রিচার্ডের দেয়া
ধারণা কাজে লাগিয়ে আরলিনের এই প্রাপ্তিতে আরেকটু মনযোগ দিল সে রিচার্ডের প্রতি। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে
পারছিল না রিচার্ড। জেরোমের পরে তার আরেকজন
প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটলো। হ্যারোল্ড গ্যাস্ট - রিচার্ডেরই খুব ভাল
বন্ধু। আরলিন একবার
রিচার্ডের দিকে ঝোঁকে তো পরমুহূর্তে হ্যারোল্ডের দিকে
ঝুঁকতে থাকে। আরলিন আসলে মনস্থির করতে পারছিলো না।
এর মধ্যে রিচার্ডদের
স্কুলের গ্র্যাজুয়েশান এসে গেলো। আরলিন সমাবর্তনে গেলো
হ্যারোল্ডের সাথে। কিন্তু গিয়ে বসলো রিচার্ডের মা-বাবার পাশে।
রিচার্ড
পদার্থবিজ্ঞান, গণিত আর রসায়নে সেরা ছাত্রের পুরষ্কার নিতে বার বার স্টেজে
যাচ্ছিল। হ্যারোল্ডও কম নয়। সে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসে সেরা ছাত্র। স্কুলের
বার্ষিক নাটক লিখেছে সে। সেও স্টেজে যাচ্ছিলো বার বার পুরষ্কার নিতে।
ইংরেজি সাহিত্যে
রিচার্ড ছিল মারাত্মক রকমের খারাপ ছাত্র। এই বিষয়টাকে সে সহ্যই
করতে পারত না। বানান ভুল করলে নম্বর কাটা যেত। সেটা নিয়ে তার মেজাজ
যেতো চড়ে। এমন বিরক্তি লাগতো তার - "আরে বাপু, কীরকম বানানে আমি শব্দটা লিখলাম তাতে কী এসে যায়?
একটা এ বেশি দিলে বা এ'র জায়গায় ই দিলে প্রাকৃতিক কোন নিয়ম বদলে যাচ্ছে? ভাষাটাতো মানুষের সৃষ্টি, কতকগুলো চিহ্ন। এখন তুমি চিহ্নের মাধ্যমে
জিনিসটা বুঝতে পারলেই হল। তুমি ইচ্ছে করলে যে কোন ভাবে তোমার পছন্দমত
চিহ্ন দিয়েও তো বানানটা লিখতে পারো।"
কিন্তু না,
তার কথা কে শোনে। ইংরেজিটার ওপর তাই তার ভীষণ
রাগ, সে জন্যই হয়তো
সে ভীষণ খারাপ নম্বর পেতো এই বিষয়ে।
তখন
নিউইয়র্ক স্টেট গভর্নমেন্ট অব এডুকেশন প্রত্যেক হাইস্কুলে কিছু পরীক্ষা নেয়ার
ব্যবস্থা করেছিল। পরীক্ষাগুলোর নাম ছিল রিজেন্টস। এই পরীক্ষাগুলো
ছিল একটু উচ্চমার্গের। যেমন ইংরেজি সাহিত্যের কোন বইয়ের সমালোচনা লিখতে হতো, আবার
রচনাও লিখতে হতো।
ক'মাস আগে রিচার্ড যখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, তার বন্ধু হ্যারোল্ড আর ডেভিড জিজ্ঞেস করলো - "বুক রিভিউর জন্য কোন্ বই
বাছাই করেছিস?"
হ্যারোল্ডের মত
ডেভিডও ঝানু ছাত্র, স্কুলের পত্রিকার
এডিটর সে। রিচার্ড তাদের
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, "তোরা কোন্ বই ঠিক করেছিস?"
ডেভিড বাছাই করেছে সিনক্লেয়ার লিউজ এর 'সোশাল ইমপ্লিকেশান্স' নামক খটমটে
এক বই। আর হ্যারোল্ড বাছাই করেছে, অ্যাবস্ট্রাক্ট নাটকের কোন একটা বই। রিচার্ড যখন বললো যে সে লিখবে 'ট্রেজার আইল্যান্ড' নিয়ে, তারা হাসতে শুরু করলো।
বন্ধুরা
হাসলেও কিছু করার নেই রিচার্ডের। কারণ লিখতে গেলে তো পড়তে
হয়। রিচার্ড তো সাহিত্যের বই
কিছুই পড়েনি। ট্রেজার আইল্যান্ডটা ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে হয়েছে বলেই পড়েছে।
হ্যারোল্ড আর ডেভিড হাসতে হাসতে বললো, "এরকম একটা শিশুতোষ বই সম্পর্কে লিখলে
গোল্লা পাবি তুই।"
রিজেন্টস
পরীক্ষার জন্য রচনা লিখতে হতো। রচনা লিখতে
গিয়ে রিচার্ড বেছে নিল 'দি
ইম্পর্ট্যান্স অব সায়েন্স ইন এভিয়েশান'। সে জানত তার বন্ধুরা সব জটিল বস্তু নিয়ে জটিল বাক্যে রচনা লিখবে। কিন্তু রিচার্ড তো সায়েন্স
ছাড়া আর কিছুই তেমন
লিখতে পারে না।
খুব সাধারণ ইংরেজিতেই রচনা লিখতে শুরু করেছিল রিচার্ড। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো হ্যারোল্ড বা ডেভিডরা এত চোস্ত ইংরেজি লেখে যে তাদের ভারী ভারী খটমটে ইংরেজিতে দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা হয় তাদের লেখা পড়তে।
সেও
তো চেষ্টা করতে পারে। "এমনিতেই তো এই বিষয়ে আমি পাবো
গোল্লা। সুতরাং চেষ্টা করতে দোষ কী। চেষ্টা ঠিক নয়, একটা খেলা খেলে দেখা যেতে পারে।"
যেই
ভাবা সেই কাজ। রিচার্ড লিখলো - "Aeronautical
science is important in the analysis of the eddies, vortices, and whirlpools
formed in the atmosphere behind the aircraft..."
রিচার্ড
জানতো যে eddies, vortices, whirlpools সবগুলো একই জিনিস, শুধুমাত্র তিন নামে
ডাকা। শুনতে গালভারী শোনায়। তো রচনাটা এরকম মোটা মোটা ভারী ভারী শব্দের
বহুল প্রয়োগে ভরিয়ে দিল
রিচার্ড।
রিচার্ডের
রচনাটি যিনি পরীক্ষা করেছিলেন তিনি তার শব্দচয়নে এতটাই
মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে
রিচার্ড একশ'র মধ্যে ৯১ পেয়ে গেল। তার জটিল কাব্যিক
বন্ধুরা পেয়েছিল ৮৮।
সেবছর
থেকে স্টেট গভর্নমেন্ট নিয়ম করেছিলো রিজেন্টসের কোন বিষয়ে যদি
কেউ শতকরা ৯০ বা তার বেশি নম্বর পায় তাহলে তাকে ঐ
বিষয়ের বেস্ট স্টুডেন্টের পুরষ্কার দেয়া হবে। সুতরাং নাট্যকার আর স্কুলের পত্রিকার এডিটর সাহেব
চেয়ারে বসে থাকলো আর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র রিচার্ডকেই ডাকা হলো
পুরষ্কার নিতে -
ইংরেজিতে বেস্ট স্টুডেন্ট।
এতগুলো
পুরষ্কার প্রাপ্তিতে আরলিন রিচার্ডের দিকে আরো মনযোগী
হলো। যাই হোক -
রিচার্ডের বাবা-মা আর
হ্যারোল্ডের বাবা-মা বসেছিলেন একসাথে। এসময় রিচার্ডের গণিত
বিভাগের প্রধান উপস্থিত হলেন। এই স্যারটি রাশভারী। লম্বা, শক্ত চোয়াল, যাকে বলে পেটানো শরীরের
মানুষ।
হ্যারোল্ডের
মা তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বললেন, "হ্যালো ডক্টর অক্সব্যারি, আমি
হ্যারোল্ডের মা, আর ইনি ফাইনম্যানের মা।"
ডক্টর
অগ্সব্যারি হ্যারোল্ডের মাকে কোন পাত্তাই দিলেন না।
সরাসরি রিচার্ডের মায়ের কাছে এসে বললেন, "মিসেস ফাইনম্যান, আমি আপনাকে জানাতে এসেছি যে আপনার ছেলের মত
প্রতিভাবান ছেলে খুব সহজে পাওয়া যায় না। এরকম ছেলেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাহায্য
সহযোগিতা করা দরকার। আপনারা তাকে অবশ্যই ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন। দেশের সেরা ইউনিভার্সিটিতে।"
রিচার্ডের
অংকের স্যার ভেবেছিলেন যে তার বাবা-মা হয়তো তাকে বেশিদূর পড়াবেন না। কারণ ওইসময় অসংখ্য ছেলেমেয়ে স্কুলের পরপরই চাকরিতে যোগ দিতো। পরিবারের দায়-দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে হতো তাদের। রিচার্ডের
বন্ধু রবার্টও পড়তে পারেনি ইউনিভার্সিটিতে। অথচ সে খুব ভাল ছাত্র ছিল, তার বাড়িতে একটা
ল্যাবরেটরিও ছিল।
যাই
হোক, রিচার্ডের মা ডক্টর অগ্সব্যারিকে নিশ্চয়তা দিলেন, "আমরা আমদের সাধ্যমত
চেষ্টা করছি তার জন্য। আমরা তাকে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে অথবা এম-আই-টিতে
পাঠাবো।"
আরলিন সব কথাবার্তা শুনছিলো। রিচার্ডের ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল দেখতে পেলো
সে। আর রিচার্ডও দেখতে পাচ্ছিল আরলিনের মনের আয়নায় নিজের মুখ।
আরলিন রিচার্ডের
চেয়ে বয়সে ছয় মাসের বড়। ন্যাসাউ কাউন্টি লরেন্স হাইস্কুলের
স্কুল পত্রিকার এডিটর আরলিন। চমৎকার পিয়ানো বাজায় আর ভীষণ শৈল্পিক তার কাজকর্ম।
রিচার্ড আর
আরলিনের মেলামেশা বেড়ে গেল। তাদের বাবা-মাও জেনে গেল তাদের সম্পর্কের কথা।
আরলিনের পরিবারটা ছিল খুবই ভদ্র। তারা সবাই অন্যের অনুভূতির ব্যাপারে
ভীষণ সচেতন। আরলিনও তাই। সে রিচার্ডকে বোঝাতে শুরু করলো, "মানুষের মুখের ওপর ধুমধাম কথা
বলা তোমার উচিত নয়। লোকে কষ্ট পায় না? অন্যের দিকটাও তো তোমার ভাবা উচিত।"
আরলিনের
মতে অনেক সময় অপ্রিয় সত্য কথা বলার চেয়ে নির্দোষ মিথ্যা অনেক ভালো।
কিন্তু
রিচার্ডের দর্শন ছিলো অন্যরকম। সে ভাবত what do you care
what other people think? লোকের কথায় তোমার কী আসে যায়?
আরলিনকে
বললো, "অন্যের মতামত শোনার দরকার অবশ্যই আছে এবং সে মতামত বিবেচনা করার
দরকারও আছে। কিন্তু যদি দেখো ঐ মতামত যুক্তিহীন, তখন তা বর্জন করাই উত্তম
কাজ।"
আরলিন রিচার্ডের কথাটাকে গুরুত্বের সাথে মেনে নিলো। মনে হলো তার দর্শনও
কিছুটা রিচার্ডের প্রভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করেছে।
পরস্পরকে সব কথা
খোলাখুলি বলতে শুরু করল
রিচার্ড ও আরলিন। তাদের আশাগুলো, ভাবনাগুলো, হতাশাগুলো, স্বপ্নগুলো পরস্পর শেয়ার
করতে শুরু করলো কোনরকম রাখঢাক না করেই। পরস্পরের কাছে তারা
প্রথমেই অকপট হয়ে গেল।
দেখলো তাদের ভালোবাসাও অকপট। এরকম পরম ভালোবাসার কোন
তুলনা হয় না।
কোটার কারণে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারল না রিচার্ড ফাইনম্যান। ইহুদিদের জন্য কোন সিট খালি ছিল না। যেতে হলো ম্যাচাচুসেট্স-এ এম-আই-টিতে।
বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়
জীবন শুরু হলো
ফাইনম্যানের। আরলিনের কাছ থেকে অনেক দূরে। বন্ধুদের
কাছ থেকে চিঠি পেতে শুরু
করল ফাইনম্যান। যাদের সাথে সে তেমন ঘনিষ্ঠ নয় তারাও
চিঠি লিখে জানাতে লাগলো যে
আরলিনকে এর-ওর সাথে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে, হ্যারোল্ডের সাথে ঘুরছে আরলিন ইত্যাদি
ইত্যাদি।
বস্টনে
এম-আই-টিতে ফাইনম্যানও মেলামেশা করছে অনেক মেয়ের সাথে, এখানে ওখানে বেড়াতেও গেছে অনেকের
সাথে। সেসব যেমন আলাদা কোন গুরুত্ব বহন করে না, তেমনি আরলিনের ব্যাপারেও বিচলিত
হবার কিছু নেই। কারণ ফাইনম্যান জানে আরলিন ও তার মধ্যে লুকোচুরির কোন ব্যাপার নেই,
থাকতে পারে না।
সামারের
ছুটিতে বাড়িতে আসে ফাইনম্যান, সময় কাটায় আরলিনের সাথে। রোমঞ্চকর দিনগুলো কেটে যায়
বড় দ্রুত।
১৯৩৯ সালের জুন মাসে
এম-আই-টি থেকে গ্র্যাজুয়েশান শেষ করলো ফাইনম্যান। একটা পার্ট-টাইম কাজও জুটে গেল
তার - ক্রাইসলার কোম্পানিতে।
সেই সামারে আরলিনও একটা বেবি সিটিং-এর কাজ নিয়ে চলে এলো কেমব্রিজ থেকে মাত্র বিশ মাইল দূরে।
ইচ্ছে করলেই এখন দেখা হতে পারে আরলিন আর ফাইনম্যানের।
কিন্তু ফাইনম্যানের
বাবা এসময় বার বার হুসিয়ারি দিতে শুরু করলেন। তিনি ভেবেছিলেন রিচার্ড যদি
আরলিনের সাথে বেশি মেলামেশা করে তবে পড়ালেখার বারোটা বাজবে। তখনকার দিনে
লেখাপড়াটা যা করার বিয়ের আগে করে নেয়াই ছিলো রেওয়াজ।
ছয় বছরের পরিচয়ে এবং
ভালোবাসায় খুব সামান্য সময়ই কাছাকাছি ছিল আরলিন ও ফাইনম্যান। তাই তারা ঠিক করেছিল এম-আই-টি থেকে গ্র্যাজুয়েশানের
পরপরই বিয়ে করবে।
কিন্তু গ্র্যাজুয়েশানের পরে পিএইচডি করার
জন্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বেশ ভাল স্কলারশিপ পাবার পরেও নিউ জার্সির
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো ফাইনম্যান। কারণ আলবার্ট আইনস্টাইন তখন
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে।
পদার্থবিজ্ঞানী
ইউজিন উইগনারের গবেষণা সহকারী হবার সুযোগ পেয়েছিল ফাইনম্যান। কিন্তু সে যোগ দেয়
প্রিন্সটনে সদ্য যোগ দেয়া তরুণ প্রফেসর জন উইলারের গ্রুপে। 'থিওরি অব লিস্ট
অ্যাকশান' নিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হয় ফাইনম্যানের।
No comments:
Post a Comment