১৯০০
আইনস্টাইন ও মিলেইভা কারোরই মনের অবস্থা ভালো নয়। বিশেষ করে মিলেইভা ভীষণ
চিন্তিত তাঁদের ভবিষ্যত নিয়ে। আইনস্টাইনের মা পলিন মিলেইভা সম্পর্কে আসলেই কী
ভাবছেন তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন মিলেইভা। তাঁর এক বান্ধবী হেলেন কাফলার(Helene
Kaufler) জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের ছাত্রী। মিলেইভা খবর পেয়েছেন হেলেন মিলানে
যাচ্ছেন। হেলেনের খুব ইচ্ছে মিলানে গিয়ে আইনস্টাইনের বাবা মায়ের সাথে দেখা করেন।
আইনস্টাইন ও মিলেইভা হেলেনকে অনুরোধ করলেন যেন বুদ্ধি করে মিলেইভা সম্পর্কে পলিনের
মনোভাব জেনে আসেন। পলিন জানেন না যে হেলেন মিলেইভার বন্ধু। মিলেইভা হেলেনকে অনুরোধ
করেছেন যেন তাঁর পরিচয় না দেন।
মিলান থেকে ফিরে হেলেন যা জানালেন তাতে মিলেইভার মন একেবারেই ভেঙ্গে গেলো। মিলেইভা সম্পর্কে পলিন হেলেনকে বলেছেন, ওই বুড়ি শয়তানীটা আমার কচি ছেলের মাথা খেয়েছে। ডাইনিটা কিছুতেই আমার ছেলের উপযুক্ত নয়। ভীষণ অপমানিত মনে হচ্ছে তাঁদের দুজনেরই। কিন্তু মিলেইভা ভেঙে পড়েছেন সাংঘাতিক বেশি।
দেখতে দেখতে ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেলো। ফাইনাল পরীক্ষার আগে একটি মিনি-থিসিস
লিখে জমা দিতে হয়। থিসিসের জন্য তিনমাস সময় দেয়া হয়। আইনস্টাইন ও মিলেইভা একই বিষয়
নিয়ে থিসিস লিখছেন। প্রফেসর ওয়েবার তাপ পরিবাহিতা বিষয়ে এখনো কিছুটা গবেষণা করেন।
আইনস্টাইন ও মিলেইভা তাপ পরিবাহিতা বিষয়ে থিসিস লিখলেন। যদিও আইনস্টাইন মনে করেন
এই থিসিসটি কোন কাজেই লাগেনি তাঁর। আইনস্টাইন থিসিস লিখে জমা দিলেন ওয়েবারকে। পলিটেকনিকের
নির্দিষ্ট রেগুলেশান পেপারে লিখে আনতে। পরীক্ষার আর কয়েকদিন মাত্র বাকী, এসময় আবার
রেগুলেশান পেপারে লিখতে হলো পুরো থিসিসটা। আইনস্টাইনের মনে হলো প্রফেসর ওয়েবার
ইচ্ছে করেই শত্রুতা করছেন তাঁর সাথে।
মিলেইভার অবস্থা আরো খারাপ। পড়তে বসলেই পলিনের কথা মনে হয় তাঁর। তাঁর হবু শাশুড়ি তাঁকে তাহলে এরকম বুড়ি ডাইনিই মনে করেন! পড়াশোনা তাঁর কিছুই হচ্ছে না। মিডটার্মেও ভালো করতে পারেননি। এখন ফাইনাল পরীক্ষায় কী হবে জানেন না তিনি। আইনস্টাইনের মানসিক অবস্থাও খুব খারাপ। মায়ের কথাগুলো তাঁকে সারাক্ষণ খুঁচিয়ে মারছে। তাছাড়া প্রফেসর ওয়েবারের ব্যাপারটিও অপমানজনক মনে হচ্ছে তাঁর। মিডটার্ম পরীক্ষা হয়েছিলো শুধু মৌখিক। ফাইনাল পরীক্ষা লিখিত ও মৌখিকের মিশ্রণ।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। মিলেইভা বা আইনস্টাইন কারোরই রেজাল্ট খুব একটা ভালো হলো না। ক্লাসের পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই আইনস্টাইনকে টপকে গেছেন। আইনস্টাইন শুধুমাত্র মিলেইভাকে টপকাতে পেরেছেন। পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যায় আইনস্টাইন ও মিলেইভা সমান স্কোর করেছেন-১০। তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় আইনস্টাইনের স্কোর-১০, মিলেইভার-৯। মিলেইভা গণিতে খুব খারাপ করেছেন। আইনস্টাইন গণিতে স্কোর করেছেন ১১, মিলেইভার স্কোর মাত্র ৫। মিলেইভা জ্যোর্তিবিদ্যায় স্কোর করেছেন মাত্র ৪। থিসিসে আইনস্টাইনের স্কোর ১৮, মিলেইভার ১৬। জটিল গ্রেডিং সিস্টেমে ফাইনাল স্কোরিং এ আইনস্টাইন ছয়ের মধ্যে গড় স্কোর করেছেন ৪.৯১। পাস করতে হলে ছয়ের মধ্যে পাঁচ স্কোর করতে হয়। সে হিসেবে আইনস্টাইনও ফেল করতে পারতেন, কিন্তু আইনস্টাইনের স্কোর ৪.৯১কে ৫ ধরে পাস করিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু মিলেইভার গড় স্কোর হলো ৪। মিলেইভা ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করতে পারলেন না। তাঁকে আগামী বছর আবার পরীক্ষা দিতে হবে।
পাস করার পর আইনস্টাইন মা ও বোনের সাথে দেখা করতে গেলেন। পলিন ও মায়া তখন লুসার্ন(Lucerne) হ্রদের দক্ষিণে ছোট একটি পর্যটন শহর মেলশটালে (Melchtal) ছুটি কাটাচ্ছেন। আইনস্টাইন গেলেন সেখানে। শুরুতে মনে হলো কোথাও কোন গন্ডগোল নেই। পলিন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন, স্বাভাবিক উচ্ছাস প্রকাশ করলেন। কিন্তু মায়া আইনস্টাইনকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন,
-দাদা, মাকে কিন্তু তোমার ডলি সম্পর্কে কিছু বলো না। মা খুব রেগে আছেন এ
ব্যাপারে। তুমি কিন্তু মায়ের সাথে ঝগড়া করবে না।
আইনস্টাইন কিছুই বললেন না। কিন্তু বুঝতে পারলেন এবার মিলেইভার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। হোটেলে গিয়ে মায়ের রুমে গেলেন আইনস্টাইন। পরীক্ষার রেজাল্টের কথা বললেন। মিলেইভা যে ফেল করেছেন তাও বললেন। পলিন চুপচাপ শুনলেন মিলেইভার ফেলের কথা। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন,
-এবার কী হবে তার?
আইনস্টাইন বুঝতে পারছেন মিলেইভা সম্পর্কে পলিনের মনোভাব। কিন্তু কথা যখন উঠলোই, তখন আর পাশ কাটিয়ে যাবার মানে হয়না। বললেন,
-এবার সে আমার বৌ হবে।
মুহূর্তেই পলিন চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আইনস্টাইন পলিনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়া যে কান্নাকাটির পর্যায়ে চলে যাবে তা ভাবেননি। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন তিনি। পলিন বুঝতে পারলেন আইনস্টাইন শুরুতেই কাবু হয়ে গেছেন। এবার তিনি চোখ মুছতে মুছতে শুরু করলেন বাক্যবাণ,
-নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারছিস তুই। নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করতে চাচ্ছিস ওই
বুড়ি ডাইনিটার জন্য। কোন ভদ্রঘরে ঠাঁই হবে না ওই মেয়ের।
আইনস্টাইন কিছু বলার আগেই পলিন আবার বিছানায় শুয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। আইনস্টাইন আবার অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন দেখে আবার উঠে বসলেন পলিন।
-এখন ওই ডাইনিটা যদি গর্ভবতী হয়ে পড়ে- দেখিস কোন ঝামেলা পোহাতে হয় তোকে।
আইনস্টাইন আর সহ্য করতে পারলেন না। কী মনে করেন তাঁকে তাঁর মা?
-তুমি আমাদের কী মনে করো? তুমি কি মনে করো আমরা অনৈতিক কোন কাজ করছি?
-করছিসই তো। ওই মেয়েটার কোন বিশ্বাস আছে? তোর চেয়ে কত বছর বড় সে জানিস? তোর
মুন্ডু চিবিয়ে খাচ্ছে সেই মেয়ে- তা কি আমি বুঝিনা? ওই মেয়ে সব পারে। পেটে বাচ্চা
এনে সে তোকে বশ করবে দেখিস।
-আজে বাজে কথা বলবে না মা। আমি তাকে ভালোবাসি।
-ভালোবাসার কিছুই বুঝিস না তুই। এটার নাম ভালোবাসা নয়। ওই মেয়ে জাদু করেছে
তোকে। কী আছে তার? কুৎসিত বিকলাঙ্গ বুড়ি একটা।
-খবরদার মা-
ঝগড়া আরো অনেকদূর গড়ানোর আগেই দরজায় টোকা পড়লো। পলিনের বান্ধবী ফ্রাউ বার (Frau Bar) এসেছেন পলিনের সাথে দেখা করতে। ফ্রাউ রুমে ঢোকার সাথে সাথেই রুমের পরিবেশ হঠাৎ বদলে গেলো। আইনস্টাইন ও পলিন উভয়েই এমন ভাব করতে লাগলেন যেন কিছুই হয়নি। একটু পরেই তাঁরা আবহাওয়া বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন, অবকাশকেন্দ্রের অন্যান্য লোকদের নিন্দা করতে লাগলেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের অবাধ্যতার কথা বলতে লাগলেন। পলিন বন্ধুকে রাতের ডিনারের নিমন্ত্রণ করলেন। ডিনারের পরে আইনস্টাইন বেহালা বাজিয়ে শোনালেন। পরে ফ্রাউ চলে যাবার সময় কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে নিজের ঘরে ঘুমাতে গেলেন যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু একটু পরেই পলিন এলেন তাঁর রুমে। এসেই বললেন,
-একটা কথা পরিষ্কার বলছি তোকে আলবার্ট, তুই সারাজীবন বিয়ে না করলেও আমার কোন
আপত্তি নেই। কিন্তু ওই মেয়েকে তুই বিয়ে করতে পারবি না।
মায়ের সাথে এ ব্যাপারে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আইনস্টাইনের। তিনি কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। কিন্তু পলিন চুপ করলেন না। তিনি বলেই চলেছেন,
-ওই মেয়েকে বিয়ে করলে খুব ভুল করবি তুই। কী আছে ওই মেয়ের? বই পড়তে পড়তে ওই
মেয়ে নিজেই তো একটা বই হয়ে গেছে। তোর একটা বৌ দরকার, বই নয়। তোর চেয়ে কত বড়
মেয়েটা। তোর বয়স ত্রিশ হতে হতে তো ওই মেয়ে বুড়ি ডাইনির মত হয়ে যাবে। ওই বুড়িটার তো
কোন ছেলেমেয়েও হবে না। রূপসী হলেও নাহয় বুঝতাম রূপ দেখে মজেছিস। ওইতো ডাইনির মত
দেখতে, কী দেখে তুই ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস আমি জানিনা। আমরা হলাম ইহুদি। ওরা
কোন জাতি কে জানে। ওরকম অজাত কুজাতের মেয়ে তুই বিয়ে করতে পারবি না এটাই আমি বলে
দিচ্ছি।
আইনস্টাইন মাকে কীভাবে থামাবেন বুঝতে পারছেন না। মাকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসেন। কিন্তু মা কেন তাঁর ভালোবাসা বুঝতে পারছেন না তিনি বুঝতে পারছেন না। মা এখন অবুঝ বাচ্চার মত আচরণ করছেন। মায়ের সাথে এখন ঝগড়া করে লাভ নেই। আইনস্টাইন মাকে বললেন,
-ঠিক আছে মা, ঠিক আছে। তোমাদের আপত্তি থাকলে আমি বিয়ে করবো না। তুমি এবার
শান্ত হও। যাও ঘুমাতে যাও।
পলিন চলে গেলেন তাঁর রুমে। আইনস্টাইন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আজকের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে মিলেইভাকে চিঠি লিখলেন। চিঠি পড়ে মিলেইভার খারাপ মন আরো খারাপ হয়ে গেলো।
সেদিনের পর মায়ের সাথে সে প্রসঙ্গে আর কথা বলেনি আইনস্টাইন। পলিনও মিলেইভা প্রসঙ্গে আর কিছু বলছেন না। আইনস্টাইন জানেন মা কিছুতেই মেনে নেবেন না মিলেইভাকে। কিন্তু তিনিও মিলেইভাকে ছাড়তে পারবেন না। মায়ের চেয়ে তাঁর জেদ কোন অংশেই কম নয়। মিলেইভার ব্যাপার নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করার পর কিছুটা খারাপ লাগছে আইনস্টাইনের। সেটা কাটাতে তিনি এখন মায়ের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। মায়ের বন্ধুদের বেহালা বাজিয়ে শোনাচ্ছেন বারবার। পলিনের বান্ধবীরা আইনস্টাইনের প্রশংসা করলে পলিন খুশি হয়ে ওঠছেন। আইনস্টাইন মাকে খুশি রাখতে চাচ্ছেন যে কোন ভাবে যাতে তিনি মিলেইভার প্রসঙ্গটা ভুলে থাকতে পারেন।
আইনস্টাইন জানেন মা নিশ্চয় বাবাকে ব্যাপারটি জানিয়েছেন। আইনস্টাইন বাবার চিঠির আশা করছেন যেকোন দিন। কদিন পরেই মিলান থেকে হারম্যানের চিঠি এলো। বাবা আইনস্টাইনের সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধিতা না করে অন্যপথ ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, এখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা কিছুতেই উচিত হবেনা আইনস্টাইনের। কারণ কোন চাকরি বাকরি নেই, উপার্জন নেই, এ অবস্থায় একটি বৌ পোষার সামর্থ্য আইনস্টাইনের নেই। কারণ বিয়ে করাটা এখন বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে যা বড়লোকদেরই মানায়।
বাবার চিঠি পড়ে ক্ষোভে অপমানে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছেন আইনস্টাইন। বাবা এসব কী লিখলেন? বিয়ে করাটা কি রক্ষিতা রাখার সমতুল্য নাকি যে সেটা শুধু ধনীদেরই মানায়? ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আইনস্টাইনের সহজ পথ হলো পড়াশোনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। তিনি কার্শফের বই নিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে মায়াকে সাথে নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে যান। মায়ার সাথে কিছুটা শেয়ার করতে চান নিজের কষ্ট। কিন্তু মায়াটাও কেমন জানি বদলে যাচ্ছে ইদানিং। তাঁর মনে হচ্ছে একমাত্র মিলেইভাই তাঁকে ঠিকমত বুঝতে পারেন। আইনস্টাইন মনে মনে মিলেইভাকেই আঁকড়ে ধরেন আরো বেশি।
বাবার চিঠির কথাগুলো শুরুতে খুব খারাপ লাগলেও এখন আইনস্টাইনের মনে হচ্ছে সত্যিই তো একটা চাকরি দরকার তাঁর। তিনি আশা করছেন চাকরি পেতে খুব একটা সমস্যা হবে না তাঁর। পলিটেকনিকের প্রফেসরদের তো অ্যাসিস্টেন্ট লাগেই। ফিজিক্সে লাগে ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট, আর গণিতের প্রফেসরদের লাগে খাতা দেখার জন্য ও ক্লাসে সাহায্য করার জন্য সহকারী। ওটুকু নিশ্চয় জোগাড় করতে পারবেন আইনস্টাইন। মনে মনে হিসেব করেন তিনি কার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবেন। জিন পারনেটের নাম শুরুতেই বাদ দিলেন। পারনেটের সাথে কাজ করবেন না তিনি, আর পারনেটও তাঁকে চাকরি দেবেন না। প্রফেসর ওয়েবারের সাথে কাজ করা যায়। কিন্তু শেষের দিকে ওয়েবারের সাথে তাঁর সম্পর্কটা ঠিক ভালো যায়নি। তাতে কী? মিলেইভা আর আইনস্টাইন ছাড়া ফিজিক্স মেজর তো আর কারো ছিলো না। তাহলে সহকারী হিসেবে হয় তাঁকে নিতে হবে, নয়তো মিলেইভাকে। মিলেইভাতো এখনো পাস করেনি। সেহেতু তাঁর চাকরি হচ্ছেই। গণিতে প্রফেসর হারউইজ(Hurwitz) আছেন। তাঁর সাথেও কাজ করা যায়। তবে হারউইজ হলেন গণিত সেমিনারের ইনচার্জ। আইনস্টাইন কোন সেমিনারেই উপস্থিত থাকেননি। সেটা একটা সমস্যা হতে পারে। আপাতত প্রফেসর ওয়েবারের কাছেই চাকরিটা চাওয়া যাক। আইনস্টাইন প্রফেসর ওয়েবারকে লিখলেন চাকরির ব্যাপারে।
আগস্টের আঠারো তারিখে মা ও বোনের সাথে মিলানে ফিরলেন আইনস্টাইন। তিনি জানেন মা এতদিন চুপ করে থাকলেও এবার বাড়িতে বাবাকে সামনে রেখে আবার শুরু করবেন মিলেইভার বিরুদ্ধে বিষোদাগার। মিলেইভা এখন তাঁর মাবাবার কাছে। সেখানে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের একটা অসুখ দেখা দিয়েছে তাঁর। এ খবরটি মায়ার কাছ থেকে জেনে গেছেন পলিন। শুরু হলো আবার আক্রমণ,
-দেখেছিস কেমন রোগী একটা। একেতো বুড়ি, তার ওপর রাজ্যের রোগে ভুগছে। একে
বিয়ে করলে একটা দিনও সুখে থাকতে পারবি না তুই।
আইনস্টাইনের আর সহ্য হচ্ছে না এসব। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, মা কী করে ছেলের প্রেমিকাকে এরকম ভাষায় আক্রমণ করতে পারে। আইনস্টাইন বাইরে যতই চুপচাপ হয়ে থাকছেন, ভেতরে ততই জেদি হয়ে ওঠছেন। মিলেইভাকে তিনি বিয়ে করবেনই। আইনস্টাইনের বাবা চাচ্ছেন আইনস্টাইন তাঁর ব্যবসাটা বুঝে নিক। কিন্তু ব্যবসা করার কোন ইচ্ছেই নেই আইনস্টাইনের। তাছাড়া ব্যবসার অবস্থাও এখন ভালো নয়। তাঁর বাবার খুড়তুতো ভাই রুডলফ বাবার ব্যবসায় টাকা ঢেলেছেন বলে দিনরাত বাবার কাছে টাকার জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করছেন। আইনস্টাইনের ভালো লাগছেনা এসব। বাবার শরীরও খুব ভেঙে গেছে। খুব বুড়িয়ে গেছেন তিনি। মায়ের মত শক্ত নন বাবা। খুব খারাপ লাগছে তাঁর ভালোমানুষ বাবাটার জন্য।
প্রফেসর ওয়েবারের কাছে যে দরখাস্ত করেছিলেন তার উত্তর এসেছে। চিঠিটি খোলার সময়েও আইনস্টাইন নিশ্চিন্ত ছিলেন যে চাকরি তাঁর হয়ে গেছে। কিন্তু না, ওয়েবার তাঁকে চাকরি দেননি। ওয়েবার এবার দুজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে চাকরি দিয়েছেন। আইনস্টাইন হতাশ হয়ে গেলেন। তিনি ভেবে রেখেছিলেন চাকরিটা হলে ওয়েবারের সাথে থার্মোইলেকট্রিসিটি বিষয়ে পিএইচডি-র গবেষণা করবেন। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ওয়েবার তাঁকে যতটুকু ভেবেছিলেন তাঁর চেয়ে বেশিই অপছন্দ করেন। সে যাই হোক, ওয়েবারের সাথে প্রজেক্টটা করবেন ভাবলেন। আর মিলেইভাও তাঁর ফাইনাল ইয়ারের থিসিসটি করছেন ওয়েবারের সাথে। পলিটেকনিকে চাকরির শেষ সম্ভাবনা থাকলো গণিতের প্রফেসর হারউইজের কাছে। তিনি প্রফেসর হার-উইজকে বললেন দরখাস্ত করলে তিনি বিবেচনা করে দেখবেন। আইনস্টাইন দরখাস্ত করলেন।
আইনস্টাইন জুরিখে ফিরে দেখলেন মিলেইভা ওয়েবারের ল্যাবে পার্টটাইম একটি কাজ নিয়েছেন। মিলেইভার বাড়ি থেকে সামান্য টাকাই নিয়ে এসেছেন তিনি। আর আইনস্টাইনের পড়াশোনা শেষ হবার সাথে সাথে জুলি মামীর টাকা আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন চলবে কীভাবে? একটি প্রাইভেট টিউশনি শুরু করলেন তিনি। তিনি বুঝে গেছেন পলিটেকনিকে চাকরি তাঁর হচ্ছে না। প্রফেসর হার-উইজ তাঁকে নিয়োগ করেননি। ওয়েবারের সাথে পিএইচডি গবেষণাও হচ্ছে না তাঁর। কারণ তাঁর প্রস্তাব ওয়েবারের পছন্দ হয়নি। ওয়েবার চাচ্ছেন পরীক্ষামূলক কাজ। আইনস্টাইন তরলের ক্যাপিলারিটি সম্পর্কে একটি পেপার লেখার কাজ করছেন। আশা করছেন তিনি সেটা প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু উপার্জনের তো একটা উপায় তাঁকে করতে হবে।
ওয়েবারের সাথে কাজ করার চিন্তা বাদ দিয়ে এবার তিনি জুরিখ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলফ্রেড ক্লেইনারের (Alfred Kleiner) সাথে দেখা করলেন। প্রফেসর ক্লেইনার রাজী হলেন আইনস্টাইনকে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করতে। খুব ভালো লাগলো তাঁর। তিনি নতুন উৎসাহে বোলজম্যানের পদার্থবিজ্ঞান পড়তে শুরু করলেন। বোলজম্যান ইউনিভার্সিটি অব লিপজিকের (University of Leipzig) প্রফেসর। থার্মোডায়নামিক্স ও স্ট্যাটিস্টিক্সে অনেক অবদান আছে বোলজম্যানের। ডিসেম্বরে আইনস্টাইন তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য পাঠালেন ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত জার্নাল অ্যানালেন ডার ফিজিকে। কয়েকদিন পরেই তিনি জানতে পারলেন তাঁর পেপারটি প্রকাশের জন্য মনোনীত হয়েছে। দারুন খুশি হলেন আইনস্টাইন। এবার তাঁর চাকরি পেতে কোন সমস্যা হবে না। চাকরির দরখাস্তের সাথে তিনি এখন তাঁর প্রকাশিত পেপারের কপি পাঠাতে পারবেন। তিনি এখন পাবলিশড সায়েন্টিস্ট।
আইনস্টাইন মিলেইভার সাথেই থাকছেন মনে করে পলিন একটি চিঠি পাঠালেন আইনস্টাইনকে। লিখেছেন ক্রিস্টমাস উপলক্ষে বাড়ি চলে আসতে। আরো লিখেছেন আইনস্টাইনের সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্বের দরখাস্ত এখনো মঞ্জুর হয়নি। তার ওপর গোয়েন্দাদের নজর থাকতে পারে। এসময় আইনস্টাইন যদি মিলেইভার সাথে থাকে, তাহলে সে নাগরিকত্ব নাও পেতে পারে। মায়ের এরকম দুর্বল যুক্তি হেসে উড়িয়ে দিলেন আইনস্টাইন। গার্লফ্রেন্ড থাকার কারণে কারো নাগরিকত্ব পেতে সমস্যা হবে,তা তিনি মানতে পারেন না। তাছাড়া তাঁরা তো লিভ-টুগেদার করছেন না।কিন্তু বাড়ি তো যেতে হবে। মাকে এসময় আরো ক্ষ্যাপানোর কোন মানে হয়না। কিন্তু মিলেইভার সাথে এবারের ক্রিস্টমাস কাটাবেন বলে কথা দিয়েছেন তিনি। মিলেইভা আইনস্টাইনকে যেতে দিতে চাচ্ছেন না। তাঁর ধারণা পলিন তাঁর বিরুদ্ধে আইনস্টাইনের মন বিষিয়ে দেবেন। কিন্তু আইনস্টাইনকে জুরিখে আটকে রাখা গেলো না। আইনস্টাইন চলে গেলেন মিলানে মাবাবার সাথে ক্রিস্টমাস পালন করতে। তাঁরা ইহুদি, কিন্তু উৎসব হিসেবে ক্রিস্টমাস পালন করেন।
No comments:
Post a Comment