০৭ আগস্ট ১৯৯৮ শুক্রবার
ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আজ কেমন যেন
অন্যরকম লাগলো। এই প্রথম দেখলাম সকালবেলা কেনের দরজা বন্ধ। পিটারও নেই। দু’জনই এখন ইউরোপে। কেন্ ফিরবেন চার সপ্তাহ
পর। কাল বিকেলে কেনের সাথে কথা হয়েছে অনেকক্ষণ। বলে গেছেন কোন কিছুর দরকার হলে যেন
ই-মেইল করে জানাই।
দশটা
বাজার পাঁচ মিনিট আগে লেসের ক্লাসে যাবার জন্য বেরিয়েছি, এসময় করিডোরে লেসের সাথেই
দেখা হয়ে গেলো।
“তুমি কালকের ক্লাস মিস করেছো”
“আমি ফার্স্ট ইয়ার ল্যাবে ছিলাম”
“ঠিক আছে। এই নাও কালকের লেকচার নোট”
শিক্ষার্থীদের
প্রতি শিক্ষকদের যত্ন-আত্তি একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে না এখানে? সব শিক্ষার্থীর
প্রতিই কি এরকম আচরণ করেন এঁরা? নাকি কেনের ছাত্র বলে কিছুটা বিশেষ সুবিধে পাচ্ছি
আমি?
সারা
দুপুর-বিকেল বসে বসে ই-মেইল করলাম অনেকগুলো। কলেজের সহকর্মীদের সবাইকে লিখে
রুবায়েতের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। প্রিন্ট করতে করতে রুবায়েতের প্রিন্টারের কালি
শেষ হয়ে যাবে। বেচারা রুবায়েৎ ভাববে- “কোন কুক্ষণে যে প্রদীপ স্যারকে বলেছিলাম আমার ঠিকানায় অন্যের ই-মেইল
পাঠাতে!” আর আমার সহকর্মীরা? সাঈদ ভাই তো
প্রায়ই বলেন, “যে যত বেশি কষ্ট দেয়, মানুষ তাকেই তত
বেশি মনে রাখে”। মনে রাখার জন্য যতটুকু কষ্ট দিতে
হয়- ততটুকু কষ্ট দিতে পেরেছি কি না জানি না। তাই কয়েকদিন হয়তো মনে পড়বে আমার কথা,
তারপর সবাই ভুলে যাবেন।
পাঁচটার
দিকে জিনেট এসে বললো, “অল ওয়ার্ক
নো প্লে- নট গুড। কম্পিউটার বন্ধ করো। চলো আমার সাথে”।
“কোথায়?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“গ্র্যাজুয়েট হাউজে। কিছুটা সামাজিকও হতে হয়,
বুঝলে গুড বয়?”
আমার
প্রতি জিনেটের হঠাৎ এরকম আন্তরিকতার কারণ কী জানি না। তবে ভালো লাগলো খুব। তার
সাথে গিয়ে হাজির হলাম গ্র্যাজুয়েট হাউজের সামাজিক আসরে। গ্র্যাজুয়েট হাউজের পেছন
দিকে যে একটা বার আছে আমি তা জানতামও না। জিনেটকে অনুসরণ করে ‘গ্র্যাজুয়েট বার’-এ ঢুকে দেখি ডিপার্টমেন্টের অনেকেই সেখানে। বীয়ার মদ কোক
যার যা খুশি খাচ্ছে। ক্যামেরুন পরিচয় করিয়ে দিলো তার গার্লফ্রেন্ড অ্যানের
সাথে। ঝকঝকে সুন্দর হাসিখুশি অ্যান ক্যামেরুনের চেয়ে কমপক্ষে চার ইঞ্চি লম্বা।
একটু
পরে ভীড়ের মধ্য থেকে সুদর্শন এক যুবক এসে জিনেটের
সামনে দাঁড়ালো, আর পর মুহূর্তেই দেখা গেলো জিনেট যুবকটির ঠোঁট কামড়ে ধরেছে।
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরালাম। কিছুক্ষণ পর কাঁধে ঝাঁকুনি খেয়ে
ফিরে তাকালাম। জিনেট বলছে, “প্রাডিব,
দিস ইজ মাইকেল, মাই বয়ফ্রেন্ড। এন্ড মাইক- দিস ইজ প্রাডিব”। শক্ত হাতে আমার হাত ঝাঁকিয়ে দিলো মাইকেল। জিনেটের সাথে
বেশ মানিয়েছে মাইকেল-কে। কিছুক্ষণ কথা হলো মাইকেলের সাথে। সে মেকানিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ার। এখন চাকরি করছে। বেশ ভালো লাগলো মাইকেলকে। হঠাৎ মনে হলো ব্লন্ড জিনেট
আর রেড-হেড মাইকেলের সন্তানদের ব্লন্ড হবার সম্ভাবনা শতকরা কত?
বিলিয়ার্ড
টেবিলের কাছে আসতেই “হাই প্রাডিব” বলে এগিয়ে এলো নিকোল। সে যে আমার নাম জানে তা আমি
জানতাম না। পার্টিক্যাল থিওরির উজ্জ্বল ছাত্রী নিকোল বেল। শিক্ষাজীবনের প্রত্যেক
স্তরেই স্কলারশিপ পাওয়া নিকোল যে তুখোড় বিলিয়ার্ড প্লেয়ার তা চোখের সামনেই দেখলাম।
জীবনে প্রথম বিলিয়ার্ড খেললাম আজ। নিকোল আর জিনেট দেখিয়ে দিলো কীভাবে খেলতে হয়। নিয়ম-কানুনও
কিছু কিছু শিখে ফেললাম। গো-হারা হেরেও আনন্দ পেলাম খুব। পৌনে আটটার দিকে সবাই
বেরিয়ে চলে এলাম লেবি থিয়েটারে।
আটটায় লেবি থিয়েটারে ফিজিক্স পাবলিক লেকচার। আজকের
বক্তা এসোসিয়েট প্রফেসর রে ভল্কাস। বিষয়ঃ “Neutrino: the Cosmic
messenger of the Earth, the Sun, and the Universe.” রে ভল্কাস পার্টিক্যাল
থিওরি গ্রুপের সবচেয়ে কম বয়সী প্রফেসর। আমাদের ফ্লোরেই ৬১৫নং রুমে তাঁর অফিস।
শিক্ষার্থীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় প্রফেসর ভল্কাস। নিকোল তাঁর কাছেই পি-এইচ-ডি
করছে।
আজও দারুণ মুগ্ধতায় কেটে গেলো নব্বই
মিনিট। প্রফেসর ভল্কাস কত সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিলেন পার্টিক্যাল ফিজিক্সের কত জটিল
জটিল জিনিস। প্রায় নগণ্য ভরের চার্জ-নিরপেক্ষ মৌলিক কণা নিউট্রিনো- প্রতি সেকেন্ডে
কয়েক কোটি হারে আমাদের শরীরের একদিকে ঢুকে অন্যদিকে বেরিয়ে যাচ্ছে কোন ধরনের
ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ছাড়াই। ভর এতো কম এবং কোন ধরণের বৈদ্যুতিক চার্জ না থাকাতে কঠিন
জটিল ফাঁদ পেতেও যাদের ধরা যায় না- সেই জটিল নিউট্রিনোর গণিত আরো জটিল। অথচ এগুলো
না বুঝলে পারমাণবিক স্তরের তত্ত্বগুলো সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। গাণিতিক বাধার কারণে
পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য অনেকের কাছেই অধরা থেকে যায়। প্রফেসর ভল্কাসের বক্তৃতা
আজ এই অধরাকে ধরতে সাহায্য করেছে অনেকখানি। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার যে সামাজিক
দায়িত্ব বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের থাকে তার কতটুকু আমরা পালন করি?
রাত এগারোটার দিকে ফোন-কার্ড সাথে
নিয়ে বেরোলাম ঘর থেকে। মাসের প্রথম শুক্রবার ফোন করার দিন। আমাদের সামনের বিল্ডিং
এর নিচে একটা পাবলিক ফোনবুথ আছে। সেখান থেকে ফোন করলাম দিদিভাইর বাসায়। দিদিরাও
এসেছে ওখানে। দশ ডলারের কার্ডে মাত্র ছয় মিনিট। সবার সাথে ‘কেমন আছিস?’ ‘ভালো আছি’ বলতে বলতেই
সময় শেষ। শুধুমাত্র ওটুকুর জন্যই আবার এক মাসের অপেক্ষা। সীমিত সামর্থ্যের মানুষ
আমরা। আমাদের ইচ্ছেঘুড়ির সুতো যে কত শক্ত করে টেনে বেঁধে রাখতে হয়!
No comments:
Post a Comment