সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হলো ফাইনম্যানের বাবার। ফাইনম্যানকে
নিজের হাতে মানুষ করেছেন তিনি। তাঁর আশা আকাঙ্ক্ষা হলো
একদিন সফল বিজ্ঞানী হবে
ফাইনম্যান। তাঁর ধারণা -
এসময় বিয়ে করলে ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে। তাছাড়া তেইশ বছর বয়সটা
বিয়ের জন্য খুবই অল্প বয়স।
ফাইনম্যানের
বাবার অনেক আজেবাজে ধারণা ছিলো মেয়েদের ব্যাপারে। কোন
মানুষ বিপদে পড়লে তিনি সবসময় বলতেন -
"ঘটনার পেছনের মেয়েটাকে
খুঁজে বের কর। পুরুষ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হল স্ত্রীলোক। স্ত্রীলোকের ব্যাপারে পুরুষ মানুষ শক্ত না হলে জীবনে উন্নতি সম্ভব নয়।"
বাবা
যাই বলুন, কোন কিছুই শুনতে রাজি নয় ফাইনম্যান।
এতকিছু
যুক্তির পরেও ফাইনম্যানের বাবার আসল কথা হলো একজন টিউবারকিউলোসিসের রোগীকে বিয়ে করার অর্থ হলো নিজেও
অসুস্থ হয়ে যাওয়া। তার
কাকা-কাকী, মামা-মামী - পুরো পরিবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে
উঠলো। তাদের পারিবারিক ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এলো তারা।
ডাক্তার ফাইনম্যানকে
বুঝাতে লাগলেন, "টিউবারকিউলোসিস মারাত্মক রোগ বাপু। এর
কাছে এলে তোমারও ওই রোগ হতে বাধ্য। তুমি তো জানো না, - আমি ডাক্তার "
ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফাইনম্যান
বললো,
"ঠিক আছে, আমাকে বলুন রোগটা
একজনের কাছ থেকে অন্যজনে সংক্রামিত হবে কীভাবে? এটা জানার পরে
আমরা দেখবো কী করা যায়।"
ফাইনম্যান ও আরলিন
শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে তখন থেকেই খুব সতর্ক। তারা দু'জনই জানে যে তারা কখনো গভীরভাবে
চুমুও খেতে পারবে না।
ডাক্তার
বিদায় নিলেন। এবার ফাইনম্যানের মাসীরা তাকে বোঝাতে লাগলেন - "দেখো, তুমি যখন
আরলিনকে কথা দিয়েছিলে তখন তো তুমি জানতে না যে এরকম কিছু হবে। এখন তুমি যদি তাকে বিয়ে না কর তাতে তোমার কোন দোষ হবে
না। কথা না রাখার দায়ে কেউ তোমাকে দোষী করতে পারবে না।"
"শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে আরলিনকে বিয়ে করছি এরকম বাজে ধারণা আমার মনেও আসেনি। আমরা পরস্পর
ভালবাসি। বিয়েটা তো জাস্ট ফর্মালিটি। মানসিকভাবে তো আমরা বহু আগেই পরস্পর বিবাহিত।"
মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো
ফাইনম্যানের।
বললো - "কোন স্বামী যদি জানতে পারে
তার স্ত্রীর টিউবারকিউলোসিস হয়েছে তখন তোমরা কি স্বামীটাকে বলবে স্ত্রীকে ত্যাগ করতে? ওটাই কি তোমরা চাও?"
ফাইনম্যানের এক মাসী ছাড়া আর কেউ তার পক্ষে ছিলো না। কিন্তু এসময় পরিবারের
সবাই যে পরামর্শগুলো দিচ্ছিলো তার কোন মূল্য ছিল না ফাইনম্যানের কাছে। নিজের অবস্থান
থেকে একটুও সরলো না ফাইনম্যান।
তার কথা হলো,
"আমার সমস্যা আমি ভাল বুঝি। আরলিন এবং আমি ভালভাবেই
জানি যে আমরা কী করছি আর কী করবো।"
আরলিনকে সাথে নিয়ে সব পরিকল্পনা করে
ফেলল ফাইনম্যান। নিউ জার্সিতে ফোর্ট ডিক্সের
ঠিক দক্ষিণ পাশে একটি হাসপাতাল আছে। ফাইনম্যান যখন প্রিন্সটনে কাজ করবে তখন আরলিন
থাকবে ঐ হাসপাতালে।
হাসপাতালটি অনেকটা দাতব্য হাসপাতাল। নাম ডেবোরাহ্ হসপিটাল। নিউইয়র্কের গার্মেন্টস
ওয়ার্কার্স ওম্যান ইউনিয়নের অর্থ সাহায্যে পরিচালিত হতো হাসপাতালটি। আরলিন যদিও
গার্মেন্টস ওয়ার্কার ছিলো না তবুও অসুবিধে হলো না ভর্তি হতে।
ফাইনম্যান
তখন মাত্র পোস্ট-ডক্টরেট ফেলো। সরকারী
একটা প্রজেক্টে খুব কম বেতনে কাজ করছে। তার পক্ষে দামী হাসপাতালের ব্যবস্থা করা তো সম্ভব নয় যেখানে অন্তত
শেষ পর্যন্ত আরলিনের দেখাশোনা করতে
পারবে ফাইনম্যান।
বাসা থেকে হাসপাতালে যাবার পথে কোথাও তারা বিয়েটা
করে ফেলবে এরকম সিদ্ধান্ত পাকা হলো। ফাইনম্যান প্রিন্সটনে গেল কোন গাড়ি ভাড়া পাওয়া
যায় কিনা দেখতে।
প্রিন্সটনের গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট বিল উডওয়ার্ড তার স্টেশান-ওয়াগনটা ধার দিতে রাজি হলো। গাড়িটার
পেছনের সিটে একটা বিছানা পেতে অনেকটা অ্যাম্বুলেন্সের মতো করা হলো যেন
আরলিন ক্লান্ত হলে শুয়ে থাকতে পারে।
সেই সময়টা আরলিনের মোটামুটি একটু ভাল থাকার কথা। মাসখানেক ভালো থাকবে।
তারপর আবার খারাপ হবে। তখন হাসপাতালে থাকতে হবে।
অ্যাম্বুলেন্স
কাম বিয়ের গাড়ি নিয়ে ফাইনম্যান তার কনেকে আনতে গেল। ফাইনম্যানের মা-বাবা
ফাইনম্যানের বিয়ে সমর্থন করেন নি। ফাইনম্যানও ঘর ছেড়ে চলে এসেছে। তার ছোটবোন জোয়ান
তখন মাত্র চৌদ্দ বছরের কিশোরী। তার পক্ষে তার ভাইকে সমর্থন করা সম্ভব ছিলো না।
ফাইনম্যানের বন্ধুবান্ধবদের খবর দেয়ার সময় নেই। তাই একাই এসেছে আরলিনকে নিয়ে যেতে।
আরলিনের মা-বাবা
আরলিনকে গাড়িতে তুলে দিলেন। তাদের গাড়ি যতক্ষণ পর্যন্ত চোখের আড়াল না হচ্ছে ততক্ষণ
হাত নেড়ে বিদায় জানালেন তারা।
দ্রুত
গাড়ি চালাচ্ছে ফাইনম্যান। কুইন্স পেরিয়ে ব্রুকলিন হয়ে স্টেনেন
আইল্যান্ডের ফেরিতে চাপলো
তারা। ফেরিটাকেই তারা ধরে নিলো তাদের রোমান্টিক
বোটিং। তারপর রিচমন্ডে গিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিসের
সামনে গাড়ি থামালো
ফাইনম্যান।
অফিসটা দোতলা। সিঁড়ি বেয়ে খুব আস্তে আস্তে আরলিনকে নিয়ে উপরে উঠল ফাইনম্যান। রেজিস্ট্রার ভদ্রলোক খুবই
ভালোমানুষ। সবকিছু দ্রুত করে ফেললেন।
আইনে যা যা লাগে সব লিখে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনাদের কোন সাক্ষী নেই?"
দু'জনেই না সূচক মাথা নাড়ল। ভদ্রলোক পাশের অফিস থেকে দু'জন অফিসার ডেকে নিয়ে এলেন। একজন
একাউন্ট্যান্ট, অন্যজন বুককিপার।
১৯৪২
সালের ২৯শে জুন নিউইয়র্কের আইন অনুযায়ী বিবাহ বন্ধনে
আবদ্ধ হলো আরলিন ও
রিচার্ড ফাইনম্যান।
খুব
আনন্দ হচ্ছিলো তাদের। বুককিপার ভদ্রলোক ফাইনম্যানকে বললেন, “আপনারা এখন বিবাহিত। আপনার স্ত্রীকে চুম্বন করতে
পারেন।”
খুব সাবধানে আরলিনের চিবুকে ঠোঁট ছোঁয়ালো ফাইনম্যান। তারপর ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে তাকে রেখে
এলো ডেবোরাহ হসপিটালে।
প্রত্যেক
উইক-এন্ডে প্রিন্সটন থেকে আরলিনকে দেখতে যায় ফাইনম্যান। একদিন বাস পৌঁছতে
দেরি করলো। ঠিক সময়ে হাসপাতালে যেতে না পারাতে ভেতরে ঢুকতে পারল না ফাইনম্যান। চিন্তায় পড়ে গেল সে। আশেপাশে কোন হোটেলও নেই। ফিরে যাবার কোন বাসও নেই। এখন ঘুমাতে তো হবে।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ নির্জনে চলে গেল সে। ঘরবাড়ি নেই আশেপাশে, জায়গাটা ভালো লাগলো। একটা গাছের নিচে শুয়ে ওভারকোটটা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ক্লান্ত ছিল, তাই ঘুম আসতে দেরি হলো না।
খুব
ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখে - সে ঘুমিয়ে আছে ময়লার ডিপোতে। ঐ অঞ্চলের সব
ময়লা ফেলা হয় সেখানে। তার খুব হাসি
পাচ্ছিলো আর নিজেকে খুব পাগল পাগল লাগছিলো।
আরলিনের ডাক্তারটি বেশ ভালো। হাসিখুশি চমৎকার মানুষ। কিন্তু যখন
মাসের শেষে ফাইনম্যান আঠারো ডলারের একটা চেক তাঁর হাতে দিতো খুব রেগে যেতেন তিনি। বলতেন - "মিস্টার ফাইনম্যান, হাসপাতালে আপনাদের কিছুই দেয়ার দরকার নেই।"
তাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কথা তিনি জানতেন। জানতেন বলেই হাসপাতালের জন্য তার চেক নিতে
চাইতেন না। ফাইনম্যান তবুও প্রত্যেক
মাসের শেষে চেকটা দিয়ে দেয় হাসপাতালের একাউন্টে। এর বেশি কিছু তো
দেয়ার সামর্থ্য তাদের নেই তখন।
হাসপাতালের বেডে
শুয়ে সারা সপ্তাহ কিছুই করার থাকে না আরলিনের। সুস্থ থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে,
কিন্তু শরীর তার ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। একটু ভাল লাগলেই চিঠি লেখে ফাইনম্যানকে।
নানারকম মজা করে তার রিচার্ডের সাথে।
একদিন প্রিন্সটনে ফাইনম্যানের কাছে এক বাক্স পেন্সিল এলো বাই পোস্ট।
ঘন সবুজ রঙের পেন্সিলগুলো। গায়ে সোনালী রঙে লেখা আছে "RICHARD
DARLING, I LOVE YOU! PUTSY"
পুটসি হলো আরলিনের আদরের নাম।
খুব খুশি হওয়া উচিত ফাইনম্যানের। এটা খুবই ভাল উপহার। আর আরলিনকে সেও খুব
ভালবাসে। কিন্তু সমস্যা
হচ্ছে পেন্সিলগুলো সে ব্যবহার করবে কীভাবে!
ফাইনম্যান
ভাবনায় পড়ে গেলো। হয়তো সে প্রফেসর উইগনারকে (Eugene
Wigner) একটা ফর্মুলা দেখাতে গেছে বা অন্যকিছু নিয়ে আলোচনা করছে। করার
পরে পেন্সিলটা তাঁর টেবিলেই যদি
ফেলে আসে পেন্সিলটা পেয়ে কী ভাববেন প্রফেসর উইগনার? আবার এতগুলো পেন্সিল নষ্ট করার মতো অবস্থাও তার নয়। সুতরাং সে একটা
ব্লেড নিয়ে পেন্সিলের গায়ের সোনালী অক্ষরগুলো ছেঁচে ফেলে দিল।
আরলিন
জানে রিচার্ড কী করতে পারে। পরদিন আরলিনের চিঠি এলো। চিঠিটা
শুরুই হয়েছে এভাবে,
"পেন্সিল থেকে নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করছো, এটা
কি ভাল হচ্ছে রিচার্ড? আমি যে তোমাকে ভালবাসি
সেজন্য কি তুমি লজ্জা পাও? তুমি না বলো - what do you care what other people think?"
তারপর একটা দীর্ঘ কবিতা। কবিতার
বিষয়বস্তু হলো "আমার ভালোবাসায় যদি তুমি লজ্জা পাও তাহলে তোমাকে মজা দেখাবো ইত্যাদি ইত্যাদি যতরকম
মৃদু হুমকি দেয়া যায়।
এর কিছুদিন
পরে ম্যানহাটান প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ চলে
গেলো লস আলামোসের গোপন ল্যাবরেটরিতে। ফাইনম্যানকেও যেতে হলো সেখানে।
পারমাণবিক
বোমা প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহেইমার সবার ব্যাপারেই খবর রাখেন। তিনি জানেন
ফাইনম্যানের স্ত্রী খুব অসুস্থ। তিনি আরলিনকে লস আলামোসের
সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন। এই সবচেয়ে কাছের হাসপাতালটি হলো ফাইনম্যানের অফিস থেকে একশ’ মাইল দূরে
আলবুকারকিতে।
No comments:
Post a Comment