সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরটি বেশ প্রাণবন্ত।
মিলেইভারও বেশ ভালো লাগছে। আইনস্টাইন অফিস টাইমে মন দিয়ে প্যাটেন্ট অফিসের কাজ
করেন। অফিস শেষে মেতে ওঠেন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়। বাড়িতে তিন বন্ধুর সাথে মিলে
একটা একাডেমি খুলেছেন - নাম দিয়েছেন অলিম্পিক একাডেমি। মিলেইভা হলেন একাডেমির
চতুর্থ সদস্য। সলোভাইন, হ্যাবিশ্ট আর আইনস্টাইন মিলে যখন গভীর আলোচনা চলে মিলেইভা
চুপ করে শোনেন।
এক
সময়ের তুখোড় ছাত্রী মিলেইভা পরপর দু’বার চেষ্টা করেও
পাস করতে না পেরে নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিয়েছেন জ্ঞানবিজ্ঞানের জগৎ থেকে। তার
স্বতন্ত্র ব্যক্তিস্বত্বার মৃত্যু ঘটেছে। স্বামীকে আঁকড়ে ধরেই তিনি এখন বাঁচার
স্বপ্ন দেখছেন। একদা স্বপ্ন দেখেছিলেন মেরি কুরির মত হবেন। পলিটেকনিকে পড়ার সময়
আইনস্টাইন যখন মিলেইভার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন ভাবনার কথা আলোচনা করতেন -
মিলেইভা স্বপ্ন দেখতেন আইনস্টাইনের সাথেই তিনি এগিয়ে যাবেন বিজ্ঞান সাধনায় যেমন
মেরি ও পিয়ের কুরি।
কিন্তু
সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে কত আগে। এখন তো তিনি বোঝেনও না আইনস্টাইন কী নিয়ে গবেষণা
করছেন। আইনস্টাইন এখন একান্তভাবেই তার, কিন্তু সম্পূর্ণ তার কি? মিলেইভা বুঝতে
পারেন আইনস্টাইনের ভাবনার বেশির ভাগ জুড়েই এখন বিজ্ঞান। সেখানে মিলেইভার জন্য
কতটুকুই বা সময় আছে তার জনির?
প্যাটেন্ট
অফিসের কাজে কোন রকম নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছেন না আইনস্টাইন। একটা একাডেমিক চাকরি
পেলে গবেষণায় পুরো সময় দিতে পারতেন। কিন্তু কীভাবে হবে? এখনো তো পিএইচডি-টাও করা
হলো না। এদিকে বিয়ে করেছেন ছয় মাস হয়ে গেলো অথচ হানিমুনে যাওয়া হলো না। অবশেষে
মিলেইভার পীড়াপীড়িতে লেক জেনেভায় গিয়ে কিছুদিন ঘুরে এলেন দু’জনে। সেখান থেকে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যে তাঁর
অলিম্পিক একাডেমি বন্ধ হয়ে গেল। কারণ তাঁর দু’বন্ধুই চাকরি নিয়ে চলে গেছেন অন্য শহরে।
১৯০৪ সালের ১৪ই মে আইনস্টাইন ও মিলেইভার প্রথম পুত্র
হ্যান্সের জন্ম হয়। আইনস্টাইন কিছুটা ঘরমুখী হবার চেষ্টা করছেন। ঘরের কাজে
মিলেইভাকে সাহায্য করারও চেষ্টা করেন। অফিস থেকে ফিরে বাচ্চা কোলে কাগজ-কলম নিয়ে
বসেন। একসময় দেখা যায় ছোট্ট হ্যান্স তাঁর কোলে বসে চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে, আর
আইনস্টাইন গভীর চিন্তায় মগ্ন।
পরের
এক বছরের মধ্যেই আইনস্টাইন প্রকাশ করে ফেললেন চারটি বিখ্যাত গবেষণাপত্র যেগুলোর
জন্য পৃথিবীর পুরো পদার্থবিজ্ঞানই বদলে যেতে বাধ্য হলো। আইনস্টাইন ফটো-ইলেকট্রিক
ইফেক্ট, ব্রাউনিয়ান মোশান, স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করলেন ১৯০৫ সালে।
আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc2 এর জন্ম হলো এবছর। একই বছরে তিনি তাঁর পি-এইচ-ডি
ডিগ্রিটাও পেয়ে গেলেন জুরিখ ইউনিভার্সিটি থেকে।
দ্রুত
বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন আইনস্টাইন। যতই বিখ্যাত হচ্ছেন ততই ব্যস্ত হচ্ছেন। অফিস থেকে
ফিরেই গবেষণা নিয়ে বসে পড়েন। ঘরে যে স্ত্রী আর শিশুপুত্র আছে তাদের কথা মনেই থাকে
না আইনস্টাইনের। এ নিয়ে মিলেইভার ক্ষোভের শেষ নেই। তার মনে হচ্ছে খ্যাতির সাথে
সাথে কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছেন আইনস্টাইন।
১৯০৯
সালে প্যাটেন্ট অফিসের চাকরি ছেড়ে জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর
হিসেবে যোগ দিলেন আইনস্টাইন। সংবাদপত্রে বেশ ফলাও করে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রফেসর
হওয়ার খবর। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের খ্যাতির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপের
বিজ্ঞান-সমাজে।
অক্টোবর
মাসে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বার্ন থেকে জুরিখে চলে এলেন আইনস্টাইন। জুরিখে তখন
নির্মাণ শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বাসা পাওয়া খুব মুশকিল। কোনরকমে একটা ছোট বাসা
জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে। মিলেইভা বার্ন ছেড়ে আসতে চাননি। আইনস্টাইনের খ্যাতি ও যশ
যত বাড়ছে মিলেইভার আত্মবিশ্বাস ততই কমছে। তিনি দেখছেন আইনস্টাইন দিন দিন বহির্মুখী
হয়ে যাচ্ছেন।
ইউরোপের
মেয়েদের মধ্যে আইনস্টাইনের ভক্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পার্টিতে আইনস্টাইন থাকলে
প্রায় সব মেয়েদেরই নজর থাকে তাঁর প্রতি। আইনস্টাইনও পছন্দ করেন মেয়েদের সঙ্গ। এসব
দেখে মিলেইভার মাথা ঠিক থাকে না। ঈর্ষায় রাগে জ্বলতে থাকেন তিনি। নিজেকে খুবই
অপমানিত ও অবহেলিত মনে হয় তাঁর।
আইনস্টাইনের
প্রফেসর হওয়ার খবর পেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখছেন অনেকেই। তার মধ্যে
বিশেষ একটা চিঠি - অ্যানা স্মিডের। আইনস্টাইনের মনে পড়লো এই সেই অ্যানা স্মিড যার
খাতায় কবিতা লিখে দিয়েছিলেন তিনি অনেকদিন আগে। সেদিনের সপ্তাদশী অ্যানা এখন আটাশ
বছরের যুবতী। জর্জ মেয়ার নামে এক উকিলের সাথে বিয়ে হয়ে অ্যানা স্মিড এখন অ্যানা
মেয়ার। ভীষণ খুশি হয়ে অ্যানার চিঠির উত্তর দিলেন আইনস্টাইন। লিখলেন একবার যেন
জুরিখে এসে দেখা করে যায়। আইনস্টাইনের
চিঠি পেয়ে অ্যানা তো ভীষণ খুশি। দেখা করার পরিকল্পনা করে অ্যানা চিঠি লিখলেন
আইনস্টাইনকে। কিন্তু সে চিঠি পড়লো মিলেইভার হাতে। চিঠি পড়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল
মিলেইভার। তিনি রাগের মাথায় চিঠি লিখলেন অ্যানার স্বামীকে। লিখলেন স্ত্রীকে যেন
সামলে রাখেন। অ্যানার স্বামী উকিল মানুষ। আইনস্টাইনকে জানালেন সব।
এবার
আইনস্টাইন রেগে গেলেন মিলেইভার ওপর। মিলেইভাও ছেড়ে কথা বলার মানুষ নন। অ্যানার
সাথে আইনস্টাইনের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। আইনস্টাইন কোন রকমে শান্ত
করলেন মিলেইভাকে। মিলেইভা আবার গর্ভবতী হলেন। ১৯১০ সালের ২৮শে জুলাই তাঁদের
দ্বিতীয় পুত্র এডোয়ার্ডের জন্ম হয়।
বিভিন্ন
ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপনার অফার আসছে আইনস্টাইনের। ১৯১১ সালে জার্মান
ইউনিভার্সিটি অব প্রাগের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের পরিচালক পদে যোগ
দিলেন আইনস্টাইন। এই নতুন পদের জন্য তিনি প্রায় দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছেন। ফলে সংসারে
বেশ সাচ্ছন্দ্য এলো। অভিজাত এলাকায় বেশ বড় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলেন
আইনস্টাইন।
কিন্তু
মনে সুখ নেই মিলেইভার। প্রাগের অভিজাত সমাজের মানুষের নাকউঁচু স্বভাব পছন্দ নয়
মিলেইভার। জার্মান ছাড়া অন্য কোন জাতিকে মানুষ বলেই মনে করে না প্রাগের উঁচুতলার
মানুষেরা। একটি গভীর অবসাদ সারাক্ষণ ঘিরে থাকে মিলেইভাকে।
১৯১২
সালের জুলাইতে জুরিখের ফেডারেল পলিটেকনিকে ফিজিক্সের প্রফেসর পদে যোগ দেন
আইনস্টাইন। এখানে পড়ার সময়েই মিলেইভার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। প্রাগ থেকে
সপরিবারে ফিরে এলেন নিজের অনেক স্মৃতিবিজড়িত শহর জুরিখে। জুরিখে ফিরে এসে মিলেইভা
কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। প্রাগের পরিবেশ সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু
জুরিখে এসে আইনস্টাইন আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। পুরনো সব বন্ধুদের সাথে নতুন করে আলাপ
জমছে, নতুন নতুন বন্ধু জুটছে। অধ্যাপনা, গবেষণা আর আড্ডায় ঘরের বাইরেই বেশি সময়
কাটে আইনস্টাইনের।
জুরিখে
ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই মিলেইভার পায়ের পুরনো ব্যথাটা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেলো।
তিনি প্রায় হাঁটতেই পারছেন না। কিন্তু আইনস্টাইনের সময় নেই তাঁর দিকে তাকানোর।
শরীরের কষ্ট আর মনের কষ্ট নিয়ে দুটো ছোট ছোট ছেলেকে সামলাতে সামলাতেই সময় কেটে যায়
মিলেইভার।
পরের
বছর মে মাসের শেষের দিকে প্যারিসে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা করতে যান আইনস্টাইন।
সেখানে আইনস্টাইনের সাথে মেরি কুরির দেখা হবার সম্ভাবনা আছে জেনে মিলেইভা এক
প্রকার জোর করেই আইনস্টাইনের সাথে প্যারিসে গেলেন।
প্যারিসে
মেরি কুরি তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান আইনস্টাইন ও মিলেইভাকে। চোখের সামনে তাঁর আইডল
মাদাম কুরিকে দেখে কী যে ভাল লাগছিল মিলেইভার, আবার একই সময়ে এটাও মনে হচ্ছিল যে
তাঁর স্বপ্নের কেন মৃত্যু হলো এভাবে? মেরি কুরি স্বামীকে হারিয়ে একাই দুই মেয়েকে
মানুষ করার পাশাপাশি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট চালাচ্ছেন, সরবোন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা
করছেন, আর মিলেইভা? আফসোস হচ্ছে - কেন নিজের লেখাপড়াটা শেষ না করে নিজেকে জড়াতে
গেলেন আইনস্টাইনের সাথে। তবে কি ভাগ্য বলে কোন কিছু আছে?
শরীর
ও মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে গেলে অনেক মানুষ অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ে, ধর্মের দিকেও
ঝুঁকে পড়ে। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মিলেইভাও কিছুটা ধর্মের দিকে ঝুঁকে
পড়লেন। সেবছর সেপ্টেম্বর মাসে ছেলেদের নিয়ে হাঙ্গেরিতে গেলেন মিলেইভা তাঁর
মা-বাবার সাথে দেখা করতে। সেখানে স্থানীয় সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চে গিয়ে ছেলেদের
ব্যাপ্টাইজড করালেন। আইনস্টাইন এসবে বিশ্বাস করেন না, তাই তিনি যাননি।
১৯১৩ সালের নভেম্বরে প্রুসিয়ান
একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হলেন আইনস্টাইন। বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে চালু
হচ্ছে কাইজার উইলহেল্ম ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স। আইনস্টাইনকে এই ইনস্টিটিউটের
পরিচালক পদে যোগদানের অফার নিয়ে জুরিখে এসে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করলেন বিখ্যাত
পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক ও ওয়ালথার নার্নস্ট। বেতন অফার করা হচ্ছে এখন যা
পাচ্ছেন তার দ্বিগুণেরও বেশি। এমন সুযোগ প্রত্যাখ্যান করার মত বোকা আইনস্টাইন নন।
জুরিখ
ছেড়ে বার্লিনে যেতে চাচ্ছেন না মিলেইভা। আইনস্টাইন তাকে বোঝালেন ফিজিক্সের বাঘা
বাঘা সব বিজ্ঞানী প্ল্যাঙ্ক, বিন, নার্নস্ট, সামারফেল্ড সবাই এখন বার্লিনে। এসময়
বার্লিনে থাকলে তাঁর গবেষণার কত সুবিধে হয়। কেবল একটি অন্যরকম সুবিধের কথা কিছুতেই
জানতে দিলেন না আইনস্টাইন তা হলো এলসার সাথে দেখা করার সুবিধা।
এলসা
আইনস্টাইনের আপন মাসতুতো দিদি। তার চেয়ে তিন বছরের বড়। বিয়ে হয়েছিল ম্যাক্স
লোয়েনথালের সাথে। কিন্তু বছর দুয়েক আগে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে এখন মা-বাবার সাথে
থাকেন বার্লিনে। বছর দুয়েক আগে আইনস্টাইন যখন তাঁর মায়ের সাথে দেখা করতে যান তখন
দেখা হয়েছিল এলসার সাথে।
ফুটফুটে
দুই মেয়ে এলসার - তেরো বছরের আইল্স ও এগারো বছরের মার্গট। কিন্তু নীলনয়না ঝকঝকে
স্মার্ট এলসাকে দেখে মনেই হয়না যে তার এত বড় দুটো মেয়ে আছে। আইনস্টাইনের উন্নতি ও
খ্যাতির খবর এলসা খুব ভালোভাবেই রাখেন। এত বছর পর আইনস্টাইনকে দেখে গভীরভাবে জড়িয়ে
ধরেছিলেন এলসা। আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছেন এই আলিঙ্গনে দিদির স্নেহ ছিল না - ছিল
অন্যকিছু। তারপর থেকে গত দু’বছর অনেক
চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে আইনস্টাইন ও এলসার মধ্যে মিলেইভার অজান্তে।
১৯১৪
সালে বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে কাজ শুরু করলেন আইনস্টাইন। বার্লিনে বাসা নিয়েছেন
এলসাদের বাড়ির খুব কাছে। এলসার সাথে নিয়মিতই দেখা হচ্ছে আইনস্টাইনের। তাদের
সম্পর্কটা আর গোপন নেই মিলেইভার কাছে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে আইনস্টাইন ও এলসাকে
জড়িয়ে নানারকম স্ক্যান্ডাল এখন নিয়মিত ঘটনা।
মিলেইভা
বুঝতে পারছেন আইনস্টাইনের সাথে তার সম্পর্ক ভেতরে ভেতরে মরে গেছে। এরকম একটি
মৃত-সম্পর্ককে বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না। আইনস্টাইনকে এলসার ব্যাপারে কিছু
জিজ্ঞেস করতে রুচিতে বাধে মিলেইভার। কিন্তু অন্য কোন ব্যাপারেও খুব সামান্যতেই
ঝগড়া লেগে যায় দু’জনের মধ্যে।
আর
আইনস্টাইন যেন এটাই চান। তিনি যে কোন অজুহাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলসাদের বাড়িতে চলে
যান। মিলেইভাকে আর ভালো লাগছে না তাঁর। আইনস্টাইনের মনে হচ্ছে এলসা ছাড়া আর কেউ
তাকে ঠিকমত বুঝতে পারে না। এলসার কাছে মিলেইভার নামে যা খুশি বলেন। একদিন বললেন, “মিলেইভা হলো আমার এমন এক কর্মচারি যাকে ইচ্ছে
করলেও ছাঁটাই করতে পারছি না।”
বার্লিনে মিলেইভার তেমন কোন বন্ধু নেই। আইনস্টাইনের
বস ফ্রিট্জ হ্যাবারের স্ত্রী ক্ল্যারা মিলেইভাকে বেশ স্নেহ করেন। মিলেইভার সাথে আইনস্টাইন
যে ব্যবহার করছেন তাতে তিনি বিরক্ত। একদিন আইনস্টাইনের ব্যবহারে প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে
ছেলে দুটোকে নিয়ে ক্ল্যারার কাছে চলে গেলেন মিলেইভা।
হ্যাবার দম্পতি আইনস্টাইনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
তাঁরা চাচ্ছেন না আইনস্টাইন ও মিলেইভার বিয়েটা ভেঙে যাক। কিন্তু মিটমাটের চেষ্টা
করতেই আইনস্টাইন মিলেইভার জন্য লম্বা এক ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ তৈরি করলেন। মিলেইভা আইনস্টাইনের
শর্তগুলো পড়ে দেখলেন। ওগুলো মেনে নিলে তাঁকে আইনস্টাইনের ক্রীতদাসী হয়ে যেতে হয়।
এত্তো অপমান তিনি কীভাবে সহ্য করবেন?
মিলেইভা
সহ্যের শেষ সীমানায় চলে গেছেন। জুলাই মাসের শেষে তাঁর ছেলেদের নিয়ে তিনি জুরিখে
চলে গেলেন। আইনস্টাইনের সাথে সেপারেশান চুক্তি অনুসারে বছরে ৫,৬০০ মার্ক তিনি
পাচ্ছেন আইনস্টাইনের কাছ থেকে ছেলেদের ভরণ-পোষণ বাবদ। এদিকে বার্লিনের খালি বাড়িতে
এলসার সাথে ভালোবাসায় এখন আর কোন রাখঢাক নেই আইনস্টাইনের। এভাবে কেটে গেলো আরো দু’বছর।
১৯১৬
সালে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মিলেইভা তাঁর ছেলেদের নিয়ে সুইজারল্যান্ডে
আছেন। সুইজারল্যান্ড নিরপেক্ষ যুদ্ধমুক্ত দেশ। আইনস্টাইন ছেলেদের ব্যাপারে কিছুটা
নিশ্চিন্ত আছেন সেজন্য। কিন্তু মিলেইভার কাছ থেকে তিনি এখনো ডিভোর্স পাচ্ছেন না।
ডিভোর্সের কথা তুললেই মিলেইভা রেগে যান। মিলেইভা জানেন আইনস্টাইনের সাথে তাঁর সম্পর্ক মরে গেছে। কিন্তু ডিভোর্স দিলেই আইনস্টাইন
এলসাকে বিয়ে করে ফেলবে। এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
আইনস্টাইন
জুরিখে ছেলেদের সাথে দেখা করতে গিয়ে আবারো ডিভোর্সের প্রসঙ্গ তুললেন। মিলেইভা
আবারো রেগে গেলেন। আইনস্টাইন ছোট ছেলে এডোয়ার্ডের ব্যাপারে কিছুটা চিন্তিত।
ছেলেটার শরীর ভালো নেই। কিন্তু মানসিক গড়নটা অস্বাভাবিক। বয়সের তুলনায় সে অনেক বেশি
মেধাবী। তিন বছর বয়সেই সে সংবাদপত্র পড়তে শুরু করেছে। ফটোগ্রাফিক মেমোরি তার। পাঁচ
বছর বয়স থেকেই সে পিয়ানো বাজাতে শুরু করেছে একেবারে পেশাগত দক্ষতায়।
আইনস্টাইন
চিন্তিত মনে ফিরে গেলেন বার্লিনে। এদিকে মিলেইভা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাত্র
একচল্লিশ বছর বয়সেই মিলেইভাকে দেখতে ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধা মহিলার মত দুর্বল আর
জরাজীর্ণ মনে হয়। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো মিলেইভাকে।
আইনস্টাইন
মিলেইভার অসুস্থতার খবর পেয়েও দেখতে এলেন না। মিলেইভার দেখাশোনার জন্য এগিয়ে এলেন
আইনস্টাইনের বন্ধু মাইকেল বেসো। মাইকেল বেসোর স্ত্রী অ্যানা হলেন আইনস্টাইনের
প্রথম প্রেমিকা মেরির দিদি। আইনস্টাইনের ওপর স্বাভাবিক ভাবেই বিরক্ত অ্যানা। এদিকে
অ্যানা ও মেরির দাদা পলের সাথে বিয়ে হয়েছে আইনস্টাইনের ছোটবোন মায়ার। মায়াও এখন
আইনস্টাইনের আচরণে ভীষণ বিরক্ত।
১৯১৭
সালের শুরুতে পাকস্থলীর সমস্যায় ভুগতে ভুগতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন আইনস্টাইন। দু’মাসের মধ্যে প্রায় পঁচিশ কেজি ওজন কমে যায় তাঁর।
এসময় এলসা তাঁর সেবাযত্ন করার জন্য তাঁর বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করেন।
এদিকে মিলেইভা ও এডোয়ার্ডও অসুস্থ হয়ে জুরিখের হাসপাতালে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে শুয়ে মিলেইভা ভেবে দেখলেন আইনস্টাইনকে ডিভোর্স না দিলে তার তো কোন লাভ হচ্ছে না। এলসার সাথে বিয়ে না হলেও তো তাদের এক সাথে থাকতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তিনি ঠিক করলেন এবার ডিভোর্স দিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর ছেলেদের কী হবে? ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি একটা শর্ত ঠিক করলেন।
No comments:
Post a Comment