উইকএন্ডে ছুটি থাকে
ফাইনম্যানের। আরলিনকে দেখতে
যাবার সময় পায় তখন। শনিবার সকালবেলা আলবুকারকির পথে কোন গাড়িকে হাত দেখিয়ে লিফ্ট নেয়। বিকেলটা আরলিনের
সাথে কাটায়। রাতটা কাটায়
আলবুকারকির কোন হোটেলে। রোববার সকালে আবার আরলিনকে দেখে
বিকেলে অন্য কারো গাড়িতে চেপে ফিরে আসে লস আলামোসে।
প্রতি সপ্তাহে আরলিনের চিঠি
পায় ফাইনম্যান। বেশ মজা করে চিঠি লেখে আরলিন।
একবার একটা পুরনো ওয়ার্ড-পাজল
দু'টুকরো করে একটা এনভেলাপে ঢুকিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ফাইনম্যানকে। ফাইনম্যান দেখলো চিঠিটার সাথে প্রজেক্টের
মিলিটারি সিকিউরিটি অফিসারের নোট - "দয়া করে আপনার স্ত্রীকে বলবেন এখানে
ধাঁধার খেলা খেলার সময় আমাদের নেই।"
পারমাণবিক
বোমা প্রকল্পের পুরো নিরাপত্তা মিলিটারিদের হাতে। তারা সব
চিঠিই সেন্সর করে। আরলিনের পাজলগুলো পেয়ে আর্মি অফিসারদের ঘাম বেরিয়ে গেছে তার অর্থ বের করতে। শত্রুপক্ষের কোন
গোপন সংকেত যে নয় তা প্রমাণ করতে অনেক সময় লেগেছে তাদের। তাই অফিসিয়াল
সতর্ক-বার্তা।
ফাইনম্যান
পছন্দ করে প্র্যাকটিক্যাল জোক্স। মিলিটারিদের বুদ্ধির মাত্রা সম্পর্কে তার খুব
একটা শ্রদ্ধা নেই। তাই সে আরলিনকে কিছুই বললো না এ
ব্যাপারে।
আরলিনের এরকম পাগলামী চলতে থাকলো। ফাইনম্যানের ভালো লাগে তা, যদিও সেজন্য
মাঝে মাঝে তাকে অপ্রস্তুত হতে হয়।
একদিন মে মাসের শুরুতে হঠাৎ দেখা গেলো
লস আলামোসে ফাইনম্যানের অফিসের
প্রত্যেকের মেইলবক্সেই একটা করে সংবাদপত্র চলে এসেছে। শত শত নিউজপেপার। অথচ কেউই পত্রিকার
গ্রাহক নয়।
পত্রিকায়
বিশাল হেডিং "সারা জাতি
যথাযোগ্য মর্যাদায় ফাইনম্যানের জন্মদিন পালন করছে"। আলবুকারকির স্থানীয় প্রেস
থেকে পত্রিকার মত করে কাগজগুলো ছাপিয়ে আনিয়েছে সে ফাইনম্যানের জন্মদিনের উপহার
হিসেবে।
আরলিন
সারা পৃথিবীর সাথে খেলতে শুরু করেছে। সারাদিন হাসপাতালে
শুয়ে সে আর করবেই বা কী। মাঝে মাঝে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়। আর রাজ্যের যত আইডিয়া
মাথায় ভর করে, আর ফাইনম্যানকে লেখে।
একদিন ফাইনম্যানকে পাঠালো রান্নার
সামগ্রীর এক বিশাল ক্যাটালগ। যে
বস্তুগুলো লাগে বিশাল বিশাল রান্নাঘরে - জেলখানায় বা মিলিটারি ব্যারাকে যেখানে হাজার হাজার মানুষের
রান্না হয় এক সাথে।
এই ক্যাটালগ দিয়ে ফাইনম্যান কী করবে বুঝতে পারছিল না। বিশাল বিশাল ডেকচি-পাতিল দিয়ে কী করবে
আরলিন?
এর আগেও একবার এরকম করেছিল
আরলিন। এম-আই-টিতে পড়ার সময়। তখন পাঠিয়েছিল বিশাল যুদ্ধজাহাজের ক্যাটালগ। ফাইনম্যান জানতে চেয়েছিল, "জাহাজের ব্যাপারটা কী?"
"আমি ভাবছিলাম আমরা বিয়ের পর এরকম একটা জাহাজ কিনবো।"
"তুমি কি পাগল হয়েছো?
জাহাজের দাম জানো?"
উত্তরে অন্য একটা ক্যাটালগ এসে পৌঁছালো। এটা একটা
লম্বা নৌকা - তিরিশ-চল্লিশ জন মানুষের জন্য, ধনীলোকের প্রমোদতরী।
আরলিন লিখেছে,
"জাহাজ কিনতে না পারলেও এরকম একটা নৌকা আমরা সম্ভবত কিনতে পারি।"
"দেখো তুমি আমাদের সামর্থ্যের বাইরে চিন্তা করছো।"
খুব
শীঘ্র আরেকটা ক্যাটালগ হাজির। বিভিন্ন রকম ইঞ্জিন চালিত ছোট্ট নৌকা এবং এটা সেটা।
ফাইনম্যান
লিখলো - "এগুলোর দামও কিন্তু অনেক বেশি আরলিন।"
এবার এলো ছোট্ট
একটা চিরকূট। আরলিন লিখেছে - "তুমি সব সময় 'না' বলছো রিচার্ড। এটা কিন্তু
তোমার শেষ সুযোগ।"
শেষ সুযোগটা হলো আরলিনের এক বান্ধবীর একটা দাঁড়টানা নৌকা আছে। সে ওটা
বিক্রি করবে। দাম পনের ডলার। পুরনো হলেও এখনো সচল। সামারে হয়তো তারা ওটা
নিয়ে একটু নৌকাভ্রমণও করতে পারবে। ফাইনম্যানকে নৌকাটা কিনতে হয়েছিল।
এখন এই রান্নাঘরের জিনিসপত্রের আইডিয়াটা আরলিনের মাথায় কেন এলো তা নিয়ে
ভাবছে ফাইনম্যান। এরমধ্যেই দ্বিতীয়
ক্যাটালগ উপস্থিত। এটা একটা হোটেলের রেস্টুরেন্টের ক্যাটালগ। এর কয়েকদিন পরে যে
ক্যাটালগটা এলো তা হলো একটা নতুন সংসারের রান্নাঘরের জিনিসপত্রের ফর্দ।
পরের শনিবারে আরলিনকে দেখতে যখন হাসপাতালে গেল তখন ফাইনম্যান বুঝল আসল ব্যাপারটা
কী। আরলিনের রুমে ছোট্ট একটা কয়লার চুলা এসেছে। আঠারো ইঞ্চির মত চওড়া। আরলিন চুলাটা
কিনেছে। খুব উৎসাহ নিয়ে
বললো সে, "আমি ভাবলাম আমরা ওটাতে রাঁধতে পারবো।"
"এখানে?
পাগল হয়েছো? কয়লার ধোঁয়া কী জিনিস জানো?"
"আরে না। এই রুমের ভেতর না। আসলে কী করতে হবে জানো - চুলাটা নিয়ে আমরা সামনের লনে চলে যাবো। প্রত্যেক
রবিবার তুমি বাইরে বসে রান্না করবে।"
হাসপাতালটি
একদম রাস্তার পাশে। আমেরিকার ইন্টার-স্টেট হাইওয়ে রোড সিক্সটি সিক্স চলে গেছে
হাসপাতালের সামনে দিয়ে। ফাইনম্যান বললো, "অসম্ভব। আমি পারবো না। রাজ্যের যত ট্রাক গাড়ি দিনরাত চলছে রাস্তায়। লোকজন লনের পাশ দিয়ে
সারাক্ষণ আসা যাওয়া করছে। আর আমি সেখানে বসে তোমার জন্য মাংস ভাজবো না? লোকে কী ভাববে বলো?"
"what do you care what other people think?"
ফাইনম্যানের
কথা দিয়ে ফাইনম্যানকে খোঁচা দেয় আরলিন। একটা ড্রয়ার খুলতে খুলতে বললো, "ঠিক
আছে, তোমাকে এই শেফের টুপি পরতে হবে না। আর গ্লাভসও পরতে হবে না।"
আরলিনের হাতে পুরোদস্তুর হোটেলের শেফের ইউনিফর্ম।
"দেখো তো এই এপ্রোনটা তোমাকে কেমন মানায়?"
ফাইনম্যান
দেখলো এপ্রোনের গায়ে লেখা আছে - বারবিকিউ কিং।
আতঙ্কিত গলায় ফাইনম্যান
বললো, "ঠিক আছে, ঠিক আছে, এসব লাগবে না। আমি লনে বসে রাঁধবো।"
এরপর থেকে
প্রত্যেক শনিবার বা রবিবার রাজপথের ধারে ধোঁয়া
ছড়াতে ছড়াতে রাঁধতে লাগল
ফাইনম্যান।
ক্রিস্টমাস
কার্ড পাঠাবার সময় হয়ে এসেছে ফাইনম্যানের লস আলামোসে আসার কয়েক সপ্তাহ পরেই। আরলিন লিখলো
- "চলো আমরা সবাইকে ক্রিস্টমাস কার্ড পাঠাই। আমি
কার্ড রেডি করে রেখেছি।"
ফাইনম্যান
দেখলো কার্ডগুলো খুবই সুন্দর। কিন্তু তাতে লেখা আছে - 'মেরি ক্রিস্টমাস ফ্রম
রিচার্ড এন্ড পুটসি'।
"এগুলো সবাইকে পাঠানো যাবে না। আমি এনরিকো ফার্মি বা হ্যান্স বেথেকে
এগুলো পাঠাতে পারবো না। তাদেরকে আমি এখনো এত বেশি চিনি না যে ডাকনামে কার্ড পাঠানো
যায়। তাঁরা এগুলো পেলে কী বলবেন আমাকে?"
"what do you care what other people think?"
সুতরাং ঐ কার্ডগুলোই পাঠানো হলো।
পরের বছর ক্রিস্টমাস আসছে। এর মধ্যে
এনরিকো ফার্মি আর হ্যান্স বেথের সাথে ফাইনম্যানের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। তাঁদের বাসায় যায় ফাইনম্যান। তাঁদের ছেলেমেয়েদের সাথেও তার দারুণ বন্ধুত্ব।
এবারের ক্রিস্টমাস কার্ডে আরলিন লিখেছে
অত্যন্ত ফর্মাল ভঙ্গিতে
- 'মেরি ক্রিস্টমাস এন্ড হ্যাপি নিউ ইয়ার ফ্রম রিচার্ড এন্ড আরলিন ফাইনম্যান'।
"চমৎকার হয়েছে। এগুলো আমরা সবাইকে পাঠাতে পারবো" -বললো ফাইনম্যান।
"আরে
না না" - প্রতিবাদ করলো আরলিন, "ওগুলো সবার জন্য নয়। ফার্মি বা বেথের মত
বিখ্যাত যারা আছেন তাদের জন্য অন্যরকম কার্ড।"
বিখ্যাত ব্যক্তিদের কার্ডে ফর্মাল কথাবার্তার পরে
লেখা আছে - "ফ্রম ডক্টর এন্ড মিসেস আর পি ফাইনম্যান।”
সুতরাং
বিখ্যাত ব্যক্তিরা পেলেন সেগুলো। ফাইনম্যানের কাছ থেকে এরকম ফর্মাল কার্ড পেয়ে
তাঁরা তো অবাক। এনরিকো ফার্মি ফাইনম্যানকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "এসমস্ত
ফর্মালিটি কখন থেকে শুরু হলো ডিক?"
আরলিন শুধু এরকম মজা করেই ব্যস্ত থাকতো না। ইতোমধ্যে সে 'সাউন্ড এন্ড সিম্বল ইন
চায়নিজ' নামে একটা বড় বই জোগাড় করেছে। বইটা খুব চমৎকার। প্রায় পঞ্চাশ রকমের চায়নিজ
চিহ্নের ক্যালিগ্রাফি করা আছে উদাহরণ ও ব্যাখ্যা সহ।
আরলিন বইটা থেকে ক্যালিগ্রাফি করতে শুরু করলো। কাগজ ব্রাশ কালি সব
জোগাড় করেছে। এমন কি একটা চায়নিজ টু ইংলিশ ডিকশনারিও কিনেছে।
এক শনিবারে
ফাইনম্যান এসে দেখে আরলিন ক্যালিগ্রাফি প্র্যাকটিস করছে। কাগজে
গভীর মনযোগে একটা একটা চিহ্ন ফুটিয়ে তুলছে। আবার আপন মনেই বলছে - 'না ঠিক হয়নি, হচ্ছেনা,
ভুল হয়েছে' ইত্যাদি।
এতক্ষণ চুপ করে দেখছিল
ফাইনম্যান। আরলিনের কথা শুনে বললো, "ভুল হয়েছে বলতে কী
বোঝাচ্ছ? এটা তো মানুষের তৈরি কিছু চিহ্ন। জাস্ট ভাব বিনিময়ের কিছু ভাষা। ঠিক
এভাবেই চিহ্নটা প্রকাশ করতে হবে এমন কোন নিয়ম কি আছে প্রকৃতিতে? তোমার যেমন খুশি
তেমন চিহ্ন দিয়েই তো তুমি ভাবটা প্রকাশ করতে পারো।"
"সব কিছুর একটা শৈল্পিক দিক থাকে রিচার্ড। আমি ভুল বলতে বোঝাতে চাচ্ছি শিল্পমান সম্মত হয়নি।
ক্যানভাসে ব্যালান্সিং বলে একটা ব্যাপার আছে। শুধু শুদ্ধ হলেই চলে না। দেখতে কেমন লাগছে তাও দেখতে
হয়।"
"কিন্তু যেকোন ভাবেই হোক, হয়েছে তো চিহ্নটা। এটা হয়তো অন্যরকম সুন্দর।"
আরলিন ফাইনম্যানের হাতে তুলি ধরিয়ে দিয়ে বললো, "এই নাও, নিজে করে দেখাও একটা।
তারপর কথা বলো আর্ট সম্পর্কে।"
আর
কী করা। বই দেখে দেখে একটা চিহ্ন আঁকলো ফাইনম্যান। কিন্তু মনে হলো ঠিক হয়নি। বললো,
“দাঁড়াও এক মিনিট। আরেকটা করতে দাও।
এটা একটু মোটা দাগের হয়েছে। মানে সামান্য হিজিবিজি।” 'ভুল হয়েছ' বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় ফাইনম্যান।
"তুমি
কীভাবে জানো যে এটা হিজিবিজি হয়েছে? কতটুকু হিজিবিজি হওয়া দরকার তা কি তুমি জানো?”
আরলিনের
কাছে ফাইনম্যান শিখলো আর্টের বিভিন্ন দিক। আসলে আর্ট একটা
আশ্চর্য জিনিস। কোন কিছুর ঠিক নিয়ম নেই, আবার আছেও। এটা গণিত নয়, আবার কোথাও যেন
সূক্ষ্ম একটা গাণিতিক মাত্রা আছে। আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে তা বোঝা
যায় না। ফাইনম্যান ক্যালিগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলো।
আরলিনের
কাছ থেকে ফাইনম্যান এমন অনেক কিছুই শিখেছে তা তার ভাষায় ঠিক বিজ্ঞান নয়, কিন্তু
আকর্ষণীয়। ফাইনম্যান পরবর্তী জীবনে অনেকবার স্বীকার করেছে যে আরলিন তার ভেতর
মানবিক গুণাবলী বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরলিনের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে দিনের পর দিন। আরলিনের
বাবা নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন আরলিনকে দেখতে। যুদ্ধের সময়ে এতদূরে আসা সহজ নয়। আবার
খরচও কম নয়। তবুও তিনি এসেছেন। আরলিনের কাছে থাকলেন ক'দিন। ফাইনম্যান তখন লস আলামোসে।
একদিন হঠাৎ আরলিনের বাবার ফোন - "রিচার্ড তুমি এক্ষুনি চলে এসো।"
এই সময়টার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত ছিল ফাইনম্যান। লস আলামোসে তার বন্ধু
ক্লস ফাসকে বলে রেখেছিল
যেন তার গাড়িটি ধার দেয়। টেলিফোন পাবার সাথে সাথে ফাইনম্যান গাড়িটি
নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আরলিনের হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
No comments:
Post a Comment