০৫ আগস্ট ১৯৯৮ বুধবার
জিনেট আসার পর থেকেই দেখছি আমাদের
৬১২নং রুমের টেলিফোনটা বড় বেশি ঘন ঘন বাজতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ কল তার কাছেই
আসে। তাই টেলিফোন সেট-টা ইদানিং তার ডেস্কেই থাকে। রুমে অন্য কেউ থাকলে আমার টেলিফোন
ধরার প্রশ্নই ওঠে না। রুমে আর কেউ না থাকলেও যখন টেলিফোন বাজে- ইচ্ছে করে ছুটে
পালিয়ে যেতে। টেলিফোন-ফোবিয়ার কারণ আর কিছুই নয়- অন্য প্রান্তের দুর্বোধ্য ইংরেজি।
পিটার
আর কেন্ ইউরোপীয় কনফারেন্সের জন্য পেপার তৈরি করছেন। পিটার বেশির ভাগ সময় কেনের
অফিসেই থাকেন। ম্যান্ডিকেও দেখছি না ক’দিন থেকে। জিনেট আর ইমাজিন যতক্ষণ রুমে থাকে অনবরত কথা বলতে থাকে- যার
বেশির ভাগই আমি বুঝতে পারি না।
ইমাজিন
ক্লাসের জন্য বেরিয়ে যাবার পর জিনেট কিছুক্ষণ তার ডেস্কে বসে টেলিফোনে আড্ডা মারলো
কারো সাথে। তারপর খট্ খট্ করে বেরিয়ে গেলো। ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো। দ্রুত উঠে
বাইরে গিয়ে দেখলাম জিনেটকে দেখা যায় কি না। না- চলে গেছে। বাধ্য হয়ে ফোন ধরলাম।
ওপ্রান্তে মহিলার কন্ঠস্বর। কাকে চাচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললাম, “সরি, শি ইজ নট হিয়ার নাউ।’
“নট শি। হি- হি ইজ এ হি, পিটার ইজ এ ম্যান।”
বুঝতে
পারছি বেশ রেগে গেছেন মহিলা। চুল লম্বা হলেও পিটার যে একজন পুরুষ তা তো আমি জানি।
ভয়ে ভয়ে বললাম, “সরি ম্যাডাম। পিটার ইজ নট হিয়ার”। ভদ্রমহিলার রাগ কমলো কি না জানি না। তবে
যা বললেন তাতে বুঝলাম পিটার এলে যেন বলি যে লিজ ফোন করেছিল। কিন্তু ঠিক বুঝলাম তো?
মহিলার নাম কি লিজ? নাকি কোন কিছু লিজ নেয়া অর্থে লিজ?
“হোয়াট লিজ?” প্রশ্ন করেই বুঝতে পারলাম ভুল হয়ে গেছে। মহিলার কন্ঠ
আরো ঝাঁঝালো হয়ে উঠলোঃ “ইয়েস, লিজ,
লিজ। মাই নেম ইজ লিজ। পিটার’স ওয়াইফ”।
লিজের
রেগে যাওয়ার কারণ বুঝলাম। স্বামীকে ‘শি’ বললে স্ত্রী তো রেগে যাবেই। কিন্তু
পিটার যে বিবাহিত তা তো জানতাম না। পিটারের জন্য ম্যাসেজটা লিখে আর কোন ফোন আসার
আগেই চুপচাপ বেরিয়ে পড়লাম। ফার্স্ট ইয়ার ল্যাবে গিয়ে ইলেকট্রিসিটি-ম্যাগনেটিজমের
এক্সপেরিমেন্টগুলো একবার দেখে আসা উচিত। কাল সকাল দশটায় আমার প্রথম ল্যাব ক্লাস।
চারটার
দিকে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে সোয়ান্সটন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম ট্রাম
লাইনে জ্যাম লেগে গেছে। লাইনের উপর বিশ-পচিঁশটা ট্রাম একটার পেছনে আরেকটা পর পর
দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও গন্ডগোল হলো নাকি? ফুটপাত ধরে হাঁটছে সবাই। মেলবোর্ন
সেন্ট্রালের কাছে এসে দেখলাম নীল পোশাকের অনেক পুলিশ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক
নিয়ন্ত্রণ করছে। লা-ট্রোব স্ট্রিটে সোয়ান্সটন স্ট্রিটের ট্রামের দিক-পরিবর্তন করা
হচ্ছে। স্টেট লাইব্রেরির সামনে একটা গাড়ির সংঘর্ষ হয়েছে ট্রামের সাথে। ঝকঝকে নতুন
গাড়িটির সামনের অংশ ট্রামের নিচে ঢুকে গেছে। হলুদ পোশাক পরা লোকজন যন্ত্রপাতি নিয়ে
গাড়িটিকে বের করার চেষ্টা করছে। এরকম একটা ঘটনা- অথচ কৌতূহলী জনতার ভীড় নেই মোটেও।
সবাই যার যার গতিতে চলে যাচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে কলিন স্ট্রিটের
ইনফরমেশান সেন্টারে ঢুকলাম। ‘ইন্ডিয়ান
এক্সপ্রেস’ রেস্টুরেন্টের ঠিকানাটা দেখিয়ে
জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে যেতে হবে। ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশন থেকে স্যান্ড্রিংহাম
লাইনের ট্রেনে উঠতে হবে। লাস্ট স্টেশনের আগের স্টেশন হ্যাম্পটন।
উপচে
পড়া ভীড় ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনে। টিকেট মেশিনে কয়েন ঢুকিয়ে একটা দু’ঘন্টার টিকেট কিনলাম। স্টেশনের প্রবেশ-পথে
বসানো স্বয়ংক্রিয় টিকেট-চেকারে টিকেট ঢোকাতেই দরজা খুলে গেল। গেট পেরিয়ে ওপাশ থেকে
টিকেটটা নিয়ে দেখলাম টিকেটের গায়ে টিকেটের মেয়াদ প্রিন্ট করা হয়েছে- রাত আটটা
পর্যন্ত। এখন সোয়া পাঁচটা। তার মানে দু’ঘন্টার টিকেটে সময়ের ভগ্নাংশ হিসেব করা হয় না।
বিশাল
স্টেশন ফ্লিন্ডার স্ট্রিট। অফিস ছুটির ব্যস্ত-সময় বলেই হয়তো- প্রচন্ড ভীড় চৌদ্দটা
প্লাটফর্মের সবগুলোতে। ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে ট্রেনের সময় আর প্লাটফর্ম নম্বর
দেখে ছুটলাম। পরের ট্রেন পাঁচটা সাঁয়ত্রিশে পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে।
পাঁচটা
তিরিশে ট্রেন এলো প্লাটফর্মে। এই প্রথম চড়ছি মেলবোর্নের ট্রেনে। ঝকঝকে
পরিচ্ছন্ন সুন্দর ট্রেন। ঠিক পাঁচটা
সাঁয়ত্রিশে ট্রেন ছাড়লো। ট্রেনের ভেতর ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ভেসে উঠছে পরবর্তী
স্টেশনের নাম। সাথে যান্ত্রিক ঘোষণা “দি নেক্সট স্টেশান ইজ …” “উই আর এপ্রোচিং …” ইত্যাদি। রিচমন্ড স্টেশনে আসার পর
কম্পার্টমেন্ট প্রায় খালি হয়ে গেলো। ট্রেনের বাইরে জমাট অন্ধকার। জানালা দিয়ে তেমন
কিছু দেখা গেলো না। রেল লাইনের আশে-পাশের ছোট-ছোট টাউনশিপগুলোর সব প্রায় একই ধাঁচে
তৈরি। বহুতল ভবন খুব একটা চোখে পড়ে না।
আধঘন্টার
মধ্যে হ্যাম্পটন পৌঁছে গেলাম। টুপ টুপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে আবার। ছাতা খুলতে হলো।
স্টেশন থেকে বেরোবার পথে টিকেট চেক করার কোন মেশিন বা মানুষ দেখলাম না। যত
প্রতিবন্ধক তাহলে শুধু সিটিতে।
শহরের
বাইরের উপশহরগুলো সব একই ধাঁচে তৈরি। একটা বা দুটো প্রধান সড়ককে কেন্দ্র করে একটা
সাবার্বের বাসিন্দাদের যা যা লাগে তার সবকিছুর দোকান। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ খুঁজে বের করতে বেশি বেগ পেতে হলো না। স্টেশন থেকে
মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ।
ঠিক
সোয়া ছ’টায় প্লাস্টিকের দড়ির মত পর্দা ঠেলে
ঢুকলাম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে। টুং-টাং করে কিসের যেন শব্দ হলো ঢোকার সময়। ইরাবতী
কারি হাউজের চেয়েও আয়তনে অনেক ছোট রেস্টুরেন্ট ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। কিছুটা অগোছালো
বলেও মনে হলো। প্রায় একই রকমের কাচঘেরা কাউন্টারে সাজানো তরকারি।
ক্যাশ-রেজিস্ট্রার, পাশে টেলিফোন আর পেছনের দেয়ালে সিদ্ধিদাতা গণেশ। এখানে আরো
একটা জিনিস বেশি আছে- তা হলো একটা বড় হনুমানের ছবি। বজরং বলী’র বেশ কদর আছে ভারতের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে। তবে
হনুমানের সাথে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সম্পর্কটা ঠিক পরিষ্কার নয় আমার কাছে।
কাউন্টারে
কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিচেনের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে বাইরে থেকে। পাশে একটা মাঝারি
আকারের তন্দুর। একজন আধ-বয়সী মহিলা লোহার লম্বা শিক হাতে তন্দুরের ভেতর থেকে রুটি
বের করে আনছেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন মহিলা। তাঁর কালো এপ্রোনে সাদা ময়দার দাগ
স্পষ্ট। তিনি হয়তো আমাকে কাস্টমার ভেবেছেন। বললেন, ‘গুড ইভিনিং। এনি অর্ডার?”
বেশির
ভাগ ভারতীয়দের ইংরেজি উচ্চারণে অদ্ভুত একটা টান থাকে। তাঁর মধ্যে সেই টানটা প্রকট।
তিনি কিছু বলার আগেই বললাম, “আমি মিস্টার
হারিশ দেশাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি”।
“ওয়ান মিনিট” বলে ভেতরের দিকে চলে গেলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে
টেলিফোন বাজলো। মহিলা আবার এসে ফোন ধরলেন। লোকে টেলিফোন করে খাবারের অর্ডার দেয়।
বিশ-পঁচিশ মিনিট পরে এসে দাম দিয়ে খাবার নিয়ে যায়। খুব বেশি ব্যস্ততা দেখতে পাচ্ছি
না এখনো। হয়তো এখনো ডিনারের সময় হয়নি। ভদ্রমহিলা কাগজে অর্ডার লিখে ভেতরে চলে
গেলেন। হারিশ দেশাইকে হয়তো খবর দেয়া হয়েছে।
মাত্র
চার পাঁচটা টেবিল এই রেস্টুরেন্টে। সাদা টেবল-ক্লথের উপর সাদা-কাগজ বিছানো। খাওয়ার
পর কাগজটা ফেলে দিলেই টেবিল আবার পরিষ্কার। পাঁচ মিনিট পরেও হারিশ দেশাই’র দেখা নেই। ভদ্রমহিলা রুটি বেলতে শুরু করেছেন। আমার দিকে একবারও
তাকাচ্ছেন না। আরো মিনিট সাতেক পরে বেশ বড়
একটা গামলা হাতে নিয়ে খর্বাকৃতি একজন মানুষ বেরিয়ে এলেন রান্নাঘরের পেছন থেকে।
গামলার মধ্যে হলুদ মাখানো বড় বড় চিকেন দেখা যাচ্ছে। তন্দুরের পাশে গামলাটা রেখে
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইয়েস?”
“গুড ইভনিং স্যার। আমি মিস্টার হারিশ দেশাই’র সঙ্গে দেখা করতে এসেছি”
“ইয়েস?”
ইনিই
তাহলে হারিশ দেশাই। কালো প্যান্ট আর নীল গেঞ্জি। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন,
মনে হচ্ছে দুটো পায়ের দৈর্ঘ্যে সামান্য অসামঞ্জস্য আছে।
“আমাকে ইরাবতী কারি হাউজের মালহোত্রা সাহেব
পাঠিয়েছেন। আপনার নাকি কিচেন-হ্যান্ড দরকার?”
“হুঁ” বলেই চুপ করে গেলেন মিস্টার হারিশ দেশাই। আমাকে আর
কিছুই না বলে গামলা থেকে একটা করে হলুদ চিকেন তুলছেন আর লোহার শিকে গেঁথে তন্দুরের
মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। টেলিফোন বাজছে, ভদ্রমহিলা
টেলিফোনে অর্ডার নিচ্ছেন। দেশাই মশাই তন্দুরে চিকেন ঢুকানো শেষ করে অর্ডার অনুযায়ী
খাবার তৈরি করছেন। একজন দু’জন করে
কাস্টমার এসে অর্ডার দেয়া খাবার নিয়ে চলে যাচ্ছেন।
রেস্টুরেন্টের
ব্যবসায় লাভের পরিমাণ যে অনেক বেশি তা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। আড়াইশ’ মিলিলিটারের এক কৌটো ভাতের দাম নিচ্ছে দুই
ডলার। অথচ এক কেজি বাসমতি চালের দাম এক ডলার। এক কেজি চাল রান্না করলে কমপক্ষে আট
কৌটো ভাত হবে। তার মানে এক ডলার বিনিয়োগ করে ষোল ডলার উপার্জন। আড়াইশ’ মিলিলিটারের এক কৌটো চিকেন কারির দাম ছয়
ডলার। অথচ এক কেজি চিকেনের দাম মাত্র আড়াই ডলার।
হারিশ
দেশাই কি আমার কথা একেবারেই ভুলে গেলেন? তাঁর চোখের সামনে কাউন্টারের পাশে প্রায়
এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি- অথচ তিনি চোখ তুলে তাকাচ্ছেনও না আমার দিকে। ভদ্রতা করে
বসতেও তো বলতে পারতেন। মানুষ তো মশা-মাছিকেও এরকম উপেক্ষা করে না। চাকরি চাইতে
এসেছি জেনেই কি ধরে নিয়েছেন যে আমার কোন মান-মর্যাদা নেই!
রেস্টুরেন্টে
এমন কোন ব্যস্ততা নেই। টেলিফোন অর্ডারও আসছে না অনেকক্ষণ। হারিশ দেশাই ধীরে সুস্থে
তন্দুরির ভেতর থেকে একটা করে লোহার শিক বের করে চিকেন চেক করছেন। টিপে-টুপে দেখে
আবার ঢুকিয়ে দিচ্ছেন তন্দুরের ভেতর। তিনি কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন? একটু
অধৈর্য হলেই ফেল করিয়ে দেবেন?
ঘড়ি দেখলাম। সোয়া ছ’টায় ঢুকেছি,
এখন সোয়া সাতটা বেজে গেছে। আটটায় আমার টিকেট শেষ হয়ে যাবে। আটটার আগে ফ্লিন্ডার
স্ট্রিট স্টেশনে পৌঁছাতে না পারলে স্টেশন থেকে বেরোবার জন্য আবার টিকেট কিনতে হবে।
ধৈর্য শেষ। বললাম, “এক্সকিউজ মি স্যার”
যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে দেশাই
সাহেব ফিরে তাকালেন আমার দিকে।
“ইয়েস? ও ইয়েস”- আবার মনযোগ
দিলেন আধ-পোড়া চিকেনের দিকে। আমি বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতেই তিনি বললেন, “হোয়ার ইউ ফ্রম?”
“কার্লটন”
“তা জানতে
চাচ্ছি না আমি। দেশ কোথায় তোমার?”
“বাংলাদেশ”
“এদেশে এসেছো
কতদিন হলো?”
“আটাশ দিন”
“স্টুডেন্ট
ভিসা?”
“হ্যাঁ”
“আন্সুর সাথে
কীভাবে পরিচয়?”
“আমার বন্ধু কাজ
করে সেখানে”
ভদ্রলোক কথা বলার সময় আমার দিকে
তাকাচ্ছেনও না। আমার চেয়েও তন্দুরিস্থ মুরগির দাম অনেক বেশি তাঁর কাছে।
“এখানে বর্তমানে
একজন ট্রায়াল দিচ্ছে। সে যদি না টিকে তবে জানাবো তোমাকে। তুমি শনিবার রবিবারের
দিকে একবার ফোন করো”
এই মহার্ঘ্য কথাগুলো তিনি একঘন্টা
আগেই বলতে পারতেন আমাকে।
“সো কাইন্ড অব ইউ
স্যার। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ স্যার” বলে চলে এলাম। এক দৌড়ে স্টেশন। কয়েক মিনিটের
মধ্যেই ফ্লিন্ডার স্ট্রিট অভিমুখী ট্রেন এলো।
ট্রেনের জানালায় চোখ রেখে
লক্ষ্যহীন তাকিয়ে আছি বাইরের অন্ধকারের দিকে। একটু পরপর স্টেশনে ট্রেন থামছে।
যাত্রী উঠানামা করছে। একটু পর হঠাৎ কানে এলোঃ “শো ইওর টিকেট
প্লিজ”। চমকে তাকিয়ে দেখি হাতে একটা ধাতব পরিচয় পত্র দেখিয়ে টিকেট চেক করতে শুরু
করেছেন চার জনের একটা টিম। পকেট থেকে টিকেট বের করে দিতেই টিকেটের ভ্যালিডিটি দেখে
‘থ্যাংক ইউ স্যার’ বলে ফেরত দিলেন মহিলা অফিসার।
আমার সামনের আসনে বসা দু’জন অল্পবয়সী
মেয়ে এতক্ষণ উচ্চস্বরে গল্প করছিলো। তারা এখন নিম্নস্বরে অফিসারকে বোঝানোর চেষ্টা
করছে কেন তাদের কাছে টিকেট নেই। বিনা টিকেটে ভ্রমণের জরিমানা একশ’ ডলার। চোখের
সামনে এরকম একটা ঘটনা ঘটছে দেখে উৎসাহিত হয়ে উঠলাম।
অফিসারটি খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন
না তাদের কথায়। জানতে চাইলেন তাদের সাথে কোন ফটো-আইডি আছে কি না। তারা জানালো-
এখনো ড্রাইভার্স লাইসেন্স পায়নি। অফিসারটি ইশারায় অন্য একজন অফিসারকে ডাকলেন।
অন্য অফিসারটি এসে একটা ছাপানো খাতা বের করে কিছু একটা লিখতে লিখতে মেয়ে দু’জনের একজনকে
ডেকে নিয়ে একটু দূরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মহিলা অফিসারটি মেয়েটির কাছ থেকে
তার ও তার সাথের মেয়েটির বাসার ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর জেনে নিলেন। মোবাইল ফোন
বের করে মেয়েটির দেয়া নম্বরে ফোন করে নিশ্চিন্ত হলেন যে ঠিকানা ঠিক আছে। তারপর
একটা রসিদ দিয়ে বললেন, “এটা তোমার আজকের টিকেট। মেয়াদ আজ মধ্যরাত পর্যন্ত”। অফিসারটি চলে
গেলেন অন্য অফিসারের কাছে। অন্য মেয়েটি ফিরে এসে বসলো তার সঙ্গীর পাশে। তার হাতেও
একটা বিকল্প-টিকেট। জরিমানার নোটিশ পৌঁছে যাবে তাদের বাড়ির ঠিকানায়।
আটটা বাজার দু’মিনিট আগে
ট্রেন এসে থামলো ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনের প্লাটফর্মে। চলমান সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়
উঠে এক্সিট গেটে টিকেট ঢোকালাম। গেট খুলল না, টিকেট বেরিয়ে এলো গায়ে “এক্সপায়ার্ড” ছাপ নিয়ে।
আটটা বেজে গেছে এক মিনিট আগে। এবার? আরেকটা টিকেট কিনতে হবে? গেটের পাশে দাঁড়ানো
একজন অফিসার এগিয়ে এসে আমার টিকেট দেখতে চাইলেন। টিকেট দেখিয়ে বললাম- “এক মিনিট আগে
মেয়াদ চলে গেছে”। তিনি বললেন, “নট এ প্রোব্লেম। ওপাশের গেট দিয়ে চলে যান”। হেঁটে হেঁটে
রাতের মেলবোর্ন দেখতে দেখতে বাসায় ফিরতে আরো চল্লিশ মিনিট।
No comments:
Post a Comment