কয়েক মাস পর সেপ্টেম্বরে প্রিন্সটনে
চলে গেলেন ডিরাক। ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড স্টাডিজের ফাইন হলে ডিরাকের অফিস।
ডিরাকের পাশের রুমেই বসেন ইউজিন উইগনার এবং তাঁর পাশের রুমে আইনস্টাইন।
ডিরাক
আর আইনস্টাইনকে একই সাথে প্রিন্সটনে পেয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে একটা বিরাট আশার সঞ্চার
হয়েছিল যে এই দু’জন মহারথী একসাথে কাজ করবেন। কিন্তু
ডিরাক আর আইনস্টাইনের মধ্যে কোন রকমের বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা গড়ে ওঠেনি। কারণ
আইনস্টাইন ভালো ইংরেজি জানতেন না আর ডিরাক তাঁর স্বভাবমতো আইনস্টাইনের সাথেও কথা
বলতে আগ্রহী ছিলেন না।
ডিরাককে
প্রিন্সটনে স্বাগত জানান এবং সব ব্যাপারে সহযোগিতা করেন প্রফেসর উইগনার।
হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার ডিরাকের সমবয়সী। প্রিন্সটনে যোগ দিয়েছেন ১৯২৯
সালে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট অবদান রেখে বৈজ্ঞানিক সমাজে মর্যাদা
লাভ করেছেন। [১৯৬৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান উইগনার।]
উইগনার
ডিরাককে দেখিয়ে দিলেন প্রিন্সটনের কোথায় কী পাওয়া যায়, কোন্ রেস্টুরেন্টে ভালো
লাঞ্চ পাওয়া যায়, ডিনারের জন্য কোথায় গেলে ভালো ইত্যাদি।
ইউনিভার্সিটি
ক্যাম্পাস থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই টাউন সেন্টার। লাঞ্চ টাইমে একা একা
হাঁটতে হাঁটতে টাউন সেন্টারে গিয়ে উইগনারের নির্দেশিত রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন ডিরাক।
ঢুকতেই বেশ জোরালো হাসির শব্দ শুনে এক কোণার টেবিলের দিকে নজর গেলো।
ডিরাক
দেখলেন টেবিলে বসে আছেন উইগনার এবং তাঁর সামনের চেয়ারে বসে খিলখিল করে হাসছেন এক
যুবতী। তার চেহারার সাথে উইগনারের চেহারার আশ্চর্য মিল। বয়সে উইগনারের চেয়ে কয়েক
বছরের ছোট মনে হচ্ছে, কিন্তু মুখে লম্বা কালো পাইপ এবং পাইপের আগায় জ্বলন্ত
সিগারেট। ডিরাক থমকে দাঁড়ালেন। বুঝতে পারছেন না উইগনারের দিকে এগিয়ে যাবেন, নাকি
অন্য কোন টেবিলে গিয়ে বসবেন।
উইগনার
বসেছিলেন দরজার দিকে পিঠ দিয়ে। তাই ডিরাককে দেখতে পাননি তিনি। কিন্তু সামনে বসা
তাঁর ছোটবোন মার্গিট ডিরাককে দেখতে পেয়েছেন। লম্বা পাতলা কুঁচকানো পুরনো স্যুট পরা
অতি-সাধারণ যুবকটিকে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াতে দেখে মার্গিট জিজ্ঞেস করলেন,
“লোকটা অদ্ভূত তো?”
“কোন্ লোকটা?”
“পেছনে দেখো। আমার দিকে তাকিয়ে আছে হা করে।”
পেছনে তাকিয়ে দেখলেন উইগনার।
“আরে কাকে কী বলছিস? ইনি পল ডিরাক। কেমব্রিজের
বিরাট ফিজিসিস্ট। গতবছর নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আমাদের ভিজিটিং প্রফেসর।”
হাত
তুলে ডিরাককে ডাকলেন উইগনার - “প্রফেসর ডিরাক,
আমাদের টেবিলে চলে আসুন।”
ডিরাক
এগিয়ে এসে বসলেন উইগনারের পাশে মার্গিটের মুখোমুখি। উইগনার পরিচয় করিয়ে দিলেন, “আমার ছোটবোন মার্গিট। বুদাপেস্টে থাকে, আমার কাছে
বেড়াতে এসেছে।”
“হ্যালো প্রফেসর ডিরাক। নাইস টু মিট ইউ” - বললেন মার্গিট।
ডিরাক
কিছুই বললেন না। চুপচাপ তাকিয়ে খেয়াল করলেন মার্গিটের ইংরেজিতে হাঙ্গেরিয়ান টান
প্রবল।
ডিরাক
কিছুই বলছেন না দেখে মার্গিট খুব অবাক হলেন, তার চেয়েও বেশি অবাক হলেন ডিরাকের
পোশাক দেখে। জামাকাপড় যা পরে আছেন তা মনে হচ্ছে এক যুগ পুরনো। ডিরাককে দেখে একজন
বোকা সাদামাটা মানুষ বলেই মনে হয়। না চিনলে কেউ ভাবতেই পারবেন না যে এই মানুষটা
একজন নোবেল লরিয়েট।
“তারপর বলুন কেমন আছেন?” ভদ্রতার খাতিরে প্রশ্ন করেন মার্গিট। ডিরাক ভাবলেশহীন চোখে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন, “কেন জানতে চাচ্ছেন?”
মার্গিট
বুঝতে পারছেন না ডিরাক কি পাগল নাকি অন্যকিছু। ডিরাক চুপচাপ দেখছেন মার্গিটকে। খুবই দামী এবং অভিজাত
পোশাক তাঁর পরনে। সিগারেট টানার ভঙ্গিতেও একটা রাজকীয় ভাব আছে। আর কথায় কথায় হেসে
ওঠার অভ্যাস তাঁর।
নীরবতা
ভাঙার জন্য মার্গিট বললেন, “বাইরে বেশ দমকা
হাওয়া আজ।”
ডিরাক
কিছু না বলে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীর পায়ে চলে গেলেন রেস্টুরেন্টের
বাইরে। মার্গিট বুঝতে পারলেন না কী হলো। ডিরাক কি রাগ করে চলে গেলেন?
মার্গিট
তাকিয়ে দেখলেন ডিরাক রাস্তায় গিয়ে দুই হাত উপরের দিকে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন।
কয়েক
মিনিট পরে ফিরে এলেন ডিরাক। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “হ্যাঁ, বাইরে বেশ দমকা হাওয়া।”
মার্গিটের
মুখ হা হয়ে গেলো। এত সরল মানুষও হয়! ডিরাকের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করলেন
মার্গিট। ডিরাকের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি - গভীর স্নিগ্ধ বিষন্ন একজোড়া
চোখ, যেখানে তাঁর মত আকর্ষণীয়া যুবতীর জন্যও কামনার কোন ছিঁটেফোঁটা নেই।
মুনি
দেখলেই ধ্যান ভাঙাতে ইচ্ছে করে মেয়েদের। মার্গিটেরও ইচ্ছে হলো ডিরাক-মুনির ধ্যান
ভাঙাবার।
ডিরাক
প্রিন্সটন ক্যাম্পাসের কাছে একটি বাসা ভাড়া করে একাকী থাকছেন। যতক্ষণ অফিসে থাকেন
তাঁর কোয়ান্টাম মেকানিক্স বইটার দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ করেন। তারপর নতুন কিছু
গাণিতিক সমস্যার কাজ। উইগনার তাঁর একাডেমিক কাজে ভীষণ ব্যস্ত। মার্গিট ডিরাককে সময়
দিতে শুরু করলেন। প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ডিরাকের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হন তিনি।
ডিরাককে নিয়ে বেরিয়ে যান ডিনারে। শুরুতে ডিরাক চুপ করে শুনেই যেতেন মার্গিটের কথা।
মাঝে মাঝে ‘এক ডিরাক’ বা ‘দুই ডিরাক’ কথা বলতেন।
মার্গিট
বলে যান নিজের কথা। চার বছরের বড় ভাই ইউজিনের মেধার সাথে তুলনা করলে নিজেকে গাধা মনে
হয় মার্গিটের। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে গাধা ভাবতে ভাবতে পড়ালেখা যেটুকু হতে পারতো
তাও হয়নি। মা-বাবা সারাক্ষণই ‘পড়ো’ ‘পড়ো’ করতে করতে
পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ নষ্ট করে ফেলেছে মার্গিটের। মার্গিট সারাক্ষণই ভাবতো কীভাবে
মা-বাবার হাত থেকে পালানো যায়। বাড়ি থেকে চলে যাবার জন্যই সে কিশোর বছর বয়স থেকেই
বেছে বেছে ধনী ছেলেদের সাথে প্রেম করতে শুরু করে। উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলে
রিচার্ড ব্যালাজকে।
ধনী
বাপের ছেলে রিচার্ড অনেকটা প্লেবয় টাইপের। আট বছর ঘর করেছে মার্গিট রিচার্ডের
সাথে। দুটো ছেলে-মেয়ে হয়েছে তাদের। আট বছর ধরে মার্গিট দেখেছে রিচার্ড দিনের পর
দিন অসংখ্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরি করছে, ভাঙছে। একসময় যে প্লেবয়কে দেখে মজেছিল
মার্গিট, আট বছরের মধ্যে সেই রিচার্ড অসহ্য হয়ে ওঠে। আর না পেরে রিচার্ডকে ডিভোর্স
করে ছেলে গ্যাব্রিয়েল আর মেয়ে জুডিথকে নিয়ে মা-বাবার কাছে ফিরে এসেছেন দু’বছর আগে। কিন্তু এই দু’বছর ধরে কানের কাছে সারাক্ষণ মা-বাবার উপদেশ অসহ্য লাগতে শুরু করেছে
মার্গিটের। তাই ছেলে-মেয়েকে বুদাপেস্টে মা-বাবার কাছে রেখে ভাইয়ের কাছে বেড়াতে
এসেছেন মার্গিট। ছেলে-মেয়েকে কথা দিয়ে এসেছেন খ্রিস্টমাসের আগেই ফিরে যাবেন।
ডিরাকের
স্বভাবের সাথে কোন মিল নেই মার্গিটের। ডিরাক মুখচোরা, মার্গিট মুখরা। ডিরাট
অন্তর্মুখী, মার্গিট বহির্মুখী। ডিরাক আবেগশূন্য, মার্গিট আবেগপূর্ণ। ডিরাক
সায়েন্টিফিক হিরো, মার্গিট ‘সায়েন্টিফিক
জিরো’।
এত
বৈপরীত্য সত্ত্বেও মার্গিটকে ভালো লাগতে শুরু করেছে ডিরাকের। কিন্তু বুঝতে পারছেন
না এর নাম প্রেম কিনা।
মার্গিট
ভাবলেন ডিরাকের ভেতর আবেগের মত সূক্ষ্ম অনুভূতি জাগাতে হলে নাটক, সংগীত ইত্যাদি
শিল্পকলার প্রতি ভালোলাগা জাগিয়ে তুলতে হবে। ডিরাককে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে শুরু
করলেন মার্গিট।
হলিউডে তখন ‘গন উইথ দ্যা উইন্ড’-এর মত অনেক ভালো ভালো সিনেমা তৈরি শুরু হয়ে গেছে। দেখা গেলো ডিরাক হাসির
ছবি খুব পছন্দ করছেন। বিশেষ করে কার্টুন। পরবর্তীতে অনেক বয়স হবার পরেও ডিরাক একা
একা বসে টিভিতে ‘টম এন্ড জেরি’ বা ‘স্লিপিং বিউটি’ দেখতে দেখতে মিটিমিটি হাসতেন।
প্রিন্সটনে
সময় দ্রুত কেটে যাচ্ছে ডিরাকের এবং মার্গিটেরও সময় হয়ে আসছে বুদাপেস্টে ফিরে
যাবার। খ্রিস্টমাসের সময় প্রিন্সটনে প্রচন্ড ঠান্ডা। এই মারাত্মক ঠান্ডা থেকে
কিছুটা মুক্তি পেতে ডিরাক ঠিক করেছেন ফ্লোরিডাতে কাটিয়ে আসবেন দু’সপ্তাহ। মার্গিটকে একথা বলতেই তিনি দেখলেন একটা
অন্যরকম সুযোগ। তিনি ছেলে-মেয়েদের কাছে চিঠি লিখলেন - বিশেষ কারণে খ্রিস্টমাসের
আগে তিনি বুদাপেস্টে ফিরতে পারছেন না। তারপর ডিরাকের গাড়িতে গিয়ে উঠলেন ফ্লোরিডার
উদ্দেশ্যে।
ফ্লোরিডার-
উত্তর-পূর্বে সেন্ট অগাস্টিনে একটা রিসোর্টে উঠলেন ডিরাক ও মার্গিট। পরবর্তী দু’সপ্তাহ একটা ঘোরের মধ্যে কাটলো ডিরাক ও
মার্গিটের। ডিরাকের মনে হলো তিনি একটা নতুন কোর্স শিখলেন মার্গিটের কাছ থেকে -
জীবনের একটা নতুন অধ্যায়। এই অধ্যায়ে যেসব ঘটনা ঘটলো তা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের
সমীকরণে লেখা যায় না। এখানকার ‘ব্রা ফাংশান’ আসলেই অন্যরকম।
১৯৩৫
সালের মধ্য-জানুয়ারিতে বুদাপেস্টে ছেলে-মেয়েদের কাছে ফিরে গেলেন মার্গিট।
প্রিন্সটনে স্বাভাবিক রুটিনে কাজ চলছে ডিরাকের। বুদাপেস্ট থেকে প্রায় প্রতি
সপ্তাহেই ডিরাককে চিঠি দেন মার্গিট। চিঠিতে পাতার পর পাতা জুড়ে আবেগ আর ভালোবাসার
কথা। ডিরাক বুঝতে পারেন না এরকম আবেগের জবাবে কী লিখতে হয়। তিনি কয়েক লাইনেই
মার্গিটকে জানিয়ে দেন - “আমি তোমার মত এত সুন্দর করে চিঠি
লিখতে পারি না। কারণ আমার অনুভূতি তোমার মত প্রখর নয়। আমার জীবন মূলত ঘটনার ওপর
নির্ভরশীল, আবেগের ওপর নয়।”
এরকম
সাদামাটা চিঠি পেয়ে মন খারাপ হয়ে যায় মার্গিটের। তিনি বুঝতে পারেন ফ্লোরিডার দু’সপ্তাহ ডিরাক শুধু ঘটনা হিসেবেই নিয়েছেন, প্রকৃত
অনুভুতি বুঝার মত ক্ষমতা তাঁর এখন তৈরি হয়নি। যা করার মার্গিটকেই করতে হবে।
মার্গিট চিঠিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান প্রিন্সটনে কী কী হচ্ছে, ডিরাক কী কী
করছেন, ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করছেন কিনা, শরীরের যত্ন নিচ্ছেন কিনা ইত্যাদি। আরো
জানতে চান মার্গিটকে ছাড়া একা একা কেমন লাগছে, মার্গিটকে মিস করছেন কিনা।
উত্তরে
নিরুত্তাপ ভাষায় ডিরাক লিখলেন, “আমাকে নিয়ে
তোমার এত চিন্তা করার দরকার নেই। তুমি তোমার জীবন এবং তোমার পাশে যারা আছেন তাঁদের
কথা ভাবো। আমি একা একা বেশ ভালোই থাকতে জানি। মানুষের সাথে যত কম মিশতে হয় আমি ততই
ভালো থাকি।”
চিঠির
সাথে ডিরাক মার্গিটের চিঠিতে ইংরেজি শব্দ ও ব্যাকরণে কী কী ভুল আছে তারও একটা
তালিকা পাঠান।
মার্গিট
যখন চিঠির সাথে নিজের ছবি পাঠান - ছবি সম্পর্কে ডিরাক মন্তব্য করেন - “তোমার এই ছবিটা খুব একটা ভালো লাগেনি আমার। তোমার
চোখগুলো বিষন্ন - যা তোমার মুখের হাসির পরিপন্থি।”
এরকম
যান্ত্রিক চিঠি পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই মনটা খারাপ হয়ে যায় মার্গিটের। তিনি পরের
চিঠিতে অনুযোগ করেন, “পল, তুমি আমার আগের চিঠির সব প্রশ্নের
উত্তর দাওনি।”
ডিরাক
আগের সব চিঠি বের করে আবার পড়েন। বুঝতে চেষ্টা করেন কী কী প্রশ্নের উত্তর দেয়া
হয়নি। তারপর তালিকা করতে বসেন। ক’দিন পরে মার্গিট
চিঠির বদলে একটা ছকবদ্ধ উত্তর পান ডিরাকের কাছ থেকে:
চিঠির নম্বর
|
প্রশ্ন
|
উত্তর
|
৫
|
তুমি কি জানো কিসে আমি (মার্গিট) খুব কষ্ট পাই?
|
যখন কোন কাজে তোমার বিশেষ কোন আগ্রহ থাকে না।
|
৫
|
তোমাকে ছাড়া আর কাকে আমি ভালোবাসতে পারি?
|
এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছ থেকে আশা করো না। আমি উত্তর
দিলে তুমি বলবে আমি খুব নির্মম।
|
৫
|
তুমি কি জানো যে তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে আমার?
|
হ্যাঁ, কিন্তু তাতে তো আমার কোন হাত নেই।
|
৬
|
তুমি কি জানো আমার কেমন লাগে?
|
খুব একটা জানি না। কারণ তুমি দ্রুত পরিবর্তনশীল।
|
৬
|
আমার জন্য তোমার সামান্য অনুভূতিও কি নেই?
|
আছে,
সামান্য।
|
এরকম উত্তর পেয়ে
কষ্টের পাশাপাশি মজাও পেলেন মার্গিট। তিনি বুঝতে পারলেন ডিরাক জানেন না কোন্টা
প্রশ্ন আর কোন্টা অভিমান। তিনি পরিষ্কার করে লিখে জানালেন যে অনেক প্রশ্ন আছে
যেগুলো আসলে প্রশ্ন নয়।
“তোমাকে আরেকটা নোবেল পুরষ্কার দেয়া দরকার -
নির্মমতার জন্য।”
“আমি তো বোকা একটা মেয়ে তাই তোমার মত বিখ্যাত
মানুষের মনযোগ আশা করি।”
“আমি তো তোমার ভালবাসা পাবার যোগ্য নই।”
এরকম
লাইনে ভর্তি থাকে মার্গিটের চিঠি। ডিরাক ঠিক বুঝতে পারেন না কোন্টার কী উত্তর
দেবেন, বা আদৌ কোন উত্তর দেবার দরকার আছে কিনা। কী লিখবেন বুঝতে না পেরে ডিরাক
ভাবলেন - মার্গিট কি ভাবছেন যে তিনি
প্রেমে পড়ে গেছেন?
ডিরাক
লিখলেন, “তোমার জানা উচিত যে আমি তোমার প্রেমে
পড়িনি। আমি যেহেতু কখনো প্রেমে পড়িনি সুতরাং প্রেমে পড়ার মত সূক্ষ্ম অনুভূতি আমি
বুঝতে পারি না।”
চিঠি
পেয়ে একটুও অবাক হলেন না মার্গিট। মনে মনে বললেন, “প্রেমে পড়া কি জিনিস তোমাকে আমি বুঝিয়েই ছাড়বো প্রফেসর।”
সোভিয়েত
ইউনিয়নে বিজ্ঞানী কাপিৎজাকে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে। কাপিৎজা রাশিয়ায় গিয়েছিলেন
পারিবারিক কাজে। কিন্তু সেখান থেকে তাঁকে আর কেমব্রিজে ফিরতে দেয়া হচ্ছে না।
স্ট্যালিন সরকার তাঁকে বলছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে থেকে সরকারী বিজ্ঞানীদের কথামত কাজ
করতে যা বৈজ্ঞানিক স্বাধীনতার পরিপন্থি। কাপিৎজার স্ত্রী আনা ডিরাকের সাহায্য চেয়েছেন।
ডিরাক আমেরিকাতে যত পদার্থবিজ্ঞানী আছেন সবার কাছে চিঠি লিখে কাপিৎজার মুক্তির
ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ দেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি ঠিক করেছেন আমেরিকা থেকে ফিরে
রাশিয়ায় যাবেন কাপিৎজার সাথে দেখা করতে।
১৯৩৫
সালের জুন মাসে আমেরিকা থেকে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ডিরাক একটা জাপানি
জাহাজে চড়ে। মার্গিটকে জানিয়েছিলেন তাঁর রাশিয়া যাবার কথা। মার্গিট ডিরাককে অনুরোধ
করলেন রাশিয়া থেকে ফিরে বুদাপেস্টে তাঁর কাছে বেড়িয়ে যেতে।
রাশিয়ায়
জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত কাটালেন ডিরাক। কাপিৎজার সাথে দেখা করলেন। কাপিৎজা
মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছেন। সোভিয়েত সরকার ডিরাককে বাধা দিলেন না কোথাও। কিন্তু
কাপিৎজাকে কিছুতেই কেমব্রিজে আসতে দিতে রাজী হলো না। কাপিৎজা ভাবছেন
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা বাদ দিয়ে মনোবিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করবেন তাহলে সোভিয়েত
বিজ্ঞানী আইভান পাভলভের সাথে কাজ করতে পারবেন।
কাপিৎজার
জন্য কিছু করতে না পেরে সেপ্টেম্বরে কেমব্রিজে ফিরে আসার পথে বুদাপেস্টে মার্গিটের
বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন ডিরাক। মার্গিট তাঁর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে মা-বাবার বাড়ির কাছে
একটা বাড়িতে থাকেন। মার্গিটের মা-বাবা যে এত ধনী তা ডিরাক ধারণাও করেন নি।
প্রাচুর্য উপচে পড়ছে সবখান থেকে। মার্গিট ক’দিন আগেই একটা সিক্স সিলিন্ডার মার্সেডিজ কিনেছেন। নয় দিন ধরে খুব আনন্দে
কাটলো ডিরাক ও মার্গিটের। মার্গিটের মা-বাবা আশ্চর্য হয়ে গেলেন এই দুই বিপরীত
চরিত্রের মানুষের মধ্যে মিলনের সম্ভাবনা দেখে।
কেমব্রিজে
ফিরে এসে ডিরাক চিঠি লিখলেন মার্গিটকে। চিঠি পেয়ে মার্গিটের মনে হলো তাঁর এতদিনের
চেষ্টা সফল হতে চলেছে। ডিরাক লিখেছেন - “তোমার কাছ থেকে
চলে আসার সময় আমার খুব কষ্ট হয়েছে। এখানে আসার পরেও খুব মিস করছি তোমাকে। আমি আগে
কখনো কাউকে মিস করিনি। আমার মনে হচ্ছে তুমি আমাকে বদলে দিয়েছো।”
No comments:
Post a Comment