১৯১১
জানুয়ারির শুরুতে আইনস্টাইন জানতে পারলেন যে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান
সাম্রাজ্যের সম্রাট ফ্র্যাঞ্জ জোসেফ তাঁকে প্রাগের জার্মান ইউনিভার্সিটির তত্ত্বীয়
পদার্থবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এপ্রিল থেকেই
এ নিয়োগ কার্যকরী হবে। শুধু তাই নয়, আইনস্টাইন হবেন ইনিস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল
ফিজিক্সের ডিরেক্টর। খুবই সম্মানজনক এ পদের জন্য মনোনীত হয়ে আইনস্টাইন তো দারুণ
খুশি।তাঁকে যে বেতন দেয়া হবে তা জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে তাঁর বর্তমান বেতনের প্রায়
দ্বিগুণ। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে আইনস্টাইন জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে পদত্যাগপত্র জমা
দেন। মার্চের শেষের
দিকে আইনস্টাইন সপরিবারে প্রাগে গিয়ে পৌঁছান।
আইনস্টাইনের বর্তমান বেতনে বেশ সাচ্ছল্য এলো সংসারে। অভিজাত এলাকায়
বেশ বড় একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া করলেন আইনস্টাইন। এতবড় বাড়ি, প্রচুর
আসবাবপত্র সহ নানারকম সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পরও মিলেইভার মনে সুখ নেই। প্রাগের অভিজাত
সমাজের মানুষের নাকউঁচু স্বভাব পছন্দ নয় মিলেইভার। জার্মান ছাড়া
অন্যকোন জাতিকে মানুষ বলেই মনে করে না প্রাগের উঁচুতলার মানুষ। একটি গভীর অবসাদ
সারাক্ষণ ঘিরে থাকে মিলেইভাকে। আইনস্টাইন নামেযশে অর্থবিত্তে যতই প্রসিদ্ধ হতে লাগলেন, তাঁর
ঘরের হাওয়া ততই গুমোট হতে শুরু করলো। আইনস্টাইন ও মিলেইভা যেন
দুজন দুজগতের বাসিন্দা এখন।
বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে আইনস্টাইনের চাকরির অফার আসছে তো আসছেই। এখন সবাই আইনস্টাইনকে
নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে চায়। জুরিখের সুইস ফেডারেল পলিটেকনিকের চাকরির প্রস্তাব বিবেচনা
করে দেখছেন আইনস্টাইন। এই পলিটেকনিক থেকেই পাস করেছেন আইনস্টাইন। পদার্থবিজ্ঞান
কোর্সের জন্য ইউরোপে একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে আছে এই ইনিস্টিটিউট। তাছাড়া এখানের
চাকরিটি নেবার জন্য আইনস্টাইনকে সুপারিশ করেছেন স্বয়ং মেরি কুরি এবং গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের
আরেক দিকপাল হেনরি পয়েনকেয়ার।
আইনস্টাইনের বন্ধু মার্সেল গ্রোসম্যান এখন পলিটেকনিকের ডিন। আইনস্টাইনের জন্য এটাও একটি প্লাস পয়েন্ট।
আইনস্টাইনের বন্ধু মার্সেল গ্রোসম্যান এখন পলিটেকনিকের ডিন। আইনস্টাইনের জন্য এটাও একটি প্লাস পয়েন্ট।
এবছর হঠাৎ পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলেন আইনস্টাইন। পরে জীবনের বিভিন্ন
পর্যায়ে পেটের ব্যথায় কষ্ট পেয়েছেন আইনস্টাইন। শত ব্যস্ততার
মধ্যেও শহরের একটি বিশেষ অভিজাত রেস্তোরায় নিয়মিত যান আইনস্টাইন। বের্তা ও অটো
ফ্যান্টা
(Berta and Otto Fanta) এ রেস্তোরার মালিক। এর চল্লিশ বছর
পর তাঁদের ভাইঝি জোয়ানার সাথে খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে আইনস্টাইনের। নিয়মিত আড্ডা
জমে এই রেস্তোরায়। শহরের উহুদি বুদ্ধিজীবীরা এখানে এসে প্রাত্যাহিক বিজ্ঞান
ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করে ঘন্টার পর ঘন্টা। বার্নের মত এখানেও আড্ডা
জমে আইনস্টাইনের।
নভেম্বর মাসে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হয় ইউরোপের সব বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের সম্মেলন
‘প্রথম সলভে কংগ্রেস
(First
Solvay Congress)বিশিষ্ট শিল্পপতি আর্নেস্ট সলভে(Ernst Solvay) এই
সম্মেলনের ব্যয়ভার বহন করেন। আইনস্টাইন এ কংগ্রেসে বক্তৃতা দেন। এ কংগ্রেসে উপস্থিত
ছিলেন মেরি কুরি, পল ল্যানগেভিন, হেনড্রিক লরেঞ্জ,
জিন পেরিন, ম্যাক্স প্ল্যাংক, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। প্রথম সলভে কংগ্রেসকে এখনো
পদার্থবিজ্ঞানের মহারাজাদের সম্মেলন হিসেবে ধরা হয়। আইনস্টাইন ছিলেন
সম্মেলনের সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী। এখানেই আইনস্টাইন মেরি কুরির সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হন।
এবছর আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের খসড়া তৈরি করেন। মাধ্যাকর্ষণের
কারণে আলোর গতির কী পরিবর্তন ঘটে- তার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে আইনস্টাইনের
জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য পাঁচটি গবেষণাপত্রঃ
পেপারঃ৩০ “A Relationship between Elastic Behavior and Specific
Heat in Solids with a Monatomic Molecule.”Annalen der Physik,সংখ্যা ৩৪ (১৯১১), পৃষ্ঠাঃ১৭০-১৭৪। উইলিয়াম সাদারল্যান্ড
(William Sutherland)পর্যবেক্ষণ করেন যে কঠিন পদার্থের ভেতর সবসময় একধরণের কম্পন অনুভূত হয়। খালিচোখে এ কম্পন
দেখা যায় না। ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত রশ্মিতে এ কম্পন ধরা পড়ে। সাদারল্যান্ড
মনে করেন পদার্থের স্থিতিস্থাপক কম্পন বা ইলাস্টিক ভাইব্রেশানের ফলেই এধরণের অপটিক্যাল
ভাইব্রেশান বা আলোক-কম্পন তৈরি হয়। আইনস্টাইন এ
পেপারে সাদারল্যান্ডের ধারণার কিছুটা পরিবর্তন করেন। আইনস্টাইনের
মতে অপটিক্যাল ভাইব্রেশান তৈরি হয় পরমাণুর বৈদ্যুতিক চার্জের কারণে, আর ইলাস্টিক
ভাইব্রেশান তৈরি হয় অণুগুলোর পারস্পরিক গতির কারণে।
পেপারঃ৩১ “The Theory of
Relativity.”Naturforschende
Gesellschaft in Zurich.Vierteljahrsschriftসংখ্যা ৫৬ (১৯১১), পৃষ্ঠাঃ১-১৪। জানুয়ারিতে জুরিখ
ইউনিভার্সিটিতে বিদায়ী বক্তৃতা দেন আইনস্টাইন। এই পেপারটি হলো
সেই বক্তৃতার লিখিতরূপ। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে এরকম আরো কয়েকটি পেপার ইতোমধ্যেই
প্রকাশিত হয়েছে। এ পেপারটি ২৪ নম্বর পেপারের সরল সংস্করণ।
পেপারঃ৩২ “Elementary
Observations on Thermal Molecular Motion in Solids.”Annalen der Physik, সংখ্যা ৩৫ (১৯১১), পৃষ্ঠাঃ৬৭৯-৬৯৪। ১৯০৭ সালে কঠিন পদার্থের আপেক্ষিক তাপ সংক্রান্ত যে গবেষণা
শুরু করেছিলেন আইনস্টাইন, সে গবেষণার ধারাবাহিকতায় এ পেপারটি লিখেছেন তিনি। এ গবেষণাপত্রে
আইনস্টাইন পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে কঠিন পদার্থের আপেক্ষিক তাপের সমীকরণ
প্রতিষ্ঠা করেন। খুব কম তাপমাত্রায় আইনস্টাইনের সূত্র প্রয়োগে প্রাপ্ত আপেক্ষিক তাপের সাথে পরীক্ষালব্ধ
আপেক্ষিক তাপের পার্থক্য দেখা যায়। আইনস্টাইন এ পার্থক্যের কারণ সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেন
এই পেপারে।
পেপারঃ৩৩ “On the Influence of
Gravitation on the Propagation of Light.”Annalen der Physik, সংখ্যা ৩৫
(১৯১১), পৃষ্ঠাঃ৮৯৮-৯০৮। এ পেপারে আইনস্টাইন আলোর ওপর অভিকর্ষণ বলের প্রভাব নিয়ে আরো
বিস্তৃত আলোচনা করেন। আইনস্টাইন দাবী করেন যে, নির্দিষ্ট ত্বরণে গতিশীল
কোন রেফারেনস ফ্রেমে যদি আলোক রশ্মি বেঁকে যায়, তাহলে
(যদি তাঁর তত্ত্ব সঠিক হয়) অভিকর্ষণ বলের
প্রভাবেও আলোক রশ্মি ঠিক একই পরিমাণে বেঁকে যাবে। অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের
প্রভাবে আলোক রশ্মির বেঁকে যাওয়ার ধারণা তাঁর জেনারেল রিলেটিভিটির একটি প্রধান শর্ত।
পেপারঃ৩৪ “On the Present State
of the Problem of Specific Heats.”৩ নভেম্বর ১৯১১, ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত প্রথম সলভে কংগ্রেসে
আইনস্টাইন এ পেপারটি উপস্থাপন করেন। পরে ১৯১৪ সালে পেপারটি প্রকাশিত
হয়েছে আর্নল্ড ইউকেন(Arnold Eucken) সম্পাদিত Die Theorie der Strahlung und der
Quanten (Halle a.s.Knapp,1914) জার্নালের ৩৩০-৩৫২ পৃষ্ঠায়। আইনস্টাইন তাঁর
আপেক্ষিক তাপ ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিস্তারিত বিবরণ দেন এই প্রবন্ধে।
১৯১২
এবছর স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর একটি রিভিউ পেপার লেখার কাজ শুরু করেছিলেন
আইনস্টাইন। কাজটি শেষ করতে দুবছর লেগে যায়। কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
শুরু হয়ে যাবার ফলে সেটি প্রকাশের কাজ থেমে যায়। অনেক বছর পরে
পেপারটি প্রকাশের জন্য সম্পাদক আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু পেপারটি
নিয়ে আবার কাজ করার সময় হয়নি আইনস্টাইনের। তখন তিনি আরো বেশি ব্যস্ত
হয়ে পড়েছেন। (পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে আইনস্টাইনের রচনাবলীর(The Collected Papaers of
Albert Einstein) চতুর্থ খন্ডে।
জানুয়ারি মাসে জুরিখের ফেডারেল ইনিস্টিউট অব টেকনোলজি বা পলিটেকনিকের প্রফেসর
পদে আইনস্টাইনের নিয়োগ সম্পন্ন হয়। জুলাই থেকে পলিটেকনিকে চাকরি শুরু করেন আইনস্টাইন। জুলাই মাসে সপরিবারে
প্রাগ থেকে ফিরলেন নিজের ছাত্রজীবনের স্মৃতিবিজড়িত শহর জুরিখে। জুরিখে আসার
আগে আইনস্টাইন বার্লিনে গিয়েছিলেন তাঁর কাকা ও মাসীর সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে আবার
নতুন করে পরিচয় হয় মাসতুতো বোন এলসার(Elsa) সাথে। এলসার মা ফ্যানি
আইনস্টাইনের মাসী। এলসার বাবা রুডলফ আইনস্টাইনের কাকা। এই রুডলফ কাকাকে
পছন্দ করেন না আইনস্টাইন, কারণ এই ধনী কাকাটিকেই আইনস্টাইন তাঁর বাবার মৃত্যুর জন্য
দায়ী করেন কিছুটা। তবুও ছোটবেলায় আইনস্টাইনের সাথে বেশ ভাব ছিলো এলসার। এলসা আইনস্টাইনের
চেয়ে বয়সে তিন বছর বড়। ডির্ভোস হয়ে যাবার পর দুটি কন্যা সন্তান নিয়ে এলসা এখন তাঁর মাবাবার
সাথে বার্লিনে থাকেন। এলসার ফুটফুটে দুই মেয়ে; তের বছরের আইলস(Ilse)
ও এগারো বছরের মার্গট(Margot)। নীলনয়না ঝলমলে
স্মার্ট এলসাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন আইনস্টাইন। মনে মনে মিলেইভার
সাথে এলসার তুলনা করে মন খারাপ হয়ে গেলো আইনস্টাইনের। এলসার তুলনায়
মিলেইভা একেবারেই প্রাণহীন। প্রাগে ফিরে এসে এলসাকে চিঠি লিখলেন আইনস্টাইন। শুরু হলো এলসার
সাথে তাঁর গোপন প্রণয়। স্ত্রীপুত্রদের সাথে নিয়ে জুরিখে চলে আসার পরেও আইনস্টাইন
ও এলসার পত্রযোগাযোগ থেমে নেই।
জুরিখে এসে মিলেইভা কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। প্রাগের পরিবেশ
সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু আইনস্টাইনের ব্যাপারে মিলেইভা বুঝতে পেরেছেন, স্ত্রীপুত্রসংসার
আইনস্টাইনের কাছে অপ্রয়োজনীয়। জুরিখে এসে আইনস্টাইন আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুরনো সব বন্ধুদের
সাথে নতুন করে আলাপ জমছে, নতুন নতুন বন্ধু জুটছে। গবেষণা, অধ্যাপনা
ও আড্ডায় ঘরের বাইরেই বেশি সময় কাটে আইনস্টাইনের। মিলেইভার পায়ের
পুরনো ব্যথা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেলো এসময়। তিনি প্রায় হাঁটতেই পারেন
না এখন। কিন্তু আইনস্টাইনের সময় নেই মিলেইভার দিকে ফিরে তাকানোর। তিনি সময় পেলেই
বন্ধুদের আড্ডায় বেহালা বাজান, আর এলসাকে চিঠি লেখাতো আছেই।
বলকান রাজ্যগুলোতে প্রথম বলকান যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সার্বিয়াতেও
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। মিলেইভার মা-বাবা থাকেন সার্বিয়ার বেলগ্রেডে। মাবাবার জন্য
চিন্তায় অস্থির মিলেইভা, কিন্তু কাকে বোঝাবেন তিনি।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের চারটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্রঃ
পেপারঃ৩৫ “Thermodynamic Proof of the Law of Photochemical
Equivalence.”Annalen
der Physik,সংখ্যা ৩৭ (১৯১২), পৃষ্ঠাঃ ৮৩২-৮৩৮। এ পেপারে আইনস্টাইন
পদার্থের ওপর আলো পড়লে কী ধরণের বিক্রিয়া ঘটে তার বর্ণনা দেন। বিশেষ করে কী
ধরণের আলোক-রাসায়নিক(photochemical) পরিবর্তন দেখা যায়। এ পেপারে আইনস্টাইন
কোন ধরণের কোয়ান্টাম মতবাদ ব্যবহার করেননি। তিনি দেখিয়েছেন থার্মোডায়নামিক
সূত্র ব্যবহার করেও আলোক-রাসায়নিক সাম্যের সূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।
পেপারঃ৩৬ “The speed of Light and
the Statics of the Gravitational Field.” Annalen der Physik. সংখ্যা ৩৮
(১৯১২), পৃষ্ঠাঃ৩৫৫-৩৬৯। অভিকর্ষণের ওপর আরো বিস্তৃত গবেষণা করে আইনস্টাইন
দেখালেন যে অভিকর্ষজ ক্ষেত্রবল স্থান ও কালের সমস্যার সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত।
পেপারঃ৩৭ “On the
Theory of the Static Gravitational Field.”Annalen der
Physik, সংখ্যা ৩৮ (১৯১২), পৃষ্ঠাঃ৪৪৩-৪৫৮। ৩৬ নং গবেষণাপত্রে উল্লেহিত গতির
সমীকরণগুলোকে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন এ পেপারে। আইনস্টাইন এ সিদ্ধান্তে আসেন
সে আলোর বেগের ক্ষেত্র-সমীকরণ গুলো নিউটনের তৃতীয় সূত্র (ক্রিয়া= - প্রতিক্রিয়া)
মানে না। সুতরাং সেগুলোকে শুদ্ধ করা দরকার। এ পেপারে আইনস্টাইন আলোর বেগের
ক্ষেত্র-সমীকরণের পরিবর্তন করেন। প্রথমবারের মত জিওডেসিক্সের নিয়ম(Law of
geodesics) ব্যবহার করেন আইনস্টাইন। তাঁর অভিকর্ষণ তত্ত্বে জিওডেসিক্সের ভূমিকা
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পেপারঃ৩৮ “Is There a Gravitational
Field That Is Analogous to Electrodynamic Induction?”Vierteljahrsschrift
fur gerichtliche Medizin, সংখ্যা ৪৪ (১৯১২), পৃষ্ঠাঃ৩৭-৪০। জুরিখ ইউনিভার্সিটির
ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হেনরিখ ঝ্যাঙ্গার (Heinrich Zangger) ছিলেন
আইনস্টাইনের বন্ধু। ঝ্যাঙ্গারের উৎসাহে আইনস্টাইন এ পেপারটি প্রকাশ করেন ফরেনসিক
মেডিক্যাল জার্নালে। রিলেটিভিটির স্পেশাল থিওরি থেকে জেনারেল থিওরির দিকে অগ্রসর
হবার প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ পেপারে।
১৯১৩
মিলেইভার পায়ের ব্যথা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সাথে পাল্লা
দিয়ে বেড়ে চলেছে আইনস্টাইনের সাথে তাঁর দূরত্ব। আইনস্টাইন মিলেইভার
দিকে এখন একটুও নজর দিচ্ছেন না। তিনি তাঁর নতুন অভিকর্ষজ তত্ত্ব নিয়ে ব্যস্ত। এলসাকেও ভুলে
যাবার চেষ্টা করছেন আইনস্টাইন। গত নয়মাস কোন চিঠি লেখেননি তিনি এলসাকে। কিন্তু মার্চের
১৪ তারিখ আইনস্টাইনের জন্মদিনে কার্ড পাঠান এলসা। কার্ড পেয়ে আবার
চিঠি লিখতে শুরু করেন আইনস্টাইন।
মে মাসের শেষের দিকে প্যারিসের একটি কনফারেনসে বক্তৃতা দিতে যান আইনস্টাইন। দুবার নোবেল
বিজয়ী মেরি কুরি নিজের বাড়িতে আইনস্টাইন ও মিলেইভাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। মেরি কুরির বাড়িতে
বেশ ভালো সময় কাটে মিলেইভার। এর কিছুদিন পর মেরি কুরির সাথে সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ে বেড়াতে
যান আইনস্টাইন ও মিলেইভা। মেরি কুরির সাথে তাঁর দুই মেয়ে আইরিন ও ইভ কুরিও ছিলো। পায়ের জন্য মিলেইভার
পক্ষে পাহাড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তবুও তাঁর খুব ভালো লেগেছে তাঁর এক সময়ের ‘আদর্শ’ মেরি
কুরির কাছাকাছি আসতে পেরে।
সেপ্টেম্বরে মিলেইভা আইনস্টাইন ও ছেলেদের নিয়ে তাঁর মাবাবাকে দেখতে যান হাঙ্গেরিতে। শারীরিক ও মানসিকভাবে
বিধ্বস্ত মিলেইভা এখন কিছুটা ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। মানুষ দুর্বল
হয়ে গেলে হয়তো এরকমই হয়। মিলেইভার বিশেষ অনুরোধে হ্যান্স আলবার্ট ও এডোয়ার্ডকে ব্যাপ্টাইজড করা হলো একটি স্থানীয়
সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চে। আইনস্টাইন সংগঠিত ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি তাই ছেলেদের
ব্যাপ্টিজম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না।
এরপর তাঁরা ভিয়েনা গেলেন। সেখানে আইনস্টাইন তাঁর নতুন অভিকর্ষজ তত্ত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা
দিলেন। ভিয়েনার সংবাদপত্রগুলো আইনস্টাইনের নতুন তত্ত্ব নিয়ে বিরাট হৈ চৈ ফেলে দিলো। আইনস্টাইন সাধারণ
মানুষের কাছেও ক্রমশ বিরাট হয়ে উঠতে লাগলেন। মিলেইভা ভিয়েনা থেকে জুরিখের
বাড়িতে ফিরে গেলেন। কিন্তু আইনস্টাইন চলে গেলেন বার্লিনে। সেখানে কিছু
কাজ ছিলো তাঁর, কিন্তু তার চেয়েও বড় কাজ ছিলো এলসার সাথে গোপনে দেখা করা।
আইনস্টাইন তাঁর বন্ধু গণিতবিদ মার্সেল গ্রোসম্যানের সাথে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির
ওপর একটি বই প্রকাশ করেন এবছর। বইটির পদার্থবিজ্ঞানের অংশ রচনা করেন আইনস্টাইন, আর গণিতের
অংশ লেখেন গ্রোসম্যান।
নভেম্বরে আইনস্টাইন প্রুসিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হন। সাথে সাথে বার্লিন
ইউনিভার্সিটি থেকে রিসার্চ প্রফেসরের পদে অফার পান। খুব শীঘ্রই চালু
হতে চলেছে কাইজার উইলহেলম ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স। আইনস্টাইনকে
ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদ অফার করা হলো। অফারটি নিয়ে বার্লিন থেকে
জুরিখে এসেছেন ম্যাক্স প্ল্যাংক ও ওয়ালথার নার্নস্ট। তাঁরা আইনস্টাইনকে
ভাবার জন্য একটি দিন সময় দিলেন। পরের দিন আইনস্টাইনের সিদ্ধান্ত জানবেন বলে তাঁরা জুরিখের
প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে চলে গেলেন। আইনস্টাইন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা করে বললেন, কাল
আমার উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে কোটের পকেটে একটি লাল গোলাপ
গুঁজে যাবো। আর উত্তর যদি না হয়, তাহলে দেখবে সাদা গোলাপ।
তাঁর প্রতি জার্মানদের আগ্রহ দেখে কিছুটা অবাকই হচ্ছেন আইনস্টাইন। তিনি জার্মান
নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন। অথচ এখন জার্মানরা তাঁকে নিজেদের ইউনিভার্সিটিতে পাবার জন্য
বছরে ১২৯০০ মার্কস দিতে চাচ্ছে, জুরিখে এখন যা পাচ্ছেন তার চেয়ে এটা অনেক
বেশি। অফারটি গ্রহণ না করার কোন মানে হয়না। বার্লিনে ফিরতে পারলে আইনস্টাইনের
অনেকদিক থেকেই সুবিধা হবে। ফিজিক্সের বাঘা বাঘা গবেষক প্ল্যাঙ্ক, উইয়েন,
নার্নস্ট, সামারফেল্ড সবাই এখন বার্লিনে। তাছাড়া এলসাও
আছেন বার্লিনে। আইনস্টাইন জানেন, মিলেইভা বার্লিনে যেতে চাইবেন না। এলসার কথা নিশ্চয়ই
জানেন তিনি। কিন্তু মিলেইভার কথা চিন্তা করতে আর ভালো লাগে না আইনস্টাইনের। তিনি লাল গোলাপ
সংগ্রহ করলেন।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য পাঁচটি প্রকাশনাঃ
পেপারঃ৩৯ “Thermodynamic Deduction of the Law of Photochemical
Equivalence.”Journal
der physique,সংখ্যা ৩ (১৯১৩), পৃষ্ঠাঃ২৭৭-২৮২। মার্চে অনুষ্ঠিত
প্যারিসের পদার্থবিজ্ঞান সম্মেলনে আইনস্টাইনের বক্তৃতার প্রকাশিত রূপ এ পেপার। আইনস্টাইনের
৩৫ নম্বর পেপারে আলোচিত প্রসঙ্গই আবার আলোচিত হয়েছে এ পেপারে।
পেপারঃ৪০ “Outline of a Generalized Theory of Relativity and of a
Theory of Gravitation.”(সহলেখকঃমার্সেল গ্রোসম্যান)।প্রকাশকঃটিউবনার, লিপজিগ
(১৯১৩)। মার্সেল গ্রোসম্যানের সাথে লেখা এ বইতে আইনস্টাইন থিওরি অব
গ্র্যাভিটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন ও সেখান থেকে তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির
ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেন। স্থান ও কালের বক্রতার তত্ত্বও আলোচিত হয় এখানে। কার্ভড টাইম
বা বেঁকে যাওয়া সময়ের ধারণাটা সহজে বোঝা যায় না।
পেপারঃ৪১ “Physical Foundations of a Theory of Gravitaion.”Naturforschende
Gesellschaft in Zurich.Vierteljahrsschrift সংখ্যা ৫৮ (১৯১৩), পৃষ্ঠাঃ২৮৪-২৯০। সেপ্টেম্বর মাসের
নয় তারিখে সুইস সোসাইটি অব ন্যাচারাল সায়েন্টিস্টদের ৯৬তম বার্ষিক অধিবেশনে দেয়া আইনস্টাইনের
বক্তৃতার প্রকাশিত রূপ এই পেপার। এই বক্তৃতায় আইনস্টাইন তাঁড় অভিকর্ষণ তত্ত্বের একটি সুনির্দিষ্ট
ও পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেন। জটিল গাণিতিক বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্বের
মূলনীতিগুলো ব্যাখ্যা করেন।
পেপারঃ৪২ “On the Present State of the Problem of Gravitation.”Physikalische
Zeitschrift,সংখ্যা ১৪ (১৯১৩), পৃষ্ঠাঃ১২৪৯-১২৬২। সেপ্টেম্বর মাসের
২৩ তারিখে আইনস্টাইন ‘কংগ্রেস অব জার্মান ন্যাচারাল সায়েন্টিস্টস এন্ড ফিজিশিয়ানস’-এর ৮৫
তম বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। এই পেপারটি তাঁর বক্তৃতার
প্রকাশিত রূপ। এখানে আইনস্টাইন তাঁর অভিকর্ষজ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি গুনার নর্ডস্ট্রমের
স্কেলার থিওরি নিয়েও আলোচনা করেন। গুনার নর্ডস্ট্রম ছিলেন আইনস্টাইনের তত্ত্বের ঘোর বিরোধী। আইনস্টাইন এই
বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন যে, ভবিষ্যতে শুধুমাত্র সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমেই
জানা যাবে তাঁদের মধ্যে কার তত্ত্ব সঠিক।
পেপারঃ৪৩ “Max Planck as Scientist.”Die Naturwissenschaften,সংখ্যা ১ (১৯১৩), পৃষ্ঠাঃ১০৭৭-১০৭৯। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক
সম্পর্কে লেখেন। আইনস্টাইন ব্যক্তিগত ভাবে প্ল্যাঙ্কের গবেষণার ভক্ত ছিলেন। আইনস্টাইন মনে
করেন প্ল্যাঙ্কের গবেষণা অত্যন্ত উঁচুমানের শিল্পও বটে।
No comments:
Post a Comment