Saturday, 29 June 2019

আইনস্টাইনের কাল - পর্ব-১০


১৯০৬
জানুয়ারি মাসে আইনস্টাইন ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিলোঃ A New Determination of Molecular Dimensions.দুমাস পর প্যাটেন্ট অফিসের চাকরিতে প্রমোশন পেলেন আইনস্টাইন জটিল প্যাটেন্ট পরীক্ষায় দক্ষতার জন্য তাঁকে সেকেন্ড ক্লাস টেকনিক্যাল এক্সপার্ট পদে পদোন্নতি দেয়া হলো ছোটবোন মায়ার প্রেমিক পল উইন্টেলারের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আইনস্টাইনের

গতবছরে প্রকাশিত পেপারগুলোর প্রতিক্রিয়া কেমন হয় দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন আইনস্টাইন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী এইচ এ লরেঞ্জ ও ম্যাক্স প্ল্যাংক আইনস্টাইনের পেপারগুলো বুঝতে পেরেছেন এবং খুব প্রশংসা করেছেন আইনস্টাইনের ম্যাক্স প্ল্যাংককে খুব শ্রদ্ধা করতেন আইনস্টাইন অনেক বছর পরে প্ল্যাংক সম্পর্কে বলতে গিয়ে আইনস্টাইন বলেছেন, আমি যে কজন চমৎকার মানুষকে চিনি, ম্যাক্স প্ল্যাংক তাঁদের একজন কিন্তু একটু পরেই আইনস্টাইন তাঁর স্বভাবসুলভ ধারালো কথায় বলেছেন, কিন্তু তিনি আসলে ফিজিক্স বুঝতে পারেননি ফিজিক্স বুঝতে পারলে ১৯১৯ সালে চন্দ্রগ্রহণ চলাকালে অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে আলোর গতিপথ বদলে যায় কিনা দেখার জন্য সারারাত জেগে থাকতেন না তিনি আসলেই যদি আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বুঝতে পারতেন, তাহলে কী হবে তা আগে থেকেই জানতেন এবং জেগে না থেকে ঘুমাতে যেতেন, যেমন আমি ঘুমিয়েছি তবে আইনস্টাইন স্বীকার করেছেন যে ম্যাক্স প্ল্যাংকের মত বিজ্ঞানী সেদিন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সাপোর্ট করেছিলেন বলেই এত দ্রুত আরো অনেক বিজ্ঞানীর নজরে এসেছিলো তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব

আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সমালোচকদের সন্তুষ্ট করার জন্য আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা বিষয়ে আরো বিস্তারিত প্রবন্ধ প্রকাশ করার ব্যাপারে মনযোগী হলেন এরমধ্যেও মাঝে মাঝে ছেলে হ্যান্স  আলবার্টকে কিছুটা সময় দেন তিনি মিলেইভা নিজেকে খুব অবহেলিত মনে করছেন, কারণ আইনস্টাইনের সাথে ধরতে গেলে এখন কোন কথাই হয় না তাঁর প্রাত্যাহিক আর জৈবিক প্রয়োজন ছাড়া মিলেইভার কোন অস্তিত্বই যেন নেই আইনস্টাইনের কাছে

প্রকাশনা
এবছর আইনস্টাইনের তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে

পেপারঃ১০  A New Determination of Molecular Dimensions. Annalen der Physik 19,সংখ্যা ১৯ (১৯০৬), পৃষ্ঠাঃ ২৮৯-৩০৫ এটি আসলে আইনস্টাইনের ডক্টরেটের থিসিস ১৯০২ সালে প্রথমবার যে থিসিসটি জমা দিয়েছিলেন তা অযোগ্য বিবেচিত হবার তিনবছর পর ১৯০৫ সালে এ থিসিসটি জমা দেন গবেষণাপত্রের আকারে লিখে তা জার্নালে পাঠিয়েছিলেন গতবছর ৩০ এপ্রিল কিন্তু এডিটরের আপত্তির কারণে পেপারটি প্রকাশিত হতে দেরী হয় ক্লাসিক্যাল থার্মোডায়নামিক্সের সাথে ডিফিউশান থিওরির সংযোগ ঘটিয়ে বস্তুর আণবিক আকার নির্ধারণের একটি নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেন আইনস্টাইন তাঁর থিসিসে আইনস্টাইন চাচ্ছিলেন পরমাণুসমূহের আকার নির্ধারণে কী কী মৌলিক বিষয় সংযুক্ত তা খুঁজে বের করতে এই একই পেপার তিনি বার্নের একটি জার্নালেও প্রকাশ করেন

পেপারঃ১১  On the Therory of Brownian Motion. Annalen der Physikসংখ্যা ১৯ (১৯০৬), পৃষ্ঠাঃ ৩৭১-৩৮১ আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির ওপর তাঁর আগে প্রকাশিত কাজের আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন এ প্রবন্ধে ব্রাউনিয়ান গতির দুটো নতুন ঘটনার গাণিতিক হিসেব প্রতিষ্ঠা করেন তরলে ভাসমান আণুবীক্ষণিক কণা যদি ওপর থেকে নিচের দিকে কাঁপতে থাকে তাহলে অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে তার গতিপ্রকৃতি কীরকম হবে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয় এ প্রবন্ধে আর যদি একটি গোলকের মধ্যে কণাটি ঘুরতে থাকে, তাহলে তার গতিপ্রকৃতি কীরকম হবে তারও গাণিতিক ব্যাখ্যা করেন আইনস্টাইন জিন পেরিন (Jean Perrin)আইনস্টাইনের এ গাণিতিক কাজের ওপর পরীক্ষামূলক কাজ করে ১৯২৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান

পেপারঃ ১২  The Principle of Conservation of Motion of the Center of Gravity and the Inertia of Energy. Annalen der Physik,সংখ্যা ২০ (১৯০৬), পৃষ্ঠাঃ ৬২৭-৬৩৩ এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন একটি ফাঁপা সিলিন্ডারের মধ্য দিয়ে শক্তিচালনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভর ও শক্তির মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করেন শক্তি ও ভরের মধ্যে একটি সাম্যতার সূত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন তিনি

১৯০৭
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে করতে আইনস্টাইন নিজেকে প্রশ্ন করছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সব তত্ত্বই প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে আপেক্ষিক সেক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণও কেন আপেক্ষিক হবে না? প্যাটেন্ট অফিসে কাজের ফাঁকে হঠাৎ তাঁর মনে হলো কেউ যদি মুক্তভাবে উপর থেকে নিচের দিকে পড়তে থাকে, তাহলে সে কোন ধরণের ওজন অনুভব করবে না কারণ লোকটির সাথে সাথে তার চারপাশের সবকিছুও তো পড়ে যাচ্ছে মনে হবে, সেক্ষেত্রে সে কীভাবে বুঝবে যে সে মাধ্যাকর্ষণ বলের ভেতরে আছে কি নেই অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কোন ধরণের রেফারেন্স পয়েন্ট নেই এক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে সে স্থির আছে, কিন্তু বাকি সবকিছু চলে যাচ্ছে উপরের দিকে তারমানে মাধ্যাকর্ষণও আপেক্ষিক পরবর্তীতে তাঁর এ ধারণা থেকেই জন্ম নেয় আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্র(General Theory Of Relativity) আইনস্টাইন তাঁর এ ধারণাকে বর্ণনা করেছেন জীবনের আনন্দময় ধারণা হিসেবে এবছর আইনস্টাইন বুধগ্রহের গতিপ্রকৃতির বিষয়েও কিছুটা আগ্রহী হয়ে ওঠেন

আইনস্টাইনের পেপারগুলো ইউরোপের বিখ্যাত সব পদার্থবিজ্ঞানীর নজরে আসতে শুরু করেছে ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনে ম্যাক্স প্ল্যাংকের সহকারী ম্যাক্স ভন লাউ(Max Von Laue) রিলেটিভিটি থিওরির প্রতি আগ্রহী হয়ে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে চাইলেন ভন লাউ ভেবেছিলেন আইনস্টাইন ইউনিভার্সিটি অব বার্নের প্রফেসর কিন্তু ম্যাক্স প্ল্যাংকের কাছে যখন শুনলেন আইনস্টাইন বার্নের প্যাটেন্ট অফিসে কাজ করেন, ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন তিনি বার্নে এলেন আইনস্টাইনের সাথে দেখা করার জন্য

বার্নের প্যাটেন্ট অফিসে এসে ম্যাক্স ভন লাউ আইনস্টাইনের খোঁজ করলে অফিসের সেক্রেটারি আইনস্টাইনকে খবর পাঠালেন ভন লাউ আইনস্টাইনকে দেখেনি আগে কখনো তিনি লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে লাগলেন আইনস্টাইনের জন্য আইনস্টাইন এসে লাউঞ্জে উঁকি মেরে দেখলেন ভন লাউ আইনস্টাইনকে দেখে ভেবেছেন অফিসের কোন পিয়ন তিনি আবার কাগজ পড়ায় মন দিলেন আইনস্টাইনও ভন লাউকে আগে কখনো দেখেননি তিনি সেক্রেটারির কাছে গিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে জানলেন যে এই ভদ্রলোকই ম্যাক্স ভন লাউ আইনস্টাইন ভন লাউয়ের কাছে এসে বললেন,
-আপনি কি ম্যাক্স ভন লাউ?
-হ্যাঁ
-আইনস্টাইনের জন্য অপেক্ষা করছেন?
-হ্যাঁ আপনি?
-আমিই আইনস্টাইন

ভন লাউ অপ্রস্তুত হয়ে হাত মেলালেন ভন লাউ ভেবেছিলেন আইনস্টাইনের তত্ত্বের মত ব্যক্তি আইনস্টাইনও আকর্ষণীয় হবেন কিন্তু একমাথা এলোমেলো চুলের অপরিপাটি পোশাকের এই লোকটিই যে আইনস্টাইন তা তিনি ভাবতেও পারেননি কিছুক্ষণ কথা বলার পর আইনস্টাইন ভন লাউকে অফিস ছুটির পর নিজের এপার্টমেন্টে নিমন্ত্রণ করলেন ভন লাউ আইনস্টাইনের অফিস ছুটির পর আবার এলেন দুজনে কথা বলতে বলতে এপার্টমেন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন বার্লিনে আইনস্টাইনের পেপার নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে জানতে পেরে খুশি হলেন আইনস্টাইন তিনি পকেট থেকে সিগার বের করে ভন লাউয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন ভন লাউ সিগারটি নিয়ে গন্ধ শুঁকে প্রায় আঁৎকে উঠলেন এরকম সাধারণ মানের সিগার টানেন আইনস্টাইন! তিনি সিগারটি আস্তে করে কোটের পকেটে চালান করে দিলেন পরে ব্রিজের ওপর দিয়ে আরি নদী পার হবার সময় সিগারটি নদীতে ফেলে দেন ভন লাউ আইনস্টাইন এসবের কিছুই খেয়াল করলেন না তিনি রিলেটিভিটি থিওরি ব্যাখ্যা করতে করতে হাঁটছেন!
ম্যাক্স ভন লাউ আইনস্টাইনকে বার্লিনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন আইনস্টাইন দেখলেন গটিনজেন ইউনিভার্সিটি থেকে একটি চিঠি এসেছে তাঁর নামে খুশি হয়ে খুলে দেখেন জুরিখের পলিটেকনিকে তাঁর গণিত শিক্ষক হারম্যান মিনকৌস্কির চিঠি মিনকৌস্কি ১৯০২ সালে পলিটেকনিকের চাকরি ছেড়ে গটিনজেন ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছেন বিখ্যাত গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের সহকারী হিসেবে হিলবার্ট ও মিনকৌস্কি পদার্থবিজ্ঞানের ভৌতকাঠামো বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেছেন সম্প্রতি আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি পেপারের কথা শোনার পর তাঁরা ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেছেন মিনকৌস্কি কখনো ভাবতেই পারেননি যে সেই ক্লাস ফাঁকি দেয়া আইনস্টাইনের পক্ষে এরকম কিছু করা সম্ভব মিনকৌস্কি আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছেন তাঁর পেপারটির একটি কপি পাঠিয়ে দেবার জন্য
পরে মিনকৌস্কি আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি পেপারটির ওপর আরো কাজ করেন তিনি আইনস্টাইনের গাণিতিক সমীকরণগুলোকে চতুর্থ মাত্রায় উন্নীত করেন সময়কেও স্থানের আরেকটি মাত্রা ধরে- সৃষ্টি হলো চতুর্মাত্রিক বিশ্বের আইনস্টাইন প্রথম দিকে মেনে নিতে চাননি তাঁর সমীকরণগুলোর পরিবর্তন তিনি যেন নিজেই চিনতে পারছিলেন না নিজের আবিষ্কৃত সমীকরণ কিন্তু পরে দেখলেন গণিতবিদ মিনকৌস্কির হাতে পড়ে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলো আর সুন্দর হয়ে ওঠেছে

প্রকাশনাঃ
এ বছর পাঁচটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের

পেপারঃ১৩  Plancks Theory of Radiation and the Theory of Specific Heat.Annalen der Physik,সংখ্যা ২২ (১৯০৭), পৃষ্টাঃ ১৮০-১৯০ কঠিন পদার্থের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর লেখা আইনস্টাইনের প্রথম পেপার এ পেপারে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সম্ভাবনার সূত্র প্রয়োগ করে প্ল্যাংকের রেডিয়েশান ফর্মুলার গাণিতিক প্রমাণ দেন মাস তিনেক পরে অবশ্য এ পেপারের একটি সংশোধনীও প্রকাশিত হয় এ পেপারটিকে আপেক্ষিক তাপের ক্ল্যাসিক পেপার বলা হয় পরমশূন্য তাপমাত্রা থেকে কক্ষতাপমাত্রা পর্যন্ত তাপমাত্রার ব্যপ্তিতে কঠিন পদার্থের আপেক্ষিক তাপের ধর্মের একটি পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এই পেপারে

পেপারঃ১৪  On the Limit of Validity of the Law of Thermodynamic Equilibrium and on the Possibility of a New Determination of the Elementary Quanta.Annalen der Physik,সংখ্যা ২২ (১৯০৭), পৃষ্ঠাঃ ৫৬৯-৫৭২ ইলেক্ট্রিক কন্ডেনসার বা বৈদ্যুতিক ধারকের ভোল্টেজের ওঠানামা সম্পর্কে ধারণা পাবার জন্য আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির থার্মোডায়নামিক্স ব্যবহার করেন এ পেপারে তাঁর তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণের জন্য তাঁর একটি নতুন ধরণের ইলেকট্রোমিটারে দরকার হলো প্রচলিত ইলেকট্রোমিটারগুলো এত সূক্ষ্মমাত্রার ভোল্টেজ মাপতে পারে না আইনস্টাইনের দরকার একটি ইলেকট্রোমিটার যেটা একহাজার ভাগের একভোল্টের চেয়েও ছোটমাত্রার ভোল্টেজ মাপতে পারবে আইনস্টাইন নিজেই এই যন্ত্রের ডিজাইন তৈরি করে যন্ত্রটি বানিয়ে নিলেন যন্ত্রটির নাম দিলেন Maschinchen বা ছোট মেশিন তিনি ভাবলেন যন্ত্রটির প্যাটেন্ট নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করার ব্যবস্থা করবেনকিন্তু যন্ত্রপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিও কোন আগ্রহ দেখালো না আইনস্টাইনের ছোট মেশিন-এর প্রতি আইনস্টাইন প্যাটেন্ট নেবার চিন্তা বাদ দিয়ে পরের বছর মেশিনটির প্রস্তুতপ্রণালী বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন

পেপারঃ১৫  Theoretical Remarks on Brownian Motion. Zeitschrift fur Elektrochemie und Angewandte Physikalishche Chemie,সংখ্যা ১৩ (১৯০৭), পৃষ্ঠাঃ ৪১-৪২ আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছেন যে গাণিতিক দক্ষতার অভাবে অনেক সময় পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক কিছু বিষয় বোঝা যায় না এ পেপারে আইনস্টাইন জটিল গণিত ছাড়াই সহজভাবে ব্রাউনিয়ান গতির ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করলেন আইনস্টাইন দেখালেন যে তরলে ভাসমান পদার্থের ব্যতিক্রমধর্মী গতির কারণে পরীক্ষাগারে তা হুবহু পরীক্ষা করেও দেখা সম্ভব হয়না

পেপারঃ১৬  On the Inertia of Energy Required by the Relativity Principle. Annalen der Physik, সংখ্যা ২৩ (১৯০৭), পৃষ্ঠাঃ৩৭১-৩৮৪ ১২ নম্বর পেপারে আইনস্টাইন পদার্থের ভর ও শক্তির মধ্যে সাম্যের সম্পর্ক আলোচনা করেছিলেন এই পেপারে তিনি যুক্তি দিলেন, প্রত্যেক বস্তুর ভরের সমানুপাতিক একটি শক্তি থাকবে, সেরকম প্রত্যেক শক্তিরই সমানুপাতিক একটি ভর থাকবে তার মানে, ভরহীন ফোটনের যেহেতু শক্তি আছে, সেহেতু ফোটন রুপান্তরিত হয়ে বস্তুতে পরিণত হতে পারে আবার বস্তু রুপান্তরিত হয়ে শক্তিতে পরিণত হতে পারে এই পেপারে তিনি ভর ও শক্তির বিখ্যাত সূত্র E= mc2  প্রতিষ্ঠা করেন

পেপারঃ১৭  On the Relativity Principle and the Conclusions Drawn from It. Jahrbuch der Radioaktivitat und Elektronik (Yearbook of Radioactivity and Electronics)সংখ্যা ৪ (১৯০৭), পৃষ্ঠাঃ ৪১১-৪৬২ এ পেপারের কিছু সংশোধনী প্রকাশিত হয়েছে পরের বছর Jahrbuch der Radioaktivitat und Elektronik(Yearbook of Radioactive and Electronics)সংখ্যা ৫ (১৯০৮), পৃষ্ঠাঃ ৯৮-৯৯ রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা বিষয়ে দীর্ঘ এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলোর সারসংক্ষেপ আলোচনা করেন এ গবেষণাপত্রে একটি কণার আপেক্ষিক গাণিতিক প্রক্রিয়া, অপটিকস, তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব এবং আপেক্ষিক গতিবিদ্যার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেন আইনস্টাইন তারপর একাধিক কণার সমন্বয়ে তৈরি একটি বড় পদার্থের ওপর  আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রয়োগ করলে তা কীরকম হবে তার ব্যাখ্যা দেন তিনি প্রমাণ করে দেখান যে কোন বস্তুর প্রাথমিক ভর ও অভিকর্ষজ ভরের মান সমান এবং উভয় ক্ষেত্রেই তার মান  এখান থেকেই ১৯১৫ সালে তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বা জেনারেল রিলেটিভিটি প্রতিষ্ঠিত হয়

১৯০৮
বছরের শুরুতে প্রফেসর ক্লেইনারের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলেন আইনস্টাইন জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর ক্লেইনার বেশ কয়েকবছর ধরে চেষ্টা করছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করতে তাতে তাঁর ক্লাসের চাপ কিছুটা কমবে প্রফেসর ক্লেইনার এখন ইউনিভার্সিটির রেক্টর(rector) হয়েছেন এবং পদসৃষ্টির ব্যাপারে আগের চেয়ে কিছুটা বেশি ক্ষমতা লাভ করেছেন ক্লেইনার শুরুতে তাঁর প্রাক্তন সহকারী ফ্রেডরিক এডলারের (Friedrich Adler)কথা ভেবেছিলেন এডলারকে তিনি ইউনিভার্সিটির প্রাইভেটডোজেন্ট হবার জন্য দরখাস্ত করতেও বলেছিলেন কিন্তু এখন তিনি এডলারের ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট কারণ এডলার সম্প্রতি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন এডলারের বাবা অস্ট্রিয়ান সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ক্লেইনার এখন আইনস্টাইনের কথা ভাবছেন
আইনস্টাইনের থিসিস ডিরেকটর তিনি, আইনস্টাইনের কাজের সাথেও তিনি পরিচিত তাছাড়া আইনস্টাইনের সাম্প্রতিক পেপারগুলো নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে ফিজিক্স কমিউনিটির মধ্যে এখন আইনস্টাইন যদি প্রাইভেটডোজেন্ট হতে পারেন কোন ইউনিভার্সিটির, তাহলে তাঁকে জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর পদে নিয়োগ দিতে সুবিধা হবে ক্লেইনার আইনস্টাইনকে লিখেছেন বার্ন ইউনিভার্সিটিতে প্রাইভেটডোজেন্ট পদের জন্য দরখাস্ত করতে আইনস্টাইন জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর পদের সম্ভাবনার কথা শুনে খুশি হয়েছেন কিন্তু তার আগে বার্ন ইউনিভার্সিটির প্রাইভেটডোজেন্ট হতে হবে তাঁকে তিনি তো পরপর দুবার দরখাস্ত করেও ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে ক্লেইনার সম্ভবত তা জানেন না আইনস্টাইন ক্লেইনারকে জানালেন বার্ন ইউনিভার্সিটিতে তাঁর ব্যর্থতার কথা ক্লেইনার লিখলেন, হতোদ্যম না হয়ে আবার দরখাস্ত করতে

আইনস্টাইন আবার একটি থিসিস লিখলেন, প্রকাশিত পেপারপগুলোর কপি সংগ্রহ করে আবার দরখাস্ত করলেন বার্ন ইউনিভার্সিটিতে আইনস্টাইন এবারও খুব একটা আশাবাদী নন প্রফেসর ফরেস্টার কি তাঁর রিলেটিভিটি পেপার বুঝতে পারবেন এবার? কিন্তু বার্ন ইউনিভার্সিটির অনেক কিছুই বদলে গেছে এবার আইনস্টাইনের জন্য আইনস্টাইন যে ইতোমধ্যেই ইউরোপে বিখ্যাত হতে শুরু করেছেন তা বার্ন ইউনিভার্সিটির অনেক শিক্ষক কর্মকর্তা জানেন আইনস্টাইন এই ইউনিভার্সিটিতে পরপর দুবার প্রাইভেটডোজেন্ট হতে ব্যর্থ হয়েছেন তা যে ইউনিভার্সিটিরই ব্যর্থতা তা তাঁরা বুঝতে পারছেন আইনস্টাইনকে তাঁরা সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি এই লজ্জায় তাঁরা সংকুচিত হয়ে আছেন এবার আইনস্টাইনের সবকিছুই বিনাবাক্যব্যয়ে গ্রহণ করলেন তাঁরা ফেব্রুয়ারি মাসেই আইনস্টাইন বার্ন ইউনিভার্সিটির প্রাইভেটডোজেন্ট বা অবৈতনিক খন্ডকালীন লেকচারার নিযুক্ত হলেন

এতদিন পরে ইউনিভার্সিটির একটি চাকরি পেয়ে খুশি হলেন আইনস্টাইন কিন্তু তিনি জানেন এতে অর্থনৈতিক ভাবে কোন লাভ হবেনা তাঁর এখনো তাঁকে দৈনিক আটঘন্টা কাজ করতে হবে প্যাটেন্ট অফিসে তাই বার্ন ইউনিভার্সিটিতে তাঁর লেকচারের সময় নির্ধারণ করতে হয়েছে অফিসের আগে বা পরে গ্রীষ্মের শুরুতে সকাল সাতটায় শুরু হলো আইনস্টাইনের প্রথম লেকচার দেখা গেলো মাত্র তিনজন ছাত্র এসেছেন লেকচারে আর তিনজনই তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু; মাইকেল বেসো,লুসিন শ্যাভেন ও হ্যানরিখ শেঙ্ক আইনস্টাইন ফরমাল লেকচার দিতে খুব একটা উৎসাহ পেলেন না পুরো সেমিস্টার ধরে এই তিনজনের বেশি শ্রোতা পাওয়া গেলো না মাঝে মাঝে অবশ্য মায়া এসে বসেন ক্লাসে মায়া বার্ন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন রোমান্টিক ল্যাংগুয়েজ বিষয়ে আইনস্টাইন লেকচারের জন্য প্রস্তুতি নিতেও উৎসাহ পাননা তিনজনের জন্য কী প্রস্তুতি নেবেন মাঝে মাঝে দেখা যায় শুধু একজন আছেন ক্লাসে এসব করার কোন মানে হয় না কিন্তু ক্লেইনার বলেছেন জুরিখে প্রফেসরশিপ পাওয়া যেতে পারে লেকচারের এই অভিজ্ঞতাটুকু না থাকলে চলবে না তাই চালিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে তাঁর এই লেকচার

মার্চে উইলহেলম উইনের(Wilhelm Wien) ছাত্র জ্যাকব লাউব (Jakob Laub)বার্নে এলেন আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে লাউব এরমধ্যে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন এবং দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তিনিও ভন লাউয়ের মত ভেবেছিলেন আইনস্টাইন বার্ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর প্যাটেন্ট অফিসে আইনস্টাইনকে আবিষ্কার করে হাহাহা করে হাসলেন দুজন জ্যাকব লাউব আইনস্টাইনের সাথে কথা বলার মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি বার্নে তিনমাস ধরে থেকে আইনস্টাইনের সাথে যৌথভাবে গবেষণা করে দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন জ্যাকব লাউব হলেন আইনস্টাইনের প্রথম গবেষণা-সহকর্মী

এদিকে হারম্যান মিনকৌস্কি (Hermann Minkowski)আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের গাণিতিক সূত্রকে জ্যামিতিক পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করেন এবং স্থান ও কালের সমন্বয় সাধন করে চতুর্মাত্রিক জ্যামিতির ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার নিয়মের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করেন মিনকৌস্কি

প্রকাশনাঃ
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের চারটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা

পেপারঃ১৮  A New Electrostatic method for the Measurement of Small Quantities of Electricity.Physikalische Zeitschrift,সংখ্যা ৯ (১৯০৮), পৃষ্ঠাঃ২১৬-২১৭ আইনস্টাইন তাঁর ১৪ নম্বর পেপারে ব্যবহৃত ছোট মেশিন তৈরির মূল পদ্ধতি ও তার কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করেন এই গবেষণাপত্রে

পেপারঃ১৯  Elementary Theory of Brownian Motion. Zeitschrift fur Elektrochemie and ungewandte physikalische Chemie,সংখ্যা ১৪ (১৯০৮), পৃষ্ঠাঃ২৩৫-২৩৯ ব্রাউনিয়ান গতি নিয়ে অনেক রসায়নবিদ পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন তাঁরা আইনস্টাইনের ব্রাউনিয়ান গতি সম্পর্কিত তত্ত্ব ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রায় সময়েই তা ঠিকমত বুঝতে না পেরে সঠিক ফল পাচ্ছিলেন না আইনস্টাইন তাঁর ব্রাউনিয়ান তত্ত্বের একটি বিস্তৃত অথচ সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এ গবেষণাপত্রে ডিফিউশান ও অসমোটিক প্রেসারের মধ্যে সম্পর্কের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে এ প্রবন্ধে এ তরলে ব্রাউনিয়ান গতির আণুবীক্ষনিক কণাগুলো ভাসতে থাকে, সে তরল পদার্থ যদি কণাগুলোকে তরলে দ্রবীভূত করে ফেলে, তাহলে তরল ও ব্রাউনিয়ান কণাগুলোর মধ্যে ডিফিউশান কনস্ট্যান্ট কত হবে তাও বের করেন আইনস্টাইন

পেপারঃ২০  On the Fundamental Electromagnetic Equations for Moving Bodies.(সহলেখক- জ্যাকব লাউব),Annalen der Physik,সংখ্যা ২৬ (১৯০৮), পৃষ্ঠাঃ ৫৩২-৫৪০ আইনস্টাইন এ পেপারের একটি সংশোধনী প্রকাশ করেন পরের সংখ্যায়,Annalen der Physik, সংখ্যা ২৭ (১৯০৮), পৃষ্ঠাঃ২৩২ এ পেপারের একটি সংযোজনী প্রকাশিত হয় পরের বছর: Annalen der Physik,সংখ্যা ২৮ (১৯০৯), পৃষ্ঠাঃ ৪৪৫-৪৪৭ শূন্যস্থানে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সমীকরণগুলোর ওপর আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রয়োগ করলে তা কীরকম আকার ধারণ করবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ গবেষণাপত্রে

পেপারঃ২১  On the Ponderomotive Forces Exerted on Bodies at Rest in the Electromagnetic Field.(সহলেখক- জ্যাকব লাউব)Annalen der Physik,সংখ্যা ২৬ (১৯০৮) পৃষ্ঠাঃ ৫৪১-৫৫০ আইনস্টাইন পেপার ২০ ও ২১ রচনা করেছেন মাত্র তিনসপ্তাহ সময়ের মধ্যেএ দুটো গবেষণাপত্রে আইনস্টাইনের সাথে কাজ করেছেন জ্যাকব লাউব জ্যাকব লাউব হলেন আইনস্টাইনের প্রথম বৈজ্ঞানিক সহযোগী এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন ও লাউব কোন গতিশীল পদার্থের মধ্যে প্রবাহিত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের ওপর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রয়োগ করলে তার প্রকৃতি কেমন হবে তা বিশ্লেষণ করেন বছরখানেক আগে হেরম্যান মিনকৌস্কি আপেক্ষিকতার তত্ত্বের যে কাঠামো তৈরি করেছেন, আইনস্টাইন ও লাউব সে কাঠামোর প্রয়োগ করলেন এই গবেষণাপত্রে


No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts