১৯০৪
মে মাসের ১৪ তারিখে আলবার্ট ও মিলেইভা
আইনস্টাইনের প্রথম পুত্র হ্যান্স অ্যালবার্টের জন্ম হয়। আইনস্টাইন কিছুটা
ঘরমুখী হয়েছেন এখন। ঘরের কাজে মিলেইভাকে সাহায্যও করতে হয়।অফিস থেকে ফিরে
হ্যান্সকে কোলে নিয়ে বসেন আইনস্টাইন। বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে কাগজ পেন্সিল নিয়ে লিখতে শুরু করেন আইনস্টাইন। বাচ্চাকে কোলে
বসিয়ে কাগজ পেন্সিল নিয়ে লিখতে শুরু করেন আইনস্টাইন। প্রচন্ড হট্টগোলের
মধ্যেও গভীর মনযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন তিনি। অনেক সময় দেখা
যায়, কোলের ওপর বাচ্চা কাঁদছে, অথচ তিনি গভীর চিন্তায়
মগ্ন।
অফিসে একটু অবসর পেলেই তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসেন। অবশ্য সেখানে
একেবারে ধ্যানমগ্ন হতে পারেন না। বসের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। ডিরেক্টর আসার
আগেই নিজের গবেষণা লুকিয়ে ফেলতে হয়। অফিসে বসে নিজের গবেষণা করতে দেখলে বস নিশ্চয় খুশি হবেন না। তবে প্যাটেন্ট
অফিসের কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন আইনস্টাইন। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্যাটেন্ট
পরীক্ষা করতে করতে নানারকম নতুন নতুন যন্ত্র দেখতে দেখতে বেশ অভিজ্ঞ পরীক্ষক হিসেবে
নাম করেছেন আইনস্টাইন।
একদিন অফিসের বুলেটিন বোর্ডে দেখলেন সেকেন্ড গ্রেডের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। বেতন বছরে ৪৮০০ ফ্রাঙ্ক। আইনস্টাইন এখনো থার্ড গ্রেডের এক্সপার্ট, বেতন বছরে ৩৬০০ ফ্রাঙ্ক। থার্ড গ্রেড থেকে প্রমোশন পেয়ে সেকেন্ড গ্রেডে উঠতে উঠতে তিনি বুড়ো হয়ে যাবেন। তারচেয়ে সরাসরি সেকেন্ড গ্রেডের জন্য পরীক্ষা দিলে কেমন হয়। তিনি দরখাস্ত করলেন। এদিকে বন্ধু মাইকেল বেসোর কথাও মনে পড়ছে। মাইকেল বেসো তাঁর পলিটেকনিকের বন্ধু। আইনস্টাইন বেসোর সাথে মেরি উইন্টেলারের বড়বোন আনা উইন্টেলারের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই আনা আর বেসো প্রেমে পড়ে যান। একবছরের মধ্যেই তাঁরা বিয়ে করে ফেলেছেন। এখন বেসো ইটালির ট্রিয়েস্টে। স্কুল মাস্টারি ছেড়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আইনস্টাইন জানেন, বেসোর ব্যবসায়িক বুদ্ধি নেই। তিনি বেসোকে লিখলেন প্যাটেন্ট অফিসে সেকেন্ড গ্রেডের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট পদে দরখাস্ত করার জন্য।
আইনস্টাইন ও বেসোসহ বত্রিশজন ইন্টারভিউ দিলেন পদটির জন্য। শেষপর্যন্ত মাইকেল বেসোকে চাকরিটি দেয়া হলো। আইনস্টাইন খুব খুশি হলেন। থার্ড গ্রেডের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে আইনস্টাইনের পদ স্থায়ী করা হলো। তাঁর বাৎসরিক বেতন ৩৬০০ ফ্রাঙ্ক থেকে বেড়ে হলো ৩৯০০ ফ্রাঙ্ক। আনা আর বেসো বার্নে চলে এলেন। আইনস্টাইন ও মিলেইভা তাঁদের ঘর গোছানোতে সাহায্য করলেন। আইনস্টাইন বেসোকে বাসা ঠিক করে দিয়েছেন নিজের বাসার কাছেই। দুবন্ধু একসাথে হেঁটে হেঁটে অফিসে যাতায়াত করেন। আনা আর মিলেইভা এখন দারুণ বন্ধু হয়ে গেছেন। আইনস্টাইন এখন বেসোর সাথেই তাঁর বৈজ্ঞানিক ভাবনাগুলো শেয়ার করেন।
প্রকাশনা
আইনস্টাইনের একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবছর।
পেপারঃ ৫ “On the General Molecular Theory of Heat”, Annalen der Physik,সংখ্যা ১৪ (১৯০৪), পৃষ্ঠাঃ ৩৫৪-৩৬২। স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজিক্সের ভিত্তি প্রসারের জন্য তাপের আণবিক তত্ত্বের আবারো ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ পেপারে। আণবিক তত্ত্ব ও থার্মোডায়নামিক্স বিষয়ে তাঁর এটাই শেষ প্রবন্ধ। এরপর তিনি অন্য গবেষণায় মন দেন।
১৯০৫
এবছরটি হলো আইনস্টাইনের জন্য বিস্ময়কর একটি বছর। পদার্থবিজ্ঞানের
গবেষণায় এবছর তিনি যে অবদান রাখেন তাতেই তিনি হয়ে ওঠেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানীদের
একজন ।এবছর তিনি চারটি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যার জন্য পরে নোবেল পুরষ্কার
পেয়েছেন। শুধু তাই নয় এবছর সংবাদপত্রের জন্য তেইশটি সমালোচনা প্রবন্ধ লেখেন। এবং এবছর তিনি
আবার তাঁর পিএইচডির থিসিস লিখে জমা দেন। এর সবগুলোই তিনি করেছেন
অফিসের কাজের পরে তাঁর নিজস্ব সময়ে। একাডেমিক জগতের বাইরের কারো পক্ষে এভাবে গভীর গবেষণা চালিয়ে
যাওয়া অস্বাভাবিক কঠিন কাজ। কিন্তু আইনস্টাইন এই কঠিন কাজটিই করে গেছেন আত্মবিশ্বাসের
সাথে। একাডেমিক জগতের নিয়মিত প্রফেসররা তাঁর কাজের সাথে কখনো একমত হয়েছেন কখনো বা
হননি। আইনস্টাইন জোরালো ভাষায় তাঁর বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যাখ্যা করেছেন। একাডেমিক জগতের
কেউ কেউ এরকমও বলেছেন যে আইনস্টাইনের যেহেতু একাডেমিকদের মত ক্লাস নিতে হয়নি। পরীক্ষা দিতে
হয়নি, একাডেমিক মিটিং করতে হয়নি বা কোন নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়নি-
তাই স্বাধীনভাবে কাজ করে তা প্রকাশ করতে পেরেছেন তিনি। পরে অবশ্য আইনস্টাইন
নিজেও বলেছেন একাডেমিক প্রফেসররাও স্বাধীন নন।
বছরের শুরুতে আইনস্টাইন ভাবছেন ডক্টরেট ডিগ্রিটা না থাকলে প্যাটেন্ট অফিসেই কাটাতে হবে সারাজীবন। আরেকটি থিসিস লেখা দরকার। কিন্তু কী বিষয়ে লিখবেন? কোন ইউনিভার্সিটিতে? বার্ন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের হেড প্রফেসর ফরেস্টার একবার তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জুরিখ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ক্লেইনার তাঁর থিসিস ফেরত দিয়েছেন একবার। আবার থিসিস লিখলে কোথায় পাঠাবেন? ন্যাচারাল সোসাইটির জোসেফ সটারের পরামর্শ চাইলেন আইনস্টাইন। সটার বললেন জুরিখ ইউনিভার্সিটিতেই লেগে থাকতে।
আবারো প্রফেসর ক্লেইনারের কাছেই থিসিস পাঠাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু এবার কী নিয়ে লিখবেন? ক্লেইনার গতিশীল বস্তুর ইলেকট্রোডায়নামিক্স সম্পর্কে আইনস্টাইনের ধারণা পছন্দ করেছিলেন। আইনস্টাইন এ বিষয়ে থিসিস লিখে ক্লেইনারকে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু ক্লেইনার এবারো তাঁর থিসিস গ্রহণ করলেন না। ক্লেইনার বললেন, আইনস্টাইনের গাণিতিক বিশ্লেষণ বোধগম্য নয়। আইনস্টাইন রাগে গজরাতে লাগলেন। তিনি থিসিসটি একবারে ফেলে দিলেন না। ওটা নিয়ে আরো গবেষণা করতে লাগলেন। ম্যাক্স প্ল্যাংকের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে শুরুতে তিনি গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু এখন আবার পড়ার পর মনে হচ্ছে প্ল্যাঙ্ক ঠিক কথাই বলছেন, শক্তি গুচ্ছাকারে থাকতে পারে। কয়েকবার আগে প্রকাশিত ফিলিপ লেনার্ডের পেপারটাও আবার পড়ে দেখলেন আইনস্টাইন। লেনার্ডের রেজাল্টের সাথে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ করে আইনস্টাইন দেখলেন তত্ত্বের সাথে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল মিলে যায়। ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্টের ওপর পেপারটি লিখে ফেললেন আইনস্টাইন। মার্চের ১৭ তারিখে পেপারটি অ্যানালেন ডার ফিজিকে পাঠিয়ে দিলেন। জুনের নয় তারিখে পেপারটি প্রকাশিত হয়।
মার্চে পেপারটি পাঠানোর পরেই পিএইচডির থিসিস নিয়ে আবার চিন্তা শুরু করেছেন আইনস্টাইন। আরেকটি থিসিস লিখতেই হবে তাঁকে। কিন্তু কোন বিষয়ে? এই নিয়ে দুবার থিসিস লিখেছেন তিনি। দুবারই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রফেসর ক্লেইনার। একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে কফি খাচ্ছেন আইনস্টাইন ও বেসো। কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বেসোর সাথে কথা বলছেন আইনস্টাইন, “কফিতে চিনি মেশানোর পর কফির ভিসকোসিটি(সান্দ্রতা) বদলে যাচ্ছে। আরো কিছু চিনি মেশালে আরো বদলে যাবে। তার মানে চিনির কণার আয়তনের সাথে ভিসকোসিটির সম্পর্ক আছে। এখন যদি ভিসকোসিটি জানা থাকে, তাহলে আমরা চিনির অণুর আয়তন পরিমাপ করতে পারবো”। আণুবীক্ষণিক কণার আয়তন বের করার পদ্ধতি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করলেন আইনস্টাইন।
কয়েকদিন একটানা কাজ করে তিনি ডিফিউশান কনস্ট্যান্ট ও ভিসকোসিটির সম্পর্ক ব্যবহার করে কণার আয়তন নির্ণয়ের সমীকরণ বের করে ফেললেন। কয়েকদিনের মধ্যেই আরেকটি থিসিস লিখে এপ্রিলের শুরুতে পাঠিয়ে দিলেন প্রফেসর ক্লেইনারের কাছে। আইনস্টাইন জানেন ক্লেইনার অনেক সময় নিয়ে থিসিসটি পড়বেন। তারপর ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু আইনস্টাইনকে অবাক করে দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই ক্লেইনার তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। ক্লেইনার থিসিসটি প্রত্যাখ্যান করছেন, কারণ থিসিসটি পিএইচডি থিসিস হিসেবে খুবই সংক্ষিপ্ত। থিসিসটি ছিলো মাত্র সতেরো পৃষ্ঠা।
আইনস্টাইন আবারো রেগে গেলেন। থিসিসের দৈর্ঘ্যের ওপর কিছুই নির্ভর করে না। তিনি আবার থিসিসটি পড়ে দেখলেন। কোথাও কোন ভুল পেলেন না। থিসিসের শেষে আর একটি মাত্র লাইন যোগ করে থিসিসটি আবার পাঠিয়ে দিলেন ক্লেইনারের কাছে। এবার অবাক হবার পালা ক্লেইনারের। তিনি দেখলেন আইনস্টাইন কিছুই পরিবর্তন করেননি থিসিসের, দৈর্ঘ্য বেড়েছে মাত্র একলাইন। এত আত্মবিশ্বাসের কারণ কী? তিনি এবার আরো মনযোগ দিয়ে পড়ে দেখলেন থিসিসটি। থিসিসের বিষয়বস্তু চমৎকার, তবে জটিল গাণিতিক সমীকরণগুলো তিনি বুঝতে পারছেন না। ক্লেইনার থিসিসটি পাঠিয়ে দিলেন গণিত বিভাগের হেড হেনরিখ বার্কহার্ডকে(Heinrich Burkhardt)। বেশ কয়েকদিন পরে বার্কহার্ড তাঁর মন্তব্য সহ থিসিসটি ফেরত পাঠালেন ক্লেইনারের কাছে। বার্কহার্ড লিখেছেন, “থিসিসে যে পদ্ধতিতে গাণিতিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা নির্ভুল, এবং অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা ছাড়া এরকম কারো পক্ষে সম্ভব নয়”। ক্লেইনার থিসিসটি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গ্রহণ করে আইনস্টাইনকে অফিসিয়াল চিঠি দিলেন।
আইনস্টাইন এখন ডক্টর আইনস্টাইন। মহা আনন্দ ও উৎসাহে কয়েকদিনের মধ্যেই থিসিসটিকে গবেষণাপত্রের আকারে লিখে পাঠিয়ে দিলেন অ্যানালেন ডার ফিজিকে। কিন্তু জার্নালের এডিটর পল ড্রুডি পেপারটিতে কিছু জিনিস পরিবর্তন করা দরকার বলে ফেরত পাঠালেন। আইনস্টাইন ড্রুডির ওপর এমনিতেই বিরক্ত, এখন আরো বিরক্ত হলেন। এই পেপারটি প্রকাশিত হতে আরো ছয়মাস সময় লেগেছে।
আইনস্টাইন তাঁর পরবর্তী পেপার লেখার কাজে হাত দিলেন। কফিতে চিনি মেশানোর সময় যে ধারণাটি পেয়েছিলেন, চিনির অণুর আয়তন নির্ণয়ের ব্যাপারটিকে এখন অন্যভাবে ভাবছেন। তিনি ভাবছেন পানিতে চিনি দ্রবীভূত হয়ে যায়। পানির অণুগুলোর নিজস্ব একটি গতি আছে। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে এই গতিও বাড়তে থাকে। আপাত দৃষ্টিতে চিনি পানিতে মিশে গেছে মনে হলেও আসলে আণুবীক্ষনিক ভাবে তারা মেশেনা, কারণ সেখানে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটেনি। এখন পানির অণুর গতির কারণে চিনির অণুও গতিপ্রাপ্ত হয়। তরলে এই ছোট ছোট অণুর গতি কেমন হবে? আইনস্টাইন এ ধারণার কথা মাইকেল বেসোকে বলার সাথে সাথে বেসো বুঝতে পারলেন আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান মোশানের(Brownian motion) কথা বলছেন। কিন্তু বেসোর মুখে ব্রাউনিয়ান মোশান শুনে অবাক হয়ে গেছেন আইনস্টাইন। তিনি জানেন না ব্রাউনিয়ান মোশান কী, এর আগে কখনো নামও শোনেননি।
আইনস্টাইনের প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে তরল পদার্থে ছোট ছোট বস্তুকণার অনিয়মিত গতি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন স্কটিশ উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন। ব্রাউনের নামে এই গতির নামকরণ করা হলেও ব্রাউন কিন্তু এর কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আইনস্টাইন বেশ কয়েকদিন কাজ করে এ সম্পর্কে একটি তত্ত্ব দাঁড় করালেন। ব্রাউনিয়ান গতি সম্পর্কিত পেপারটি তৈরি হলো। পেপারটি জার্নালে পাঠিয়ে দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই অন্য একটি সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন তিনি।
আসলে এই সমস্যাটি নিয়ে আইনস্টাইন ভাবছেন অনেকদিন থেকে। ষোলবছর বয়সে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিলো আলোক রশ্মির সাথে সমবেগে ছুটতে পারলে কেমন হতো। স্থান ও সময়ের মধ্যে সম্পর্কের কথা মাথায় আসে তাঁর। প্রায় দুশ বছর আগে আইজাক নিউটন ধারণা দিয়ে গেছেন যে স্থান ও কাল পরম। অর্থাৎ মহাবিশ্বের যে কোন জায়গাতেই স্থান ও কালের পরিমাপ একই হবে। কিন্তু আইনস্টাইনের কাছে ব্যাপারটি সন্দেহযুক্ত। আর্নস্ট মাখ ও হেনরি পয়েনকেয়ারও একই সন্দেহ পোষণ করেছেন।
আইনস্টাইন ভাবছেন সময়ের কথা। দুটো ঘড়ি যদি একই স্থানে সমান সময় দেয়, তবে একটি ঘড়িকে অন্য একটি গ্রহে নিয়ে গেলেও কি সমান সময় দেবে? আইনস্টাইন দেখলেন যদি গ্যালিলিয়ান ট্রান্সফরমেশান (Galilean Transformation)বিবেচনা করা হয়, তবে দুটো ঘড়ি সবসময়েই সমান সময় দেবে। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হলো সব ট্রান্সফরমেশান কিন্তু গ্যালিলিয়ান নয়। সেক্ষেত্রে সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য নতুন ধরনের ট্রান্সফরমেশানের ধারণা দরকার। আইনস্টাইন লরেঞ্জের জ্যামিতি ব্যবহার করে সৃষ্টি করলেন লরেঞ্জ-আইনস্টাইন ট্রান্সফরমেশান সূত্র(Lorentz-Einstein transformation law)। নতুন এই সূত্রের সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। তিনি দেখালেন গতি হিসেব করার সময় ডপলারের ইফেক্ট হিসেব করতে হবে। নিঊটনের পরম গতির সমীকরণ এখানে খাটবে না। কারণ পরম গতি বলে কিছু নেই। সকম গতিই আপেক্ষিক। পৃথিবীর ভেতরে আমরা তা বুঝতে পারিনা, কারণ এখানে গতি হিসেব করার সময় আমরা আসলে কোন বস্তুর সাপেক্ষেই গতি হিসেব করি। পৃথিবীর নিজের গতির কথা বিবেচনায় না রেখে আমরা পৃথিবীকে স্থির ধরেই অন্যবস্তুর গতি হিসেব করি। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে গেলে রেফারেন্স হিসেবে একটা ফ্রেম রাখতেই হবে গতি হিসেব করার জন্য। এবং সে গতি হবে আপেক্ষিক গতি। এখানে থেকেই আপেক্ষিকতার সৃষ্টি হচ্ছে। রূপ নিচ্ছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব।
আইনস্টাইন হিসেব করে দেখলেন আলোর গতির চেয়ে বেশি কোন গতি হতে পারে না। তিনি আরো দেখলেন আলোর প্রবাহের জন্য ইথারের কোন প্রয়োজন নেই। পয়েনকেয়ারও একই কথা বলেছেন ইথার সম্পর্কে। আলো বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ প্রবাহের জন্য কোন ধরণের মাধ্যমের দরকার নেই। আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে করতে দেখলেন গতিশীল বস্তুর ভরও স্থির নয়। গতির সাথে বস্তুর ভর বেড়ে যায়। আইনস্টাইনের সূত্র মতে কোন বস্তু যদি আলোর বেগে চলে-তবে তার ভর অসীম হয়ে যায়। আইনস্টাইন ধারণা দিলেন আলো ছাড়া আর কোন কিছুই আলোর বেগে চলতে পারে না।
আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের গবেষণাপত্র জার্নালে পাঠিয়ে দিলেন জুনের ৩০ তারিখে। সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে পেপারটি প্রকাশিত হয়। পেপারটি জার্নালে পাঠিয়েই আইনস্টাইন সেটার একটি সম্পূরক পেপার লিখে ফেললেন। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সম্পূরক চার পৃষ্ঠার এই ছোট পেপারে আইনস্টাইন দেখিয়েছেন বস্তুর ভরের সাথে শক্তির সম্পর্ক। সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণ E=mc2,
অফিস থেকে ফিরেই গবেষণা নিয়ে বসেন, পরদিন আবার অফিস চলে যান-এরকম করতে করতে স্ত্রী-পুত্রের কথা প্রায় ভুলেই গেছেন তিনি। মিলেইভার ক্ষোভের শেষ নেই। নিজেকে বড়ই অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তাঁর। লিজেলের জন্য মন কেমন করে তাঁর। কিন্তু কাকে বলবেন সে কথা। স্বামী তো বিজ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত। তবুও তিনি অনেক মান অভিমান করে আইনস্টাইনকে রাজী করিয়েছেন কিছুদিন ছুটি নিতে। আইনস্টাইন কয়েক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন স্ত্রীপুত্রের সাথে। মিলেইভা নভি সাদে যেতে চাচ্ছেন। আইনস্টাইনের সাথে এখনো দেখা হয়নি শ্বশুর শাশুড়ির। তাঁর যেতে ইচ্ছেও করছে না। তাঁকে যে তাঁর শ্বশুর শাশুড়ি মন থেকে মেনে নেননি সেজন্য ক্ষোভ আছে তাঁর। এদিকে মিলেইভার মা-বাবা তাঁদের প্রথম নাতি হ্যান্সকে দেখার জন্য উদগ্রীব। আইনস্টাইন রাজী হলেন নভি সাদে যেতে।
নভি সাদে মিলেইভা আইনস্টাইনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর মাবাবার সাথে। শ্বশুর শাশুড়ি হাসিমুখেই বরণ করলেন আইনস্টাইনকে। মিলেইভার বাবাকে খারাপ লাগেনি আইনস্টাইনের। তবে সমস্যা হলো ভাষা নিয়ে।
আইনস্টাইন জার্মানভাষী। কিন্তু মিলেইভার মা-বাবা জার্মান জানেন না। মিলেইভা দোভাষীর কাজ করলেন। আইনস্টাইনের কিছুটা অস্বস্তি হলেও তা বেশিক্ষণ টিকলো না। কারণ তাঁর চেয়েও তাঁর ছেলের দিকেই সবার মনযোগ বেশি। আর যেহেতু এক বছর বয়সী হ্যান্সের সাথে কঠা বলার জন্য যে কোন ভাষাই যথেষ্ঠ, সেহেতু হ্যান্সের সাথেই কথা বলছেন সবাই।
বার্নে ফিরে এসে আইনস্টাইন দেখলেন তাঁর রিলেটিভিটি পেপারটি প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে। পরের কয়েকমাসে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না আইনস্টাইনের পেপারের। ম্যাক্স প্ল্যাংকের সাথে আইনস্টাইনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।জুরিখ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হেনরিখ জ্যানগার (Heinrich Zangger)তাঁর ব্রাউনিয়ান মোশান সংক্রান্ত পেপারটি সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছেন। আইনস্টাইন আরো অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া হবে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু সেরকম কিছুই হচ্ছে না এখনো। আশা করেছিলেন এবার অন্তত কোন ইউনিভার্সিটিতে একটি চাকরি পাবেন তিনি। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে প্যাটেন্ট অফিসেই সারাজীবন কাটাতে হবে তাঁকে।
বার্ন ইউনিভার্সিটিতে প্রাইভেটডোজেন পদে আরেকবার চেষ্টা করে দেখলেন আইনস্টাইন। এখন তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি আছে, বেশ কয়েকটি পেপার প্রকাশিত হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতা এখন তাঁর। কিন্তু এবারেও কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরেস্টার। এবং তিনি এখনো সেই আগের মতোই- কিছুই বোঝেন না। আইনস্টাইনকে তিনি এবারও অযোগ্য মনে করলেন।
প্রকাশনা
এবছর আইনস্টাইনের চারটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসকে
বদলে দেয়। পরবর্তীতে একশ বছর পরে এবছরকে স্মরণ করে পৃথিবীর মানুষ ২০০৫ সালকে আন্তর্জাতিক
পদার্থবিজ্ঞান বছর ঘোষণা করে।
পেপারঃ৬ “On a Heuristic Point of View Concerning the Production and Transformation of Light”.Annalen der Physik,সংখ্যা ১৭ (১৯০৫), পৃষ্ঠাঃ১৩২-১৪৮। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন আলোর কণা ফোটনের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দেখান আলো তরঙ্গের আকারে যেমন থাকে তার ধারণা ইতোমধ্যে ম্যাক্স প্ল্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। আলোর এরকম গুচ্ছাকার শক্তিকে আলোর কোয়ান্টা বলা হয়। আলোর কোয়ান্টা বা ফোটনের ধারণার ওপর ভিত্তি করে আইনস্টাইন দেখান যে, কোন বস্তুর ওপর আলো প্রতিফলিত হবার সাথে সাথে সে বস্তু থেকে কিছু ইলেকট্রন নির্গত নয়। অবশ্য এ ইলেকট্রন বেরিয়ে আসার জন্য কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির দরকার হয়। আলো যেহেতু তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, বস্তুর ওপর আলোকপাতের ফলে বস্তু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হবার ঘটনাকে বলা যায় একধরণের তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ।এই বিশেষ ধরণের বিকিরণের নাম ফটো-ইলেক্ট্রিক ইফেক্ট। ম্যাক্স প্ল্যাংকের শক্তির বিকিরণের সূত্র অনুযায়ী পদার্থের ভেতর ইলেকট্রনগুলোকে পদার্থ একধরণের আকর্ষণবল দ্বারা ধরে রাখে। পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের করতে আনতে হলে এই আকর্ষণবলের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। আইনস্টাইন হিসেব করে দেখান যে এই শক্তির পরিমাণ আলোর কম্পাঙ্কের সমাণুপাতিক। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলা যায়, শক্তি= প্ল্যাংকের ধ্রুবকx কম্পাঙ্ক (E=hv, h= Planck’s constant; v= frequency). আইনস্টাইন এই সম্পর্ক আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান ১৯২১ সালে। আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনেক উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। বিশেষ করে বোরের পরমাণু তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয় আইনস্টাইনের ফোটন তত্ত্বের ওপর। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে আইনস্টাইন ও বোরের মধ্যে অনেক তর্কবির্তক হয়েছে। আইনস্টাইন কখনোই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র মেনে নেননি। আইনস্টাইন বিশ্বাস করেছেন বিশ্বের সব ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতি থাকে। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে- পৃথিবীর সব ঘটনাই সম্ভাবনার সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
পেপারঃ৭ “On the Motion of small Particles Suspended in Liquids at Rest Required by the Molecular-Kinetic Theory of Heat”, Annalen der Physik,সংখ্যা ১৭ (১৯০৫), পৃষ্ঠাঃ ৫৪৯-৫৬০। এই প্রথমবারের মত আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতি (Brownian Motion) সম্পর্কে আলোচনা করলেন। কোন তরল পদার্থের ওপর খালি চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট ছোট পদার্থের কণা ভাসতে থাকলে কণাগুলোর গতি কোন নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায়না। তাদের গতি হয় অত্যন্ত অনিয়মিত। আঠারো শতকে স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ব্রাউন এ গতি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এ গতির নাম দেয়া হয়েছে ব্রাউনিয়ান গতি। আইনস্টাইন এ পেপারে প্রমাণ করেন যে এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের একভাগের সমান বা তার চেয়েও ছোট কণাগুলো তরল পদার্থে ওরকম বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করার কারণ হলো তাদের থার্মাল ডায়নামিক্স। বোলটজম্যানের সূত্র ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন। তিনি গ্যাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুগুলোর গতির গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আইনস্টাইনের এ পেপার থেকে পরবর্তীতে তাপের আণবিক- গতিতত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। আইনস্টাইনের পেপারগুলোর মধ্যে এই পেপারটিই এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখিত হয়েছে গবেষকদের গবেষণাপত্রে।
পেপারঃ৮ “On the Electrodynamics of Moving Bodies”. Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭ (১৯০৫), পৃষ্ঠাঃ ৮০১-৯২১। বাস্তব পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পর্যন্ত বদলে দিয়েছে যে দুটি পেপার, এ পেপারটি তার একটি। (অন্যটি পেপারঃ৯)। ১২১ পৃষ্ঠার বিশাল এই গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিশেষ সূত্র ব্যাখ্যা করেন। একই বেগে চলমান সকল পর্যবেক্ষকের কাছে আলোর বেগ স্থির ধরে নিয়ে আইনস্টাইন প্রমাণ করে দেন যে স্থান(space) এবং কাল (time)পরস্পর স্বাধীন নয়, বরং স্থান ও কাল একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এখান থেকেই জন্ম হলো স্পেস-টাইম বা স্থান কালের ধারণার। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতাকে x, y, z ধরে ত্রিমাত্রিক জগতের প্রচলিত ধারণা ভেঙে শুরু হলো চতুর্মাত্রিক জগৎ। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার সাথে যোগ হলো চতুর্থমাত্রা- সময়।
পেপারঃ৯ “Does the Inertia of a Body Depend on Its Energy Content”? Annalen der Physik, সংখ্যা ১৮ (১৯০৫), পৃষ্ঠাঃ ৬৩৯-৬৪১। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় সূত্র হলো E=mc2. আর এ সূত্রের জন্ম হয়েছে আইনস্টাইনের এই পেপারে। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ধারণাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আইনস্টাইন দেখালেন, বস্তু থেকে যে শক্তি নির্গত হয় তা বস্তুর ভরের পরিবর্তনের সমানুপাতিক। প্রাথমিকভাবে সূত্রটি ছিলোঃ m = E/c2
প্রথমবারের মত পদার্থের ভরের সংজ্ঞা দিলেন তিনি, “বস্তুর ভর হলো তার ভেতরের শক্তির পরিমাণ (The mass of a body is a measure of its energy content)”। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এতদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিলো। এখন থেকে স্থান ও কালের ধারণা অপরিহার্য হয়ে উঠলো যে কোন ধরণের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে। পদার্থবিজ্ঞানের সিমেট্রি বা সাম্যতার ধারণার ব্যাপক প্রভাব ফেললো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সূত্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের কৃতিত্বে ভাগ দিয়েছেন আইজ্যাক নিউটন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ও এইচ এ লরেঞ্জকে।
No comments:
Post a Comment