Sunday, 12 May 2019

ফাইনম্যানের ইলেকট্রোডায়নামিক ভালোবাসা - ৪র্থ পর্ব




            
একবার ছুটিতে গিয়ে দেখলো আরলিনের ঘাড়ের একপাশে ছোট্ট একটা আঁচিলের মত হয়েছে। সে অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে। তাই খুব ঘাবড়ে গেছে এতে তার সৌন্দর্যহানি ঘটছে কিনা ভেবে।
কিন্তু ফাইনম্যান খুব একটা পাত্তা দিলো না এটাকে। সুতরাং আরলিনও ভাবলো এটা সিরিয়াস কিছু নয়। আরলিন তার ডাক্তারকাকাকে দেখালো ওটা। কাকা বললেন ওমেগা তেল মালিশ করতে।
            
কিছুদিন  পর আঁচিলটি বড় হতে শুরু করলোআর আরলিনের হতে লাগলো জ্বর, ভয়ানক জ্বর। দিনের পর দিন অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হতে লাগলো। আরলিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার বললো - টাইফয়েড।
            
ফাইনম্যান লাইব্রেরি থেকে মেডিকেলের বই নিয়ে এসে টাইফয়েড সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করে দিল টাইফয়েড সম্পর্কে যত তথ্য বইতে পাওয়া যায় সব জেনে আরলিনকে হাসপাতালে দেখতে গেল ফাইনম্যান
            
আরলিনকে রাখা হয়েছে আলাদা কেবিনে কেবিনে ঢুকার সময় বিশেষ গাউন পরে ঢুকতে হলো। ডাক্তার ছিলেন সেখানে। ফাইনম্যান ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো - "ওয়াডেল টেস্ট এর রেজাল্ট কী?"
            
বই পড়ে ফাইমন্যান মোটামুটি কিছু বিষয় জেনেছে টাইফয়েড সম্পর্কে। টাইফয়েড এর ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করার জন্য ওয়াডেল টেস্ট করানো জরুরি। ডাক্তার উত্তর দিলেন - "নেগেটিভ।"
            
"নেগেটিভ? কেমন পরীক্ষা করলেন যে আপনারা জীবাণু খুঁজে পেলেন না। তাহলে এভাবে গাউন টাউন পরে এখানে ঢোকা কেন? নিশ্চয়ই আরলিনের টাইফয়েড হয়নি।"
            
ফাইনম্যানের এরকম চিৎকার চেঁচামেচিতে ডাক্তারের প্রতিক্রিয়া হলো মারাত্মক। তিনি আরলিনের বাবা-মা'র কাছে অভিযোগ করলেন ফাইনম্যানের বিরুদ্ধে।
            
আরলিনের বাবা ফাইনম্যানকে বললেন শান্ত হতে। অনুরোধ করলেন যেন ডাক্তারের কাজে বাধা না দেয়। "যাই হোক তিনি তো ডাক্তার। তিনি তোমার চেয়ে ভাল বুঝবেন।"
            
ফাইনম্যান বুঝতে পারছিলো এই ডাক্তাররা নিজেরাও পরিষ্কার জানেন না তাঁরা কী করছেন বা রোগীকে নিয়ে কী করতে যাচ্ছেন। অথচ কেউ কোন সৎ পরামর্শ দিলে নিজেদের অপমানিত ভাবছেন।
            
ফাইনম্যানের মনে হচ্ছে আরলিনের বাবা-মাকে তার তখুনি বলা উচিত ছিল যে ডাক্তারটা একটা ইডিয়ট। ডাক্তারটি জানে না তিনি কী করছেকিন্তু তা বলা হয়নি। আরলিনের বাবা-মা'র সিদ্ধান্তই তখন গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত।
            
এর কিছুদিন পর আরলিন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল। জ্বর নেমে গেল, আঁচিলটাও মনে হল একটু ছোট হয়েছে আগের চেয়ে।
            
কিন্তু না, কয়েক সপ্তাহ পরেই আঁচিলটা দ্রুত বড় হয়ে টিউমারের রূপ নিতে শুরু করলো। দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো আরলিনকে। আরলিনের বগলের নিচে ও তলপেটে আরো কয়েকটা টিউমারের সন্ধান পাওয়া গেল। ওগুলো শরীরের ভেতরে বেশ বড় হয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে চামড়ার ওপরে।
            
ডাক্তার বললেন আরলিনের লিম্ফেটিক গ্ল্যান্ডের সমস্যায় এসব হচ্ছে। তিনি সঠিক রোগের নাম বলতে পারলেন না। বললেন, অন্য ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
            
খবর পেয়ে ফাইনম্যান ছুটে গেল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। লিম্ফেটিক ডিজিজ নিয়ে লেখাপড়া শুরু করে দিল মেডিকেলের বইগুলোতে লিম্ফেটিক গ্ল্যান্ডের স্ফীতি সম্পর্কে লেখা আছে: Tuberculosis of the lymphatic glands - this is very easy to diagnose ---
            
ফাইনম্যান ভাবলো আরলিনের নিশ্চয় এটা হয়নি। এটা হলে ডাক্তাররা নিশ্চয় সহজে ধরে ফেলতে পারতেন।
            
আরো পড়তে লাগল ফাইনম্যান - lymphodenema, lymphodenoma, Hodgkin's disease এরকম আরো যত অসুখ আছে। এগুলো সব বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক ক্যান্সার।
            
খুব মনযোগ দিয়ে পড়ার পরে lymphodenema আর lymphodenoma'র মধ্যে যে পার্থক্য খুঁজে পেল তা হলো - যদি রোগী মারা যায় lymphodenoma আর রোগী যদি অন্তঃত কিছুদিন বেঁচে থাকে তাহলো lymphodenema
            
দিনরাত খেটে যেভাবেই হোক লিম্ফেটিক ডিজিজ সম্পর্কে যত তথ্য পাওয়া যায় সব পড়ে ফেলল ফাইনম্যান এবং বুঝতে পারল আরলিনের যে অসুখটি হয়েছে তা সারবার নয়।
            
বার বার পড়েও এ ছাড়া আর কোন সম্ভাবনা খুঁজে পেল না সেফাইনম্যানের মনে হলো তার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
            
কিন্তু নিজের মনের এ অবস্থাতেও তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জগতে তেমন কোন পরিবর্তন হলো না। ক্লাস সেমিনার ছাড়াও প্রিন্সটনের সাপ্তাহিক চা-চক্রেও যোগ দিচ্ছিল সে। এমন কি পামার হল-এ গণিতবিদ বন্ধুদের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তর্ক করছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
           
অথচ আরলিন আর বাঁচবে না এই তথ্যটি তাকে অসাড় করে দেয়ার কথা। দেখা গেলো খুব অদ্ভুত স্বভাব ফাইনম্যানের যেন একই শরীরে সম্পূর্ণ দু'রকম মন নিয়ে একসাথে চলছে সে।
            
আরলিনকে দেখতে গিয়ে মন হালকা করার জন্য রসিকতা করে আরলিনকে বললো, "মেডিকেলের বইগুলো পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল যে কারোরই এমন রোগ হতে পারে। যে রোগের ওষুধ কেউ জানে না।" তারপর হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগলো। হাসি থামার পর তার মনে হলো কোন দরকার ছিল না হাসার। বুঝতে পারছিল নিজের অস্থিরতা।
           
আরলিনকে বললো, "দেখো আরলিন, আমরা খুবই সংকটে আছি এখন। তোমার জীবন সংকট। অসুখটা সহজে সারবার নয়।"
            
এরপর সদ্যশেখা লিম্ফেটিক ডিজিজগুলোর বর্ণনা দিতে শুরু করল আরলিনকে। হড্‌জকিন্স ডিজিজ সম্পর্কেও বলল সে।
           
পরের সপ্তাহে আরলিনকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, আরলিন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা, আমার কি হড্‌জকিন্স ডিজিজ হয়েছে?"
           
ডাক্তার কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, "হতে পারে, আমরা এখনো নিশ্চিত নই।"
            
আরলিন যখন পরের বার হাসপাতালে গেল তার কাগজপত্র দেখে ডাক্তাররা লিখলেন "হড্‌জকিন্স ডিজিজ।"
            
ফাইনম্যান বুঝতে পারছিল যে  ডাক্তাররা হাতড়ে হাতড়ে চিকিৎসা করছে। এই মুহূর্তে লিম্ফেটিক ডিজিজ সম্পর্কে ফাইনম্যান নিজে ডাক্তারদের চেয়ে বেশি জানে।
            
যাই হোক, এরপর এক্সরে থেকে শুরু করে হড্‌জকিন্স ডিজিজে যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয় আরলিনের সব করা হলো। হাসপাতালে মেডিকেল বোর্ড বসলো। ফাইনম্যান অপেক্ষা করছিল বোর্ডের বাইরে
            
ডাক্তারদের মিটিং শেষে একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে আরলিনকে নিয়ে এলো একজন নার্স। ফাইনম্যান গিয়ে নার্সের হাত থেকে আরলিনের হুইল চেয়ার নিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছিল। হঠাৎ দেখল বেঁটে মতন এক লোক মিটিং রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে সোজা তাদের কাছে চলে এলেন।
            
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার কাশির সাথে বা থুতুর সাথে কি কখনো রক্ত বেরিয়েছিল?"
            
এসব শুনে নার্সটি ভীষণ ক্ষেপে গেলোলোকটিকে বললো, "এই মুহূর্তে চলে যান এখান থেকে। কেমন মানুষ আপনি? এসব কী প্রশ্ন করছেন?" বলে একপ্রকার জোর করে ঠেলে নিয়ে গেল লোকটিকে।
            
মিটিংরুম পর্যন্ত গিয়ে নার্সটি ফিরে এলো তাদের কাছে। বলল, "লোকটি ডাক্তার। মিটিং-এ এসেছিলেন। ডাক্তার হিসেবে খুবই ভাল, কিন্তু সবসময়ই কোন না কোন সমস্যা সৃষ্টি করেন। রোগীকে এসব জিজ্ঞেস করে কেউ?"
            
ফাইনম্যান বুঝতে পারছিল ডাক্তারটি কিছু একটা সম্ভাবনা খুঁজছেন। শেষ পর্যন্ত মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানানো হলো। রুমের ভেতর ফাইনম্যানকে ডেকে নিয়ে জানানো হলো - আরলিনের অসুখটা খুব সম্ভবত হড্‌জকিন্স ডিজিজ।
            
ডাক্তার বললেন, "এই অসুখটা মাঝে মাঝে খুব বাড়বে। তখন হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কিছুদিন পরে অবস্থা একটু ভাল হবে। কিন্তু কখনোই একেবারে সেরে যাবে না। কয়েক বছর পর রোগী মারা যাবে।"
            
একটুও অবাক হল না ফাইনম্যান। কারণ হড্‌জকিন্স ডিজিজ সম্পর্কে ডাক্তার যা যা বললেন তার সবই সে জানে। সে বললো, " এটা শুনতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি আরলিনকে বলবো আপনি যা যা বললেন।"
            
"না, কক্ষনো না" - ডাক্তার ফাইনম্যানের হাত চেপে ধরলেন।
           
"প্লিজ, তাকে এসব কিছুই বলবেন না। আমরা তাকে হতাশ করতে চাই না। আমরা তাকে বলবো রোগটা হলো গ্ল্যান্ডুলার ফিভার। গ্ল্যান্ডের গন্ডগোল। ততোটা ঘাবড়াবার মত কিছু নয়।"
           
"না, এটার দরকার হবে না। আমরা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি। হড্‌জকিন্স ডিজিজের সম্ভাবনার কথা আমরা জানি। আমি তাকে বিস্তারিত বলেছি। সে মেনে নিতে পারবে"
           
"কিন্তু তার মা-বাবা চাচ্ছেন না যে আরলিন কিছু জানুক। এখন আপনি যদি জানাতে চান তাহলে আরলিনের বাবা-মা'র সাথে আগে কথা বলুন।"
            
বাড়িতে সবাই ফাইনম্যানকে নিয়ে পড়লো। তার বাবা-মা, পারিবারিক ডাক্তার, তার দুই মাসী তাকে বোঝাতে লাগলেন, "কেমন ছেলে তুমি? বুঝতে পারছো না? আরলিনের মত এত চমৎকার একটা মেয়ে যখন জানতে পারবে যে সে আর বাঁচবে না, তখন তার কী প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে দেখেছো? তুমি কীভাবে বলবে যে আরলিন তুমি আর বাঁচবে না?"
            
ফাইনম্যান খুব ধীরে পরিষ্কারভাবে বলল, আমাকে বলতেই হবে। আমরা কখনোই কেউ কাউকে মিথ্যা বলি না। কোন কিছু গোপনও করি না কেউ কারো কাছ থেকে। শুধু শুধু কথা ঘোরানোর কোন মানে হয় না। সে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করবে আমাকে তার কী হয়েছে। আমি তখন তাকে মিথ্যে বলতে পারব না।"
           
"ওসব ছেলেমানুষী কাজকারবার। আর এখন তো জীবন মরণের প্রশ্ন। কেন বুঝতে পারছো না তুমি?"
           
"তুমি বুঝতে পারছো না, তুমি ভুল করছো" - এরকম দীর্ঘক্ষণ তার কানের কাছে মন্ত্রের মত জপ করতে লাগলো সবাই
           
কিন্তু ফাইনম্যান জানে সে ভুল করছে না। সে আরলিনকে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সম্ভাবনার কথা বলেছে। তার ধারণা আরলিন মানসিকভাবে প্রস্তুত আছে যে কোন বিষয় মেনে নেয়ার জন্যকিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইনম্যানকে হার মানতে হলো তার ছোটবোন জোয়ানের কাছে।
            
জোয়ানের বয়স তখন মাত্র এগারো কি বারো বছর। সে কাঁদতে কাঁদতে ফাইনম্যানকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, "আরলিন এত চমৎকার একটি মেয়ে। আর তুমি কিনা বলতে যাচ্ছো যে সে মরে যাবে। এত নিষ্ঠুর তুমি?"
            
ফাইনম্যান জোয়ানের কান্না সহ্য করতে পারলো না। আরলিনের কাছে একটা চিঠি লিখল ফাইনম্যান। চিঠিতে সবকিছু খুলে লিখলো। সে যে তাকে মিথ্যা বলতে বাধ্য হচ্ছে তাও। যদি আরলিন কখনো সত্যি কথাটা জানতে পারে তখন তাকে দেখাবে এই চিঠি। চিঠিটা ভাঁজ করে তার ওয়ালেটে রেখে দিলো যেন সবসময় তার সাথে থাকে।
             
মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আরলিনকে হাসপাতালে দেখতে গেল ফাইনম্যান। আরলিন বিছানায় বসে আছে মন খারাপ করে। তার বাবা-মাও আছেন সেখানে।
            
ফাইনম্যানকে দেখার সাথে সাথে আরলিনের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আরলিন বললো, "এবার আমি বুঝতে পারছি রিচার্ড, আমরা যে একজন আরেক জনের কাছে মিথ্যা কথা বলি না তার মূল্য কতখানি।"
            
তার মা-বাবার দিকে একটু তাকিয়ে আরলিন আবার বললো, "এরা আমাকে বলছে আমার নাকি হয়েছে গ্ল্যান্ডুলার ফিভার। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তাদের কথা বিশ্বাস করবো কিনা। রিচার্ড, এবার তুমি বলো আমাকে, আমার কী হয়েছে? গ্ল্যান্ডুলার ফিভার নাকি হড্‌জকিন্স ডিজিজ?"
            
ফাইনম্যান বললো, "গ্ল্যান্ডুলার ফিভার।"
            
বলতে গিয়ে মনে হলো তার ভেতরটা মরে গেছে ততক্ষণে। অসহ্য লাগছে তার। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা। এরকম মানসিক কষ্ট সে আগে কখনো পায়নি। এমনকি আরলিন আর বাঁচবে না জানার পরেও যতটা না কষ্ট পেয়েছে - তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেলো আরলিনকে মিথ্যে বলার পর।
            
আরলিনের প্রতিক্রিয়া ছিলো অবিশ্বাস্য রকম শান্ত। খুবই সহজ গলায় বললো, ", ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।"      
            
তারা পরস্পরের প্রতি এত বেশি বিশ্বস্ত ছিল যে আরলিন সত্যিই বিশ্বাস করলো তার হড্‌জকিন্স ডিজিজ হয়নি। আরলিনের বাবা-মাও ফাইনম্যানের কথায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। মনে হলো সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
            
কয়েক দিনের ভেতর আরলিন কিছুটা সুস্থবোধ করলো এবং হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে চলে গেলো।
            
সপ্তাহখানেক পরে আরলিন ফোন করলো ফাইনম্যানকে, "রিচার্ড, আমি তোমার সাথে সামনা-সামনি কথা বলতে চাই। তুমি এক্ষুনি বাসায় চলে এসো।"
            
ফাইনম্যান বুঝতে পারলো আরলিন তাকে কী বলবে। যাবার আগে ওয়ালেটটা দেখে নিল চিঠিটি আছে কি না। অন্তত আরলিনকে পুরো ব্যাপারটা বুঝানো যাবে।
            
আরলিনদের বাড়িতে গিয়ে সোজা আরলিনের ঘরে চলে গেল ফাইনম্যান। আরলিন বললো, "বসো এখানে।"
            
ফাইনম্যান বসলো তার বিছানায় আরলিন বসলো ফাইনম্যানের সামনে। চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, "এবার বলো, আমার কি আসলেই গ্ল্যান্ডুলার ফিভার হয়েছে নাকি হড্‌জকিন্স ডিজিজ?"
            
"হড্‌জকিন্স ডিজিজ" - বলেই ওয়ালেট খুলে চিঠিটা হাতে নিল ফাইনম্যান।
            "ওহ্‌ মাই গড" - আর্তনাদ করে উঠলো আরলিন"তোমাকে তো নরকে যেতে হবে রিচার্ড।"
            
আরলিন বিশ্বাস করে মিথ্যে বললে নরকে যেতে হয়সে ফাইনম্যানের জন্য চিন্তা করছে, অথচ  রিচার্ড তার বিশ্বাসভঙ্গ করেছে।
            
আরলিনকে সব বলল ফাইনম্যান। তাকে চিঠিটা দিয়ে বললো, "আরলিন, তোমার কাছে মিথ্যে বলতে আমি বাধ্য হয়েছি। কিন্তু তারপর থেকে আমি শান্তি পাচ্ছি না।"

            "তুমি এটা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছো আমি বুঝি। যা হবার হয়েছে। কিন্তু আর কখনো আমাকে মিথ্যা কথা বলো না প্লিজ।"
            
হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসা অবধি আরলিন দোতলার ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুঝতে চেষ্টা করতো নিচে কে কী করছে। সে দেখলো তার মা ভীষণ কান্নাকাটি করছে।
            
সে ভাবতে লাগলো, "আমার যদি গ্ল্যান্ডুলার ফিভারই হয়ে থাকে তাহলে মা এত কাঁদছে কেন? তবে কি আমার হড্‌জকিন্স ডিজিজ হয়েছে? কিন্তু রিচার্ড তো বলেছে আমার গ্ল্যান্ডুলার ফিভার। তবে কি রিচার্ড মিথ্যা কথা বলেছে? তা কীভাবে হবে? তবে কি এমন কিছু হয়েছে যে রিচার্ড মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছে?" এরকম ভাবতে ভাবতে ফাইনম্যানকে ডেকে এনেছে সে।
            
আরলিনকে এখন অনেক শান্ত দেখাচ্ছে। খুবই শান্তভাবে আরলিন এবার প্রশ্ন করলো ফাইনম্যানকে, "ওকে, আমার হড্‌জকিন্স ডিজিজ। এখন তুমি কী করবে?"
            
তাদের দু'জনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কী হবে জানতে চাচ্ছে আরলিন।
            
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির একটি স্কলারশিপ আছে ফাইনম্যানের। কিন্তু ওটা থাকবে না যদি তারা এখন বিয়ে করে। তারা দু'জনই জানে অসুখটার রকম-সকম। মাস দুয়েক ভাল থাকবে, তখন বাসায় থাকতে পারবে। কিন্তু ক'মাস পরেই অবস্থা খারাপ হবে, তখন হাসপাতালে থাকতে হবে। এভাবে টানা-হ্যাঁচড়ার মধ্যে থাকতে হবে যতদিন বাঁচে। বড়জোর আর দু'বছর বাঁচবে আরলিন।
            
ফাইনম্যানের পিএইচডি তখন মাঝপথে। এসময় চেষ্টা করলে বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে একটা রিসার্চের চাকরি হয়তো পেতে পারে সে। তখন হয়তো কুইন্সে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকতে পারবে যা তার ল্যাবরেটরি আর আরলিনের হাসপাতাল থেকে কাছে হবে। প্রিন্সটনের স্কলারশিপটা গেলেও মোটামুটি চলতে পারবে
            
ফাইনম্যান সিদ্ধান্ত নিলো কয়েক মাসের মধ্যেই সে আরলিনকে বিয়ে করবে। সেই বিকেলেই সে আর আরলিন তাদের ভবিষ্যতের ছক এঁকে ফেলল অনেক দূর।
            
বেশ কিছুদিন থেকেই ডাক্তাররা চাচ্ছিলেন আরলিনের টিউমারটার একটা বায়োপ্‌সি করতে। কিন্তু আরলিনের বাবা-মা রাজি হচ্ছিলেন না। তাঁদের কথা হলো, "কেন শুধু শুধু কষ্ট দেবে মেয়েটাকে? যে ক'দিন বাঁচে শান্তিতে বাঁচতে দাও।"
            
কিন্তু ফাইনম্যান চাচ্ছিল যত বেশি তথ্য পাওয়া যায় ততই ভাল। আরলিনকে বুঝিয়ে আরলিনের সাহায্যেই তার বাবা-মাকে রাজি করালো।
            
এর কয়েকদিন পর আরলিন ফোন করে ফাইনম্যানকে বললো, "আমার বায়োপ্‌সি রিপোর্ট এসেছে।"
            "ভাল না খারাপ?"
            "বুঝতে পারছি না। তুমি এসে দেখে যাও।"
            
ফাইনম্যান আরলিনের বাড়িতে গিয়ে রিপোর্ট দেখল রিপোর্টে লেখা আছে - tuberculosis of the lymphatic glands.
            
আরে এটাতো লিম্ফেটিক গ্ল্যান্ডের অসুখগুলির তালিকার শুরুতেই ছিল যেটা সহজে নির্ণয় করা যায়। অথচ ডাক্তাররা নির্ণয় করতে পারছিল না বলে ফাইনম্যান ভেবেছিল আরলিনের ওটা হয়নি। ফাইনম্যান নিজেও তেমন গুরুত্ব দেয়নি সেটাকে। যে ডাক্তারটা ছুটে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন থুতুর সাথে রক্ত যায় কিনা তিনি সঠিক প্রশ্নই করেছিলেন। লিম্ফেটিক গ্ল্যান্ডের টিউবারকিউলোসিসের লক্ষণ ওটা। ঐ ডাক্তারটা হয়তো সঠিক অনুমান করেছিলেন।
            
আরলিন বললো, "তাহলে আমার মেয়াদ দু'বছর থেকে সাত বছর পর্যন্ত বাড়লো। এমনকি তার চেয়ে বেশিও বাঁচতে পারি।"
            "অথচ তুমি বলছ ভালো কি মন্দ বুঝতে পারছো না!"
            "এখন তো আর আমরা বিয়ে করতে পারছি না" - বিমর্ষভাবে বললো আরলিন।
            
আর মাত্র দু'বছর বাঁচবে জানার পর আরলিনের দিকটা বিবেচনা করে তড়িঘড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। এখন আরলিন ভাবছে তার মৃত্যুটা যেমন সাময়িকভাবে পিছিয়েছে বিয়েটাও যদি পিছিয়ে যায়!"
            
ফাইনম্যান আরলিনকে বোঝাল, "এটা আরো ভালোই হল। বিয়ে আমরা এখনই করবো। তুমি আমার হয়ে আরো কয়েক বছর আমার কাছে থাকবে এটা তো আমার উপরি পাওনা।"
            
তারা জানতো যেকোন সমস্যার মোকাবেলা করার মতো মানসিক শক্তি তারা অর্জন করেছে। মৃত্যুকে যেখানে মেনে নিয়েছে সেখানে অন্য সমস্যাগুলো কোন সমস্যাই নয়।
            
তখন বিশ্বযুদ্ধের সময়। আমেরিকার সবচেয়ে মেধাবী বিজ্ঞানীদের নিয়ে শুরু হয়েছে প্রথম পারমাণবিক বোমা প্রকল্প 'ম্যানহাটান প্রজেক্ট' পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট উইলসনের আহ্বানে প্রজেক্টের কাজে যোগ দিতে হলো ফাইনম্যানকে। প্রকল্পের তত্ত্বীয় বিভাগের প্রধান ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী হ্যান্স বেথে। টেকনিক্যাল কম্পিউটেশান গ্রুপের লিডার নির্বাচিত হল রিচার্ড ফাইনম্যান। তখন তার বয়স মাত্র তেইশ।
            
প্রজেক্ট থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে পিএইচডি থিসিসটা লিখে ফেললো ফাইনম্যান। পিএইচডি ডিগ্রি পাবার সাথে সাথে সে বাড়িতে জানিয়ে দিল "আরলিনকে আমি বিয়ে করছি"


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts