০৪ আগস্ট ১৯৯৮ মঙ্গলবার
বিট্টু বলেছিল তিনটার দিকে তিন তলায়
স্টুডেন্ট সেন্টারের ওখানে থাকতে। আমি আড়াইটায় চলে এসেছি। রয়েল মেলবোর্ন
ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি সংক্ষেপে আর-এম-আই-টি’তে আগে আসিনি কখনো। এই ইউনিভার্সিটির বিশাল বিশাল সব
বিল্ডিং মনে হচ্ছে গায়ে গায়ে লাগানো। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির সাথে আর-এম-আই-টি
ইউনিভার্সিটির গুণগত পার্থক্য কী তা জানি না, তবে বস্তুগত পার্থক্য অনেক।
সোয়া
তিনটার দিকে বিট্টু এলো। সাথে তার ক্লাসমেট টনি। পরিচয় হলো টনির সাথে। টনির কথ্য-ইংরেজির
অবস্থা ভয়াবহ। “আই গো ইয়েস্টারডে” “হি গো টুমরো”- ক্রিয়া-পদের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার বাংলাদেশের কারো পক্ষে
সম্ভব নয়।
ক্যাম্পাস
থেকে বেরিয়েই সোয়ান্সটন স্ট্রিট, আর তার ওপারেই মেলবোর্ন সেন্ট্রাল। চলমান সিঁড়ি বেয়ে
তাদের পিছু পিছু উঠে এলাম দোতলার ফুডকোর্টে। নানা দেশের নানা রকম খাবারের সমাবেশ। টনির
জন্যই ফুডকোর্টে আসা। সে নাকি লাঞ্চ করেনি। কিন্তু সে যে পরিমাণ খাবার নিলো এবং
যেভাবে খাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তিনদিনের উপোসী। বিট্টুর
চোখাচোখি হতেই সে হাসিমুখে টনির উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে বললো- “ভালো করে খেয়ে নাও টনি। একটু পরেই তো বুঝবে
মজা। রবিবারের সব ডেক্চি-পাতিল আজ তোমাকেই মাজতে হবে”। শুনে ঠোঁট উল্টে বিশ্রী একটা গাল দিলো টনি। ইংরেজি
ক্রিয়াপদ ঠিকমত শিখতে না পারলে কী হবে, ইংরেজি গালাগালিগুলো ঠিকই শিখে নিয়েছে।
টনি
আর বিট্টু একই রেস্টুরেন্টে কাজ করে। কিচেন-হ্যান্ড। টনি কাজ করে মঙ্গল, বৃহস্পতি,
শুক্র আর শনিবার সন্ধ্যায়। আর বিট্ট কাজ করে বুধবার আর রবিবার সন্ধ্যায়। যা পায় তা
নাকি টনির মদ-সিগারেট আর বিট্টুর টেলিফোনের পেছনেই চলে যায়।
বিট্টু
যে রেস্টুরেন্টে কাজ করে আজ আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে। রেস্টুরেন্টের মালিকের এক
বন্ধুর রেস্টুরেন্টে লোক দরকার। আমাকে ঠিকানা দিয়ে দেবেন। শুধু ঠিকানা দেবার জন্য
ডেকে নিয়ে যাবার দরকার কী? বন্ধুর কাছে পাঠাবার আগে নিজেও একবার দেখে নিতে চান
হয়তো।
কাজে
যাবার জন্য ট্রামে উঠে গেল টনি। বিট্টুও যাবে সেখানে আমাকে নিয়ে- তবে একটু পরে।
কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটারের ব্যবসাও শুরু করেছে বিট্টু। কমদামে
কম্পিউটার সাপ্লাই দেয় সে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞাপন-বোর্ড আছে। সেখানে
পিন দিয়ে আটকে দিলো তার বিজ্ঞাপন। এরপর আমাদের ক্যাম্পাসে এসেও কিছু বিজ্ঞাপন
লাগালো। মানুষের কত রকমের ব্যবসায়িক বুদ্ধি থাকে। বিট্টুর কম্পিউটার ব্যবসায় নাকি
কোন মূলধনই লাগে না। কৈ-এর তেলে কৈ ভেজেই নাকি অনেক লাভ। আমার ব্যবসায়িক বুদ্ধি
এবং আগ্রহ দুটোই শূন্য। সুতরাং এ ব্যাপারে আলোচনা খুব একটা এগোলো না।
সাউথ
মেলবোর্ন বিচ গামী ১নং ট্রামে উঠে রওনা দিলাম। ট্রাম ইয়ারা নদী পার হয়ে মেলবোর্ন
আর্ট সেন্টার পর্যন্ত এসে ডানে মোড় নিলো। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার সংমিশ্রণ
এদিকে। ট্রামে বেশ ভীড়। অফিস শেষে অনেকেই যেমন
বাড়ি ফিরছেন, তেমনি অনেকেই যাচ্ছেন সান্ধ্যকালীন খন্ডকালীন কাজে। বিট্টুকেও
এই ট্রামে যাতায়াত করতে হয়।
প্রায়
আধঘন্টা পর বিট্টুকে অনুসরণ করে নেমে গেলাম একটা স্টপে। শহরতলীর মত জায়গা। মূল
রাস্তার দু’পাশে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। রাস্তা
পেরিয়ে একটা বেকারি, তারপর ফুলের দোকান, তার পাশে ডোমিনোজ পিৎজার ঠিক পাশের
রেস্টুরেন্ট-ই আমাদের গন্তব্য।
দরজা
ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগে হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বিট্টু বললোঃ “খবরদার, ভুলেও বলবে না যে পি-এইচ-ডি করছো।
জিজ্ঞেস করলে বলবে- মাস্টার্স করতে এসেছো। এখানে পি-এইচ-ডি’র কোন চাকরি নেই”
কাচের
দেয়ালে লেখা “ইরাবতী কারি হাউজ” “অথেন্টিক ইন্ডিয়ান কুজিন” “B-Y-O”। কাচঘেরা সুদৃশ্য কাউন্টারে সাজানো নানারকম ইন্ডিয়ান
তরকারি। ছোট ছোট স্টিকারে লেখা ‘বিফ
ভিন্ডালু’, ‘রগেন জোস’- ইত্যাদি-
যাদের নামও শুনিনি আগে। কাউন্টারের পেছনের দেয়ালজুড়ে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি।
ভারতীয় রেস্তোরায় দেব-দেবীর ছবি না থাকলে মনে হয় ঠিক আবহ তৈরি হয় না। মৃদু
যন্ত্রসঙ্গীত ভেসে আসছে কোথাও লুকোনো সাউন্ডবক্স থেকে।
কাউন্টারের
পেছনে দাঁড়ানো কালো-শার্টপ্যান্ট পরা ভারতীয় মেয়েটি বিট্টুর দিকে তাকিয়ে পরিচিতের
হাসি হাসলো। বড় সুন্দর সে হাসি। দশ বারোটা টেবিলের ছোট-খাট রেস্টুরেন্ট। খুব বেশি
ভীড় নেই, একটা টেবিলে দু’জন মধ্য
বয়সী নারী-পুরুষ গভীর মনযোগে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের সামনে রাখা
মদের পাত্র এখনো ভর্তি।
বিট্টু
দ্রুত চলে গেল রেস্টুরেন্টের ভেতরের দিকে। তিন ধাপের ছোট্ট একটা সিঁড়ি আছে এদিকে।
দুটো বড় বড় ফ্রিজ ভর্তি কোমল পানীয় রাখা আছে এখানে। ছোট্ট পরিসরের একটা টেবিলও আছে
এককোণায়। বিট্টুকে অনুসরণ করে এ পর্যন্ত আসার পর বিট্টু বললো, “তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি মালিকের সাথে
কথা বলে আসি”।
এখান
থেকে রান্নাঘরের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে। দুই ফুট বাই তিন ফুটের একটা কাউন্টার আছে
কিচেনের এদিকের দেয়ালে। অর্ডার দেয়া খাবার রেডি হলে ওখানেই রেখে দেয়া হয়। বিট্টু
ঢুকে গেলো রান্নাঘরের ভেতরে। টনিকে দেখা গেলো। সিঙ্কের ওপর বিশাল একটা ডেক্সির
ভেতর মাথা ঢুকিয়ে সম্ভবত মাজার চেষ্টা করছে।
একটু
পর বেরিয়ে এলো বিট্টু, তার পেছনে মাঝারি উচ্চতার বেশ স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ।
ঝাঁকড়া চুল, ফুটবলের মত গোল মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, গায়ে অনেকগুলো বোতাম লাগানো
এপ্রোন টাইপের একটা শার্ট- বাবুর্চির পোশাক।
“হ্যালো” বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। তাঁর হাতে এখনো ময়দা লেগে
আছে। বিট্টু পরিচয় করিয়ে দিলো। ইনিই ইরাবতী কারি হাউজের মালিক কাম শেফ আন্সু
মালহোত্রা। আন্সুকে বেশ হাসিখুশি মানুষ বলে মনে হলো। প্রাথমিক সম্ভাষণের পরেই
সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেনঃ “সাউথ হ্যাম্পটনের
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মালিক হারিশ দেশাই-কে গিয়ে বলবে যে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি। তার
একজন লোক দরকার বলেছিল আমাকে। এখন সব নির্ভর করছে তার আর তোমার ওপর। এই নাও তার
ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর। গুড লাক”
আন্সুর
সরাসরি কথাবার্তা ভালো লাগলো। একটু পরেই শহরমুখী ট্রামে উঠে পড়লাম। সাউথ হ্যাম্পটন
কীভাবে যেতে হয় জানি না। বিট্টুও যায়নি ওদিকে কখনো। বললো “সম্ভবত স্যান্ড্রিংহাম লাইনে। ট্রেন-স্টেশন
থেকে খবর নেয়া যাবে”। আজ আর সময় নেই। বিট্টুকে জিজ্ঞেস
করলাম- “B-Y-O মানে কী?”
“ব্রিং ইওর অউন। আন্সুর তো লিকার লাইসেন্স
নাই। তাই রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু কাস্টমাররা নিজেদের মদ
নিজেরা নিয়ে আসে”।
ফ্লিন্ডার
স্ট্রিটে এসে বিট্টু নেমে গেল। ট্রেন ধরে বাসায় যাবে। আমি নামলাম লাইগন স্ট্রিটে,
কার্লটন হাউজিং এস্টেটের সামনে। ওখান থেকে একশ’ মিটার হাঁটলেই উইলির ফ্ল্যাট।
No comments:
Post a Comment