০১ আগস্ট ১৯৯৮ শনিবার
আজ সকাল দশটা থেকে বিকেল তিনটা
পর্যন্ত হেঁটে বেড়িয়েছি মেলবোর্নের ঐতিহাসিক রাস্তায় এবং জেম্স কুকের কুটিরে। এখানে
ঐতিহাসিক রাস্তা মাত্র কয়েকটা- যা এই শহরের গোড়াপত্তনের সাক্ষী হয়ে আছে।
মেলবোর্ন
শহরের ইতিহাস ইয়ারা নদী থেকে শুরু। অস্ট্রেলিয়ায় শ্বেতাঙ্গদের অভিযানের প্রায়
তিরিশ হাজার বছর আগে থেকেই আদিবাসীদের বাস। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অসংখ্য ছোটবড় জলস্রোত
মিলেমিশে সৃষ্টি হয়েছে নদী। নদীর তীর ঘেঁষে যে উরুন্ডজেরি (Wurundjeri) সম্প্রদায়ের বাস, তারা নদীকে বলে ‘বিরারুং’ (Birrarrung) যার বাংলা অর্থ- প্রবহমান বা
ক্ষেত্রবিশেষে ‘ছায়ায় ঘেরা মায়ায় ঘেরা’। এই ‘বিরারুং’ এসে মিশেছে
উপসাগরে- ইংরেজরা যার নাম দেন ‘পোর্ট ফিলিপ
বে’।
উরুন্ডজেরিদের
জীবন-যাত্রায় বিপর্যয় নেমে আসে যখন তাদের ভুবনে প্রথম শ্বেতাঙ্গ অনুপ্রবেশ ঘটে
১৮০৩ সালে। নিউ সাউথ ওয়েল্স এর সার্ভেয়র জেনারেল চার্লস গ্রাইম্স পোর্ট-ফিলিপ
ডিস্ট্রিক্ট এর ম্যাপ তৈরি করতে আসেন। গ্রাইম্স নদী আর উপসাগর দেখে মুগ্ধ হয়ে
যান। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করেন যে বসতি গড়ে তোলার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না।
গ্রাইম্সের
জরিপের পর আরো তেইশ বছর কেউ আসেনি এদিকে। ততদিনে তাসমানিয়ার লনচেস্টনে গড়ে উঠেছে
ভূমি-আগ্রাসী গোষ্ঠী ‘পোর্ট ফিলিপ এসোসিয়েশান’। ১৮৩৫ সালের ৮ জুন এই গোষ্ঠীর নেতা জন
ব্যাটম্যান জাহাজ নিয়ে চলে আসেন পোর্ট ফিলিপ উপসাগরে। ধূর্ত ব্যাটম্যান ভাব জমান
উরুন্ডজেরি সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে। জামাকাপড়, ছুরি-কাঁচি, শীতের কাপড়, খাবার
দাবার, মদ ইত্যাদির বিনিময়ে তিনি আদিবাসী নেতাদের কাছ থেকে অনেক জমি লিখে নেন।
নিজেই দলিল তৈরি করে এনেছিলেন। আদিবাসীরা ব্যাটম্যানের ভাষা বোঝেন না। সরল বিশ্বাসে বন্ধুত্বের নিদর্শন মনে করে হাতের
চিহ্ন এঁকে দেন তাতে। জন ব্যাটম্যান এটাকে ব্যবহার করেন চুক্তি-সই এর প্রমাণ
হিসেবে। লনচেস্টনে ফিরে গিয়ে জন ব্যাটম্যান ঘোষণা করেন “আমি হলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জমির মালিক”। তাঁর দাবী মিথ্যে ছিল না। তিনি
উরুন্ডজেরিদের কাছ থেকে লিখে নিয়েছিলেন প্রায় ছয় লাখ একর জমি (প্রায় আড়াই হাজার
বর্গ কিলোমিটার- সমগ্র ঢাকা জেলার ক্ষেত্রফল মাত্র দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটার)।
ব্যাটম্যানের জমি কেনার খবর শুনে লনচেস্টনের আরেকজন
নেতা জন প্যাসকো ফকনার দ্রুত একটা জাহাজ কিনে নিজের পরিবার আর লোকজন নিয়ে পোর্ট-ফিলিপ
বে’তে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কিন্তু জাহাজ কেনার টাকা না দিয়ে এবং পুরনো
ঋণ শোধ না করে পালাবার মতলব করেছিলেন বলে ফকনারকে বন্দী করা হয়। এ সুযোগে
লনচেস্টনের আরেক ব্যবসায়ী জর্জ ইভান্স ফকনারের জাহাজ নিয়ে দ্রুত চলে আসেন পোর্ট
ফিলিপ ডিস্টিক্টে। ১৮৩৫ সালের আগস্ট মাসে নদীর তীরে পৌঁছেই ইভান্স ইচ্ছেমত জায়গা
দখল করে চাষবাস পশুপালন শুরু করে দেন।
জন
ব্যাটম্যানের জমি জরিপের দায়িত্ব পড়ে জন হেল্ডার ওয়েজের ওপর। তিনি এসে পৌঁছান ১৮৩৫
সালের ২ সেপ্টেম্বর। তিনি শুনেছেন আদিবাসীরা নদীকে ‘ইয়ারা-ইয়ারা’ বলে। তিনি ভেবেছিলেন এটাই নদীর নাম। ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি নদীর নাম
লিপিবদ্ধ করেন ‘ইয়ারা’। অবশ্য পরে জানা গেছে যে আদিবাসীদের ভাষায় ‘ইয়ারা’ মানে ঝর্ণা।
দ্রুত
বসতি গড়ে উঠতে শুরু করলো ইয়ারার তীরে। যদিও নিউ সাউথ ওয়েল্স সরকারের খাতায় এই
বসতি ‘বে-আইনী’ তবুও থেমে রইলো না কিছুই। এক বছরের মধ্যেই এখানে শ’খানেক বসতি গড়ে উঠলো, প্রায় ছাব্বিশ হাজার
ভেড়া চড়তে শুরু করলো ইয়ারার তীরে।
বসতি
মানেই জীবন-যাপন। আর একে কেন্দ্র করে নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু। ধীরে ধীরে একটা
শহর দানা বাঁধতে শুরু করলো। ১৮৩৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম
ল্যাম্ব মেলবোর্নের নামানুসারে এই নতুন শহরের নাম রাখা হলো- মেলবোর্ন। ছয় ব্লক বাই
চার ব্লকের ছোট্ট শহর। স্পেন্সার স্ট্রিট, লা-ট্রোব স্ট্রিট, স্প্রিং স্ট্রিট আর
ফ্লিন্ডার স্ট্রিট হলো এই শহরের সীমানা। ১৮৩৮ সালের জুন মাসের জরিপে দেখা গেলো-
মেলবোর্নের মোট জনসংখ্যা ১৭৭ জন- ১৪২ জন পুরুষ ও ৩৫ জন নারী।
পরবর্তী
পনেরো বছর ধরে নগর-পরিকল্পনা, রাস্তা-ঘাট তৈরি এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে
স্বাভাবিক নিয়মে। ইয়ারা নদীর সাথে সমান্তরাল করে তৈরি করা হয়েছে ফ্লিন্ডার
স্ট্রিট। বাকী সব রাস্তা ও দালানের পরিকল্পনা করা হয়েছে দাবার ছকের মত করে। যতটা
সম্ভব জ্যামিতিক নিয়ম মেনে। এখন ম্যাপে দেখা যায়- মেলবোর্নের মূল বাণিজ্যিক এলাকা
একটি নিঁখুত আয়তক্ষেত্র।
১৮৫১
সালে মেলবোর্ন শহর হঠাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী শহরগুলোর তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলে।
আক্ষরিক অর্থেই স্বর্ণযুগের সূচনা হয় মেলবোর্নের। সোনার খনি পাওয়া যায় এখানে।
শুরুতে ইয়ারার তীরে ওয়ারেন্ডাইট এলাকায় সোনা আবিষ্কৃত হয়। পরে আশেপাশের আরো অনেক
জায়গায়। দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করে মেলবোর্নে। সবাই লেগে যায় খনি খোড়ার কাজে।
প্রতিদিন গড়ে আড়াই শ’ মানুষ এসে বসতি গড়তে শুরু করেছে।
তাদের থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য চাহিদার যোগান দেবার জন্য দ্রুত বাড়তে থাকে শহরের
কলেবর।
সোনার
টাকায় গড়ে ওঠে ট্রেজারি বিল্ডিং, পার্লামেন্ট হাউজ, সোয়ান্সটন স্ট্রিটের স্টেট
লাইব্রেরি ও মেলবোর্ন টাউন হল, ও এলিজাবেথ স্ট্রিটের জেনারেল পোস্ট অফিস।
পরবর্তীতে একই ঘরানার স্থাপত্যে আরো অনেক ভবন তৈরি হয়েছে। ফ্লিন্ডার স্ট্রিট ট্রেন
স্টেশন তাদের একটি। আজ ঘুরে ঘুরে সবগুলো বিল্ডিং দেখে এসেছি। ভিক্টোরিয়ান যুগের
বিল্ডিং সব। জেনারেল পোস্ট অফিসে এখন নানারকম রেস্টুরেন্ট আর দোকান-পাট।
পোস্ট-অফিসগুলো এখন সব প্রাইভেট হয়ে গেছে। কিন্তু জি-পি-ও বিল্ডিংটা রয়ে গেছে আপন
বৈশিষ্ট্যে। এটা এখন এলিজাবেথ স্ট্রিট আর বার্ক স্ট্রিট মলের একটি প্রধান আকর্ষণ।
একটা জিনিস স্বীকার করতেই হবে তা হলো
সেই সময়ের নেতাদের দূরদর্শিতা। শহরের জনসংখ্যা যখন মাত্র ১৭৭ জন তখনই তাঁরা
নগর-পরিকল্পনা করেছিলেন পরবর্তী কয়েকশ’ বছরের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। এখন এই শহরে প্রতিদিন বিশ লাখ মানুষের
আনাগোনা। অথচ সেই ১৮৫০ সালের অবকাঠামো এখনো কার্যকর।
পার্লামেন্ট
হাউজের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে সরকারি অফিসগুলো বামে রেখে এগোলাম ফিট্জরয়
গার্ডেনের ভেতর দিয়ে। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। পাতাহীন গাছের ডাল থেকে
টুপটাপ ঝরে পড়ছে বৃষ্টির রেশ। আরো কিছুদূর গিয়ে ছোট্ট একটা বাগানঘেরা লালচে পোড়া
ইটের তৈরি টালির ছাদের ছোট্ট একটা কুটির- কুক্’স কটেজ। ক্যাপ্টেন জেম্স কুকের স্মৃতিজড়িত কুটির। মজার
বিষয় হচ্ছে এই পুরো কুটিরটাকে ইংল্যান্ড থেকে তুলে এখানে এনে বসানো হয়েছে।
১৭৫৫ সালে ক্যাপ্টেন জেম্স কুকের
বাবা জেম্স কুক ও মা গ্রেস কুক ইংল্যান্ডের নর্থ ইয়র্কশায়ারে এই বাড়িটা কিনে
নিজেদের মত সংস্কার করে বসবাস করছিলেন। তাঁদের ছেলে ক্যাপ্টেন জেম্স কুক এই বাড়িতে বসবাস করেছিলেন কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে
অনেকের, কিন্তু তিনি যে তাঁর মা-বাবাকে
দেখতে মাঝে মধ্যে আসতেন তাতে কারো সন্দেহ নেই। ক্যাপ্টেন কুকের এটুকু স্মৃতিই
বাড়িটার বিখ্যাত হয়ে ওঠার পক্ষে যথেষ্ঠ। তাছাড়া যে বাড়িতে ক্যাপ্টেন কুক
জন্মেছিলেন সেই বাড়িটা ১৭৮৬ সালে ভেঙে ফেলার পর ইয়র্ক-শায়ারের এই বাড়িটাই হয়ে ওঠে
কুকের একমাত্র স্মৃতি-জড়িত বাড়ি। মালিকানা বদল হতে হতে বাড়িটা মিসেস ডিক্সনের হাতে
এসে পড়ে।
১৯৩৩
সালে মিসেস ডিক্সন বাড়িটা বিক্রি করার ঘোষণা দেন। দেশপ্রেম দেখানোর জন্য তিনি একটা
শর্ত জুড়ে দেন যে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের ক্রেতাদের কাছেই তিনি বাড়িটা বিক্রি
করবেন। এদিকে ১৯৩৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের শতবর্ষ পূর্তি হচ্ছে।
মেলবোর্নের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রাসেল গ্রিমওয়েড চাইছিলেন এ উপলক্ষে ভিক্টোরিয়ান
সরকারকে কিছু একটা উপহার দিতে। ক্যাপ্টেন কুকের কটেজটি নিলামে বিক্রি হচ্ছে জানতে
পেরে তিনি লোক লাগালেন। মিসেস ডিক্সনকে রাজী করালেন যেন তিনি তাঁর শর্তটা একটু
বদলে নেন। ব্রিটেনের বদলে ব্রিটিশ কলোনির মধ্যে তিনি বাড়িটা বিক্রি করতে রাজী
হলেন। অস্ট্রেলিয়া স্বাধীন দেশ হলেও এখনো ব্রিটিশ কলোনির মতোই- ব্রিটেনের রাণীকে
নিজেরাও রাণী মানে, পার্লামেন্টে রাণীর একজন প্রতিনিধির জন্য স্থায়ী আসন আছে।
নিলাম হলো। ব্রিটিশদের সর্বোচ্চ অফার ছিল তিনশ’ পাউন্ড। আর এক লাফে আটশ’ পাউন্ড দাম হেঁকে বাড়িটা কিনে নিলেন মেলবোর্নের রাসেল
গ্রিমওয়েড।
এবার
বাড়িটাকে মেলবোর্নে নিয়ে আসার পালা। মেলবোর্ন থেকে একদল স্থপতি গিয়ে সবকিছু
দেখেশুনে বাড়ির হুবহু নকশা নিয়ে এলেন। একটা একটা করে ইট-কাঠ-টালি খোলা হলো,
প্যাকেট করা হলো। ১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসে ২৫৩টি বড় বড় বাক্স আর চল্লিশটি ব্যারেল
ভর্তি হয়ে মেলবোর্নে এসে পৌঁছালো কুক’স কটেজ। পরের ছ’মাসে এখানে
পুনর্গঠিত হলো কুক্’স কটেজ। ১৯৩৪ সালের ১৫ অক্টোবর রাসেল
গ্রিমওয়েড কটেজটি আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দেন মেলবোর্নের মেয়রের হাতে। তখন থেকেই এটা
মেলবোর্নের একটা ঐতিহাসিক স্থান।
ভেতরে
তেমন দামী কোন আসবাব-পত্র নেই, যা আছে তা সেই সময়ের সাক্ষী। স্কুলের শিক্ষার্থীদের
ইতিহাস শেখানোর জন্য নানারকম আয়োজন এখানে সারাবছর ধরে।
কটেজের
বাইরে দেখলাম বিয়ের পোশাকে বরকনে ছবি ওঠাচ্ছে। এদেশে বিয়ে মনে হয় শুধু শনিবারেই
হয়। ছুটির দিন না হলে সম্ভবত কাউকে ফ্রি পাওয়া যায় না।
ফেরার
পথে ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট পার হয়ে ইয়ারার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে এম-সি-জি’র কাছে চলে গিয়েছিলাম। পৃথিবী বিখ্যাত
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। এখন ফুটবলের মৌসুম, এ-এফ-এল বা অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লীগ
চলছে। প্রতি শনিবার দুপুরে খেলা থাকে এখানে। আমাদের ফুটবলের সাথে এদের ফুটবলের কোন
মিল নেই। আমাদের ফুটবল বৃত্তাকার- এদের ফুটবল উপবৃত্তাকার। আমাদের ফুটবলের মাঠ
আয়তাকার, এদের মাঠ বৃত্তাকার। আমরা ফুটবল খেলি পা দিয়ে, এরা খেলে হাত-পা সবকিছু
দিয়ে। আমাদের ফুটবলের খেলোয়াড় সংখ্যা প্রতি দলে সর্বোচ্চ এগারোজন, এদের ফুটবলের খেলোয়াড়
সংখ্যা দল প্রতি আঠারো জন। আরো কত যে পার্থক্য আছে। মেলবোর্নের ঘরে ঘরে
ফুটি-ক্রেজ। এম-সি-জি থেকে বেরোনো মানুষের একদলের গায়ে লাল-কালো, অন্যদলের গায়ে
হলুদ পোশাকের প্রাধান্য। কোন্ কোন্ টিমের পোশাক জানি না এখনো। এদেশের মানুষ
রাজনৈতিক দল নিয়ে একটুও কথা বলে না, বেশির ভাগ কথাই এদের খেলার টিম নিয়ে। তবে এত
উত্তেজনার মধ্যেও খেলা নিয়ে কোন মারামারির খবর চোখে পড়েনি এতদিনেও।
বক
বক করতে করতে নিশ্চয় তোমার মাথা ধরিয়ে দিলাম। রাখছি এখন। বাসায় যাচ্ছি।
No comments:
Post a Comment