Monday, 24 June 2019

আইনস্টাইনের কাল - পর্ব-৪


১৮৯৫
মিলানে বড় আনন্দে কাটছে অ্যালবার্টের দিন কয়েকমাস সে ঘুরে বেড়ালো এখানে সেখানে পাহাড়ে উঠলো, হাঁটলো মাইলের পর মাইল ইটালির গ্রামের দিকের সহজ সরল মানুষ দেখে বড় ভালো লাগলো তার মনে হতে লাগলো, স্বাধীন মানুষের মত সুখি মানুষ আর হয় না কিছুদিন পরেই মা মনে করিয়ে দিলেন পলিটেকনিক্যালে ভর্তিপরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার কথা  আলবার্ট মনযোগ দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের বই পড়তে লাগলো গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা চলছে নিয়মিত কিন্তু পলিটেকনিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় শুধু গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান থাকে না সেখানে জীববিদ্যা, ভূগোল, ভাষাতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়েও পাস করতে হবে কিন্তু আইনস্টাইন সেগুলোর কিছুই জানেনা, সেসব বিষয়ে পড়াশোনাও করছে না

ইতোমধ্যে আইনস্টাইনদের ব্যবসা আবার দেউলিয়া হয়ে গেলো হারম্যান ছেলেকে বলে দিয়েছেন,আর খরচ দেয়া সম্ভব হবে না কীভাবে পড়ার খরচ জুটবে তা নিয়ে আপাতত চিন্তা করছে না  আলবার্ট ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি নিজস্ব গবেষণা নিয়েও ভাবছে সে

ইথারের সাথে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিন্ডের সম্পর্ক নিয়ে ভাবছে  আলবার্ট জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ আছে ১৮৮৮ সালে হেনরিখ হার্টজ পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন যে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ আছে এবং ইথারের মধ্য দিয়ে তা চলাচল করে আইনস্টাইন ভাবছে ইথারের মধ্য দিয়ে যদি তা চলাচল করে তাহলে ইথারের সাথে তার সম্পর্ক নিশ্চয় আছে কী সেই সম্পর্ক? ভাবতে ভাবতে আইনস্টাইন একটি গবেষণাপত্র তৈরি করে ফেললো প্রবন্ধটিতে নতুন কোন আবিষ্কার ছিল না, কিন্তু ষোল বছরের একজন কিশোরের পক্ষে এটাও অনেক পাঁচ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি কাকে পড়ানো যায় ভাবতে ভাবতে পাঠিয়ে দিলো তার মামা সিজারের কাছে

সিজার কোচ খাদ্যশষ্যের ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানের কিছুই জানেননা কিন্তু দেখা গেলো তিনি তাঁর ভাগনের প্রবন্ধ হাতে নিয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করতে শুরু করেছেন অ্যালবার্টের প্রশংসা করে তিনি বোন পলিনকে একটি চিঠি লিখলেন
ভাইয়ের চিঠি পাবার পরেও পলিন কিন্তু খুব একটা উচ্ছাস দেখালেন না তিনি চিঠি লিখলেন জুরিখের ফেডারেল ইনস্টিউট অব টেকনোলজি বা ফেডারেল পলিটেকনিক্যাল স্কুলে তারা জানালো যে ভর্তির জন্য কমপক্ষে আঠারো বছর বয়স হতে হয় কিন্তু  আলবার্ট যে মাত্র ষোল এখন?

সহজে হাল ছেড়ে দেবার পাত্রী নন পলিন তিনি খোঁজখবর নিতে লাগলেন পরিচিত কেউ সাহায্য করতে পারেন কিনা উলমে থাকতে তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন গুস্তাভ মেইয়ার(Gustav Maier) গুস্তাভ এখন জুরিখে থাকেন এবং জানা গেলো গুস্তাভের সাথে পলিটেকনিক্যালের ডিরেক্টর অ্যালবিন হারজগের (Albin Herzog)পরিচয় আছে পলিন গুস্তাভ মেইয়ারকে অনুরোধ করলেন  আলবার্টকে ভর্তির ব্যাপারে তিনি যেন ডিরেক্টরকে বলেন পলিন গুস্তাভকে জানালেন যে  আলবার্ট অসামান্য প্রতিভার অধিকারী বয়স কম হলেও তার বুদ্ধি ও মেধা বিস্ময়করভাবে বেশি গুস্তাভ মেইয়ার আরো কিছু বাড়িয়ে বললেন পলিটেকনিক্যালের ডিরেক্টরের কাছে জুরিখের পলিটেকনিক ইউরোপের সেরা প্রতিষ্ঠান সেখানে ভর্তির সুযোগ পাবার জন্য অনেকেই অনেক রকম অনুরোধ করেন ডিরেক্টরকে সুতরাং তিনি  আলবার্ট সম্পর্কে গুস্তাভের কোন কথাই বিশ্বাস করলেন না তবুও বললেন, যদি ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারে, তাহলে বয়স নিয়ে কোন সমস্যা হবে না

ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে মায়ের সাথে জুরিখে এলো  আলবার্ট এই প্রথম তার জুরিখে আসা গুস্তাভ মেইয়ারের বাড়িতে উঠেছে তারা জুরিখ শহরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলো  আলবার্ট এবার ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারলে হয় পরীক্ষা শুরু হলো অক্টোবরের আট তারিখ কয়েকদিন ধরে চললো পরীক্ষা পরীক্ষার দুটো অংশ প্রথম অংশ হলো সাধারণ তথ্যাবলী- যাতে আছে ভাষার ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও জার্মান ভাষা দ্বিতীয় অংশ হলো বিজ্ঞান ও গাণিতিক দক্ষতা, যেখানে আছে বীজগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা,রসায়ন ও কারিগরী অঙ্কন
অক্টোবরের চৌদ্দ তারিখে ভর্তিপরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হলো  আলবার্ট ও তার মাকে ডাকা হলো ডিরেক্টরের অফিসে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে খুবই ভালো করেছে  আলবার্ট পদার্থবিজ্ঞানে সে এতই ভালো করেছে যে, পলিটেকনিকের পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর হেনরিখ ওয়েবার (Heinrich Weber) তাঁর ক্লাসে আমন্ত্রণ জানালেন  আলবার্টকে শুধুই আমন্ত্রণ, কারণ সে সাধারণ তত্ত্বের অংশে পাস করতে পারেনি, ফলে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি  আলবার্ট ডিরেক্টর হারজগ পরামর্শ দিলেন কাছের কোন শহরের স্কুল থেকে হাইস্কুলের পড়াটা শেষ করে পলিটেকনিকে ভর্তি হতে গুস্তাভ মেইয়ার জুরিখের কাছে আরাউ (Aarau)স্কুলে আইনস্টাইনের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন আরাউ স্কুলের শিক্ষক ইয়োস্ট উইন্টেলারের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হলো তার

কিছুটা ভয় ও কিছুটা কৌতুহল নিয়ে আরাউয়ে এলো  আলবার্ট আরাউ জার্মানির সীমান্তে সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট একটি শহরতলী স্কুলে জার্মান ভাষাতেই পড়াশোনা চলে স্কুলের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগে এখানেও কি তাকে পিছিয়ে পড়তে হবে? আর এটাও যদি মিউনিখের স্কুলের মত মিলিটারি কায়দার স্কুল হয়? আরাউ শহরটা দেখেই ভালো লেগে গেলো অ্যালবার্টের সরু সরু রাস্তা, পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা ছবির মত গ্রাম
স্কুলঘরটি পুরনো তবে পাশেই নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে স্কুলের ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক ইয়োস্ট উইন্টেলারের (Jost Winteler)সাথে দেখা হলো অ্যালবার্টের চমৎকার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব উইন্টেলারের প্রথম আলাপেই ভালো লেগে গেলো অ্যালবার্টের মনে হচ্ছে এখানে বেশ আনন্দেই কাটবে সময়

আরাউ স্কুলে মোট তিনটি শ্রেণী গ্রেড ওয়ান,টু আর থ্রি- মানে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী দুরকম পদ্ধতিতে পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে জিমনেশিয়াম পদ্ধতি- যেখানে সুর করে মিলিটারি কায়দায় পড়াশোনা, আর লিবারেল স্কুল পদ্ধতি- যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা আছে উভয় পদ্ধতির ছেলেরা পলিটেকনিকে ভর্তি হতে পারে আইনস্টাইন লিবারেল পদ্ধতিতে ভর্তি হলো ভর্তি হবার আগে আরেকবার পরীক্ষা দিতে হলো পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়- কোন ক্লাসে ভর্তি হবে আইনস্টাইন থার্ড গ্রেড মানে দ্বাদশ শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পেলো অর্থাৎ একবছর পরে এই ক্লাসটি পাস করলেই সে পলিটেকনিকে ভর্তি হতে পারবে

উইন্টেলারের পরিবারের সাথে থাকতে পেরে খুব ভালো লাগছে আইনস্টাইনের ইয়োস্ট উইন্টলারের স্ত্রী পলিন উইন্টেলার খুব সহজেই আপন করে নিলেন আইনস্টাইনকে নিজের মায়ের সাথে মিল দেখে আইনস্টাইন পলিন উইন্টেলারকে মা বলে ডাকতে আরম্ভ করলো আর পলিনও আইনস্টাইনকে ছেলের মতই আদর করেন 

উইন্টেলারদের সাতজন ছেলেমেয়ে, তিনজন মেয়ে ও চারজন ছেলে বাড়িটিও অনেক বড় আইনস্টাইনের জন্য আলাদা ঘর দেয়া হলো এই পরিবারের সবার সাথে সহজেই ভাব হয়ে গেলো আইনস্টাইনের একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো তার- তা হলো পারিবারিক গণতন্ত্র যখনই সময় পায় ছেলেমেয়ে সবাই মিলে মাবাবার সাথে গল্প করে যে কোন বিষয়ে যে কেউ নির্দ্বিধায় মত প্রকাশ করতে পারে

এবাড়ির মেয়েরা সবাই গানবাজনার চর্চা করে ছোট মেয়ে মেরির বয়স আঠারো, আইন্টাইনের চেয়ে দুবছরের বড় আইনস্টাইনকে তিনবোনই স্নেহের দৃষ্টিতে দেখে মেরি খুব ভালো পিয়ানো বাজায় আইনস্টাইন তার সাথে বেহালা বাজায় এবং একসময় খেয়াল করে যে সে মেরির প্রেমে পড়ে গেছে আইনস্টাইনের প্রথম প্রেম গোপন থাকে না কিছুদিন পরেই সবাই জেনে যায় তাদের প্রেমের কথা উদার উইন্টেলার আঠারোত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের ইচ্ছায় বাধা দেননা আইনস্টাইনের সময় যেন উড়ে চলে যায়

১৮৯৬
জার্মানির বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস এড়াতে জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করার জন্য দরখাস্ত করেছিলো  আলবার্ট জানুয়ারির ২৮ তারিখ থেকে অফিসিয়ালি সে আর জার্মানির নাগরিক নয় পরবর্তী পাঁচ বছর কোন দেশেরই নাগরিকত্ব ছিলো না তার

আরাউ আসার পরে বাড়ি যাওয়া হয়নি অনেকদিন এপ্রিলের বসন্তকালীন ছুটিতে বাড়িতে গেলো মেরির কথা জানাজানি হয়ে গেছে মায়া ও পলিন সমানে ক্ষেপাচ্ছে আইনস্টাইনকে পলিন মেরিকে না দেখেই পছন্দ করে ফেলেছেন ভাবছেন অ্যালবার্টের সাথে মেরির বিয়ে হলে বেশ হয় আইনস্টাইন প্রায় প্রতিদিনই চিঠি লেখে মেরিকে ছুটি শেষ হবার আগেই আরাউতে ফিরে আসার জন্য ছটফট করছে সে

বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেখে স্কুলের নতুন বিল্ডিং তৈরি হয়ে গেছে এপ্রিলের ২৬ তারিখে নতুন বিল্ডিং উদ্বোধন করা হলো এর কয়েকদিন পরেই মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে স্কুলে বিরাট অনুষ্ঠান হলো আইনস্টাইনকে বলা হলো তলোয়ার যুদ্ধে অংশ নিতে আইনস্টাইনের মাথার ভেতর এর মধ্যেই অহিংসার মন্ত্র ঢুকে গেছে খেলাচ্ছলেও সে অস্ত্র হাতে নিতে রাজি নয় কিন্তু তার কোন আপত্তি খাটলো না বিকেলে আপাদমস্তক কালো পোশাক পরে, মানুষের খুলি আঁকা টুপি মাথায় দিয়ে হাতে টিনের তলোয়ার নিয়ে মাঠে উপস্থিত হলো আইনস্টাইন এই প্রথম এবং এই শেষ অস্ত্র হাতে নেয়া তার যুদ্ধ শুরু হবার আগেই প্রচন্ড বৃষ্টি নামলো, খেলা পন্ড হয়ে গেলো

মে মাসের শেষে স্কুলের বসন্তকালীন পরীক্ষায় বেশ ভালো করেছে আইনস্টাইন জিওলজিতে ভালো করার ফলে জিওলজির প্রফেসর মুলবার্গের সাথে ফিল্ডট্রিপে যাবার জন্য মনোনীত হয়েছে সে সুইজারল্যান্ডের পূর্বদিকে মাউন্ট স্যানটিসে ফিল্ড ট্রিপে রওয়ানা হলো মূলবার্গের গ্রুপ মাউন্ট স্যানটিসের উচ্চতা ৮১৪১ ফুট জুন মাস, অনবরত বৃষ্টিতে পাহাড়ের পথে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল আইনস্টাইন হাইকিং বুট আনেনি পিচ্ছিল পাহাড়ে ওঠার এক পর্যায়ে পা পিছলে পড়ে গেলো আইনস্টাইন আর একটু গেলেই গভীর খাড়া খাদ একজন সহপাঠী দ্রুত একটি লাঠি বাড়িয়ে ধরলো আইনস্টাইনের দিকে লাঠি ধরে কোন রকমে খাদের মুখে থামলো আইনস্টাইন আরেকটু হলেই খাদে পড়ে মৃত্যু হতে পারতো তার

স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে আইনস্টাইন মনযোগ দিয়ে পড়ছে এখন তার লক্ষ্য জুরিখের পলিটেকনিক মেরির সাথে প্রেমের জোয়ারে কিছুটা ভাটা পড়েছে এখন মেরিকে এখন আর তেমন ভালো লাগছে না তারমেরিকে অবশ্য কিছু বলেনি সে মেরি ভেবেছে সামনে পরীক্ষা বলেই তাকে সময় দিতে পারছে না  আলবার্ট

মিলানের ব্যবসা মার খাওয়ার পর হারম্যান ও জ্যাকব মিলানের কাছে আরেকটি শহর প্যাভিয়াতে ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবার সে ব্যবসাও মার খেয়েছে জ্যাকব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর ব্যবসা করবেন না তিনি চাকরি নিলেন একটি ইলেকট্রিক কোম্পানিতে হারম্যান ভাবলেন মিলানেই আবার ব্যবসা শুরু করবেন বাবার দুরবস্থা দেখে খারাপ লাগছে অ্যালবার্টের কিন্তু সামনে পরীক্ষা, এখন সে সবকিছু ভুলে পড়াশোনা করতে চায়

সেপ্টেম্বরের ১৮,১৯ ও ২১ তারিখে লিখিত পরীক্ষা শেষ হলো লিখিত পরীক্ষায় সব বিষয়েই বেশ ভালো করলো আইনস্টাইন কেবল ফরাসি ভাষায় খুব একটা ভালো করতে পারলো না সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে মৌখিক পরীক্ষা হলো মৌখিক পরীক্ষায় জুরিখ পলিটেকনিক থেকে দুজন প্রফেসর এসে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করেন এবার যে দুজন এসেছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন পলিটেকনিকের ডিরেক্টর অ্যালবিন হারজগ, যিনি আইনস্টাইনকে স্কুলের পড়া শেষ করে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন আইনস্টাইন ৬ এর মধ্যে ৫.৩৩ পেয়ে দশজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করলো

স্কুলের পরীক্ষা পাস করে এবার জুরিখের পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হতে কোন সমস্যা হলো না কিন্তু সমস্যা হলো অন্যখানে আইনস্টাইনের পড়াশোনা ও জুরিখে থাকা-খাওয়ার খরচ আসবে কোত্থেকে? বাবার তো সামর্থ্য নেই পলিন চিঠি লিখলেন তার বৌদি জুলি কোচের কাছে তারা খুব ধনী কিন্তু আইনস্টাইন পছন্দ করে না তার এই জুলি মামীকে জুলিকে তার অহংকারী বাচাল মনে হয় কিন্তু জুলি মামী টাকা দিলে তা নিতে কোন আপত্তি নেই আইনস্টাইনের জুলি পলিনকে লিখলেন যে, আইনস্টাইনের খরচ বাবদ তিনি প্রতি মাসে একশ সুইস ফ্রাংক পাঠাবেন মাসে একশ সুইস ফ্রাংক- খুব একটা বেশি কিছু নয়, তবে কোনরকমে চালিয়ে নিতে পারবে আইনস্টাইন
অক্টোবরের মাঝামাঝি জুরিখে এসে পৌঁছালো আইনস্টাইন পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে প্রথমেই রেজিস্ট্রেশান করতে হলো হাজারখানেক নতুন ছাত্র ভর্তি হচ্ছে প্রায় সকলেই ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের জন্য রেজিস্ট্রেশান করাচ্ছে আইনস্টাইন এখানে সব ছাত্রের চেয়ে বয়সে ছোট ভর্তির ন্যূনতম বয়স আঠারো হতে এখনো ছয়মাস বাকী আইনস্টাইনের

আইনস্টাইন রেজিস্ট্রেশান করালো স্কুল ফর টিচার্স অব ম্যাথমেটিক্স এন্ড ফিজিক্স- পদার্থবিজ্ঞান তার মুখ্য বিষয়, গণিত ও জ্যোর্তিবিদ্যা সহযোগী বিষয় প্রথম সেমিস্টারে শুধু গণিত পদার্থবিজ্ঞান শুরু হবে দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে ক্যালকুলাস ও অ্যানালাইটিক্যাল জিওমেট্রি দিয়ে শুরু হলো আইনস্টাইনের পলিটেকনিক পড়াশোনা পলিটেকনিকের কাছেই একটি বোর্ডিং এ থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার

আইনস্টাইনের ক্লাসে সে সহ মোট ছাত্রছাত্রী পাঁচজন তাদের মধ্যে তিনজনের মুখ্যবিষয় হলো গণিত এই তিনজন হলো মার্সেল গ্রোসম্যান(Marcel Grossmann), জ্যাকব এহরাত(Jacob Ehrat) ও লুই কলরোস(Louis Kollros) আইনস্টাইন ছাড়া অন্য যেজন মুখ্য বিষয় হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান নিয়েছে- সে একজন মেয়ে, মিলেইভা মেরিক এই প্রথম কোন মেয়েকে সহপাঠী হিসেবে ক্লাসে পেয়েছে আইনস্টাইন আরাউর স্কুলেও সবাই ছিলো ছেলে এখানে এই পলিটেকনিকেও আর কোন মেয়ে চোখে পড়েনি আইনস্টাইনের তার কারণও আছে ইউরোপে মেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার সুযোগ এখনো খুব সীমিত

পাঁচজনের ক্লাসে পরস্পর বন্ধু হতে সময় লাগলো না কারো মার্সেল গ্রোসম্যান ধনী বাপের ছেলে কিন্তু সেজন্য একটুও অহংকার নেই তার আইনস্টাইনের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো মার্সেলের আইনস্টাইনের প্রতিভাকে উৎসাহ দিয়ে অনেকখানি উস্কে দিয়েছে গ্রোসম্যান জ্যাকব এহরাত আইনস্টাইনের মতোই ইহুদি পলিটেকনিকে হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র ইহুদি ছাত্র থাকলেও শুধুমাত্র ইহুদি হবার কারণে কাউকে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি, বা ইহুদি হওয়ার কারণে কাউকে বঞ্চিত করা হয়নি লুই কলরোস এসেছে ফ্রান্সের সীমান্তের একটি গ্রাম থেকে
আর মিলেইভা এসেছে যুগোস্লোভিয়া থেকে আগে ওটা হাঙ্গেরির অন্তর্ভুক্ত ছিলো মিলেইভার বাবা মাইলোস অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার এখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। দুইবোন এক ভাইয়ের মধ্যে মিলেইভা সবার বড়। জন্ম থেকেই মিলেইভার পায়ে একটা সমস্যা আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় তাকে। তাছাড়া সার্বিয়ার মানুষ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তার গায়ের চামড়া ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মত সাদা নয়। সার্বিয়ানদের সুনজরে দেখে না ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষজুরিখেও সার্বিয়ানদের নীচুজাত মনে করা হয়। মিলেইভা তাই যথাসম্ভব গুটিয়ে রাখে নিজেকে। সার্বিয়ার নভি সাদের একটি হাই স্কুল থেকে পাস করে এসেছে মিলেইভা। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে খুব ভালো করেছে সে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসে বসার জন্য মিলেইভাকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে। কারণ ইউরোপে মেয়েদের বিজ্ঞান পড়া এখনো অনেক স্কুলেই নিষেধ। ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো মিলেইভা। কিন্তু ক্লাসে অন্যকোন মেয়ে না থাকায় ব্যবচ্ছেদ ক্লাসে সহপাঠী ছাত্ররা আজেবাজে মন্তব্য করে। সহ্য করতে না পেরে মেডিকেলের পড়া বাদ দিয়ে এখন এখানে ভর্তি হয়েছে পদার্থবিজ্ঞান পড়বে বলে। মিলেইভা আইনস্টাইনের চেয়ে বয়সে সাড়ে তিনবছর বড়। ক্লাসের অন্য তিনজন ছেলের চেয়েও বয়সে বড় সে।

পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি মিলেইভার আগ্রহ ও মেধা দেখে আস্তে আস্তে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে আইনস্টাইন। এদিকে আরাউয়ের মেরিকে এখনো আবেগপূর্ণ চিঠি লেখে সে। নিজের ময়লা জামাকাপড় মেরির কাছে পাঠিয়ে দেয়। আর মেরি সানন্দে তা পরিষ্কার করে পাঠিয়ে দেয় আইনস্টাইনের কাছে।

এবছর ডিসেম্বর মাসের দশ তারিখে সুইডেনের বিখ্যাত আবিষ্কারক ও শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেল(Alfred Nobel) মারা যান। নোবেলের উইল অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় নোবেল পুরষ্কার কমিটি। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ফিজিওলজি ও চিকিৎসা, সাহিত্য এবং শান্তি- এই পাঁচটি শাখায় ১৯০১ সাল থেকে প্রতি বছর পাঁচটি নোবেল পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়।

পূর্ব ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক সাম্প্রদায়িক অত্যাচার বাড়তে শুরু করেছেপশ্চিম ইউরোপে এন্টি-সেমিটিজম (Anti-semitism)বা ইহুদিদের অধিকারের বিরুদ্ধে মতবাদ প্রবল হচ্ছে। এসবের প্রেক্ষিতে ইহুদিরা তাদের নিজেদের মাতৃভূমি জেরুজালেমে ফিরে যাবার জন্য সংগঠিত হতে শুরু করেছে। এ আন্দোলন জিয়োনিজম(zionism) নামে পরিচিত। পরবর্তীতে আইনস্টাইন জিয়োনিজম ও ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts