বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কারের নাম নোবেল পুরষ্কার। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে নোবেলের সম্মানে অর্থনীতিতেও পুরষ্কার দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ও রসায়নের গবেষণায় সাফল্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার। সাহিত্যে যিনি নোবেল পুরষ্কার পান - তাঁর পাঠকপ্রিয়তা অনেক সময় হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান - নোবেল পুরষ্কার পাবার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়ে যায় অনেকগুণ। অবশ্য সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার যাঁরা পান তাঁদের নিয়ে অনেক সময় নানারকম বিতর্কও তৈরি হয়। তবে সেই বিতর্কে নোবেল পুরষ্কারের মর্যাদা একটুও কমে না, বরং বেড়ে যায়। এমন মর্যাদাকর পুরষ্কার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ও সম্পদে - তিনি আলফ্রেড নোবেল। ডায়নামাইটের আবিষ্কারক হিসেবে তাঁকে আমরা কিছুটা চিনি, নোবেল পুরষ্কারের মত মহান পুরষ্কার যাঁর নামে তাঁকেও বিরাট মহানুভব হিসেবে আমরা কল্পনা করে নিই ঠিক, কিন্তু ব্যক্তি আলফ্রেড নোবেল আমাদের কাছে অনেকটাই অচেনা।
মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন আলফ্রেড নোবেল? যিনি একাধারে একের পর এক বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্রের উপাদান আবিষ্কার করেছেন, সারা ইউরোপে বিরাট বিরাট কারখানা গড়ে তুলে কাড়ি কাড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু জীবন-যাপন করেছেন একাকী নিরাসক্ত। জীবনে কোনদিন ধূমপান করেন নি, মদ পান করেন নি, এমন কি বিয়েও করেন নি। তেমন কোন বন্ধুবান্ধবও ছিল না আলফ্রেড নোবেলের। প্রথম জীবনে কবি হতে চেয়েছিলেন - অনেক কবিতাও লিখেছিলেন। প্রেম ছিল সেসব কবিতায়, ক্ষোভও ছিল। কিন্তু সেরকম ভাবে তাঁর কোন রচনাই তিনি প্রকাশ করেন নি। অন্তর্মুখী এই মানুষটি একদিকে শক্তহাতে ইন্ডাস্ট্রি আর ব্যবসা সামলেছেন, অন্যদিকে নিরলস গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন একের পর এক নতুন বিস্ফোরক। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছিলেন - যে দেয়াল ভেদ করে তাঁর মনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব ছিল না কারোরই। হাতে গোনা যে ক’জন মানুষের কাছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখেছিলেন তাও তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গোপন করে রেখেছিল নোবেল ফাউন্ডেশান।
আলফ্রেড নোবেল তাঁর প্রত্যেকটি চিঠির কপি রাখতেন, একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিরও। নোবেল ফাউন্ডেশানের আর্কাইভে আছে তাঁর হাতে লেখা অনেক চিঠি। প্রত্যেকটি চিঠিতে তাঁর নিজের হাতে ক্রমিক নম্বর দেয়া। ১৯৫০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো প্রকাশ্যে আসার পর আলফ্রেড নোবেলের ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তাগুলোর কিছু কিছু দিক উন্মোচিত হয়; পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিগত ভালোবাসার অন্য একটা জগতের সন্ধান। ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগো আলফ্রেড নোবেলের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ওয়েলদিয়েস্ট ভ্যাগাবন্ড ইন ইউরোপ’। নোবেলের চিঠিগুলো থেকে কিছুটা হলেও দেখা যায় তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী এই চিরকুমার ‘ভবঘুরে’র বিস্ফোরক ভালোবাসার কয়েক ঝলক।
নোবেলদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন নোবেলিয়াস পদবীভুক্ত দরিদ্র কৃষক। আলফ্রেডের ঠাকুরদা নিজের চেষ্টায় নাপিতের কাজ শিখেছিলেন। ক্ষৌরকর্মের পাশাপাশি তিনি ছোটখাট অস্ত্রোপচারও করতেন। ১৭৭৫ সালে তিনি নিজের পদবী নোবেলিয়াসের অর্ধেক ছেঁটে ফেলে ‘নোবেল’ করে নিলেন। তাঁর বড় ছেলে ইমানুয়েল - আলফ্রেড নোবেলের বাবা।
১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে ইমানুয়েল ও ক্যারোলিন নোবেলের চতুর্থ সন্তান আলফ্রেড নোবেলের জন্ম। আলফ্রেডের বড় তিন জনের মধ্যে এক জন জন্মের পরেই মারা যায়। বাকি দুই ভাই রবার্ট ও লুডভিগ। ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এবং তাঁর নিজের কনস্ট্রাকশান ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ছিল। কনস্ট্রাকশানের কাজে ইমানুয়েল নানারকম বিস্ফোরক নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করছিলেন। তাঁর ব্যবসায় মাঝে মাঝে খুবই সাফল্য আসছিল, আবার মাঝে মাঝে তিনি সর্বস্ব হারাচ্ছিলেন। আলফ্রেডের যখন জন্ম হয় তখন ইমানুয়েল নোবেলের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর কনস্ট্রাকশান ফার্ম দেউলিয়া হয়ে গেছে। তিনি সুইডেনের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন।
এদিকে জন্ম থেকেই ভীষণ রুগ্ন আলফ্রেড। পেটের পীড়া লেগেই আছে, আর হৃদপিন্ডের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সারাজীবনই শরীর নিয়ে ভুগেছেন আলফ্রেড নোবেল। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে মা-কে আঁকড়ে ধরেই আলফ্রেডের বেড়ে ওঠা। সারাক্ষণ শারীরিক কষ্টে ভুগতে ভুগতে আলফ্রেড ছোটবেলা থেকেই কোন ধরনের খেলাধূলা করার প্রতি উৎসাহ পায়নি। তাই কোন খেলার সাথীও ছিল না। শৈশবে মা ছাড়া আর কারো সাথেই তার কোন আত্মিক গড়ে ওঠেনি। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে আলফ্রেড কখনোই হাসিখুশি উচ্ছল ছিল না। তাকে কেউ কখনো প্রাণখুলে হাসতে দেখেন নি।
ইমানুয়েল নোবেল আর্থিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির জন্য নানারকমের ব্যবসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলেন না। আলফ্রেডের বয়স যখন চার, তখন তিনি তিন ছেলে ও স্ত্রীকে সুইডেনে রেখে ফিনল্যান্ড চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু করতে পারলেন না। সেখান থেকে চলে গেলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সেই সময় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের পাঁয়তারা চলছে। ইমানুয়েল দেখলেন সম্ভাব্য যুদ্ধের বাজারে গোলাবারুদ মাইন আর যন্ত্রাংশ তৈরি ও সরবরাহের বিপুল সম্ভাবনা। তিনি কাজ শুরু করে দিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে। দ্রুত সাফল্য অর্জন করলেন তিনি, আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেলো। ১৮৪২ সালে পুরো পরিবারকে নিয়ে এলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে।
আলফ্রেড যখন সেন্ট পিটার্সবুর্গে এলো তখন তার বয়স নয় বছর। চার বছর বয়স থেকে বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ইমানুয়েল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই কোন ছেলেকেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে পাঠাননি। বাড়িতে টিউটর রেখে ব্যবহারিক শিক্ষা দিয়েছেন ছেলেদের পছন্দ, মেধা ও আগ্রহের দিকে খেয়াল রেখে। সেন্ট পিটার্সবুর্গের বাড়িতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের জন্য শিক্ষক রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো ছেলেদের জন্য।
আলফ্রেড নোবেল জীবনে কখনো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেননি। অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময় পড়াশোনাতেই কাটে আলফ্রেডের। রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আলফ্রেডের। বাবার কারখানায় নানারকম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নিজেরও অনেক নতুন নতুন আইডিয়া দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাল লাগে সাহিত্য। সতের বছর বয়স হবার আগেই সুইডিশ, রাশিয়ান, জার্মান, ইংলিশ ও ফরাসি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও লিখতে শিখে গেল আলফ্রেড। লিখতে শুরু করলো কবিতা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে লেখকই হবে সে।
আলফ্রেডের কাব্যচর্চার কথা জেনে গেলেন তার বাবা ইমানুয়েল। তিনি জানেন কাব্যচর্চা করে অর্থোপার্জন করা যায় না। তাই তিনি চাচ্ছিলেন ছেলে এমন কিছু করুক যা দিয়ে অর্থ উপার্জন করা সহজ হবে। নিজের কারখানায় আলফ্রেডকে সম্পৃক্ত করার আগে সঠিক প্রশিক্ষণ দরকার। ১৮৫০ সালে আলফ্রেডকে রাসায়নিক প্রশিক্ষণের জন্য রাশিয়ার বাইরে পাঠিয়ে দিলেন ইমানুয়েল নোবেল।
পরবর্তী তিন বছর আলফ্রেড জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও আমেরিকায় কয়েকজন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও রসায়নবিদের অধীনে কাজ শিখলো। আমেরিকায় আলফ্রেড কাজ করলো সুইডিশ বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী জন এরিকসনের সাথে যিনি ‘মনিটর’ নামে একটা আমেরিকান যুদ্ধজাহাজের ডিজাইন করেছিলেন। ফ্রান্সে গিয়ে আলফ্রেড কাজ শিখলেন রসায়নবিদ আস্ক্যানিও সবরেরোর কাছে। আস্ক্যানিও সবরেরো নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করেছিলেন। ভয়ংকর বিস্ফোরক এই নাইট্রোগ্লিসারিন এতটাই বিপজ্জনক যে সামান্য নাড়াচাড়াতেই প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে যায়। তাই এটাকে তখন কোন ব্যবহারিক কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। আলফ্রেড ভাবতে শুরু করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে কীভাবে বশে আনা যায়।
১৮৫২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে এসে বাবার কারখানায় যোগ দিলেন উনিশ বছর বয়সী আলফ্রেড। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার নৌবাহিনী বিপুল পরিমাণ নেভাল মাইন কিনছিলো - আর তা সরবরাহ করছিল তাদের ‘ফাউন্ড্রিজ এন্ড মেশিন শপ্স অব নোবেল এন্ড সন্স’। যুদ্ধ যতদিন চললো নোবেল পরিবারের উপার্জন ততই ফুলে ফেঁপে উঠলো। বিপুল উৎসাহে ইমানুয়েল বেশ কয়েক বছরের জন্য মাইন তৈরি করে মজুদ করে ফেললেন। কিন্তু ১৮৫৬ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। ইমানুয়েলের গুদামভর্তি নেভাল মাইন অলস পড়ে রইল। দু’বছরের মধ্যে কারখানা আবার দেউলিয়া হয়ে গেল।
এদিকে তরুণ আলফ্রেড নিজের পড়াশোনা, কারখানার ল্যাবরেটরিতে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেন। কবিতায় প্রেম আর স্বপ্নের মাখামাখি। অন্তর্মুখী আলফ্রেড ভালোবেসে ফেলেছেন একজন ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রাশিয়ান তরুণীকে। কিন্তু ভালোবাসার কথা কবিতায় প্রকাশ পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারে না ভালোবাসার মানুষকে। দুর্বল স্বাস্থ্য, মাঝারি উচ্চতার আলফ্রেডের দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে ভালোবাসা বোঝা সহজ নয়। আলফ্রেডের ভালোবাসা ঠিকমত গতি পাবার আগেই এক দুঃখজনক পরিণতিতে পৌঁছে যায়। যক্ষারোগে ভুগে মেয়েটি মারা যায়। গভীর অবসাদে ডুবে যান তেইশ বছর বয়সী আলফ্রেড নোবেল।
প্রথম প্রেমের মৃত্যুর পর বিষন্ন আলফ্রেড বেপরোয়ার মত নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। এ যেন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্য পাওয়া গেল। ১৮৬০ সালে ২৭ বছর বয়সে নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হলেন।
এদিকে রাশিয়ায় বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ইমানুয়েল নোবেল তাঁর পরিবারসহ রাশিয়া ছেড়ে ফিরে এলেন সুইডেনের হেলেনেবর্গে ১৮৬৩ সালে। আলফ্রেড ও তার ছোটভাই এমিল মা-বাবার সাথে সুইডেনে ফিরে এলেন। বড় দুইভাই রবার্ট ও লুডভিগ তাঁদের নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রয়ে গেলেন রাশিয়ায়। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে তাঁরা রাশিয়ায় বিপুল তেলসম্পদের মালিক হন। লুডভিগ নোবেলকে রাশিয়ার তৈলসাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট বলা হতো।
সুইডেনে ফিরে এসে স্টকহোমে ল্যাবোরেটরি স্থাপন করলেন ইমানুয়েল ও আলফ্রেড নোবেল। নাইট্রোগ্লিসারিনের পরীক্ষা চলছিলই। ১৮৬৩ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখে ৩০ বছর বয়সী নোবেল প্রথম প্যাটেন্ট পেলেন “মেথড অব প্রিপেয়ারিং গানপাউডার ফর বোথ ব্লাস্টিং এন্ড শুটিং”। ব্যাপক গবেষণায় মেতে উঠলেন আলফ্রেড।
ল্যাবোরেটরিতে তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছে ছোটভাই এমিল নোবেল। কিন্তু নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই বিপদের সম্ভাবনা। ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ বিরাট বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় আলফ্রেডের ল্যাবোরেটরি। আলফ্রেডের ছোটভাই এমিল সহ পাঁচজন মারা যান এই দুর্ঘটনায়। ভীষণভাবে আহত হবার পরেও অল্পের জন্য বেঁচে যান আলফ্রেড নোবেল।
একটু সুস্থ হবার পর আবার কাজে লেগে গেলেন আলফ্রেড। কিন্তু ছেলে এমিলের মৃত্যুশোক সামলাতে পারলেন না বাবা ইমানুয়েল। স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসার পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল আলফ্রেড নোবেলের হাতে।
দুর্ঘটনার পর স্টকহোমের কোথাও ল্যাবোরেটরি স্থাপন করার অনুমতি পাচ্ছেন না আলফ্রেড। কিন্তু তাঁর ব্লাস্টিং অয়েলের ব্যাপক চাহিদা। হ্রদের ওপর ভাসমান বার্জে অস্থায়ী ল্যাবোরেটরি স্থাপন করে ব্লাস্টিং অয়েল তৈরি চলছে। অবশেষে ১৮৬৫’র নভেম্বরে জার্মানির হামবুর্গের কাছে নাইট্রোগ্লিসারিন ফ্যাক্টরি তৈরির অনুমতি লাভ করে। সেখানেও অনেক সাবধানে কাজ করা হচ্ছিলো। দুর্ঘটনা ঘটলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে এক একটা শেডে দু’জনের বেশি কাজ করতেন না কখনোই। ১৮৬৬ সালে আবার দুর্ঘটনা ঘটলো।
ল্যাবোরেটরির ধ্বংসস্তূপ সরাবার সময় আলফ্রেড আবিষ্কার করলেন তরল নাইট্রোগ্লিসারিন মিহি বালি ও মাটির সাথে মিশে এক ধরনের পেস্টের মত তৈরি হয়েছে। ওই পেস্টগুলো জোরে নিক্ষেপ করলে বিস্ফোরিত হয়, আগুনে পোড়ালেও বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু স্বাভাবিক তাপে ও চাপে কোন ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে না। আলফ্রেড পেয়ে গেলেন তাঁর স্বপ্নলোকের চাবি।
কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি উদ্ভাবন করলেন ডায়নামাইট। তারপর সাফল্যের ইতিহাস গড়লো ডায়নামাইট। ডায়নামাইট আবিষ্কারের ব্রিটিশ প্যাটেন্ট পেয়ে গেলেন মে মাসে। ছুটে গেলেন আমেরিকায় - ডায়নামাইটের আমেরিকান প্যাটেন্ট পাবার জন্য। দু’বছর পরে আমেরিকান প্যাটেন্ট পেলেন তিনি। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর ডায়নামাইট ও অন্যান্য বিস্ফোরকের ব্যবসা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর কারখানা তৈরি হলো ফ্রান্সে ও স্কটল্যান্ডে। পরে পৃথিবীর বিশটি দেশের নব্বইটি শহরে আলফ্রেড নোবেলের কারখানা স্থাপিত হয়। নোবেল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। বাড়তে থাকে তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কার। ৩৫৫টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট পেয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল।
সবচেয়ে বড় কারখানা ফ্রান্সে থাকায় ১৮৭৩ সাল থেকে প্যারিসের মালাকফ এভিনিউতে বসবাস করতে শুরু করেন আলফ্রেড নোবেল। বিরাট বাড়ি। থাকার লোক মাত্র তিন জন, তিনি এবং কাজের লোক আর ড্রাইভার। প্রচন্ড ব্যস্ত আলফ্রেড। ব্যবসার সমস্ত কাগজপত্র নিজেই দেখাশোনা করেন। নিজের হাতে সব ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক চিঠিপত্রের উত্তর দেন। আবার তাদের কপিও রাখেন। টাকা-পয়সার নিখুঁত হিসেব রাখেন নিজেই। এর মধ্যেও যখন সময় পান নিজের লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুষ্ঠান বলতে কিছুই নেই আলফ্রেডের। যা আছে সবই ব্যবসায়িক। এত কাজ করেন কাজের তাগিদেই। যেমন ব্যবসার কাজে উকিলের সাথে কথা বলতে হয়। কিন্তু উকিল সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা শূন্যের কোঠায়। তিনি মনে করেন উকিলরা তাঁদের পেশার খাতিরে পৃথিবীর সবাইকেই অসৎ ভাবেন।
প্যারিসে বাস করলেও ফ্রান্সকে নিজের দেশ ভাবতে পারেন না আলফ্রেড। কোন নির্দিষ্ট দেশকেই তাঁর নিজের দেশ বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই তাঁর বাড়ি থাকলেও কোন বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করতে পারেন না। তিনি মনে করেন, “আমার বাড়ি হলো সেখানেই যেখানে বসে আমি কাজ করি। আর আমি সবখানেই কাজ করি।”
কাজের সাফল্যে আলফ্রেড নোবেলকে উচ্ছসিত হতে যেমন কেউ কখনো দেখেননি, ব্যর্থতায় ভেঙে পড়তেও কখনো দেখা যায়নি। এ যেন কাজের জন্যই কাজ করা। বন্ধুহীন সঙ্গীহীন একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত আলফ্রেড পুরো পৃথিবীর প্রতিই একধরনের বিতৃষ্ণভাব পোষণ করতেন। রাজনৈতিকভাবে সমাজতন্ত্রের প্রতি সামান্য সমর্থন থাকলেও নিজের ধনবাদী অবস্থান থেকে নড়তে রাজি ছিলেন না কখনোই। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিও বিশ্বাস ছিল না আলফ্রেডের। জনগণ সমষ্টিগতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করতেন না আলফ্রেড। নিজের পড়াশোনা ও ভাবনা-চিন্তার গভীরতার ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল আলফ্রেডের। তিনি যে প্রচুর সম্পদের মালিক এবং এ সম্পদ যে তাঁকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করে তুলেছে তা তিনি ভালো করেই জানতেন। জানতেন বলেই সাধারণ মানুষের সাথে একটা দূরত্ব তিনি বরাবরই রক্ষা করে চলতেন।
শরীর তাঁর কোনদিনই খুব ভাল ছিল না। সারাক্ষণই কোন না কোন শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। নিজের ভেতর একধরনের হীনমন্যতা বাসা বেঁধেছে। নিজেকে খুবই অনাকর্ষণীয় মনে করেন তিনি। ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্কের প্রতিও কোন আকর্ষণ নেই তাঁর। সেই প্রথম যৌবন থেকে অপেক্ষা করছেন কখন তাঁর ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হবে। যে রাশিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন সেই প্রেম বিকশিত হবার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। তারপর কেটে গেছে তেইশ বছর। আলফ্রেড সেরকম আর কোন মেয়ের প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেননি এতগুলো বছরে। অবশ্য ভালোবাসা পাবার জন্য যেটুকু সময় সামাজিক মেলামেশায় কাটানো দরকার তার কিছুই করেননি তিনি। মনের মধ্যে তিনি একটা ধারণা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন তা হলো তাঁকে কোন মেয়ে ভালবাসবে না, কারণ মেয়েদের আকৃষ্ট করার মতো কোনকিছুই নেই তাঁর মধ্যে।
No comments:
Post a Comment