১৮৭৯
১৪ মার্চ, শুক্রবার। জার্মানির উলম শহরের এক মধ্যবিত্ত ইহুদি দম্পতি
হারম্যান আইনস্টাইন ও পলিন কোচ আইনস্টাইনের প্রথম সন্তান আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। আক্ষরিক অর্থে
মাথামোটা ছেলেটাকে দেখে মা পলিন কিছুটা হতাশ।
১৮৮০
বছরের মাঝামাঝি সময়ে আইনস্টাইন পরিবার উলম থেকে প্রায় একশ মাইল দূরের
মিউনিখ শহরে চলে যায়। শহরের কাছাকাছি একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন হারম্যান ও পলিন।
১৮৮১
১৮ নভেম্বর আলবার্ট আইনস্টাইনের
বোন মায়ার (Maja) জন্ম হয়। শুরুতে তার নাম রাখা হয়েছিল মেরি (Marie), কিন্তু সবাই
তাকে মায়া নামে ডাকতে শুরু করলে তার নাম মায়াই হয়ে যায়। ছোট বোনকে দেখে আলবার্ট ভেবেছে তার মা-বাবা তার জন্য নতুন কোন
খেলনা নিয়ে এসেছেন। সে আধো আধো স্বরে জানতে চাইলো ‘এটার চাকা
কোথায়?”
১৮৮২
আলবার্ট আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু
করেছে। মায়ার জন্মের আগপর্যন্ত তেমন কোন কথা বলেনি আলবার্ট। বয়সের তুলনায় অ্যালবার্টের মাথাটি অস্বাভাবিক
বড় হওয়ার কারণে অ্যালবার্টের মা পলিন ভীষণ চিন্তিত।
১৮৮৩
দুবছর বয়সী মায়া পরিষ্কারভাবে কথা বলতে পারে। কিন্তু তার দাদা
আলবার্ট ভীষণ চুপচাপ। কথা বলার সময়
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটি বাক্য বলে আবার চুপ করে যায়। অ্যালবার্টের
মা-বাবা ধরেই নিয়েছেন ছেলেটি অস্বাভাবিক।
১৮৮৪
হারম্যান আইনস্টাইন ছেলে আলবার্টকে
একটি কম্পাস কিনে দেন। পাঁচ বছরের আলবার্ট অবাক হয়ে দেখে, কম্পাসের
কাঁটা সবসময় উত্তর-দক্ষিণ দিক হয়ে থাকছে। অদৃশ্য চৌম্বকীয়
শক্তি সম্পর্কে সে জানতে চায় তার বাবার কাছে। কিন্তু তাঁর
বাবা বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানেন না। অ্যালবার্টের বৈজ্ঞানিক
কৌতূহলের শুরু হয়তো তাঁর বাবার দেয়া এই কম্পাস থেকে। ঘরের বাইরে গিয়ে
খেলাধূলার প্রতি খুব একটা ঝোঁক নেই অ্যালবার্টের। ঘরে বসে তাসেরঘর
তৈরি করতে আনন্দ পায় সে। তাসের ওপর তাস সাজিয়ে সে বেশ কয়েকতলা পর্যন্ত তুলতে পারে।
ছোটবোন মায়াকে খুব আদর করে আলবার্ট। কিন্তু যখন রেগে
যায়- তখন আর আদরের কথা মনে থাকে না। একদিন রাগের
মাথায় বাউলিং বল ছুড়ে মারে সে মায়ার দিকে। ছেলের এরকম একগুঁয়ে স্বভাবের
ব্যাপারেও চিন্তিত হয়ে ওঠেন মা পলিন। বাবা হারম্যানের অবশ্য এসমস্ত ব্যাপারে কোন খুঁতখুঁতানি নেই। ছেলের বয়স পাঁচ
হবার সাথে সাথে ছেলের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলেন পলিন। অ্যালবার্টের
জন্য একজন গৃহশিক্ষিকা নিয়োগ করা হলো। মহিলা আলবার্টকে নিয়ে বসলেন প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষাদান
করার জন্য। কিন্তু আলবার্ট মোটেও বাধ্য ছাত্র নয়। একটু জোর করতেই
পড়া ছেড়ে উঠে চলে যায় আলবার্ট। ধরে আনতে গিয়েই
বিপদে পড়লেন শিক্ষিকা। আলবার্ট চেয়ার ছুড়ে
মারলো শিক্ষিকার দিকে। একটু পরে দেখা গেলো শিক্ষিকাকেই তাড়া করেছে পাঁচ বছরের রাগী
আলবার্ট। গৃহশিক্ষিকা
ইস্তফা দিলেন। কিন্তু হাল ছাড়লেন না পলিন। তিনি এবার খুব কড়া একজন শিক্ষক নিয়োগ করলেন অ্যালবার্টের
জন্য। শুধু তাই নয়, বেহালা শেখানোর জন্যও একজন শিক্ষক নিয়োগ করা হলো। শুরু হলো অ্যালবার্টের
বেহালা শেখা।
১৮৮৫
বছরের শুরুতে আইনস্টাইনরা মিউনিখ শহর থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে সেন্ডলিং (Sendling)সাবার্বে
চলে আসেন।এখানের বাড়িটি বেশ বড়। বাড়ির পেছনে অনেকগুলো বড় বড় গাছ। পাশের বাড়িতেই
থাকেন হারম্যানের ভাই জ্যাকব (Jacob)। জ্যাকব ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। হারম্যান আর
জ্যাকব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি ও সরবরাহের ব্যবসা আরম্ভ করেছেন। বাড়ির কাছেই তাঁদের
কারখানা। আলবার্ট সুযোগ পেলেই কাকা
জ্যাকবের সাথে কারখানায় চলে যায়। কারখানায় ডায়নামো, ইলেকট্রনিক মিটার, নানারকম
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি দেখতে খুব ভালো লাগে অ্যালবার্টের। জ্যাকবকে খুব ভালবাসে আলবার্ট। জ্যাকব গণিত ও বিজ্ঞানের মজার মজার
গল্প করেন তার সাথে। কাকার সাথে গল্প করতে করতেই আলবার্ট বিজ্ঞান ও গণিতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
যৌথ ব্যবসার বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী দিক সামলান জ্যাকব, আর ব্যবসায়িক দিক সামলান
হারম্যান।
আলবার্ট আইনস্টাইনের স্কুলজীবন
শুরু হলো এই হেমন্তে। অ্যালবার্টের মা-বাবা জন্মগতভাবে ইহুদি হলেও কেউই সেরকম
ধার্মিক নন। কখনো সিনেগগেও যান না তাঁরা। মিউনিখের একমাত্র ইহুদি স্কুলটি বাড়ি
থেকে অনেক দূরে। অথচ ঘরের কাছেই ক্যাথলিক স্কুল। তাই স্থানীয় ক্যাথলিক স্কুলেই
শুরু হলো অ্যালবার্টের পড়াশোনা। গৃহশিক্ষকের কাছে বেশ কিছুদিন পড়ার কারণে আলবার্ট সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেনীতে ভর্তির সুযোগ
পেলো। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভালো লাগলো না তার। সে প্রথম শ্রেণীতেই গিয়ে বসলো।
সত্তর জনের ক্লাসে আলবার্ট একমাত্র
ইহুদি। তার মা-বাবা ইহুদি ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি খুব একটা অনুরক্ত না হলেও কিছু
কিছু অনুশাসন তাকে বাড়িতেই শেখানো শুরু হলো। নানারকম যৌক্তিক অযৌক্তিক আচার আচরণ
তাকে ধর্মের প্রতি কৌতূহলী করে তোলে। পরে সারাজীবন ধরে তার এই কৌতূহলের অবসান
হয়নি।
১৮৮৬
আলবার্ট বেহালা শেখা ছেড়ে দিয়ে
পিয়ানো বাজাতে শুরু করেছে। কারো কাছে কিছু শেখার চেয়ে নিজে নিজে শিখতে পছন্দ করে আলবার্ট। অ্যালবার্টের মা পলিন চমৎকার পিয়ানো
বাজান। তিনি ছেলেমেয়ে দুজনকেই সংগীতের ব্যাপারে অনুরাগী করে তোলার ব্যাপারে
সচেষ্ট। মায়াকে নিজের হাতে পিয়ানো শেখাচ্ছেন। কিন্তু আলবার্টকে পিয়ানোর বদলে বেহালা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
হয়তো জোর করা হয়েছে বলেই আলবার্ট শিক্ষকের
কাছে বেহালা শিখতে রাজী নয় আর। নিজে নিজে বাজায় যখন ইচ্ছে হয়।
স্কুলে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। আলবার্ট শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না
ঠিকমত। তাকে কোন প্রশ্ন করা হলে সে আপন মনে বিড়বিড় করে। একটা দুটো শব্দ বলার চেয়ে
পুরো বাক্য বলতে চায় আলবার্ট। আর ভুল উত্তর দেয়ার ভয়ে কোন কিছু বলার আগে কয়েকবার মনে
মনে বলে দেখে নেয় ঠিক আছে কিনা। তা করতে গিয়ে দেরি হয়ে যায় উত্তর দিতে। শিক্ষকরা
খুব বিরক্ত তার প্রতি। ক্লাসের অন্যান্য ছেলেরাও পছন্দ করেনা আলবার্টকে। কারণ সে কারো সাথে সহজে মিশতে
পারেনা, খেলাধুলাও পছন্দ করেনা। সহপাঠীরা তার নাম দিয়েছে ‘বোরিং’।
১৮৮৭
স্কুলের পড়াশোনার পদ্ধতি ভালো লাগেনা অ্যালবার্টের। কিন্তু বাড়িতে জ্যাকবের
কাছে অংক কষতে দারুণ লাগে। কাকার কাছে বীজগণিতের চর্চা শুরু হয়েছে স্কুলে ভর্তি
হবার আগে থেকেই। জ্যাকবের শেখানোর পদ্ধতি ভিন্নরকম। তিনি আলবার্টকে একটি সমস্যার সমাধান করতে দিয়ে
ক্ষেপিয়ে তোলেন। তিনি দেখেছেন এই বয়সেই আলবার্ট ভীষণ রকমের একগুঁয়ে। কোন কিছু ধরলে তার
শেষ না দেখে ছাড়ে না সে। জ্যাকব আলবার্টকে
কোন একটি অংক কষতে দিয়ে বলেন, ‘এ সমস্যার সমাধান করা তোমার কম্ম নয়’। আলবার্ট কাকার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বলে, ‘আমি নিশ্চয়
পারবো’। এভাবেই চলে তার পড়াশোনা। সমস্যার সমাধান করার পরে আলবার্ট লাফাতে থাকে, ‘বলেছিলাম না
আমি পারবো’।
১৮৮৮
অক্টোবরের এক তারিখ থেকে শুরু হলো অ্যালবার্টের লুটপোল্ড জিমনেশিয়ামের (Luitpold
Gymnasium) ক্লাস। এটি হাইস্কুলের সমতুল্য। অ্যালবার্টের ক্লাসে সবচেয়ে গুরুত্ব
দিয়ে অনেকক্ষণ সময় ধরে পড়ানো হয় ল্যাটিন ও গ্রিক। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, গণিত, ভূগোল,
সাহিত্য ও বিজ্ঞান পড়ানো হয় মাইনর সাবজেক্ট হিসেবে। আলবার্ট ল্যাটিন কোনরকমে সহ্য করে নিলেও
গ্রিকভাষা তার ভালোই লাগে না। বিশেষ করে শিক্ষকরা যখন মিলিটারি স্টাইলে পড়ানো শুরু
করেন এবং যুক্তিহীন মুখস্ত করার ওপর গুরুত্ব দেন- ভালো লাগেনা তার। প্রাইমারি
স্কুলের শিক্ষকদের তার মনে হয়েছিল ড্রিল সার্জেন্ট, এখন হাইস্কুলের শিক্ষকদের মনে
হচ্ছে ল্যাফটেন্যান্ট।
১৮৮৯
স্কুলের পড়াশোনা প্রতি তেমন কোন আগ্রহ সৃষ্টি না হলেও বাড়িতে লেখাপড়ার একটি
নতুন পথ খুলে যায় অ্যালবার্টের। তার পরিচয় হয় ম্যাক্স ট্যালমুডের (Max Talmud)
সাথে। হারম্যান ও পলিন ইহুদিদের ধর্মীয় রীতিনীতি খুব একটা পালন না করলেও একটি
ব্যাপার তারা নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। প্রতি সপ্তাহে একজন গরীব ইহুদি ছাত্রকে
ডিনারের নিমন্ত্রণ করেন তাঁরা। প্রতি বৃহস্পতিবার আইনস্টাইনের বাড়িতে আসে ম্যাক্স
ট্যালমুড। মিউনিখ ইউনিভার্সিটির মেডিকেলের ছাত্র একুশ বছর বয়সী ম্যাক্স ট্যালমুডের
সাথে দশ বছর বয়সী আলবার্ট আইনস্টাইনের
জ্ঞানবিজ্ঞানের যোগসূত্র তৈরি হয়। ট্যালমুড আলবার্টকে গণিত ও বিজ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট করার
চেষ্টা করেন। আলবার্ট ট্যালমুডের সাথে
গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা করতে খুব উৎসাহ পায়। আর ট্যালমুডও অ্যালবার্টের
প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তার সাথে বন্ধুর মতোই ব্যবহার করেন।
১৮৯০
জার্মানির প্রচলিত আইন অনুযায়ী স্কুলে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক। আলবার্ট যেহেতু ইহুদি, ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে
পড়াশোনা করতে হচ্ছে তাকে। তার মা-বাবা কেউই ধর্মচর্চা করেন না। কিন্তু স্কুলে
কঠোরভাবে ধর্মীয় নিয়মরীতি শেখানো হচ্ছে। আলবার্ট যতই ধর্মের ব্যাপারটি জানতে পারছে- ততোই
মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ধর্মের প্রতি আলাদা একটি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেছে সে। তার
মা-বাবা ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করেনা বলে সে ক্ষুব্ধ। ধর্মের নির্দেশ অক্ষরে
অক্ষরে পালন না করলে ছোটবোন মায়াকে যখন তখন বকাঝকা করে আলবার্ট। ইহুদিদের শুকরের মাংস খাওয়া নিষেধ। অথচ
তাদের বাড়িতে শুকরের মাংস খাওয়া হয়। আলবার্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে একজন নিষ্ঠাবান
ইহুদি হবে। ঘোষণা করলো, আর শুকরের মাংস খাবে না সে। তেরো বছর বয়স হলেই সে গোঁড়া
ইহুদি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবার জন্য যেসব ধর্মীয় বিধান পালন করতে হয় তা
করবে। স্কুলে যাওয়া আসার পথে আলবার্ট এখন
ধর্মীয় সংগীত গায়, আর মাঝে মাঝে ধর্মীয় সংগীত রচনা করার চেষ্টা করে।
গরমের ছুটিতে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির একটি বই হাতে পেয়ে ভীষণ ভালো লেগে গেলো
অ্যালবার্টের। জ্যামিতিক সমস্যাগুলোর ভিন্নরকম সমাধান করা যায় কিনা চেষ্টা করতে
লাগলো সে। গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হবার আগেই দেখা গেলো অনেকগুলো সমস্যার সমাধান সে
নিজে নিজে করে ফেলেছে। পরবর্তীতে আইনস্টাইন এই জ্যামিতি বইটার নাম দিয়েছিলেন, ‘পবিত্র
জ্যামিতি বই (holy geometry book)’।
No comments:
Post a Comment