মনের কথাগুলো যখন কাউকে বলতে পারেন না তখন কাল্পনিক চরিত্রের আশ্রয় নিয়ে তাদের মুখে সংলাপগুলো বসিয়ে দেন। ‘নেমেসিস’ নামে একটি নাটক তিনি অনেকদিন থেকেই লিখছিলেন। সেখানে একটা সংলাপে তিনি সোফির উদ্দেশ্যে লেখেন, “ওরে মূঢ় মেয়ে, তুই ভাবছিস শুধুমাত্র যৌবনই সব? যুবাপুরুষই প্রেমের উপযুক্ত পাত্র? যুবক হৃদয় তো আবেগ দিয়ে চলে, বাস্তব প্রেমের কিছুই বোঝে না। বুদ্ধিমতী বাস্তববাদী মেয়েদের উচিত প্রৌঢ়দের ভালোবাসা। কারণ প্রৌঢ়রাই জানে সত্যিকারের ভালোবাসা কী।”

১৮৮০ সালে সোফিকে প্যারিসে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন আলফ্রেড। অস্ট্রিয়া বা সুইডেনে সোফির সাথে এক বাড়িতে রাত কাটানো সম্ভব হলেও প্যারিসে সোফিকে নিজের বাড়িতে এনে তোলার সৎ সাহস বা ইচ্ছে নোবেলের নেই। তিনি এখনো একটা ক্লিন সামাজিক ইমেজ ধরে রাখতে চান। তাই সোফির জন্য একটা বাড়ি ভাড়া করলেন প্যারিসে নিজের বাড়ির কাছেই। একজন ফরাসি রাঁধুনি নিয়োগ করলেন সোফির জন্য। মনের ভেতর এখনো তাঁর ইচ্ছে - সোফি ফরাসি শিখবেন এই রাঁধুনির কাছে। আলফ্রেডের ইচ্ছে সোফি নিজেকে শিক্ষায়-দীক্ষায় একজন সম্ভ্রান্ত সমাজের নারীতে পরিণত করে নেবে।

সোফিকে প্যারিসের বাসায় অনেকটা গৃহবন্দী করে রাখলেন আলফ্রেড। দারোয়ানকে বলে রেখেছেন সোফির কাছে কারা কারা আসে যেন তাঁকে জানানো হয়। আর সোফিকে বলে দিয়েছেন নিজের বোনদের ছাড়া আর কারো সাথে দেখা করতে পারবেন না।

সোফি নিজেকে মিসেস নোবেল বলে যে পরিচয় দেন তাও এখন আর পছন্দ হচ্ছে না নোবেলের। সোফি যতই বোঝাতে চান যে তাঁর জীবনে আলফ্রেড ছাড়া আর কোন পুরুষ নেই - আলফ্রেড ততই অবিশ্বাস করেন তাঁকে। আলফ্রেডের হীনমন্যতা থেকে জন্ম নেয় প্রচন্ড ঈর্ষা। সোফিকে তিনি সহ্যও করতে পারেন না, আবার ত্যাগও করতে পারেন না। প্যারিসের বাইরে কোথাও গেলে প্রায় প্রতিদিনই সোফির কাছে ফুল পাঠান, চিঠি লিখেন। শুরুতে কিছু ভালোবাসার কথাও থাকে। কিন্তু তারপরই শুরু হয়ে যায় রুঢ় সন্দেহের বাক্যবাণ।

এদিকে সোফিরও আর ভালো লাগছে না এই সোনার কারাগার। তাঁরও বয়স বাড়ছে। তিরিশ পেরিয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। সেই আঠারো থেকে সম্পর্ক আলফ্রেডের সাথে। এত বছরেও তাঁদের সম্পর্কের কোনরূপ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। আলফ্রেডের মনের নাগাল তিনি পাননি, অবশ্য চেষ্টাও করেন নি কখনো। আলফ্রেডের সাথে এখন আর কোন শারীরিক সম্পর্কও নেই।

শুরুতে বিলাসী জীবনের যে স্বপ্ন ছিল সে স্বপ্নের রঙ বদলাতে শুরু করেছে। তিনি বুঝতে পারছেন শুধুমাত্র টাকা-পয়সা প্রাচুর্যই জীবনের সবকিছু নয়। যে জীবনের সত্যিকারের কোন পরিচয় নেই - সে জীবনের মূল্য কী? নিজের দুঃখের কথা তিনি আলফ্রেডকেও জানান - “আমি তো বিবাহিতও নই, অবিবাহিতও নই। আমার অবস্থানটা ঠিক কোথায়?”

ব্যারোনেস বার্থা ফন শাটনারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পত্রযোগাযোগ আছে নোবেলের। বার্থার চিঠি পেলে তিনি বার্থার সাথে সোফির তুলনা করে ভীষণ ঈর্ষায় ভোগেন। মনে হয় কেন তিনি বার্থার মত কাউকে পেলেন না জীবনে? আবার সোফির সাথে যেরকম অকপট হতে পারেন - বার্থার সাথে পারেন না। সেখানে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকতে হয়।

একদিন বার্থা অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখলেন নোবেলকে। চিঠি পড়ে বেশ অবাক হয়ে গেলেন আলফ্রেড। বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেননি বলে কিছুটা ছদ্ম-অভিযোগও জানিয়েছেন বার্থা। বার্থা লিখেছেন তিনি ভিয়েনার এক ফুলের দোকানীর কাছে জানতে পেরেছেন যে সেই দোকান থেকে নিয়মিত ফুল পাঠানো হয় প্যারিসে মিসেস নোবেলের কাছে। মিসেস নোবেল ইন প্যারিস? আলফ্রেড নোবেল ছাড়া আর কোন নোবেল তো প্যারিসে থাকেন না। ভাবলেন বন্ধু আলফ্রেড তাঁকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলেছেন।

আলফ্রেড বুঝতে পারলেন ভুলটা কোথায় হয়েছে। প্যারিসের কোন দোকান থেকে সোফির কাছে ফুল পাঠানো সম্ভব নয় আলফ্রেডের। কারণ প্যারিসে সবাই চেনে তাঁকে। তাই তিনি ভিয়েনা থেকে ফুল পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন সোফির কাছে। আর সোফিকে চিঠির ঠিকানায় ‘মিসেস নোবেল’ বলেই চালান তিনি। এখন বার্থার কাছে তো সোফির কথা বলা যায় না। যে আলফ্রেড নোবেল মনে করতেন যেকোন পরিস্থিতিতেই সত্যকথা বলা দরকার, তিনিই বার্থার কাছে অনেক ধানাই পানাই করে মিথ্যাকথা লিখলেন একঝুড়ি। জানালেন, যে মিসেস নোবেলকে ফুল পাঠানো হয়েছে - তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের স্ত্রী মিসেস লুডভিগ নোবেল।

১৮৮৮ সালে আলফ্রেডের বড়ভাই লুডভিগ নোবেল মারা যান। প্যারিসের সাংবাদিকেরা মনে করলেন বিখ্যাত আলফ্রেড নোবেলই মারা গেছেন। সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো - “মৃত্যুর কারবারির মৃত্যু”। প্যারিসের প্রায় সবগুলো সংবাদপত্রই বিস্তারিতভাবে নোবেলের বিস্ফোরক ও অস্ত্র-ব্যবসার বিবরণ দিয়ে এভাবে সংবাদ রচনা করেছে যে পড়ার পরে আলফ্রেড নোবেল বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যুর পর ঠিক কীরকমের প্রতিক্রিয়া হবে। তাঁর মনে হলো পুরো ইউরোপে যেন খুশির বান ডেকেছে তাঁর মৃত্যুতে। এত ঘৃণা করে তাঁকে মানুষ? তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর এমন কিছু করা দরকার যাতে তাঁর মৃত্যুর পর মানুষ তাঁকে ‘মৃত্যুর কারবারি’ দানব হিসেবে মনে না রেখে অন্য কোন কাজের জন্য মনে রাখবে। তিনি তাঁর উইল নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন।

পরের বছর ১৮৮৯ সালে বার্থা ফন শাটনারের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘লে ডাউন ইওর আর্মস’ প্রকাশিত হলো। অনেকগুলো ভাষায় অনুদিত হয় এ উপন্যাস। এই বইয়ের মাধ্যমে বার্থাও জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে। আলফ্রেড নোবেলও বইটি পড়েন। তিনিও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে, কিন্তু এরকম আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনায় পুরোপুরি বিশ্বাসী নন। তিনি বার্থাদের আন্দোলনে অর্থসাহায্য করেন - কিন্তু তার পরিমাণ তাঁর সামর্থ্যের তুলনায় খুবই নগণ্য।

বার্থাকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমার কারখানায় তৈরি মারণাস্ত্রই হয়তো একদিন পৃথিবীর সব যুদ্ধ থামিয়ে দেবে। আমি এমন মারণাস্ত্র তৈরি করতে চাই যা দিয়ে যুদ্ধ করে সব যুদ্ধ একদিন শেষ হয়ে যাবে - কারণ তখন যুদ্ধ করার মতো আর কেউ বেঁচে থাকবে না।”

আলফ্রেড নোবেলের এই কথায় আর যাই হোক - যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাঁর কারখানা বন্ধ করে দেয়ার কোন ইঙ্গিত ছিল না। মারণাস্ত্র তৈরি করাই যে উচিত নয় - তা তিনি উপলব্ধি করেননি কখনো। তাইতো তিনি ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮৯৩ সালে ৬০ বছর বয়সে সুইডেনের বোফোর্স অস্ত্র কারখানা কিনে নেন। রেগনার সলম্যান নামে এক ইঞ্জিনিয়ারকে দায়িত্ব দেন তিনি এই অস্ত্র কারখানার তত্ত্বাবধান করার জন্য। এই রেগনার সলম্যানই ছিলেন নোবেলের মৃত্যুর পর তাঁর উইলের নির্বাহী ব্যবস্থাপক।

১৮৮৯ সালে আলফ্রেডের মা মারা যান। আলফ্রেড মানসিকভাবে একেবারেই একা হয়ে গেলেন। ফরাসি সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কারণ তিনি ইতালিয়ান সরকারের সাথে তাঁর ধোঁয়াহীন  গানপাউডার সরবরাহের জন্য চুক্তি করছেন। ফ্রান্সের সাথে ইতালির সম্পর্ক খারাপ। ফ্রান্সে বাস করে ইতালির কাছে গানপাউডার বিক্রি করা দেশদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু আলফ্রেড যেখানে টাকা পাচ্ছেন সেখানেই বিক্রি করছেন। গান পাউডার কোথায় কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে তাঁর কোনরকম মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

১৮৯০ সালে ইতালিয়ান সরকারের সাথে তাঁর চুক্তি হওয়ার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিলেন ফ্রান্স সরকার। নোবেলের ফ্রান্সের ল্যাবোরেটরি বন্ধ করে দেয়া হলো। নোবেলকে যে কোন সময় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করা হতে পারে। নোবেল বুঝতে পারলেন ফ্রান্সের দিন শেষ। তিনি দ্রুত ফ্রান্স থেকে সবকিছু গুটিয়ে ইতালিতে চলে গেলেন। ইতালির সান রেমোতে বাড়ি কিনলেন তিনি।

এদিকে তাঁর ফরাসি পার্টনার পল বার্বি আত্মহত্যা করেন। নোবেল জানতে পারেন যে পল নোবেলকে না জানিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো নাইট্রোগ্লিসারিনের ব্যবসা করছিলেন। অথচ নোবেল পল বার্বিকে বিশ্বাস করে তাঁর সবগুলো ডায়নামাইটের কারখানাকে একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একের পর এক ধাক্কায় খুবই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলেন আলফ্রেড নোবেল।

প্যারিস থেকে ইতালিতে চলে যাবার অনেক আগেই সোফিকে ভিয়েনার ভিলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আলফ্রেড। অনেকদিন পর প্যারিসের বাড়ি নামক কারাগার থেকে ভিয়েনায় ফিরতে পেরে নিজেকে খুবই স্বাধীন মনে করলেন সোফি। অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর একজন যুবক অফিসারের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো সোফির। কিন্তু তা নোবেলকে জানাতে চান না তিনি। কারণ নোবেল তা জানতে পারলে সোফির সব যাবে। সোফির ভালোবাসা যেমন দরকার - তেমনি ভালো বাড়ি, গাড়ি প্রাচুর্যও দরকার। অস্ট্রিয়ান যুবক ভালোবাসা দিতে পারছে - কিন্তু তার সম্পদ নেই তেমন। সুতরাং নোবেলকে ছাড়া চলবে না সোফির।

কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটা সমস্যা হয়ে গেলো। সোফি গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। তিনি চিঠি লিখলেন নোবেলকে। লিখলেন “এই সন্তান ঠিক তোমার মতই হবে।” আলফ্রেড বুঝতে পারেন না - যে সন্তান তাঁর নয় সে কীভাবে তাঁর মত হবে? নিজের এতদিনের সন্দেহ এভাবেই সত্যি হয়েছে দেখে আলফ্রেড যেন কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। সোফির সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করতে চাচ্ছিলেন অনেক বছর থেকে। কিন্তু কিছুতেই পারছিলেন না। এবার আর নয়। সোফির সাথে সব সম্পর্ক শেষ বলে জানিয়ে দিলেন আলফ্রেড। কিন্তু সোফি সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নন। ভিয়েনায় যে বাড়িটি সোফির নামে কেনা হয়েছিল তা সোফিরই রইল। ভরণপোষণের জন্য প্রচুর টাকা নোবেলের কাছ থেকে আদায় করলেন তিনি।

১৮৯৫ সালে আলফ্রেড ব্রিটিশ আদালতে দায়ের করা মামলায় হেরে যান। তাঁর ধোঁয়াহীন গানপাউডারের ব্রিটিশ রাইট চলে যায়। তাঁর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুচিন্তা ঘিরে ধরতে শুরু করেছে তাঁকে। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে তাও ভাবছেন তিনি। ধর্মের প্রতি কোনরকম বিশ্বাস তাঁর নেই। সুতরাং মৃত্যুর পর কোনরকমের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় তাঁর শরীর সমাহিত হোক তা তিনি চান না। তিনি ভাবতে লাগলেন - যদি তাঁর শরীরকে ঘন সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে গলিয়ে ফেলে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় - অন্তঃত মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ানোর কাজে লাগবে।

নোবেলের অনুশোচনা হচ্ছে সারাজীবন এত ধনসম্পদ অর্জন করেছেন বিস্ফোরক আর গোলাবারুদ আবিষ্কার ও বিক্রি করে। তাঁর তৈরি মাইন আর ডায়নামাইটে কত শত মানুষ প্রাণ দিয়েছে যুদ্ধের নামে। ভবিষ্যতে আরো কত যুদ্ধ যে হবে। বিশ্বশান্তির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। সারাজীবন রোগে ভুগেছেন - চিকিৎসার উন্নতির জন্য কিছু করা দরকার। আর সাহিত্য তাঁর মনের খোরাক। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা না জানালে কীভাবে হয়? তিনি উইল তৈরি করলেন। কোন উকিলের সাহায্য ছাড়াই উইল তৈরি করলেন। স্বাক্ষর করে রেখে দিলেন নিজের কাজের ডেস্কে।

১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর ইতালির সান রেমোতে ৬৩ বছর বয়সে মারা যান আলফ্রেড নোবেল। মৃত্যুর পর তাঁর উইলে দেখা যায় তাঁর সম্পদের প্রায় চুরানব্বই শতাংশ দিয়ে গেছেন নোবেল ফাউন্ডেশান গড়ার জন্য। যার আর্থিক মূল্য সেইসময় ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার - যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫ মিলিয়ন ডলারে। নোবেল ফাউন্ডেশানের দায়িত্বও লেখা আছে উইলে। প্রতিবছর চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান যাঁরা রাখবেন তাঁদেরকে। উইল কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নোবেলের বোফোর্স অস্ত্রকারখানার ব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার রাগনার সোহল্‌ম্যানকে।

নোবেল ফাউন্ডেশান গঠিত হলো। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরষ্কার চালু হলো। নোবেল ফাউন্ডেশান সোফি হেসের কাছ থেকে অনেক টাকার বিনিময়ে নোবেলের লেখা চিঠিগুলো কিনে নিল। তারপরেও যেন নোবেলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কোনরকমের সমস্যা তৈরি না হতে পারে - সোফির সব চিঠি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত গোপন করে রাখা হয়েছিল নোবেল ফাউন্ডেশানের আর্কাইভে। নোবেলের বন্ধু বার্থা ফন শাটনার নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯০৫ সালে।

নোবেল পুরষ্কার চালু হবার পর কেটে গেছে একশ’ বছরেরও বেশি। এই একশ’ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি অর্থমূল্যের আরো অনেক পুরষ্কার চালু হয়েছে পৃথিবীতে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে নোবেল পুরষ্কারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি এখনো আর কোন পুরষ্কার। নোবেল পুরষ্কার এখন শুধু ব্যক্তিগত নয়, অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদারও প্রতীক। আলফ্রেড নোবেলকে কেউ আর ‘মৃত্যুর কারবারি’ মনে করেন না। যে নোবেল নিজেকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করতেন - নোবেল পুরষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি সবার ভালোবাসা পেয়েই চলেছেন। ব্যক্তিগত ভালোবাসার চেয়ে এই ভালোবাসার মূল্য কি কোন অংশে কম?

আলফ্রেড নোবেলের বিস্ফোরক ভালোবাসা - পর্ব-২


১৮৭৬ সালে আলফ্রেড ভিয়েনায় গিয়েছিলেন কাজে। শহরটাকে বেশ ভালোই লাগে তাঁর। ভিয়েনার হোটেলে বসেই কিছুদিন কাজকর্ম চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কাজ করতে করতে নিজেকে বড় একাকী বড় বুড়ো মনে হচ্ছে তাঁর। নিজের কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন লোক রেখেছেন কিছুদিন হলো। কিন্তু তাকে দিয়ে সবকিছু সামলানো যাচ্ছে না। মনে হলো এই ভিয়েনায় থেকে এমন একজন কাউকে খুঁজে নেয়া যায় যে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী থেকে বন্ধুও হয়ে যেতে পারে কোন এক সময়। অনেক ভেবেচিন্তে সংবাদপত্রের ‘আবশ্যক’ পাতায় একটা বিজ্ঞাপন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভিয়েনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো সেই বিজ্ঞাপন -  “প্যারিসে বসবাসরত ধনী, উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, বয়স্ক ভদ্রলোকের প্যারিসের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এবং ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য একাধিক ভাষায় পারদর্শী বয়স্কা মহিলা আবশ্যক।”

প্যারিসে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর বিজ্ঞাপনের সুবাদে অনেকগুলো দরখাস্ত এসে জমা হয়েছে। আলফ্রেড বাছাই করতে শুরু করলেন। সবার ইন্টারভিউ নেবার সময় তাঁর নেই। যা করার দরখাস্তের ভাষা, তথ্য এবং ছবি দেখে ঠিক করতে হবে। তিনি জানেন তিনি কী চাইছেন। তিনি চাইছেন এমন কাউকে নিয়োগ দিতে যিনি তাঁর চিঠিপত্র লিখতে পারবেন পাঁচটি ভাষায়, যিনি ইতিহাস সচেতন হবেন, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থাকলে তো খুবই ভালো।

দরখাস্ত বাছাই করতে করতে তিনি পেয়ে গেলেন যা চাইছিলেন তার চেয়েও বেশি। চমৎকার হাতের লেখা, চমৎকার শব্দচয়ন - পাঁচটি না হলেও ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান এই তিনটি ভাষায় পারদর্শী - কাউন্টেস বার্থা সোফিয়া ফেলিটাস কিনস্কি ফন কিনিক - সংক্ষেপে বার্থা ফন কিনস্কি। দরখাস্তের সাথে পাঠানো ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন আলফ্রেড। আশ্চর্য সুন্দর আর ব্যক্তিত্বময়ী তেত্রিশ বছর বয়স্কা কুমারী বার্থা। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল।

আলফ্রেড বার্থাকে নিয়োগপত্র পাঠালেন। অনেক বেশি বেতন অফার করলেন যেন বার্থা মত পরিবর্তন না করতে পারেন। নির্দিষ্ট দিনে প্যারিসের ট্রেন স্টেশনে বার্থাকে রিসিভ করতে নিজেই গেলেন আলফ্রেড নোবেল। ছবি দেখে যতটুকু ধারণা করেছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী ও ব্যক্তিত্বময়ী বার্থা।

“ওয়েলকাম টু প্যারিস কাউন্টেস ফন কিনস্কি। আমি আলফ্রেড নোবেল।”
“থ্যাংক ইউ মিস্টার নোবেল। ইউ আর সো কাইন্ড।”

বার্থাও আলফ্রেড নোবেলকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছেন। তাঁর চাকরিদাতাকে যতটা বুড়ো মনে করেছিলেন - মোটেও বুড়ো নন তিনি। বার্থার চেয়ে খুব বেশি হলে দশ বছরের বড় হবেন।

গাড়িতে উঠার সময় নোবেল বললেন, “আমার বাড়িতে আপনার থাকার জন্য যে রুম ঠিক করা হয়েছে তা নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। রেডি হতে কয়েকদিন দেরি হবে। আমি আপনার জন্য গ্রান্ড হোটেলে একটি সুইট ঠিক করে রেখেছি। এ ক’দিন আপনি সেখানেই থাকবেন।”

গ্রান্ড হোটেলের রুমে সুটকেস রেখে হোটেলের ডায়নিং রুমে বসে ব্রেকফাস্ট সারলেন বার্থা ও নোবেল। নোবেল বার্থাকে সংক্ষেপে বললেন তিনি কী করেন এবং বার্থার কাজ কী হবে। বার্থা বেশ অবাক হলেন। স্বাভাবিক ইউরোপিয়ানদের তুলনায় যথেষ্ট খাটো মৃদুভাষী সাদামাটা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা এই ভদ্রলোক মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই বিশ্বজুড়ে ডায়নামাইটের কারখানার একচ্ছত্র মালিক। দুটো নীল চোখে কেমন যেন বিষন্নতা। কথাবার্তা খুবই মার্জিত, কিন্তু কোথাও যেন প্রচন্ড হতাশার সুর, প্রচন্ড শূন্যতা।

হোটেল থেকে বার্থাকে বাড়ি দেখাতে এবং কাজকর্ম বুঝিয়ে দিতে নিয়ে এলেন নোবেল। বাড়ি দেখে ভালো লাগলো বার্থার। নোবেলের কাজের অফিস এবং ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দেখে ভীষণ খুশি হলেন বার্থা। লেখাপড়ার প্রতি তাঁরও আগ্রহ অনেক। বাড়িতে কাজের লোক ছাড়া আর কেউ থাকেন না দেখে সহজেই বুঝে নিলেন নোবেলের একাকীত্ব আর শূন্যতা কোথায়।

বার্থার সাথে কাজের কথা বলতে বলতে নোবেল বিস্তারিতভাবে বললেন তিনি কী কী জিনিস নিয়ে গবেষণা করছেন, কী কী বিস্ফোরক তৈরি হচ্ছে তার কারখানায়, কীভাবে সারা পৃথিবীতে রাস্তাঘাট ট্রেন লাইন তৈরি করার জন্য পাহাড়-পর্বত সমতল করার কাজে ডায়নামাইটের ব্যবহার বাড়ছে। বলতে বলতে আলফ্রেড খেয়াল করলেন - খুব আনন্দ পাচ্ছেন তিনি বার্থার সাথে কথা বলতে। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে তিনি যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁকে পেয়ে গেছেন। বার্থাই হতে পারেন তাঁর জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার।

বার্থাও একধরনের মমতা অনুভব করছেন নোবেলের প্রতি। মানুষটা কত ধনী, কত সৃষ্টিশীল, কত বৈষয়িক; আবার একই সাথে কোথাও যেন এক গহীন মননে মগ্ন কবি।
দু’দিন পর গ্রান্ড হোটেলে ডিনার করার সময় বার্থার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন নোবেল।
“কী এটা?”
“পড়ে দেখুন”
“কবিতা বলে মনে হচ্ছে!”
“একজন নিঃসঙ্গ মানুষের গোপন শখ।”

বার্থার ধারণাই ঠিক। এই আপাত কঠিন মানুষটা একজন কবি। কবিতার ছত্রে ছত্রে জাল বুনেছে গভীর কষ্ট। মানুষটা এত হতাশাবাদী কেন? ভেবে পান না বার্থা। কিন্তু বুঝতে পারেন এই মানুষটার একজন অবলম্বন দরকার। শুধুমাত্র সেক্রেটারির পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। নোবেলের দরকার বেতনভুক্ত সেক্রেটারির চেয়েও বেশি কাউকে। বার্থার ভয় হতে থাকে - তিনি কি তা হতে পারবেন নোবেলের যা দরকার?

বার্থাকে কাছ থেকে দেখে, কয়েকদিন মিশে বার্থার প্রতি একধরনের দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করেছেন আলফ্রেড। বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় তিনি ভালোবাসার কথা ভাবেননি একবারও। চেয়েছিলেন বয়স্কা কেউ এসে তার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তার ঘরবাড়ির দেখাশোনাও করবেন। একজন কথা বলার লোক হবে তাঁর। সংসারে কারো সাথেই তো মন খুলে কথা বলতে পারেন না। সবার সাথেই কেমন যেন বৈষয়িক দেয়ানেয়ার সম্পর্ক। বিশ বছর আগে যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তাকে ভুলতে পারেন নি। বার্থা স্মার্ট সুন্দরী শিক্ষিতা একাধিক ভাষায় পারদর্শী - তাঁর তো এরকমই কাউকে দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে বার্থার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন আলফ্রেড নোবেল।
পরদিন ডিনারের পর বার্থাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন আলফ্রেড, “তোমার হৃদয়ে কি আমার জন্য একটু জায়গা হবে?”
কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না বার্থা। আলফ্রেডকে দেখেই ভালো লেগে গেছে বলা যাবে না। ক’দিন কাছ থেকে দেখে যতটুকু বুঝেছেন মানুষটা ভাবুক, কবি, দয়ালু কিন্তু বিষন্ন। খুবই অসুখী, কিছুটা সন্দেহপরায়ণ। মানুষের ভাবনাচিন্তার সবকিছুই বুঝতে পারেন, কিন্তু ভীষণ নৈরাশ্যবাদী। সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, কিন্তু মানুষটা মনে হয় হাসতে জানেন না। বার্থা এক ধরনের মমতা অনুভব করেন আলফ্রেডের প্রতি - কিন্তু তা প্রেম নয়। তার হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে যে অন্য একজন বসে আছেন তা কীভাবে বলবেন বার্থা। কিন্তু না বললে যে আরো অবিচার করা হবে নোবেলের প্রতি। বার্থা নোবেলকে খুলে বললেন তাঁর হৃদয়ের কথা। 
ভিয়েনার খুব বনেদি পরিবারে জন্ম বার্থার। পারিবারিক সূত্রেই কাউন্টেস তিনি। বার্থার বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসার। বার্থার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। প্রচন্ড শোক ও হতাশা থেকে বার্থার মা মদ-জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন। ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে শিক্ষাদীক্ষা সহবতে বড় হতে হতে বার্থা দেখলেন তার মা স্বামীর অর্থসম্পদ যা ছিল সব জুয়া খেলতে খেলতেই শেষ করে ফেলেছেন। প্রচন্ড অর্থকষ্টে পড়তে হয় তাদের। বার্থাকে জীবিকার প্রয়োজনে গভর্নেসের কাজ নিতে হয়। 
সুন্দরী শিক্ষিতা দরিদ্র বার্থা ভিয়েনার খুব বনেদি ফন শাটনার পরিবারের চারজন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য গভর্নেস হিসেবে কাজ করতে শুরু করলেন। শাটনার পরিবারের ছোটছেলে আর্থার বার্থার চেয়ে সাত বছরের ছোট। কিন্তু আর্থার বার্থার প্রেমে পড়ে গেলেন। বার্থাও ভালোবেসে ফেলেছেন আর্থারকে। আর্থার ঠিক করে ফেলেছেন বার্থাকে বিয়ে করবেন। 

আর্থারের মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এ সিদ্ধান্ত। বার্থা বড়ঘরের মেয়ে এটা ঠিক। কিন্তু বিত্তহীন কাউন্টেসের কোন দাম নেই আর্থারের মায়ের কাছে। তিনি ভাবছিলেন কীভাবে বার্থাকে দূর করে দেয়া যায়। ঠিক সেই সময়েই তাঁর চোখে পড়েছিলো নোবেলের বিজ্ঞাপন। 
আর্থারের মা ভেবেছিলেন - এই তো সুযোগ। কোনভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বার্থাকে প্যারিসে পাঠিয়ে দিতে পারলে আর্থারকে সামলানো কঠিন হবে না। তিনি বিজ্ঞাপনটি বার্থাকে দেখিয়ে বুঝিয়েছেন যে প্যারিসে তার যাওয়া উচিত। বিজ্ঞাপনে বয়স্কা মহিলা চাওয়া হয়েছে। তেত্রিশ বছর নিশ্চয় অনেক বয়স। তাছাড়া বার্থা ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান তো ভালোই জানেন। বার্থা আর্থারের মায়ের মনোভাব জানেন। এটাও জানেন যে আর্থারের সাথে তার সম্পর্ক খুবই অসম সম্পর্ক। আর্থারের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়াই সব দিক থেকে ভালো। তাই বার্থা বিজ্ঞাপনের চাকরির দরখাস্ত করেছিলেন। 
বার্থা বলেন, “বিদায়বেলায় আর্থার আমার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে বলেছে ‘বার্থা, আমি তোমাকে ভুলব না’। আমিও যে আর্থারকে ভুলতে পারছি না কিছুতেই।” 
সবশুনে আলফ্রেড পরামর্শ দিলেন, “ভুলে যাও সব। আর্থারের সাথে আর কোন যোগাযোগ রেখো না।”
বার্থা ভাবলেন তাই হবে। 
ক’দিন পরেই আলফ্রেডকে দরকারি কাজে যেতে হলো স্টকহোমে। বার্থা রয়ে গেলেন প্যারিসের হোটেলে। পরদিনই দুটো টেলিগ্রাম পেলেন বার্থা হোটেলের ঠিকানায়। একটা পাঠিয়েছেন আলফ্রেড - স্টকহোমে পৌঁছেছেন ঠিকমত। দ্বিতীয়টা টেলিগ্রামটা এসেছে আর্থারের কাছ থেকে। আর্থার লিখেছেন - “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না বার্থা।” 
উথাল-পাথাল সুখে উদ্বেল হয়ে উঠলেন বার্থা। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। আলফ্রেডের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি লিখলেন। যেহেতু আলফ্রেডের চাকরিটি তিনি আর করছেন না, মনে হলো হোটেলের বিলটা তাঁরই  দিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু টাকা-পয়সা নেই তাঁর। পারিবারিকসূত্রে একটা হিরের পিন পেয়েছিলেন তিনি। সেটা বিক্রি করে হোটেলের বিলটা চুকিয়ে ট্রেনের টিকেট কেটে ফিরে গেলেন ভিয়েনায়। সেখানে আর্থার অপেক্ষা করছিলেন বার্থার জন্য। দু’জনে ভিয়েনা থেকে পালিয়ে চলে গেলেন ককেশাস (বর্তমান জর্জিয়া)। আর্থারকে বিয়ে করে বার্থা ফন কিনস্কি হলেন ব্যারোনেস বার্থা ফন শাটনার। 
এদিকে স্টকহোম থেকে প্যারিসে ফিরে এসে বার্থার চিঠি পেয়ে খুব হতাশ হয়ে গেলেন আলফ্রেড। তাঁর মনে হলো কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা তার নেই। তিনি কি বার্থার যোগ্য ছিলেন না? ৪৩ বছর বয়স কি প্রেমের জন্য খুবই বেশি? তিনি কি বার্থার কাছে এমন কিছু চেয়ে বসেছিলেন যে বার্থা এভাবে চলে গেল? এতবছর পর মনে প্রেম অনুভব করেছিলেন তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল এভাবে? 
ক’দিন পর বার্থার চিঠি এলো ককেশাস থেকে। আর্থারকে বিয়ে করে তিনি সুখে আছেন। সুন্দর করে চিঠির উত্তর দেন আলফ্রেড। বার্থার সাথে সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায় আলফ্রেডের। আমৃত্যু অটুট ছিল এ সম্পর্ক। 
বিয়ের পর প্রায় আট বছর পর্যন্ত ককেশাসে ছিলেন আর্থার ও বার্থা। সেসময় বার্থা লিখতে শুরু করেন। গল্প উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর। যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্রবিরোধী বই পড়তে পড়তে নিজেও যুদ্ধবিরোধী হয়ে গেছেন বার্থা। আট বছর পর আর্থারের মা তাঁদের সম্পর্ক মেনে নিলে তাঁরা ভিয়েনায় ফিরে আসেন। সেখান থেকে স্বামীকে সাথে নিয়ে প্যারিসে এসে দেখা করে যান আলফ্রেড নোবেলের সাথে। বিয়ের পর সেই একবারই দেখা হয়েছিল বার্থার সাথে আলফ্রেডের। তবে পত্রযোগাযোগ ছিল আলফ্রেডের মৃত্যু পর্যন্ত। 
১৮৭৬ সালে বার্থার হৃদয়ে জায়গা পেতে ব্যর্থ হয়ে আলফ্রেড মনে মনে বেশ জেদী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর হৃদয়ের দরজা জোর করে বন্ধ করতে চাইলেও কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। সময় পেলেই তিনি ভিয়েনায় চলে যান, হেলথ রিসর্টে থাকেন। একটু অবসর পেলেই ঘুরে বেড়ান। 
একদিন এক ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আলফ্রেড। দোকানে কাজ করছে অষ্টাদশী এক অস্ট্রিয়ান সুন্দরী - মিষ্টি একটা মেয়ে। পায়ে পায়ে দোকানে ঢুকলেন আলফ্রেড। তাঁর চোখের মুগ্ধতা চোখ এড়ালো না মেয়েটির। আরো বেশি উচ্ছল হয়ে উঠলো সে। এগিয়ে এসে নানারকম ফুলের তোড়া দেখাতে লাগলো আলফ্রেডকে। আলফ্রেডের মনে হচ্ছে দোকানের সবগুলো ফুলের চেয়েও সুন্দর এই মেয়েটি। নোবেলের এতদিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত তাঁর এই চিত্তচাঞ্চল্য। 

মেয়েটি খুবই চঞ্চল, অনবরত কথা বলছে, বর্ণিল প্রজাপতির মত যেন উড়ে বেড়াচ্ছে দোকানজুড়ে। হঠাৎ একটা টিউলিপের কলি নিয়ে এসে আলফ্রেডের কোটে পরিয়ে দিলো। মেয়েটির সুন্দর আঙুল ছুঁয়ে গেল আলফ্রেডের কাঁধ, গলার একপাশ আর দাড়িতে। আলফ্রেড এতদিন সীমাহীন কাঠিন্যে এড়িয়ে চলেছেন এরকম সব কমনীয় স্পর্শ। কিন্তু এখন কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
আলফ্রেডের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনেকটা ফিস ফিস করে বললো মেয়েটি - “সোফি”। আলফ্রেডের মনে হলো তাঁর কানে চুমু খেলো মেয়েটি। কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল তাঁর শরীর আর মনে। 
সোফি হেস। দরিদ্র ঘরের মেয়ে সোফি জানে এইসব ধনী টাকার কুমিরেরা তাদের মত গরীব সুন্দরী মেয়েদের কী চোখে দেখেন। সোফি জানে কীভাবে তাদের চোখে পড়তে হয়। আলফ্রেড নোবেলের মত মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়ানোর মত কোন যোগ্যতাই নেই সোফির। অথচ আলফ্রেড সোফির প্রতি আকৃষ্ট হলেন। অদ্ভূত জটিল এই আকর্ষণ। তাঁর চেয়ে বয়সে তেইশ বছরের ছোট এই মেয়েটির প্রতি আদর মায়া-মমতা অনুভব করছেন তিনি। আবার একই সাথে মেয়েটির যৌবন তাঁকে টানছে। তিনি কামনা অনুভব করছেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বদলে যাচ্ছে। পুরুষের চোখের এ দৃষ্টি খুবই চেনা সোফি হেসের। 
আলফ্রেডের এতদিনের সংযমের বাঁধ যেন হঠাৎ ভেঙে গেলো। তিনি সোফির সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুললেন - যে সম্পর্কের সামাজিক কোন স্বীকৃতি নেই। আবার নোবেলের মত ধনীদের জন্য এরকম সম্পর্কে তেমন কোন সামাজিক বাধাও নেই। কয়েক দিনের মধ্যেই আলফ্রেড ফুল কেনার মত করে ফুলের দোকানের কর্মচারী সোফি হেসকে একপ্রকার কিনেই নিলেন। 
দামি পোশাক, গয়না, আর দামি বাড়ি পেয়ে সোফির জীবন-পদ্ধতি পাল্টে যেতে সময় লাগলো না। আলফ্রেড সোফির জন্য বাড়ি কিনলেন ভিয়েনাতে। অভিজাত বাংলো ভাড়া করলেন সুইডেনে। আলফ্রেড যখন সুইডেনে বা ভিয়েনায় যান সোফিকে জানিয়ে দেন। সোফি আগে থেকেই সেখানকার বাংলোয় বা বাড়িতে চলে যান। আলফ্রেড দাপ্তরিক কাজ সেরে চলে যান সোফির কাছে। সোফির লাইফস্টাইল দ্রুত বদলে যেতে থাকে। তাঁর অর্থনৈতিক চাহিদাও বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে।
যদিও আলফ্রেড কখনোই সোফিকে নিয়ে সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে যাননি, কারো সাথে সোফির পরিচয়ও করিয়ে দেননি - সোফির সাথে আলফ্রেডের সম্পর্কের কথা গোপন থাকলো না। নোবেল কোম্পানির প্রধান যে একজন রক্ষিতা রেখেছেন তা নিয়ে সামাজিক গুঞ্জন বাড়ছে। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে লাগলেন আলফ্রেড। কাজের প্রয়োজনে সোফির কাছ থেকে দূরেই থাকতে হয় তাঁকে বেশিরভাগ সময়। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই তিনি চিঠি লিখেন সোফিকে। চিঠির ঠিকানায় লিখেন - ‘মিসেস নোবেল’ বা ‘মিসেস সোফি নোবেল’। তাঁর পক্ষ থেকে এটা হলো গুঞ্জন এড়াবার উপায়। কিন্তু সোফির কাছে এটা হলো তাঁর সামাজিক স্বীকৃতি। তিনি নিজেকে ‘মিসেস আলফ্রেড নোবেল’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করলেন। 

আলফ্রেড নোবেলের বিস্ফোরক ভালোবাসা - পর্ব-১


বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কারের নাম নোবেল পুরষ্কার। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে নোবেলের সম্মানে অর্থনীতিতেও পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ও রসায়নের গবেষণায় সাফল্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার। সাহিত্যে যিনি নোবেল পুরষ্কার পান - তাঁর পাঠকপ্রিয়তা অনেক সময় হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান - নোবেল পুরষ্কার পাবার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়ে যায় অনেকগুণ। অবশ্য সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার যাঁরা পান তাঁদের নিয়ে অনেক সময় নানারকম বিতর্কও তৈরি হয়। তবে সেই বিতর্কে নোবেল পুরষ্কারের মর্যাদা একটুও কমে না, বরং বেড়ে যায়। এমন মর্যাদাকর পুরষ্কার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ও সম্পদে - তিনি আলফ্রেড নোবেল। ডায়নামাইটের আবিষ্কারক হিসেবে তাঁকে আমরা কিছুটা চিনি, নোবেল পুরষ্কারের মত মহান পুরষ্কার যাঁর নামে তাঁকেও বিরাট মহানুভব হিসেবে আমরা কল্পনা করে নিই ঠিক, কিন্তু ব্যক্তি আলফ্রেড নোবেল আমাদের কাছে অনেকটাই অচেনা। 
মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন আলফ্রেড নোবেল? যিনি একাধারে একের পর এক বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্রের উপাদান আবিষ্কার করেছেন, সারা ইউরোপে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে তুলে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু জীবন-যাপন করেছেন একাকী নিরাসক্ত। জীবনে কোনদিন ধূমপান করেন নি, মদ পান করেন নি, এমন কি বিয়েও করেন নি। তেমন কোন বন্ধুবান্ধবও ছিল না আলফ্রেড নোবেলের। প্রথম জীবনে কবি হতে চেয়েছিলেন - অনেক কবিতাও লিখেছিলেন। প্রেম ছিল সেসব কবিতায়, ক্ষোভও ছিল। কিন্তু সেরকম ভাবে তাঁর কোন রচনাই তিনি প্রকাশ করেন নি। অন্তর্মুখী এই মানুষটি একদিকে শক্তহাতে ইন্ডাস্ট্রি আর ব্যবসা সামলেছেন, অন্যদিকে নিরলস গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন একের পর এক নতুন বিস্ফোরক। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলেন - যে দেয়াল ভেদ করে তাঁর মনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না কারোরই। হাতে গোনা যে ক’জন মানুষের কাছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখেছিলেন তাও তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন করে রেখেছিল নোবেল ফাউন্ডেশান। 

আলফ্রেড নোবেল তাঁর প্রত্যেকটি চিঠির কপি রাখতেন, একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিরও। নোবেল ফাউন্ডেশানের আর্কাইভে আছে তাঁর হাতে লেখা অনেক চিঠি। প্রত্যেকটি চিঠিতে তাঁর নিজের হাতে ক্রমিক নম্বর দেয়া। ১৯৫০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো প্রকাশ্যে আসার পর আলফ্রেড নোবেলের ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তাগুলোর কিছু কিছু দিক উন্মোচিত হয়; পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিগত ভালোবাসার অন্য একটা জগতের সন্ধান। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো আলফ্রেড নোবেলের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ওয়েলদিয়েস্ট ভ্যাগাবন্ড ইন ইউরোপ’। নোবেলের চিঠিগুলো থেকে কিছুটা হলেও দেখা যায় তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী এই চিরকুমার ‘ভবঘুরে’র বিস্ফোরক ভালোবাসার কয়েক ঝলক।
নোবেলদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন নোবেলিয়াস পদবীভুক্ত দরিদ্র কৃষক। আলফ্রেডের ঠাকুরদা নিজের চেষ্টায় নাপিতের কাজ শিখেছিলেন। ক্ষৌরকর্মের পাশাপাশি তিনি ছোটখাট অস্ত্রোপচারও করতেন। ১৭৭৫ সালে তিনি নিজের পদবী নোবেলিয়াসের অর্ধেক ছেঁটে ফেলে ‘নোবেল’ করে নিলেন। তাঁর বড় ছেলে ইমানুয়েল - আলফ্রেড নোবেলের বাবা।  
১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে ইমানুয়েল ও ক্যারোলিন নোবেলের চতুর্থ সন্তান আলফ্রেড নোবেলের জন্ম। আলফ্রেডের বড় তিন জনের মধ্যে এক জন জন্মের পরেই মারা যায়। বাকি দুই ভাই রবার্ট ও লুডভিগ।  ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এবং তাঁর নিজের কনস্ট্রাকশান ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ছিল। কনস্ট্রাকশানের কাজে ইমানুয়েল নানারকম বিস্ফোরক নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করছিলেন। তাঁর ব্যবসায় মাঝে মাঝে খুবই সাফল্য আসছিল, আবার মাঝে মাঝে তিনি সর্বস্ব হারাচ্ছিলেন। আলফ্রেডের যখন জন্ম হয় তখন ইমানুয়েল নোবেলের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর কনস্ট্রাকশান ফার্ম দেউলিয়া হয়ে গেছে। তিনি সুইডেনের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। 
এদিকে জন্ম থেকেই ভীষণ রুগ্ন আলফ্রেড। পেটের পীড়া লেগেই আছে, আর হৃদপিন্ডের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সারাজীবনই শরীর নিয়ে ভুগেছেন আলফ্রেড নোবেল। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে মা-কে আঁকড়ে ধরেই আলফ্রেডের বেড়ে ওঠা। সারাক্ষণ শারীরিক কষ্টে ভুগতে ভুগতে আলফ্রেড ছোটবেলা থেকেই কোন ধরনের খেলাধূলা করার প্রতি উৎসাহ পায়নি। তাই কোন খেলার সাথীও ছিল না। শৈশবে মা ছাড়া আর কারো সাথেই তার কোন আত্মিক গড়ে ওঠেনি। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে আলফ্রেড কখনোই হাসিখুশি উচ্ছল ছিল না। তাকে কেউ কখনো প্রাণখুলে হাসতে দেখেন নি। 
ইমানুয়েল নোবেল আর্থিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির জন্য নানারকমের ব্যবসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলেন না। আলফ্রেডের বয়স যখন চার, তখন তিনি তিন ছেলে ও স্ত্রীকে সুইডেনে রেখে ফিনল্যান্ড চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু করতে পারলেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সেই সময় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের পাঁয়তারা চলছে। ইমানুয়েল দেখলেন সম্ভাব্য যুদ্ধের বাজারে গোলাবারুদ মাইন আর যন্ত্রাংশ তৈরি ও সরবরাহের বিপুল সম্ভাবনা। তিনি কাজ শুরু করে দিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। দ্রুত সাফল্য অর্জন করলেন তিনি, আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেলো। ১৮৪২ সালে পুরো পরিবারকে নিয়ে এলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। 
আলফ্রেড যখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে এলো তখন তার বয়স নয় বছর। চার বছর বয়স থেকে বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ইমানুয়েল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই কোন ছেলেকেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে পাঠাননি। বাড়িতে টিউটর রেখে ব্যবহারিক শিক্ষা দিয়েছেন ছেলেদের পছন্দ, মেধা ও আগ্রহের দিকে খেয়াল রেখে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের বাড়িতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের জন্য শিক্ষক রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো ছেলেদের জন্য। 
আলফ্রেড নোবেল জীবনে কখনো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেননি। অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময় পড়াশোনাতেই কাটে আলফ্রেডের। রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আলফ্রেডের। বাবার কারখানায় নানারকম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নিজেরও অনেক নতুন নতুন আইডিয়া দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাল লাগে সাহিত্য। সতের বছর বয়স হবার আগেই সুইডিশ, রাশিয়ান, জার্মান, ইংলিশ ও ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও লিখতে শিখে গেল আলফ্রেড। লিখতে শুরু করলো কবিতা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে লেখকই হবে সে। 
আলফ্রেডের কাব্যচর্চার কথা জেনে গেলেন তার বাবা ইমানুয়েল। তিনি জানেন কাব্যচর্চা করে অর্থোপার্জন করা যায় না। তাই তিনি চাচ্ছিলেন ছেলে এমন কিছু করুক যা দিয়ে অর্থ উপার্জন করা সহজ হবে। নিজের কারখানায় আলফ্রেডকে সম্পৃক্ত করার আগে সঠিক প্রশিক্ষণ দরকার। ১৮৫০ সালে আলফ্রেডকে রাসায়নিক প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ার বাইরে  পাঠিয়ে দিলেন ইমানুয়েল নোবেল। 
পরবর্তী তিন বছর আলফ্রেড জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও আমেরিকায় কয়েকজন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও রসায়নবিদের অধীনে কাজ শিখলো। আমেরিকায় আলফ্রেড কাজ করলো সুইডিশ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী জন এরিকসনের সাথে যিনি ‘মনিটর’ নামে একটা আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের ডিজাইন করেছিলেন। ফ্রান্সে গিয়ে আলফ্রেড কাজ শিখলেন রসায়নবিদ আস্ক্যানিও সবরেরোর কাছে। আস্ক্যানিও সবরেরো নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করেছিলেন। ভয়ংকর বিস্ফোরক এই নাইট্রোগ্লিসারিন এতটাই বিপজ্জনক যে সামান্য নাড়াচাড়াতেই প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে যায়। তাই এটাকে তখন কোন ব্যবহারিক কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। আলফ্রেড ভাবতে শুরু করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে কীভাবে বশে আনা যায়। 
১৮৫২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে এসে বাবার কারখানায় যোগ দিলেন উনিশ বছর বয়সী আলফ্রেড। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার নৌবাহিনী বিপুল পরিমাণ নেভাল মাইন কিনছিলো - আর তা সরবরাহ করছিল তাদের ‘ফাউন্ড্রিজ এন্ড মেশিন শপ্‌স অব নোবেল এন্ড সন্স’। যুদ্ধ যতদিন চললো নোবেল পরিবারের উপার্জন ততই ফুলে ফেঁপে উঠলো। বিপুল উৎসাহে ইমানুয়েল বেশ কয়েক বছরের জন্য মাইন তৈরি করে মজুদ করে ফেললেন। কিন্তু ১৮৫৬ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ইমানুয়েলের গুদামভর্তি নেভাল মাইন অলস পড়ে রইল। দু’বছরের মধ্যে কারখানা আবার দেউলিয়া হয়ে গেল। 
এদিকে তরুণ আলফ্রেড নিজের পড়াশোনা, কারখানার ল্যাবরেটরিতে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন। কবিতায় প্রেম আর স্বপ্নের মাখামাখি। অন্তর্মুখী আলফ্রেড ভালোবেসে ফেলেছেন একজন ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রাশিয়ান তরুণীকে। কিন্তু ভালোবাসার কথা কবিতায় প্রকাশ পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারে না ভালোবাসার মানুষকে। দুর্বল স্বাস্থ্য, মাঝারি উচ্চতার আলফ্রেডের দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে ভালোবাসা বোঝা সহজ নয়। আলফ্রেডের ভালোবাসা ঠিকমত গতি পাবার আগেই এক দুঃখজনক পরিণতিতে পৌঁছে যায়। যক্ষারোগে ভুগে মেয়েটি মারা যায়। গভীর অবসাদে ডুবে যান তেইশ বছর বয়সী আলফ্রেড নোবেল। 
প্রথম প্রেমের মৃত্যুর পর বিষন্ন আলফ্রেড বেপরোয়ার মত নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। এ যেন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্য পাওয়া গেল। ১৮৬০  সালে ২৭ বছর বয়সে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হলেন। 
এদিকে রাশিয়ায় বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ইমানুয়েল নোবেল তাঁর পরিবারসহ রাশিয়া ছেড়ে ফিরে এলেন সুইডেনের হেলেনেবর্গে ১৮৬৩ সালে। আলফ্রেড ও তার ছোটভাই এমিল মা-বাবার সাথে সুইডেনে ফিরে এলেন। বড় দুইভাই রবার্ট ও লুডভিগ তাঁদের নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রয়ে গেলেন রাশিয়ায়। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে তাঁরা রাশিয়ায় বিপুল তেলসম্পদের মালিক হন। লুডভিগ নোবেলকে রাশিয়ার তৈলসাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট বলা হতো।
সুইডেনে ফিরে এসে স্টকহোমে ল্যাবোরেটরি স্থাপন করলেন ইমানুয়েল ও আলফ্রেড নোবেল। নাইট্রোগ্লিসারিনের পরীক্ষা চলছিলই। ১৮৬৩ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখে ৩০ বছর বয়সী নোবেল প্রথম প্যাটেন্ট পেলেন “মেথড অব প্রিপেয়ারিং গানপাউডার ফর বোথ ব্লাস্টিং এন্ড শুটিং”। ব্যাপক গবেষণায় মেতে উঠলেন আলফ্রেড। 
ল্যাবোরেটরিতে তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে ছোটভাই এমিল নোবেল। কিন্তু নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই বিপদের সম্ভাবনা। ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ বিরাট বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় আলফ্রেডের ল্যাবোরেটরি। আলফ্রেডের ছোটভাই এমিল সহ পাঁচজন মারা যান এই দুর্ঘটনায়। ভীষণভাবে আহত হবার পরেও অল্পের জন্য বেঁচে যান আলফ্রেড নোবেল। 
একটু সুস্থ হবার পর আবার কাজে লেগে গেলেন আলফ্রেড। কিন্তু ছেলে এমিলের মৃত্যুশোক সামলাতে পারলেন না বাবা ইমানুয়েল। স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসার পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল আলফ্রেড নোবেলের হাতে। 
দুর্ঘটনার পর স্টকহোমের কোথাও ল্যাবোরেটরি স্থাপন করার অনুমতি পাচ্ছেন না আলফ্রেড। কিন্তু তাঁর ব্লাস্টিং অয়েলের ব্যাপক চাহিদা। হ্রদের ওপর ভাসমান বার্জে অস্থায়ী ল্যাবোরেটরি স্থাপন করে ব্লাস্টিং অয়েল তৈরি চলছে। অবশেষে ১৮৬৫’র নভেম্বরে জার্মানির হামবুর্গের কাছে নাইট্রোগ্লিসারিন ফ্যাক্টরি তৈরির অনুমতি লাভ করে। সেখানেও অনেক সাবধানে কাজ করা হচ্ছিলো। দুর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে এক একটা শেডে দু’জনের বেশি কাজ করতেন না কখনোই। ১৮৬৬ সালে আবার দুর্ঘটনা ঘটলো। 
ল্যাবোরেটরির ধ্বংসস্তূপ সরাবার সময় আলফ্রেড আবিষ্কার করলেন তরল নাইট্রোগ্লিসারিন মিহি বালি ও মাটির সাথে মিশে এক ধরনের পেস্টের মত তৈরি হয়েছে। ওই পেস্টগুলো জোরে নিক্ষেপ করলে বিস্ফোরিত হয়, আগুনে পোড়ালেও বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু স্বাভাবিক তাপে ও চাপে কোন ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে না। আলফ্রেড পেয়ে গেলেন তাঁর স্বপ্নলোকের চাবি।

কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি উদ্ভাবন করলেন ডায়নামাইট। তারপর সাফল্যের ইতিহাস গড়লো ডায়নামাইট। ডায়নামাইট আবিষ্কারের ব্রিটিশ প্যাটেন্ট পেয়ে গেলেন মে মাসে। ছুটে গেলেন আমেরিকায় - ডায়নামাইটের আমেরিকান প্যাটেন্ট পাবার জন্য। দু’বছর পরে আমেরিকান প্যাটেন্ট পেলেন তিনি। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর ডায়নামাইট ও অন্যান্য বিস্ফোরকের ব্যবসা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর কারখানা তৈরি হলো ফ্রান্সে ও স্কটল্যান্ডে। পরে পৃথিবীর বিশটি দেশের নব্বইটি শহরে আলফ্রেড নোবেলের কারখানা স্থাপিত হয়। নোবেল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। বাড়তে থাকে তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কার। ৩৫৫টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট পেয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল। 
সবচেয়ে বড় কারখানা ফ্রান্সে থাকায় ১৮৭৩ সাল থেকে প্যারিসের মালাকফ এভিনিউতে বসবাস করতে শুরু করেন আলফ্রেড নোবেল। বিরাট বাড়ি। থাকার লোক মাত্র তিন জন, তিনি এবং কাজের লোক আর ড্রাইভার। প্রচন্ড ব্যস্ত আলফ্রেড। ব্যবসার সমস্ত কাগজপত্র নিজেই দেখাশোনা করেন। নিজের হাতে সব ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক চিঠিপত্রের উত্তর দেন। আবার তাদের কপিও রাখেন। টাকা-পয়সার নিখুঁত হিসেব রাখেন নিজেই। এর মধ্যেও যখন সময় পান নিজের লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুষ্ঠান বলতে কিছুই নেই আলফ্রেডের। যা আছে সবই ব্যবসায়িক। এত কাজ করেন কাজের তাগিদেই। যেমন ব্যবসার কাজে উকিলের সাথে কথা বলতে হয়। কিন্তু উকিল সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা শূন্যের কোঠায়। তিনি মনে করেন উকিলরা তাঁদের পেশার খাতিরে পৃথিবীর সবাইকেই অসৎ ভাবেন। 
প্যারিসে বাস করলেও ফ্রান্সকে নিজের দেশ ভাবতে পারেন না আলফ্রেড। কোন নির্দিষ্ট দেশকেই তাঁর নিজের দেশ বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই তাঁর বাড়ি থাকলেও কোন বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, “আমার বাড়ি হলো সেখানেই যেখানে বসে আমি কাজ করি। আর আমি সবখানেই কাজ করি।”
কাজের সাফল্যে আলফ্রেড নোবেলকে উচ্ছসিত হতে যেমন কেউ কখনো দেখেননি, ব্যর্থতায় ভেঙে পড়তেও কখনো দেখা যায়নি। এ যেন কাজের জন্যই কাজ করা। বন্ধুহীন সঙ্গীহীন একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত আলফ্রেড পুরো পৃথিবীর প্রতিই একধরনের বিতৃষ্ণভাব পোষণ করতেন। রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি সামান্য সমর্থন থাকলেও নিজের ধনবাদী অবস্থান থেকে নড়তে রাজি ছিলেন না কখনোই। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিও বিশ্বাস ছিল না আলফ্রেডের। জনগণ সমষ্টিগতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করতেন না আলফ্রেড। নিজের পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তার গভীরতার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল আলফ্রেডের। তিনি যে প্রচুর সম্পদের মালিক এবং এ সম্পদ যে তাঁকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করে তুলেছে তা তিনি ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই সাধারণ মানুষের সাথে একটা দূরত্ব তিনি বরাবরই রক্ষা করে চলতেন। 
শরীর তাঁর কোনদিনই খুব ভাল ছিল না। সারাক্ষণই কোন না কোন শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। নিজের ভেতর একধরনের হীনমন্যতা বাসা বেঁধেছে। নিজেকে খুবই অনাকর্ষণীয় মনে করেন তিনি। ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্কের প্রতিও কোন আকর্ষণ নেই তাঁর। সেই প্রথম যৌবন থেকে অপেক্ষা করছেন কখন তাঁর ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হবে। যে রাশিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন সেই প্রেম বিকশিত হবার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। তারপর কেটে গেছে তেইশ বছর। আলফ্রেড সেরকম আর কোন মেয়ের প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেননি এতগুলো বছরে। অবশ্য ভালোবাসা পাবার জন্য যেটুকু সময় সামাজিক মেলামেশায় কাটানো দরকার তার কিছুই করেননি তিনি। মনের মধ্যে তিনি একটা ধারণা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন তা হলো তাঁকে কোন মেয়ে ভালবাসবে না, কারণ মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো কোনকিছুই নেই তাঁর মধ্যে।  


Sunday, 12 May 2019

ফাইনম্যানের ইলেকট্রোডায়নামিক ভালোবাসা - ৯ম পর্ব (শেষ পর্ব)


ডিভোর্সের পর ফাইনম্যানের মনে হলো চার বছর কারাবাসের পর মুক্তি পেয়েছেন তিনি। আবার ব্যাচেলর লাইফের উদ্দাম স্বাধীনতা। ক্যাজুয়েল ডেটিং করছেন ইচ্ছেমতো। ন্যুড ক্লাবে গিয়ে জটিল গাণিতিক সমীকরণের সমাধান করছেন। গ্র্যাভিটন আর পারটনের ধারণার গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করা যায় কিনা দেখছেনকোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাবনা নিয়েও কাজ করেছেন এ সময়।
            
১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের আমন্ত্রণে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যান ফাইনম্যান
            
রবিবারের রোদেলা বিকেলে বিচ টাওয়েল হাতে নিয়ে বেড়াচ্ছেন লেক জেনেভার বিচে। সংক্ষিপ্ত পোশাকে বিচের বালিতে শুয়ে অনেকেই রোদ-স্নান করছে। টু-পিস পোলকা ডট বিকিনি পরা অনেক মেয়েই শুয়ে আছে বালির ওপর এখানে শেখানে। আমেরিকায় এখনো এরকম বিকিনির চল হয়নি। হঠাৎ চোখ গেল নীল বিকিনি পরা এক তরুণীর দিকে।
            
পায়ে পায়ে তরুণীটির দিকে এগিয়ে গেলেন চল্লিশ বছর বয়সী ফাইনম্যান। কীভাবে কথা বলবেন বুঝতে পারছেন না। সুইস ভাষা তিনি জানেন না। কিন্তু এমন সুন্দরী একজন মেয়ের সাথে কথা না বলে চলে যাবেন এটা তো হতেই পারে না। মেয়েটির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ফাইনম্যান। বিড় বিড় করে তাঁর নিজস্ব ইংরেজিতেই বললেন, "লেক জেনেভার পানি মনে হয় খুবই ঠান্ডা"
            "হ্যাঁ, খুবই ঠান্ডা" - চমকে উঠলেন ফাইনম্যান। মেয়েটি কথা বলছে ইংরেজিতে।
            "তুমি ইংরেজি জানো?"
            "ইংরেজি আমার মাতৃভাষা। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে জন্মেছি আমি।"
            "হাই, আমি ফাইনম্যান, রিচার্ড ফাইনম্যান। আমেরিকান।"
            "হাই, গোয়েনিথ হাওয়ার্থ"
            
ফাইনম্যান তো মহাখুশি। গোয়েনিথও খুশি অনেকদিন পর ইংরেজি বলার লোক পেয়ে ফাইনম্যান দেরি না করে টাওয়াল বিছিয়ে সূর্যস্নানে শুয়ে পড়লেন গোয়েনিথের পাশে। পরিচিত হতে সময় লাগলো না।
            
ইয়র্কশায়ারের ছোট্ট একটা গ্রামের মেয়ে গোয়েনিথ। তাদের গ্রামে কখনোই উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। কোন রকমে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে লোকাল লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হবার চেষ্টা করছিল গোয়েনিথ। কিন্তু কিছুই ভাল লাগছিল না তার। তাই ১৯৫৮'র শুরুতে ওয়ান-ওয়ে টিকেট কেটে চলে এসেছে জেনেভায়। ওয়ান-ওয়ে টিকেট কাটার উদ্দেশ্য হলো এখানে কাজ করে উপার্জন করে সে টাকায় দেশ-ভ্রমণ করবে।
            
ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় কোন চাকরি ঠিক করে আসেনি সে। লন্ডনের সুইস অ্যামবেসি থেকে দুটো এজেন্সির ঠিকানা নিয়ে এসেছিল। তাদের একটাতে যোগাযোগ করে সে জেনেভায় একটা চাকরি পেয়েছে। একটা ইংরেজ পরিবারে আয়ার কাজ। থাকা খাওয়া ছাড়া মাসে মাত্র পঁচিশ ডলার বেতন। দিনে প্রায় পনের ঘন্টা কাজ করতে হয় তাকে। সপ্তাহে সাড়ে ছয় দিন। সপ্তাহে একটা পুরো দিনও ছুটি নেই তার। বৃহস্পতিবার বিকেলে তিন ঘন্টা আর রবিবার বিকেলে তিন ঘন্টা ছুটি। সেরকম একটা রবিবারের বিকেলেই ফাইনম্যানের সাথে দেখা হয়েছে গোয়েনিথের।
            
ফাইনম্যান গোয়েনিথকে আমেরিকার সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে বললেন। ক্যালিফোর্নিয়ার যেখানে তিনি থাকেন সেই জায়গা কত সুন্দর তা বললেন। এবং শেষে বললেন, "দেখো, তুমি এখানে যা করছো তা যদি আমার জন্য করো - মানে আমার বাড়ির দেখাশোনা, আমি তোমাকে এখানের দ্বিগুণ বেতন দিতে রাজি আছি।"
            "আপনার বাড়ির গভর্নেস হতে বলছেন?"
            "হ্যাঁ, আমার বাড়ির কাজ করার কেউ নেই। আমার স্ত্রীর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে দু'বছর আগে। আমি একা মানুষ তোমাকে সারাদিনে দু'ঘন্টাও কাজ করতে হবে না।"
            "কিন্তু আমি তো আমেরিকা যাবার কথা ভাবছি না এখনো। আমার প্ল্যান হলো এখান থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া। সেখানে বছর দুয়েক থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া।"
            "এখান থেকে আমেরিকার দূরত্ব অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে কম। তুমি ভেবে দেখো। আমি আমেরিকায় ফিরেই তোমাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছি।"
            
ফাইনম্যান গোয়েনিথকে একজন গভর্নেসের বেশি কিছুই ভাবেননি শুরুতে। আমেরিকায় ফিরে এসে উকিলের সাথে যোগাযোগ করলেন গোয়েনিথের স্পন্সরশিপের ব্যাপারে। উকিল বললেন, "আপনি নিজে তাকে স্পন্সর করতে পারেন। কিন্তু আমি বলবো আর কাউকে দিয়ে করাতে।"
            "কেন? আমি নিজে করলে অসুবিধে কী?"
            "অসুবিধে এখন নেই। তবে ভবিষ্যতে হতে পারে। আপনার গভর্নেস যেহেতু আপনার বাড়িতে থাকবেন, সেহেতু কোনদিন যদি আপনাদের মধ্যে কোন যৌনসম্পর্ক হয় তবে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। কারণ স্পন্সরশিপের শর্ত হলো স্পন্সরকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হয়।"
            
ফাইনম্যান তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ম্যাথিউ স্যান্ডস্‌কে রাজি করালেন গোয়েনিথের স্পন্সর হওয়ার জন্য।
            
পরের বছর ১৯৫৯ সালে জেনেভা থেকে গোয়েনিথ চলে এলো ফাইনম্যানের বাড়িতে। মেরি লুইয়ের চাপে পড়ে বিরাট বাড়ি নিতে হয়েছিল ফাইনম্যানকে। সেই বিরাট বাড়িতেই থাকতে শুরু করলো গোয়েনিথ। দোতলায় একটা রুমে থাকে গোয়েনিথ, আর নিচের তলায় ফাইনম্যানের থাকা, স্টাডি সবকিছু।
            
শুরুতে ম্যাথিউ স্যান্ড্‌স ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া ক্যালটেকের আর কেউ জানতে পারেননি যে ফাইনম্যান বাড়িতে একজন গভর্নেস রেখেছেন। কিন্তু যখন দেখা গেল ফাইনম্যান প্রতিদিন লাঞ্চ টাইমে বাড়ি চলে যাচ্ছেন - তখন কৌতূহলীদের চোখ এড়ানো গেলো না।
           
গোয়েনিথকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন ফাইনম্যান। তাই গোয়েনিথ স্থানীয় কিছু আমেরিকান ছেলের সাথে আউটিং-এও যায় মাঝে মাঝে। অচিরেই ক্যালটেকের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো ফাইনম্যান-গোয়েনিথ সংক্রান্ত মুখরোচক গল্প।
           
মেয়েদের সাথে যথেচ্ছ মেলামেশার কারণে ফাইনম্যানের সুনামের ক্ষতি হচ্ছে। আর মেলামেশার ব্যাপারেও মনে হচ্ছে ফাইনম্যান কোন বাছবিচার করছেন না। অনেক বিবাহিতা মহিলার সাথেও তার ঘনিষ্ঠ মেলামেশা। অনেকেই আবার এ সুযোগে ফাইনম্যানকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেছে। অনেক মহিলা ফাইনম্যানের সাথে মেশার পরে যখন তখন চার-পাঁচশ ডলার দাবি করে চিঠি লেখে। তাদের একজন ফাইনম্যানের বাড়ি থেকে আইনস্টাইন গোল্ড মেডেল নিয়ে চলে গেলো। ফাইনম্যান তাঁর আইনস্টাইন মেডেলকে নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
            
ফাইনম্যানের শুভাকাঙ্খীরা ফাইনম্যানকে বোঝাচ্ছেন - "দেখো, যারা তোমার মেধা ও যোগ্যতার ধারে কাছেও নেই তাদের সাথে তুমি শুধুমাত্র জৈবিক প্রয়োজনে মিশছো, এবং তারা তার সুযোগ নিচ্ছে। কে কী বলছে তাতে তোমার কিছু আসে যায় না বলেই তুমি দেখেও দেখতে পাচ্ছো না লোকে কী ভাবছে তোমাকে। আর তুমিও এসব করছো কারণ তুমি মনে করছো তুমি ব্যাচেলর, যা খুশি করতে পারো। মনে করে দেখো আরলিন যখন ছিলো কিংবা মেরি লিউ, তখন তো একদিনের জন্যও অন্য কারো কাছে যাওনি। তোমার বিয়ে করা উচিত ফাইনম্যান।"
            
একদিন ফাইনম্যানের হঠাৎ মনে হলো তাঁর সহকর্মী প্রফেসর মারি গেল-ম্যান তাঁর ইংরেজ স্ত্রী নিয়ে কত সুখে আছে। গোয়েনিথও তো ইংরেজ। গোয়েনিথ যেভাবে তাঁর দেখাশোনা করছে এবং তাঁর ঘর-বাড়ি গুছিয়ে রাখছে তাতে তো মনে হচ্ছে স্ত্রী হিসেবে বেশ ভালোই হবে সে। দেরি না করে কোনরকম ভনিতা না করেই ফাইনম্যান বিয়ের প্রস্তাব দিলো গোয়েনিথকে।
           
চমকে উঠল গোয়েনিথ। ফাইনম্যান তার চেয়ে বয়সে ষোল বছরের বড়। তাছাড়া এ ব্যাপারটা নিয়ে সে ভাবেনি কখনো। সুতরাং তার সময় দরকার। কিন্তু ফাইনম্যান দেরি করতে রাজি নন। তিনি চাচ্ছেন পরের সপ্তাহেই বিয়েটা হয়ে যাক। গোয়েনিথ ফাইনম্যানকে বোঝালেন, "আমার মা-বাবাকে না জানিয়ে আমি কিছুই বলতে পারছি না।"
            
গোয়েনিথ তার মা-বাবাকে চিঠি লিখে সব জানালেন। তাঁদের কোন ধারণাই নেই কোথায় আমেরিকা, কোথায় ক্যালিফোর্নিয়া, আর ফাইনম্যানই বা কে, কেনই বা তিনি বিখ্যাত। তাঁরা খুশি কারণ তাঁদের মেয়ে অনেক বড় দেশে স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে।
            
গোয়েনিথের মা-বাবার পক্ষে বিয়েতে আসা সম্ভব নয়। গোয়েনিথকে আশীর্বাদ জানিয়ে চিঠি লিখলেন তাঁরা। গোয়েনিথ তাঁর মা-বাবার সম্মানে বিয়েটা মা-বাবার ধর্ম মেথডিস্ট খ্রিস্টান মতে করতে চাইলেন।
            
ফাইনম্যান ছোটবেলা থেকেই নাস্তিক। নিজে যা বিশ্বাস করেন না তা করেন না। তাঁর বাবার মৃত্যুর পর রাবাইরা যখন ফাইনম্যানকে বলেছিল হিব্রু ভাষায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মন্ত্র বলতে - ফাইনম্যান জবাব দিয়েছিলেন, "আমি হিব্রু বুঝি না।" তখন রাবাইরা হিব্রু মন্ত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইনম্যান তাও উচ্চারণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, "আমি ওসব বিশ্বাস করি না।"
            
কিন্তু এখন গোয়েনিথ যখন বললেন বিয়ে হলে তা  রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি মেথডিস্ট খ্রিস্টান রীতিনীতি মেনে হতে হবে বিশ্বাসের কারণে নয়, গোয়েনিথের মা-বাবার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য, ফাইনম্যান রাজি হয়ে গেলেন। ফাইনম্যান ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ডিভাইনিটি স্কুলের ডিন ওয়েসলি রবকে রাজি করালেন বিয়ের মন্ত্র পড়ানোর জন্য। ফাইনম্যানের বন্ধু ম্যাথিউ স্যান্ড্‌স, যিনি গোয়েনিথের স্পন্সর হয়েছিলে, গোয়েনিথকে মেথডিস্ট রীতি অনুযায়ী ফাইনম্যানের হাতে তুলে দিলেন। ১৯৬০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হান্টিংটন হোটেলে গোয়েনিথ ও রিচার্ড ফাইনম্যানের বিয়ে হলো। 




তারপর সারাজীবন গোয়েনিথের সাথে সুখেই কাটিয়েছেন রিচার্ড ফাইনম্যান। বিয়ের পর মারি গেল-ম্যানকে ফাইনম্যান বললেন, "তোমার মত আমারও এখন ইংরেজ স্ত্রী আছে।"
            
মারি বলেছিলেন, "আমার কিন্তু একটা ইংরেজ কুকুরও আছে।"
            
ফাইনম্যান দ্রুত একটা কুকুর নিয়ে এলেন বাসায়। কুকুরটির নাম রাখা হলো ভেনাস।
            
বিয়ের পর ফাইনম্যান গোয়েনিথকে নিয়ে গোয়েনিথের মা-বাবার সাথে দেখা করে এলেন।
            
বিয়ের দু'বছর পর ১৯৬২ সালে ফাইনম্যান ও গোয়েনিথের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। পজিট্রনের আবিষ্কারক কার্ল এন্ডার্সন ছিলেন ফাইনম্যানের বন্ধু। ফাইনম্যান ছেলের নাম রাখলেন - কার্ল। ফাইনম্যান কার্লকে নিজের মত করেই বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলেছেন। যেমন তাঁকে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর বাবা মিলভেল ফাইনম্যান। বড় হয়ে কার্ল নামকরা কম্পিউটার বিজ্ঞানী হন। ১৯৬৮ সালে ফাইনম্যান ও গোয়েনিথ একটা দুই মাস বয়সী মেয়েকে দত্তক নেন। তার নাম রাখেন মিশেল। মিশেল তাঁর বাবার মত বিজ্ঞানী হতে চান নি। তিনি একজন নামকরা ফটোগ্রাফার হয়েছেন।
            
১৯৬৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। তারপরেও অনেক বিষয়ে নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি।
            
ফাইনম্যানকে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে সবাই চিনতেন সারা বিশ্বে। তবে আমেরিকার একেবারে সব মানুষের হিরো হয়ে গিয়েছিলেন জীবনের একেবারে শেষের দিকে এসে। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি নাসার মহাকাশ যান 'চ্যালেঞ্জার' তার দশম যাত্রাকালে উৎক্ষেপণের এক মিনিট ১৩ সেকেন্ড পরেই সাতজন আরোহী সহ বিস্ফোরিত হয়।
            
এই বিস্ফোরণের কারণ খুঁজে বের করার জন্য যে বৈজ্ঞানিক কমিশন হয় তাতে দায়িত্ব পালন করেন ফাইনম্যান। তদন্ত শেষে তিনি টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বরফ-শীতল পানি ও রাবারের সাহায্যে খুবই সাধারণ একটা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কীভাবে অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে শাটলের একটা যন্ত্রাংশের রাবার ঠিকমত সম্প্রসারিত না হয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।
            
টিভি ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে ফাইনম্যানের জীবন-কাহিনি আবার নতুন করে সামনে চলে আসে। ফাইনম্যান হয়ে পড়েন বহুল উচ্চারিত একটি নাম। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'শিওরলি ইউ আর জোকিং মিস্টার ফাইনম্যান'। প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই বইটি বেস্ট সেলার হয়।
            
অনেক বছর থেকেই পাকস্থলীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন ফাইনম্যান। দুবার অস্ত্রোপচারের পরেও বেঁচেছিলেন বেশ কয়েক বছর। তৃতীয়বার অস্ত্রোপচারের পর ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রিচার্ড ফাইনম্যানের মৃত্যু হয়।

 ফাইনম্যানের মৃত্যুর পর তাঁর কাগজপত্রের সাথে একটা বাক্স পাওয়া যায়। সেখানে মুখ বন্ধ একটা খামে পাওয়া যায় একটা চিঠি। চিঠিটা ফাইনম্যান লিখেছিলেন চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় আগে আরলিনের মৃত্যুর দু'বছর পরে। ভীষণ অযৌক্তিক জেনেও মৃত আরলিনকে লিখেছিলেন ফাইনম্যানঃ

            "প্রিয় আরলিন, আমি তোমাকে ভালোবাসি প্রিয়তমা। আমি জানি এটা শুনতে তোমার কত ভাল লাগে। কিন্তু শুধু তুমি পছন্দ করো বলেই আমি তোমাকে লিখছি না। আমি তোমাকে লিখছি কারণ তোমাকে লিখলে আমার ভেতরটা জেগে ওঠে।  
            
কতদিন তোমাকে লিখিনি আমি। প্রায় দু'বছর হয়ে গেলো। আমি জানি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তোমাকে এতদিন না লেখার জন্য। কারণ তুমি তো আমাকে চেনো - কতটা জেদি আর বাস্তববাদী আমি।
            
মৃত্যুর পর তোমাকে লেখাটা অর্থহীন বলেই আমি লিখিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমাকে আমার লেখা দরকার। তোমার মৃত্যুর পর এতদিন আমি কী কী করেছি তোমার জানা দরকার।        
আমি তোমাকে বলতে চাই - আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকেই ভালবাসতে চাই, আমি সবসময় তোমাকেই ভালবাসবো।
            
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোমার মৃত্যুর পরেও তোমাকে এত ভালোবাসার কী মানে হয়? আমার বাস্তববাদী মনের তা বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি এখনো তোমার দেখাশোনা করতে চাই এবং চাই তুমিও আমার দেখাশোনা কর।
            
আমি তোমার সাথে আমার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই, আমাদের যৌথ প্রকল্পগুলো চালিয়ে নিতে চাই। আগে যেভাবে আমরা একসাথে জামাকাপড় বানাতাম, চায়নিজ শিখতাম, মুভি প্রজেক্টর নিয়ে কাজ করতাম। এখন আমি ওসব কিছুই করতে পারি না। তুমি ছাড়া আমি ভীষণ একা। তুমি ছিলে আমার প্রেরণা-নারী।
            
তুমি যখন অসুস্থ ছিলে তখন তোমার মন খারাপ থাকতো আমাকে যা দিতে চাও তা দিতে না পেরে। তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। আমাকে তোমার কিছু দেয়ার দরকার নেই। আমি তোমাকে এত বেশি ভালবাসি যে তার বিনিময়ে কোন কিছু পাবার কথা আমার মনেই হয় না।
            
এখন তুমি নেই। আমি জানি তুমি আমাকে কোন দিনই আর কোন কিছু দিতে পারবে নাকিন্তু তবুও আমি তোমাকে এত ভালবাসি যে আমি আর কাউকে ভালবাসতে গেলেই তুমি এসে দাঁড়াও সামনে। আমিও চাই তুমি এভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়াও। আমি বুঝতে পারছি মৃত আরলিন আমার কাছে জীবন্ত অনেকের চেয়েও জীবন্ত।
            
আমি জানি তুমি আমাকে বোকা ভাবছো এবং চাইছো আমি যেন আবার নতুন করে জীবন শুরু করি, ভালোবাসি। আমি জানি     তুমি চাইছো না আর আমার সামনে আসতে।
            
তুমি আশ্চর্য হবে গত দু'বছরে তুমি ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি আমি। আমি বুঝতে পারছি না এটা কীভাবে হলো। আমি অনেক মেয়ের সাথে মিশেছি। তাদের অনেকেই খুব      চমৎকার। কিন্তু দু'দিন যেতেই মনে হয়েছে তোমার মত ওরা কেউই নয়।
            
আমি একা থাকতে চাই না। কিন্তু পারছি না। আমার কাছে তুমিই একমাত্র সত্যি, আর সবাই মিথ্যে।
            
আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, আমি তোমাকে ভালবাসি। আমার স্ত্রীকে আমি ভালবাসি। আমার স্ত্রী মৃতা।
            
ইতি তোমার রিচ।
            
বিঃ দ্রঃ চিঠিটি পোস্ট করতে পারছি না বলে আমাকে মাফ করে দিও। কারণ আমি তোমার ঠিকানা জানি না।"



ফাইনম্যানের ইলেকট্রোডায়নামিক ভালোবাসা - ৮ম পর্ব



সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে শুরু করেছেন ফাইনম্যান। গবেষণা করছেন পুরোদমে। মৌলিক বলগুলো আলো, বিদ্যুৎ এবং চৌম্বক বলের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত তা নিয়ে কাজ করতে করতে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের ভিত্তি তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করেছেন ফাইনম্যান। এম-আই-টিতে ছাত্র থাকাকালীন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক পল ডিরাক ছিলেন ফাইনম্যানের হিরো। ডিরাকের কোয়ান্টাম মেকানিক্স বই তার প্রিয় পদার্থবিজ্ঞান বইগুলোর তালিকার শীর্ষে আছে। ডিরাক তাঁর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বইটা শেষ করেছেন এই বাক্য দিয়ে যে ইলেকট্রনের ডায়নামিক্স পুরোপুরি বোঝার জন্য নতুন ধারণার দরকার। ফাইনম্যান নতুন ধারণার সৃষ্টি করে চলেছেন। তাঁর কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে।

নিউইয়র্ক রাজ্যের ইথাকায় -  যেখানে কর্নেল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস - আবহাওয়া এত খারাপ - বিশেষ করে শীতকালে তুষারপাত বরফঝড় লেগেই থাকে। তখন বরফঢাকা রাস্তায় চাকায় শিকল না লাগিয়ে গাড়ি চালানো যায় না। ফাইনম্যানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এরকম আবহাওয়ায় গাড়ি চালিয়ে ক্যাম্পাসে যেতে।

একদিন তাঁর মনে হলো ইচ্ছে করলেই তো তিনি এসব থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ওয়েস্ট কোস্টের দিকে কোন ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলেই তো হয়। অনেক ভাবলেন ফাইনম্যান।

এমনিতেই তাঁর ভালো লাগছিলো না কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। কর্নেলে বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ছাড়াও গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, হোটেল ম্যানেজমেন্ট এসব বিষয়েও ডিগ্রি দেয়া হয়। এসব সাবজেক্টকে খুব একটা দরকারি সাবজেক্ট বলে মনে করতেন না ফাইনম্যান। তিনি বুঝতে পারতেন না হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে নতুন কী জিনিস আবিষ্কৃত হয়। তাঁর মনে হতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সব রকমের ডিগ্রি দেয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্বতা বলে কিছুই থাকে না।

শুধুমাত্র বিজ্ঞানের ডিগ্রি দেয়া হয় এমন প্রতিষ্ঠান ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি - ক্যালটেক। ক্যালটেকে যোগ দেয়ার জন্য তিনি অফার পেয়েছেন অনেকবার। এবার অফারটা নিয়ে নেবেন ঠিক করলেন। কিন্তু সমস্যা হলো হ্যান্স বেথে। তিনি ফাইনম্যানকে এত পছন্দ করেন  - তাঁকে যদি বলেন যে কর্নেল ছেড়ে চলে যাবেন - তখন কারণ জানতে চাইবেন, বেতন বাড়িয়ে দেবেন ইত্যাদি। সুতরাং ফাইনম্যান ঠিক করলেন আগে থাকতে কাউকে কিছু বলবেন না। ক্যালটেকে একটা সিরিজ অব লেকচার দেয়ার কথা আছে ফাইনম্যানের। তখন দেখবেন কেমন লাগে ক্যালটেকে।

তার আগে নিউইয়র্কের বাজে আবহাওয়া থেকে সাময়িকভাবে হলেও পালাতে চাইছেন। দক্ষিণ আমেরিকায় যাবার ইচ্ছে অনেক দিনের। প্রস্তুতি হিসেবে স্প্যানিশ শিখতে শুরু করেছিলেন।

১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে প্রিন্সটনে একটা সেমিনারে গিয়ে পরিচয় হলো ব্রাজিলের দু'জন প্রফেসরের সাথে। তাঁরা সে সময় জন উইলারের সাথে কাজ করছিলেন। ফাইনম্যানকে তাঁরা আমন্ত্রণ জানালেন ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যাওয়ার জন্য। ফাইনম্যান রাজি হলেন।

কর্নেলে ফিরে এসে স্প্যানিশের বদলে পর্তুগিজ শিখতে শুরু করলেন ব্রাজিলের কথা ভেবে।

১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে ব্রাজিল গেলেন ফাইনম্যান। ছয় সপ্তাহ ছিলেন সেখানে। ব্রাজিলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের আমন্ত্রণে বক্তৃতা দিলেন তাঁর কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স বিষয়ে। ব্রাজিল তাঁর ভালো লেগে গেলো। বিশেষ করে ব্রাজিলের খোলামেলা সংস্কৃতি, উদ্দাম সাম্বা নৃত্য, আর সর্বোপরি ব্রাজিলের সুন্দরী মেয়েদের খুব ভাল লাগলো ফাইনম্যানের।

ব্রাজিল থেকে ফিরে এসে ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে ক্যালটেকে অস্থায়ীভাবে কাজ করলেন। স্থায়ী পদ নেবেন কিনা ভাবছেন। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে প্রায় এক বছরের ছুটি পাওনা আছে। ভাবলেন সেই লম্বা ছুটিটা তিনি আবার ব্রাজিলে কাটিয়ে আসবেন।

১৯৫১ সালের আগস্টে আবার ব্রাজিল চলে গেলেন। রিও ডি জেনেরিও ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন ১৯৫২ সালের জুন পর্যন্ত। সেই সময় তিনি ব্রাজিলিয়ান স্টুডেন্টদের ফিজিক্স পড়াতে গিয়ে খেয়াল করলেন সবাই এত মনযোগী ক্লাসে - তিনি যা বলেন সবই তারা নোট করতে থাকে, ব্ল্যাকবোর্ডে যা লেখেন তাই তারা টুকে নেয়। কিন্তু যখন তিনি প্রশ্ন করেন - সবাই হুবহু একই রকমের উত্তর দেয়।

ফাইনম্যান দেখলেন সবাই পদার্থবিজ্ঞান মুখস্থ করছে, কিন্তু বিজ্ঞানের মূল যে সুর তা ধরতেই পারছে না কেউ। ফাইনম্যান খেয়াল করলেন ব্রাজিলে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে - অথচ সারাদেশে উল্লেখ করার মত পদার্থবিজ্ঞানী খুব একটা নেই।

ব্রাজিলের আবহাওয়া আর উদ্দাম সংস্কৃতিতে ভীষণ উদ্দীপ্ত ফাইনম্যান। সুযোগ পেলেই তিনি বংগো ড্রাম বাজাচ্ছেন বিভিন্ন পার্টিতে। ড্রামার হিসেবেও খুব নাম হয়ে গেল ফাইনম্যানের। এক পার্টিতে নাচার সময় একজন ব্রাজিলিয়ান এয়ার-হোস্টেজকে ভাল লেগে গেল ফাইনম্যানের।

এই সুন্দরী এয়ারহোস্টেজকে নিয়ে অনেকবার অনেক জায়গায় বেড়াতে গেছেন ফাইনম্যান। প্রায় মাস ছয়েক ডেটিং এর পর একদিন তারা দুজনে গেছেন মিউজিয়ামে। মিশরীয় সভ্যতার প্রদর্শনীতে গিয়ে ফাইনম্যান সবকিছুর বিস্তারিত বর্ণনা দিতে শুরু করেছেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি এতসব জানলেন কীভাবে?

মনে পড়লো মেরি লুই বেলের কথা। মেরি লুইয়ের কাছেই ফাইনম্যান শিখেছেন মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে এত সব। হঠাৎ মেরি লুইয়ের জন্য ভালবাসা জেগে উঠলো ফাইনম্যানের মনে।

মেরি লুইয়ের সাথে ফাইনম্যানের পরিচয় কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। ক্যানসাসের মেয়ে মেরি লুইর শিল্পকলার ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান, ব্যাপক ভালবাসা। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। তখন তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। ফাইনম্যানের সাথে তখন বেশ অন্তরঙ্গ সময় কেটেছে মেরি লুইর।

ক্যালটেকে যাবার পর ফাইনম্যান শুনেছিলেন মেরি লুই তখন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসের (ইউ-সি-এল-এ) কাছে ওয়েস্টউডে থাকেন। তখন যোগাযোগ করেননি। এখন মনে হচ্ছে মেরি লুইয়ের সাথে অত ঝগড়াঝাটি না করলেও চলত।

এয়ারহোস্টেজের সাথে ফাইনম্যানের সম্পর্ক কোন পরিণতির দিকে যাচ্ছিল না। ফাইনম্যান একটা স্থায়ী সম্পর্কের কথা ভাবছিলেন। মনে হলো মেরি লুইয়ের সাথে একটা স্থায়ী সম্পর্ক হলে খারাপ হয় না। যদিও মেরি লুইর নাকউঁচা স্বভাব আর কর্তৃত্বপরায়ণতার কারণে প্রায়ই ঝগড়া লেগে যেতো কর্নেলে থাকতে - এখন মনে হচ্ছে একটু মানিয়ে নিলেই হবে।

ফাইনম্যান মেরি লুইকে ব্রাজিল থেকে চিঠি লিখে বিয়ের প্রস্তাব জানালেন। মেরি লুই প্রস্তাবে রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু ফাইনম্যান ব্রাজিল থেকে আমেরিকাতে ফিরে আসার আগেই প্রশ্ন তুললেন অনেক ব্যাপারে যেগুলোর দিকে ফাইনম্যান আগে কখনো নজর দেননি।

যেমন, ফাইনম্যান যেহেতু ক্যালটেকে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদও সেরকম স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী হওয়া উচিত। ফর্মাল পোশাকের ব্যাপারটা ফাইনম্যান কোনদিনই মন থেকে মেনে নেননি। সুট-কোট-টাই পরতে পছন্দ করতেন না তিনি। বাধ্য না হলে তিনি টাই পরতেন না। দরকার ছাড়া নতুন পোশাক কেনার দরকার আছে বলেও তিনি মনে করেন না।

মেরি লুই এ ব্যাপারে ফাইনম্যানের বিপরীত। তিনি মনে করেন একজন অধ্যাপকের অবশ্যই পোশাকে আচার-আচরণে অধ্যাপক-সুলভ ব্যবহার করা উচিত।

নতুন বাসা নিলে সে বাসার নতুন ফার্নিচার কিনতে হবে। সে ফার্নিচারের বাজেট কত সেটা নিয়েও বিয়ের আগেই অনেক ঝগড়া করেন মেরি লুই।

ফাইনম্যান প্রায় সবকিছু মেনে নিয়েই বিয়ে করলেন মেরি লুইকে ব্রাজিল থেকে ফেরার পরপরই ১৯৫২ সালের ২৮ জুন।

ফাইনম্যানের সহকর্মী ও বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে গেলো ফাইনম্যান মেরি লুইকে বিয়ে করাতে। ক্যাম্পাসে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ফাইনম্যানকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তাঁরা জানেন ফাইনম্যান সুন্দরী উচ্ছল মেয়েদের সাথে মিশতে ভালবাসেন, কিন্তু যাঁকে বিয়ে করলেন তাঁর সাথে কোন কিছুরই মিল নেই ফাইনম্যানের। চোখে পড়ার মত সৌন্দর্য নেই মেরি লুইর, বয়সেও তিনি ফাইনম্যানের চেয়ে কয়েক মাসের বড়। সবচেয়ে বড় কথা হলো বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে মেরি লুইর ধারণা খুবই আপত্তিজনক।

বিয়ের দিন থেকেই মেরি লুই'র কর্তৃত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।  বিয়ের পর ফাইনম্যান ও মেরি লুই হানিমুনে গেলেন মেক্সিকো আর গুয়াতেমালায়। কিন্তু একটা ঘন্টাও নির্ঝঞ্ঝাট উপভোগ্য হলো না। সবকিছু নিয়েই ফাইনম্যানের মজা করার প্রবণতা দেখে ভীষণ বিরক্ত মেরি লুই। ফাইনম্যানের কোন কিছুই তাঁর পছন্দ হয় না।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ফাইনম্যান সম্পর্কে অভিযোগের পাহাড় মেরির - "রিচার্ড ষাঁড়ের মত চেঁচায়, কথায় ব্যাকরণ ঠিক থাকে না, লং আইল্যান্ডের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, পোশাকের কোন ঠিক নেই, প্রফেসর হয়েও কোট-টাই পরে না, জুতায় ময়লা লেগে থাকে, বংগো ড্রাম বাজায়, স্টুডেন্টদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে না" - এরকম অভিযোগের শেষ নেই মেরি লুইর।

শুরুতে কী এক আশ্চর্য কারণে ফাইনম্যান মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন।

সেই সামারে ব্রাজিল থেকে আবার আমন্ত্রণ পেলেন ফাইনম্যান। এবার সাথে নিয়ে গেলেন মেরি লুইকে। যে ক'দিন মেরি ছিলেন সেখানে ফাইনম্যান সুট-কোট-টাই পরে ইউনিভার্সিটিতে গেলেন। ক'দিন পরে মেরি লুই বলিভিয়ায় চলে গেলে সুট-কোট-টাই ছেড়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ফাইনম্যান।

মিউয়ন নিয়ে গবেষণা করছিলেন তখন ফাইনম্যান। বেশ কয়েকবার জাপান ভ্রমণ করেছেন কয়েক বছরে। ১৯৫৫ সালে মেরি লুইকেও সাথে নিয়ে গেলেন। জাপানীদের প্রচন্ড আন্তরিক আতিথেয়তাতেও বিরক্ত মেরি লুই।

ফাইনম্যানের দাম্পত্য জীবন অসহনীয় হয়ে পড়ছিল দিনের পর দিন। মেরি লুই উঠতে বসতে বলতে শুরু করেছেন তিনি একজন বুনো লোককে বিয়ে করেছেন। তাঁর মতে ফাইনম্যান একজন পি-এইচ-ডি ডিগ্রিধারী অশিক্ষিত মানুষ।

ক্যালটেকের অন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে ফাইনম্যানের মেলামেশাও পছন্দ করেন না মেরি। তিনি ফাইনম্যানকে বাধ্য করেছেন ক্যাম্পাসের অন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের বাসা থেকে দূরে একটা বড় বাংলো ভাড়া করতে।

গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা তাদের পার্টিতে ফাইনম্যানকে নিমন্ত্রণ করলে ফাইনম্যান যেতেন সেখানে। বিয়ের পর এরকম একটা পার্টিতে মেরি লুইকে নিয়ে গেলেন ফাইনম্যান। ফাইনম্যান ততদিনে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মজা করার জন্য অন্য মাতালদের সাথে মাতালের অভিনয় করতেন। ফলে তাঁকে মাতালদের চেয়েও বেশি মাতাল মনে হত।

সেদিনের পার্টিতে ফাইনম্যানকে ওরকম করতে দেখে মেরি লুই সবার সামনেই গর্জন করতে লাগলেন, "রিচার্ড, স্টপ ইট। লজ্জা করে না একজন প্রফেসর হয়ে এরকম মাতলামি করতে? ছি ছি। স্টপ ইট নাউ!" পার্টি বন্ধ হয়ে গেল। ফাইনম্যানের মত মানুষকে কেউ এরকম অপমান করতে পারে তা ক্যালটেকের কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

ফাইনম্যানের কোন কাজই পছন্দ হয় না মেরির। বংগো ড্রাম বাজালে তার শব্দে মাথা ধরে। বন্ধুদের কাছে অভিযোগ করতে শুরু করেছেন মেরি  - "ফাইনম্যান ঘুম থেকে উঠেই ক্যালকুলাস করতে শুরু করে, গাড়ি চালাতেও ক্যালকুলাস, খেতে বসেও মাথার মধ্যে ক্যালকুলাস, বিছানাতেও ক্যালকুলাস। অসহ্য!"

ফাইনম্যান সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একদিন আর পারলেন না যেদিন নিল্‌স বোরের সাথে তাঁর দেখা হওয়াটা মিস হয়ে গেল মেরির কারণে।

কেউ ফোন করে ফাইনম্যানকে কোন খবর দিতে বললে মেরি লুই প্রায়ই তা ভুলে যেতেন বা ইচ্ছে করেই ভুলে যাবার ভান করতেন। ফাইনম্যানের কাজের কোন গুরুত্বই তিনি দিতেন না।

সেদিন ডিনার করতে বসেছেন ফাইনম্যান ও মেরি লুই। হঠাৎ মেরি লুই বললেন, "ওহ, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, এখন মনে পড়েছে। সকালে টমি লরিটসেন ফোন করেছিল। বলেছিল আজ তাদের ওখানে ডিনার করতে। কোন্‌ এক বুড়ো বোয়ার নাকি এসেছে। আমি ভাবলাম কোথাকার বুড়ো এসেছে - তুমি নিশ্চয় যাবে না।"
"বুড়ো বোয়ারের সাথে দেখা করতে বলেছে নাকি নিলস্‌ বোর বলেছে?"
"কী জানি, হয়তো নিল্‌স বোর বলেছে। কী এমন পার্থক্য!"
"কী পার্থক্য! নিল্‌স বোর কে তুমি জানো না?"

না, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের জনক রিচার্ড ফাইনম্যানের স্ত্রী হয়েও মেরি লুই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক নিল্‌স বোরের নাম শোনেননি। ফাইনম্যান কীভাবে তা মেনে নেন?

একদিন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সবাই গেছেন পিকনিকে। সমস্ত ফ্যাকাল্টি মেম্বার, রিসার্চ স্টুডেন্ট ও তাদের পরিবার যোগ দিয়েছেন সেখানে। সবাই মিলে খুব হৈ চৈ মজা খেলাধূলা হচ্ছে। এ ধরনের পিকনিকে বরাবরই খুব মজা করেন ফাইনম্যান। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলতে খেলতে নিজেও অনেকটা ছেলেমানুষ হয়ে ওঠেন।

মেরি লুই এসেছেন হাই-হিল আর ধবধবে সাদা শর্টস পরে। তিনি এসেই এমন ভাব করতে শুরু করলেন যেন একদল জংলীর মাঝে এসে পড়েছেন। ক্যাম্প-চেয়ারেও বসছেন না কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে বলে। বেশি হাঁটছেন না কারণ পেন্সিল হিল মাটিতে দেবে যাচ্ছে। মেজাজ খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। প্রফেসর মারি গেলমানের স্ত্রী মার্গারেট অনেক আদর আপ্যায়ন করেও মেরিকে বসাতে পারলেন না।

বাচ্চারা ছুটতে ছুটতে কাদা ছোড়াছুড়ি করছিল। একটা বাচ্চা পড়তে পড়তে কাদামাখা হাতে মেরিকে ধরে ফেললো। মেরির ধবধবে সাদা শর্টসে কাদামাখা হাতের ছাপ। এতক্ষণ ধরে তার রাগের আগুন ফুঁসছিল - এবার দপ্‌ করে জ্বলে উঠলো।

মেরি গট্‌ গট্‌ করে ফাইনম্যানের সামনে এসে বললেন, "আর এক মুহূর্ত নয় এখানে। চলে এসো রিচার্ড।" পিকনিকের সবাই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। বুঝতে পারছে না কী ধরনের সিন-ক্রিয়েট হতে চলেছে।
"রিচার্ড, কী বলছি শুনতে পাচ্ছো না?" গলা চড়ছে মেরির। সবাই অপেক্ষা করছে ফাইনম্যান কী করেন দেখার জন্য।
"রিচার্ড, আমি চললাম।"
"তোমার যা খুশি করতে পারো মেরি। আই ডোন্ট কেয়ার।" - ফাইনম্যানের সাদাসিধে উত্তর। মেরি চলে গেলেন।

ফাইনম্যানের গবেষণা ও কাজকর্ম নিয়ে মজার মজার আলোচনা ক্যালটেকের ক্যাম্পাসে নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। সেসব আলোচনায় শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মিশে থাকতো। কিন্তু এখন ফাইনম্যান ও মেরির জীবন-যাপন নিয়ে অন্যরকম সব মুখরোচক গল্প তৈরি হতে লাগলো।

রাজনৈতিক মতাদর্শেও বিরাট ফারাক মেরি আর ফাইনম্যানের মধ্যে। মেরি কট্টর ডানপন্থী। মেরির চাপে পড়ে ফাইনম্যানও কিছুদিন রিপাবলিকানদের সাপোর্ট করেছিলেন। কিন্তু যখন ওপেনহাইমারকে কমিউনিস্ট সন্দেহে তারা বিচারের নামে দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করতে শুরু করলো - ফাইনম্যান আর সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু মেরি লুই ওপেনহাইমারের নামে যাচ্ছেতাই আজেবাজে কথা বলতে বলতে ফাইনম্যানের মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছিলেন।

১৯৫৪ সালে ফাইনম্যান লিকুইড হিলিয়ামের কোয়ান্টাম মেকানিক্স সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। তিনি চাইছিলেন দূরে কোথাও চলে যেতে। প্রফেসর হ্যান্স বেথেকে লিখলেন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে আবার ফিরে যাবার কোন সুযোগ আছে  কিনা। যেকোন বেতনেই তিনি কর্নেলে ফিরে যেতে রাজি।

হ্যান্স বেথে তো ভীষণ খুশি ফাইনম্যানের চিঠি পেয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেই মুহূর্তে ফাইনম্যানকে শুধুমাত্র একটা অস্থায়ী পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব। ফাইনম্যান চিন্তা করছিলেন কী করবেন।

এসময় ক্যালটেকে কর্মরত জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওয়াল্টার বাডে, রসায়নবিদ লাইনাস পাউলিং সহ অনেকের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘটনা ঘটলো ক্যালটেকে যা ক্যালটেকের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলো অনেকগুণ। ফাইনম্যান বুঝতে পারলেন অচিরেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও গবেষণায় ক্যালটেক বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সুতরাং ক্যালটেক ছেড়ে যাবার কোন মানেই হয় না।

সেবছর নভেম্বরের ২৮ তারিখ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল জয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি মারা গেলেন। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ফার্মির পদে ফাইনম্যানকে নিয়ে যাবার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন ওয়াল্টার বার্টকি। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর মারভিন গোল্ডবার্গারকে সাথে নিয়ে ডিন নিজে চলে এলেন ফাইনম্যানের বাসায়। বললেন ফাইনম্যানের যে কোন শর্ত মেনে নিয়ে তাঁরা ফাইনম্যানকে শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যেতে চান।

ফাইনম্যান বললেন, "ক্যালটেক থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত আমি বদল করেছি। আমি আর যাচ্ছি না।"
"সিদ্ধান্ত আরেকবার বদলানো যায় না?"
"না, এ ব্যাপারে আমি আর সিদ্ধান্ত নিতে চাই না।"
"আপনাকে আমরা কত বেতন অফার করতে রাজি আছি তা কি জানতে চান?"
"না। প্লিজ, তা উল্লেখ করবেন না। আমার স্ত্রী পাশের রুমে আছে। শুনতে পেলে আমাকে আপনাদের চাকরিটা নেবার জন্য বাধ্য করবে। আমি চাইনা আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে। আমি দুঃখিত।"

বিফল হয়ে ফিরে গেলেন বার্টকি ও গোল্ডবার্গার। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। পরের সপ্তাহেই ফাইনম্যান একটা চিঠি পেলেন শিকাগো ইউনিভার্সিটির ডিনের অফিস থেকে। চিঠির প্রথম লাইনেই লেখা আছে বেতনের অংক।

অবিশ্বাস্য রকমের বেশি বেতন অফার করছে শিকাগো - ফাইনম্যান ক্যালটেকে যত পান তার চারগুণ। ফাইনম্যান সাথে সাথেই উত্তর লিখে তাঁর অসম্মতির কথা জানালেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন এত বেশি বেতন পেলে তাঁর স্ত্রী হয়তো খুশি হবেন, কিন্তু লোভ আরো বেড়ে যাবে। ফাইনম্যানের জীবন আরো এলোমেলো হয়ে যাবে।

ফাইনম্যান ক্যালটেকে রয়ে গেলেন। কিন্তু মেরি লুইয়ের সাথে তাঁর বিয়েটা আর টিকলো না।  ১৯৫৬ সালে তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। বিচ্ছেদ ত্বরান্বিত করার জন্য ফাইনম্যানকে স্বীকারোক্তি দিতে হয় যে তিনি মেরি লুইয়ের প্রতি শারীরিক মানসিক অত্যাচার করেছেন। ডিভোর্সের পরবর্তী তিন বছরে দশ হাজার ডলার খোরপোশ দিতে হয়েছে তাঁকে।

ফাইনম্যানের ইলেকট্রোডায়নামিক ভালোবাসা - ৭ম পর্ব


পথে দু'জন মানুষ হাত দেখালে ফাইনম্যান গাড়িতে তুলে নেয় তাদের। প্রতি সপ্তাহেই তো সে অন্যের গাড়িতে যায়আর পথে গাড়ির কিছু হলে তারা সাহায্যও করতে পারবে। সান্টা ফে-র কাছে যেতেই গাড়ির একটা চাকা পাংকচার হয়ে গেলোসঙ্গী দুজনের সাহায্যে চাকাটা বদলে আবার দ্রুত ছুটল
            
কিছুদূর যেতেই আরেকটা চাকা ফেটে গেলো সশব্দে। কাছেই একটা পেট্রোল স্টেশন ছিলো। মেকানিকরা আগের একটা গাড়ি মেরামত করছিল। ফাইনম্যান চুপচাপ অপেক্ষা করছিল কখন তার গাড়িটা ঠিক করার সময় হবে মেকানিকদের। কিন্তু ফাইনম্যানের গাড়ি-সঙ্গীরা এতক্ষণে জেনে গেছে ফাইনম্যানের স্ত্রীর কথা। তারা ওয়ার্কম্যানকে গিয়ে বললো যে তার কত দ্রুত যাওয়া দরকার। তারা দ্রুত এসে তার গাড়ির চাকা বদলে দিলো। পাংকচার হয়ে যাওয়া চাকাটা রেখেই তারা ছুটলো। ওটার জন্য অপেক্ষা করতে গেলে সময় নষ্ট হবে।
            
ফাইনম্যান এমন হতভম্ব হয়ে গেছে যে মেকানিককে একটা ধন্যবাদ জানাতেও ভুলে গেছেহাসপাতাল থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে এসে গাড়ির আরেকটা চাকার হাওয়া চলে গেল। এখন আর করার কিছু নেই। গাড়িটাকে ওখানেই রেখে তারা অন্য গাড়িকে হাত দেখালটেলিফোন বুথ থেকে একটা ওয়ার্কশপে ফোন করে জানালো অবস্থা। তারা যেন এসে গাড়িটা ওয়ার্কশপে নিয়ে যায়।
            
হাসপাতালে ঢুকতেই আরলিনের বাবার সাথে দেখা হলো। তিনি তিন দিন ধরে আছেন এখানে। আরলিনের শেষ অবস্থা। তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ফাইনম্যানকে কোনরকমে বললেন, "আমি আর সহ্য করতে পারছি না মেয়েটার কষ্ট। আমি চলে যাচ্ছি।"
            
শেষবারের মত আরলিনকে দেখল ফাইনম্যান। ভীষণ দুর্বল, কেমন যেন ফ্যাকাশে সাদা। পৃথিবীর কোন কিছু সম্পর্কে যেন তার কোন অনুভূতি নেই। বিছানায় শুয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হা করে শ্বাস নিচ্ছে। বাতাস গিলতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। গলায় গব্‌ গব্‌ শব্দ হচ্ছে। মাঝে মাঝে চোখ দুটো উল্টে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এভাবে ঘন্টা দুয়েক চেষ্টার পর আরলিন আর পারলো না।
            
আরলিনের কেবিন থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের লনে কিছুক্ষণ অস্থির ভাবে হাঁটাহাঁটি করল ফাইনম্যান। তার খুব আশ্চর্য লাগছিলো। মৃত্যু সম্পর্কে, আপনজনের মৃত্যু ঘটলে আপনজনের অনুভূতি সম্পর্কে তার যে ধারণা ছিলো তার বেলায় তার কিছুই ঘটলো না। খারাপ লাগছিলো ঠিকই কিন্তু তা ভীষণ মারাত্মক রকমের ছিলো না। হয়তো তারা আগে থেকেই ব্যাপারটা জানত বা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল বলেই হয়তো
            
ফাইনম্যানের কেমন লাগছিলো বোঝানো মুশকিল। সে ভাবছিল - "আমরা মানুষেরা জানি বাঁচবো বড় জোর সত্তর কি আশি বছর। মরতে তো হবেই। তবুও আমরা হাসি, আনন্দ করি, ভালবাসি। আমরা বেঁচে থাকি। অনেকে হয়তো ভালবেসে একসাথে পঞ্চাশ বছর বেঁচে থাকে। আমি আর আরলিন না হয় মাত্র পাঁচ বছর একসাথে বাঁচলাম। এতে গাণিতিক পার্থক্যটা ছাড়া মানসিকভাবে আর তো কোন পার্থক্য নেই। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে এই ক'টা বছর তো অত্যন্ত ভালো সময় কাটিয়েছি।"
            
আবার আরলিনের কেবিনে এলো ফাইনম্যানআরলিনের শেষ সময়টা আবার মনে করতে চাইল। বুঝতে চাইল তার শেষ শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনটা। আরলিনের ফুসফুস ঠিকমত অক্সিজেন নিতে পারছিল না। রক্তে ঠিকমত অক্সিজেনের জোগান না থাকাতে মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। হৃৎপিন্ড দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলো - তখন শ্বাস নেয়া আরো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল। আরলিন খুব আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলো এবং কোন এক সময় তার শেষ নিঃশ্বাসটা বের হয়ে যাবার পর তার ফুসফুস আর কোন বাতাস টেনে নিতে পারেনি ভেতরে।
            
আরলিনের নার্স এসে নিশ্চিত হয়ে গেলো যে আরলিন মারা গেছে। ফাইনম্যানের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটু, তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
            
ফাইনম্যান কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল। তারপর উঠে আরলিনের ঠোঁটে একটা চুমু খেল, শেষ চুম্বন।
            
আরলিনের চুলের গন্ধ ঠিক আগের মতই আছে, মিষ্টি। হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে গেল ফাইনম্যান। মনে হলো আরলিন মরেনি। কিন্তু পর মুহূর্তেই বুঝতে পারলো মৃত্যুর এত কম সময়ের মধ্যে চুলের গন্ধ পরিবর্তন হওয়া তো সম্ভব নয়। টেবিল ঘড়িটার দিকে চোখ গেলে চমকে উঠলো সে। ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে নয়টা একুশ মিনিটে। আরলিনের মৃত্যুর পরপরই ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে! এটা কি অলৌকিক কোন কিছু?
            
ফাইনম্যান দেখলো এত শোকেও তার যুক্তির মৃত্যু ঘটেনি। ঘড়িটা অনেক দিন থেকেই গোলমাল করছিল। ফাইনম্যান নিজেই বেশ কয়েকবার ওটা ঠিক করেছে। এখন আরলিনের মৃত্যুর পর নার্স যখন কেবিনে এসেছিল মৃত্যুর সময় লেখার জন্য ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখছিল। সে সময় হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে পুরনো ঘড়িটা।
            
পরদিন আরলিনের  শেষকৃত্য। মৃতদেহ সৎকার করে যে কোম্পানি তাদের লোকজন এসে আরলিনের কয়েকটি আংটি দিয়ে গেল ফাইনম্যানকেএকজন জিজ্ঞেস করলো সে আরলিনকে আবার দেখতে চায় কিনা।
       
ফাইনম্যান বললো, "না, আমি দেখেছি তাকে গতকাল।"
            
গাড়ির ওয়ার্কশপে ফোন করল ফাইনম্যানআগের দিন তারা গাড়িটি রাস্তা থেকে তুলে এনে মেরামত করে রেখেছে। গাড়িটি ওয়ার্কশপ থেকে নিয়ে এসে আরলিনের জিনিসপত্র যা ছিল গাড়ির বুটে চাপিয়ে রওনা দিল লস আলামোসের দিকে। এবারো একজন মানুষকে তুলে নিল রাস্তা থেকে।
            
হাসপাতাল থেকে পাঁচ মাইলও যায়নি - ফটাস্‌স্‌সসসস্‌। গাড়ির অবশিষ্ট চাকা যেটা গতকাল রক্ষা পেয়েছিল সেটা পাংকচার। ফাইনম্যান এমন জোরে চিৎকার করে উঠল যে তার সহযাত্রী তার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো যেন সে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ।
            "এটা তো সামান্য একটা টায়ার, ম্যান"
            "হ্যাঁ এখন একটা, একটু পরে আরেকটা, তারপরে আরেকটা" - গলায় প্রচন্ড ক্ষোভ ফাইনম্যানের।
            
কোনরকমে চাকাটা বদলে খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে লস আলামোসে ফিরলো ফাইনম্যান।
           
সে চাচ্ছিল না তাকে কেউ আরলিনের কথা জিজ্ঞেস করুক বা সান্ত্বনা বাক্য শোনাক।  কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে খুব সহজভাবে বলছে, "আরলিন মারা গেছে। তা তোমার প্রজেক্টের কাজ কতদূর? ফর্মুলাটা দেখেছিলে?"
            
সবাই বুঝতে পারলো তার আঘাতটা কত গুরুতর। ফাইনম্যান যন্ত্রের মত তার নোটবই বের করলো যেখানে আরলিনের মেডিকেল কন্ডিশান লিখে রাখতো। লিখলো - ১৬ জুন, ১৯৪৫, আরলিনের মৃত্যু হয়েছে।
            
১৯৪২ সালের ২৯ জুন বিয়ে হয়েছিল তাদের। আরলিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাদের তিন বছরের অনন্য বিবাহিত জীবন।
            
লস আলামোসে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে ফাইনম্যান। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টাটা না বোঝার মত যান্ত্রিক নন ম্যানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা। হ্যান্স বেথে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন ফাইনম্যানকে।      
            
আরলিনকে বিয়ের পর একদিনের জন্যও বাড়ি যায়নি ফাইনম্যান। মা-বাবা আরলিনের সাথে তার বিয়েটা সহজভাবে মেনে নেননি বলে ফাইনম্যানের অভিমান ছিল ভীষণ। এবার আরলিনের মৃত্যুর পর বাড়িতে যেতে হলেও বেশির ভাগ সময় সে দূরে দূরে থাকলো বাড়ির সবার কাছ থেকে। বন্ধুদের সাথে জোর করে হৈ চৈ করে সময় কাটালো।
            
ক'দিন পরেই ফাইনম্যানকে ফিরতে হলো লস আলামোসে। প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। ১৬ জুলাই ১৯৪৫ ইতিহাস সৃষ্টি হলো পৃথিবীতে। সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হলো - যার নাম দেয়া হলো প্রথম ট্রিনিটি টেস্ট।
            
আরিজোনার মরুভূমির গ্রাউন্ড জিরো থেকে বিশ মাইল দূরে একটা ট্রাকের ভেতর বসে ফাইনম্যান দেখলো গত কয়েক বছরের মেধা, গবেষণা ও প্রচন্ড পরিশ্রমে যে পারমাণবিক দানব তারা তৈরি করেছে কী প্রচন্ড শক্তি তার।
            
কয়েক সপ্তাহ পরেই আগস্টের ছয় ও নয় তারিখে জাপানের হিরোশিমা ও নাকাসাকি শহর সমস্ত নাগরিক সহ ধ্বংস করে দেয়া হলো পারমাণবিক বোমা ফেলে
            
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। কিন্তু সারা বিশ্বের উপর রেখে গেল একটি বিরাট পারমাণবিক কলঙ্কের ছাপ। সেই কলঙ্ক তৈরির দায় এড়াতে পারে না ফাইনম্যান।
            
আরলিনের মৃত্যু এবং তার পরপর এতগুলো ঘটনা ফাইনম্যানকে উদাসীন করে তোলে। তার কেবলই মনে হচ্ছে কী দরকার এসব নগর সভ্যতার। এক মুহূর্তের মধ্যে সব ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা মানুষ একবার যখন অর্জন করে ফেলেছে, সেই দানবীয় ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাবে সে সুযোগ পেলেই। 
            
এক রাতে আরলিনকে স্বপ্ন দেখলো ফাইনম্যান। দেখলো আরলিন এসেছে তার কাছে। ফাইনম্যান স্বপ্নে তাকে বললো, "তুমি মরে গেছো আরলিন। স্বপ্নেও তোমার আসা ঠিক নয়।"
            
পরের রাতে আবার স্বপ্ন। এবার সে বললো - "আমি আসলে তোমার উপর বিরক্ত হয়েছিলাম। এখন আবার তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। আমি ফিরে এসেছি।"
            
মাথা কাজ করছিলো না ফাইনম্যানেরএই স্বপ্ন দেখার কারণ কী? মাথার ভেতর আরলিন থাকবে কেন? কেন সে স্বপ্নে আসা যাওয়া করবে? নিশ্চয়ই সে অবচেতন মনে কিছু একটা করেছে। ভাবতে থাকে ফাইনম্যান।
            
আরলিনের মৃত্যুর পর এক মাস কেটে গেছে, কান্না আসেনি একবারও। কিন্তু সেদিন ওক রিজের রাস্তায় একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ফাইনম্যানের চোখে পড়লো চমৎকার একটি ড্রেস, শো- কেসে সাজানো। হঠাৎ মনে হলো আরলিন খুব পছন্দ করতো এটাখুব আটপৌরে ভাবনা। কিন্তু ফাইনম্যানের চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগলো। আরলিনের মৃত্যুতে ফাইনম্যান কাঁদলো, প্রথম এবং শেষবার।
            
কাজে ডুবে থাকতে চাইলেন ফাইনম্যান। লস আলামোসের ল্যাবে কাজ করার সময়েই ফাইনম্যানের বৈজ্ঞানিক ক্ষমতায় মুগ্ধ সবাই। তত্ত্বীয় বিভাগের প্রধান হ্যান্স বেথে ফাইনম্যানকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরি দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালের অক্টোবর থেকেই রিচার্ড ফাইনম্যান অফিসিয়ালি জয়েন করেছেন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। ম্যানহাটান প্রজেক্টের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য যোগদানের পর থেকেই ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে তাঁর। ফাইনম্যান এবার কাজে যোগ দিলেন ১৯৪৫ সালের ৩১ অক্টোবর।
            
বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসছেন তাঁদের অসমাপ্ত পড়াশোনা শেষ করার জন্য। তাই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীর সমাবেশ। ছাব্বিশ বছর বয়সী অধ্যাপক ফাইনম্যানকে দেখতে আরো কমবয়সী মনে হয়। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায় সহজেই।
            
ফাইনম্যান উপভোগ করতে চাইলেন তাঁর নতুন চাকরি। ফ্যাকাল্টি ক্লাবে লাঞ্চ করতে না গিয়ে লাঞ্চ করেন ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিশে। স্টুডেন্ট সেন্টারে গিয়ে মেয়েদের সাথে বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের সাথে আড্ডা মারতে বেশ ভালোই লাগছে ফাইনম্যানের। মেয়েরাও সহজে আকৃষ্ট হচ্ছে ফাইনম্যানের ক্যারিশমার কাছে।
            
ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ছাত্রী নেই বললেই চলে। ফাইনম্যান যেসব ছাত্রীর সাথে মেশেন তারা সবাই নন-সায়েন্স স্টুডেন্ট। কেউই তাঁকে সেভাবে চেনে না। ফাইনম্যান খেয়াল করলেন তিনি যখন সত্যি কথা বলেন মেয়েদের কেউ তা বিশ্বাস করে না বা করতে চায় না। তারা জানতে চায় -
            "রিচার্ড, তুমি আসলে কী করো?"
            "আমি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর"
            "এটম বোমা সম্পর্কে কিছু জানো?"
            "জানবো না কেন? আমরাই তো বানালাম।"
            "মানে?"
            "মানে আমি তো ম্যানহাটান প্রজেক্টে কাজ করেছি। আমি ছিলাম কম্পিউটিং ডিপার্টমেন্টের হেড।"
            "তুমি কি ট্রিনিটি টেস্টের সময় ছিলে সেখানে?"
            "অবশ্যই। আমি ছিলাম গ্রাউন্ড জিরো থেকে ২০ মাইল দূরে।"
            "বিস্ফোরণ দেখেছো?"
            "আমার মত করে আর কেউ দেখেনি। যারা দেখেছে তারা সবাই চোখে কালো চশমা পরে দেখেছে। মনে হয় একমাত্র আমিই দেখেছি খালি চোখে। একটা ট্রাকের ভেতর বসে ট্রাকের জানালার কাচের ভেতর দিয়ে। কারণ আমি জানতাম যে বিস্ফোরণের পর ২০ মাইল পর্যন্ত যা আসতে পারে তা আলট্রাভায়োলেট - যার বেশির ভাগ শক্তি সাধারণ কাচেই আটকে যাবে।"
            "রিচার্ড, তোমার মত এত বড় মিথ্যুক আমি জীবনে দেখিনি।"
            
ফাইনম্যান ভেবে পান না কেন কেউ তাঁর সত্যি কথা বিশ্বাস করতে চায় না। ক'দিন পরপরই তাঁর মেয়েসঙ্গী বদলে যাচ্ছে। শান্তি পাচ্ছেন না তিনি কোথাও।
            
এক বছর পরেই ১৯৪৬ সালের ৭ অক্টোবর ফাইনম্যানের বাবা মারা যান। ফাইনম্যান আরো বিষন্ন হয়ে পড়েন। মনের মেঘ কাটানোর জন্য তাঁর সঙ্গী হয়ে পড়ে আরো বেশি পদার্থবিজ্ঞান। আর আরলিনের অভাব ঘোচাতে আরো বেশি নারীসঙ্গ।
            
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাফল্য আসতে শুরু করলেও আরলিনের অভাব-জনিত বিষন্নতা কাটছে না কিছুতেই। এসময় কর্নেল ইউনিভার্সিটির অনেক সুন্দরী মেয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন ফাইনম্যান কিন্তু কারো সাথে দু'দিন মেশার পরেই মনে হয় আরলিনের মত তো নয় মেয়েটি। জোর করে আরো কিছুদূর এগোনোর পরে মনে হয় আরলিন এসে দাঁড়িয়েছে পথজুড়ে।          



Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts