১৮৯৭
পলিটেকনিকে পড়াশোনা চলছে আইনস্টাইনের। প্রথম সেমিস্টারে অনেকগুলো গাণিতিক
বিষয় নিয়েছে সে। অ্যানালাইটিক জিওমেট্রি, জিওমেট্রি অব নাম্বারস, ডেস্ক্রিপ্টিভ
জিওমেট্রি, প্রোজেক্টিভ জিওমেট্রি, থিওরি অব ফাংশানস, পটেনশিয়েল থিওরি, ক্যালকুলাস
অব ভ্যারিয়েশানস, ডিফারেনসিয়েল ইকোয়েশানস সহ আরো কয়েকটি গাণিতিক বিষয়।
কিছুদিনের মধ্যেই গণিতের প্রতি কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠলো আইনস্টাইন। যদিও বেশ কয়েকজন চমৎকার গণিত শিক্ষক আছেন পলিটেকনিকে। যেমন, হারম্যান মিনকৌস্কি(Hermann Minkowski) , অ্যাডলভ হারউইজ(Adolf Hurwitz), কার্ল গেইজার(Carl Geiser), উইলহেলম ফিডলার(Wilhelm Fiedler)। মিনকৌস্কি সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষক। কিন্তু তিনি একেবারেই বাজে শিক্ষক। গণিতের কাল্পনিক কিছু তত্ত্ব তিনি ক্লাসে আউড়ে যান, যা কেউই বুঝতে পারে না। কোন বাস্তব উদাহরণ দেন না তিনি। ফলে তাঁর ক্লাস হয়ে পড়ে খুবই নিরস ক্লাস। আইনস্টাইন আস্তে আস্তে ক্লাস করা ছেড়ে দেয়। সে বুঝতে পারে, যে সমস্ত গণিত ক্লাসে সেখানো হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের সাথে তাদের খুব একটা যোগসূত্র নেই।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাস শুরু হলো। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের নামে যা শুরু হলো তাকে পদার্থবিজ্ঞান বলে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আইনস্টাইনের। ১৪০ জন ছাত্রের বিশাল ক্লাসে মেকানিক্স পড়ানো হচ্ছে। ডিরেক্টর অ্যালবিন হারজগ ইলাস্টিসিটি, ডায়নামিক্স এগুলো পড়াচ্ছেন। ক্লাসের বেশিরিভাগই ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। তাই পদার্থবিদ্যার কোর্সটিও ইঞ্জিনিয়ারদের উপযোগী করেই তৈরি। কিন্তু আইনস্টাইন চাচ্ছে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান। কিছুটা আশাহত হয়েছে সে।
দ্বিতীয় সেমিস্টারের মাঝামাঝি সময়ে মিলেইভা জানালো, সে হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে চলে যাচ্ছে। ভীষণ অবাক হলো আইনস্টাইন। মিলেইভার সাথে পরিচয় হবার পর থেকে গত প্রায় একবছর ধরে সে মিলেইভাকে নিয়ে ভেবেছে। প্রথম যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো সে- মেরি উইন্টালের সাথে মিলেইভার তুলনা করে দেখেছে যে মেরির মধ্যে মিলেইভার কোন গুনই নেই। শুরুতে মেরিকে কিছু না জানালেও শেষের দিকে মেরির মাকে জানিয়ে দিয়েছে যে মেরির সাথে প্রেমের সম্পর্ক সে আর রাখতে চাচ্ছে না। মেরি একথা শোনার পর ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মেরি এমনিতেই খুব সরল সোজা মেয়ে। আইনস্টাইন যখন চিঠি লেখা বন্ধ করে দেয়, তখন সে এরকম কিছু না ভেবে ভেবেছিলো আইনস্টাইন সম্ভবত অসুস্থ। মেরি তখন আইনস্টাইনের মায়ের কাছে জানতে চেয়েছে আইনস্টাইনের খবর। উত্তরে পলিন তাকে বলেছেন, আলবার্ট খুব অলস, তাই চিঠি লিখছে না।
আইনস্টাইন মিলেইভাকে এখনো জানায়নি তার ভালোবাসার কথা। মিলেইভাও নিশ্চয় ভেবেছে আইনস্টাইনের কথা। নইলে দুজন এত অন্তরঙ্গ বন্ধু হলো কীভাবে? কিন্তু এখন মিলেইভা চলে যাচ্ছে হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু কেন যাচ্ছে? হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের এখনো ডিগ্রি দেয়া হয় না। বিশেষ অনুমতি নিয়ে মেয়েরা ক্লাসে এসে লেকচার শুনতে পারে, কিন্তু সেজন্য কোন ক্রেডিট তারা পায়না। এসব জেনেও কেন যাচ্ছে মিলেইভা? আইনস্টাইন এ প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না। মিলেইভা পরিষ্কার করে কিছুই বলে না তাকে। চলে যাবার আগে একদিন আইনস্টাইন ও মিলেইভা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়ায়, পাহাড়ে, জুরিখের আশেপাশে। এর কয়েকদিন পরেই অক্টোবরের পাঁচ তারিখে পলিটেকনিক থেকে ভর্তি বাতিল করায় মিলেইভা এবং হাইডেলবার্গে চলে যায়।
মিলেইভা চলে যাবার পর হঠাৎ যেন সব খালি খালি মনে হচ্ছে আইনস্টাইনের। মনের
আবেগ উজাড় করে দিয়ে চারপৃষ্ঠাব্যাপী একটি দীর্ঘ চিঠি লিখলো মিলেইভাকে। সে জানে না
মিলেইভার মনের অবস্থা কী। তাই মিলেইভাকে লিখেছে যেন লেখার প্রচন্ড ইচ্ছে না হলে
চিঠি না লেখে। কিছুদিন পরে মিলেইভার চিঠি এলো। মনে হচ্ছে মিলেইভার মনে কিছুটা হলেও
রেখাপাত করেছে আলবার্ট আইনস্টাইন।
১৮৯৮
এতদিন পরে পদার্থবিজ্ঞানের আসল কোর্স শুরু হয়েছে। পড়াচ্ছেন প্রফেসর হেনরিখ
ওয়েবার(Heinrich Weber)। প্রফেসর ওয়েবার ইউরোপের বিখ্যাত গবেষক। শিক্ষক হিসেবেও তিনি
অতুলনীয়। আইনস্টাইন মুগ্ধ হয়ে গেছে ওয়েবারের ক্লাস করে। ওয়েবার পড়াচ্ছেন তাপ ও
তাপগতিবিদ্যা।
চৌষট্টি বছর বয়স্ক হেনরিখ ওয়েবার পলিটেকনিকে আছেন গত বিশ বছর ধরে। ইয়েনা(Jena) ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করার পর বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর হারম্যান হেলমহোলজের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন তিন বছর। ওয়েবার গবেষণা করেছেন অপটিকস, হিট আর ইলেকট্রিসিটির ওপর। এ সংক্রান্ত বিষয়ে অনেকগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তিনি। শেষের দিকে ইলেট্রোটেকনোলজি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন ওয়েবার। কিন্তু ১৮৮৮ সালের পরে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেননি ওয়েবার। তখন তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পলিটেকনিকে নতুন ফিজিক্স ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার কাজে। কয়েক বছরের মধ্যে নতুন ইনস্টিটিউটে ওয়েবার গড়ে তুলেছেন ইউরোপের সবচেয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগার। হারম্যান হেলমহোলজের সুপারিশে ওয়েবার ল্যাবোরেটরি সহকারী নিয়োগ করেছেন জিন পারনেটকে(Jean Pernet)। শুরু থেকেই জিন পারনেটের সাথে ওয়েবারের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। আইনস্টাইন যখন পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছেন তখন জিম পারনেট ও হেনরিখ ওয়েবারের মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ। আইনস্টাইন প্রফেসর ওয়েবারকে পছন্দ করেন বলে জিন পারনেট আইনস্টাইনকে অপছন্দ করতে শুরু করেছেন।
১৮৯৯
মিলেইভার সাথে নিয়মিত পত্রযোগাযোগ হচ্ছে আইনস্টাইনের। পলিটেকনিকের ঘটনাবলীর
বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চিঠি লেখে আইনস্টাইন। মিলেইভাও জানায় হাইডেলবার্গের ঘটনা।
পারস্পরিক ভালোবাসা এখন আর গোপন নেই কারো কাছে। আইনস্টাইন আদর করে মিলেইভার নাম
রেখেছে ডলি(Dollie)। আর মিলেইভার কাছে আইনস্টাইন এখন জনি(Johnnie)।
ফেব্রুয়ারি মাসে মিলেইভা জানালো যে সে ফিরে আসছে জুরিখে। আইনস্টাইনের আর তর সইছে না। সে মিলেইভাকে তাগাদা দিচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার জন্য। পলিটেকনিকে মিলেইভা কী কী কোর্স মিস করেছে তা লিখে পাঠালো আইনস্টাইন। আইনস্টাইন মিলেইভাকে লিখলো, ফিরে এসো যত দ্রুত সম্ভব, ফিরে এসো তোমার জনির কাছে। দেখবে এখানে তোমার কোন অসুবিধে হবে না। পলিটেকনিকে তুমি যা মিস করেছো তা খুব দ্রুতই পুষিয়ে নিতে পারবে তুমি। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
বসন্তকালীন ছুটি এসে গেলো। আইনস্টাইন ছুটি কাটাতে চলে গেলো মিলানে নিজেদের বাড়িতে। ছুটি শেষে জুরিখে ফিরে দেখে মিলেইভা চলে এসেছে হাইডেলবার্গ থেকে। আইনস্টাইনের পৃথিবীটাই যেন বদলে গেলো মিলেইভাকে দেখে। হাইডেলবার্গে চলে যাবার সময় যে ছিলো কেবল সহপাঠী, এখন সে তার প্রেমিকা। আইনস্টাইন মহাউৎসাহে মিলেইভার পড়াশোনায় সাহায্য করতে লাগলো। কয়েকদিনের মধ্যেই তারা দুজন একসাথে বসে পড়াশোনা শুরু করলো। পড়াশোনার সুবাদে আইনস্টাইনের বেশিরভাগ সময় কাটে মিলেইভার বাসায়।
দেখতে দেখতে মিডটার্ম পরীক্ষা এসে গেলো। আইনস্টাইনের এবার নিজের কিছু পড়াশোনা করা দরকার। ক্লাসের পড়াশোনার প্রতি সে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে অনেকদিন। ঠিকমত ক্লাসও করে না। এখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখে ক্লাসনোটও কিছুই নেই তার। এদিকে মিলেইভা বুঝতে পারছে তার পক্ষে এখন চেষ্টা করেও পরীক্ষা দিয়ে পাস করা সম্ভব নয়। একটা বছর তার নষ্ট হবেই। আর এসময়ে সে আইনস্টাইনের কাছে থাকলে আইনস্টাইনেরও পড়া হবে না। মিলেইভা চলে গেলো তার মা-বাবার কাছে নভি সাদে।
আইনস্টাইন বন্ধু গ্রোসম্যানের কাছ থেকে ক্লাসনোট নিয়ে কোনরকমে পরীক্ষা দিলো। এই পরীক্ষাগুলোর পুরাটাই মৌখিক। অক্টোবরে বেশ কয়েকদিন ধরে পরীক্ষা হলো। রেজাল্টের পরে দেখা গেলো চারজন পরীক্ষার্থীর মধ্যে আইনস্টাইন ফার্স্ট হয়ে গেছে। ৬ এর মধ্যে সে পেয়েছে ৫।৭, আর গ্রোসম্যান পেয়েছে ৫।৬। আইনস্টাইনের একটু খারাপ লাগছে এই ভেবে যে ক্লাস না করে, গ্রোসম্যানের কাছ থেকে নোট নিয়ে গ্রোসম্যানকেই টপকে গেছে সে।
পরীক্ষা শেষে আইনস্টাইন আবার ফিরে গেলো নিজস্ব পড়াশোনার জগতে। বাসা বদল করে
চলে এলো মিলেইভার বাসার কাছাকাছি একটি বাসায়। বাড়িওয়ালীর নাম ফ্রাউ মার্কওয়ান্ডার(Frau
Markwalder)। বাড়িওয়ালীর মেয়ে সুজান মায়ের সাথে একই বাড়িতে থাকে। সুজান মার্কওয়ান্ডার
একটি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে। নতুন বাসায় এসেই সুজানের সাথে পরিচয় হয়ে গেল
আইনস্টাইনের। সুজান হাসিখুশি মেয়ে, আর আইনস্টাইনও মেয়েদের সাথে হাসিতামাশা করতে
ওস্তাদ। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেলো আইনস্টাইন ও সুজান একসাথে গানবাজনা করছে,
সুজান পিয়ানো বাজিয়ে গাইছে, আর আইনস্টাইন বেহালা বাজাচ্ছে।
থার্ড ইয়ারে ওঠার আগপর্যন্ত কোনধরণের ল্যাবোরেটরি ওয়ার্ক করার সুযোগ আসেনি আইনস্টাইনের। ওয়েবারের বিখ্যাত ল্যাবে কাজ করার জন্য সে অপেক্ষা করছিলো অনেকদিন থেকে। থার্ড ইয়ারে ওঠার পর দুটো ল্যাব সেশান আছে তার। একটি হলো প্রফেসর ওয়েবারের ‘ইলেকট্রোটেকনিক্যাল ল্যাব’, অন্যটি হলো প্রফেসর জিন পারনেটের ‘ফিজিক্যাল এক্সারসাইজেজ ফর বিগিনারস’।
ওয়েবারের ল্যাবে দারুণ ভালো সময় কাটতে লাগলো আইনস্টাইনের। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি তার গভীর আগ্রহ, কিন্তু পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানেও সে খুব আনন্দ পাচ্ছে। ওয়েবারের ল্যাবে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি আছে, আর ওয়েবার নিজে ল্যাবের তত্ত্বাবধান করেন। আইনস্টাইন অনেক লেকচার ক্লাস বাদ দিয়ে ওয়েবারের ল্যাবোরেটরিতে সময় কাটাতে লাগলো।
প্রফেসর জিন পারনেটের ল্যাব কিন্তু মোটেও ভালো লাগছে না আইনস্টাইনের। বেঁটে মোটা গম্ভীর জিন পারনেটকে কোন ছাত্রই খুব একটা পছন্দ করতে পারে না। আর আইনস্টাইন প্রথম থেকেই পারনেটের কাজের পদ্ধতির ওপর খুব বিরক্ত। আর পারনেটও আইনস্টাইনকে পছন্দ করতে পারছেন না। কারণ আইনস্টাইন তাঁর কোন কথা শোনে না। ল্যাবে ক্লাসের আগে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ কীভাবে করবে সে ব্যাপারে পারনেট একটি লিখিত নির্দেশনামা দেন সব ছাত্রকে। আইনস্টাইন কখনোই পারনেটের নির্দেশাবলী অনুসারে কাজ করে না। একদিন পারনেট দেখলেন আইনস্টাইন তাঁর নির্দেশাবলী লেখা কাগজটি দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো পারনেটের।
ল্যাব সহকারীকে বললেন পারনেট,
-দেখলেন তো বেয়াদব ছেলেটার কান্ড! সে সবসময় আমি যা বলি তা না করে অন্য কিছু করবে।
-ইয়েস স্যার, তা ঠিক স্যার। তবে স্যার, অন্য
পদ্ধতিতে করলেও সে কিন্তু ভুল করে না স্যার।
-ভুল হোক,আর শুদ্ধ হোক,আমি তার ইনস্ট্রাক্টর। আমি যা বলি তা সে শুনবে
না কেন?
-ইয়েস স্যার, তা তো বটেই স্যার।
পারনেটের সহকারীও কিন্তু পারনেটকে পছন্দ করেন না। কিন্তু আইনস্টাইনের মত ঠোঁটকাটাও হতে পারেন না তিনি। কারণ তাঁর চাকরির প্রাণ রয়েছে পারনেটের হাতে।
পারনেট ডিরেক্টরের কাছে আইনস্টাইনের নামে রিপোর্ট করলেন। ল্যাবে কর্তব্যে অবহেলা করেছে আইনস্টাইন, বেয়াদবী করেছে ইত্যাদি অভিযোগ। আইনস্টাইন এসব শুনে ভীষণ রেগে গেলো। সে মুখোমুখি হলো জিন পারনেটের,
-আমি কোন কর্তব্যে অবহেলা করেছি স্যার?
-আইনস্টাইন, তুমি হলে একটা বেয়াদপ। শুধু বেয়াদপ
না, উগ্র টাইপের বেয়াদব। তোমার দ্বারা ফিজিক্সে কিছুই
হবে না। তুমি ফিজিক্সের পেছনে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছো। তোমার ভালোর
জন্যই বলছি,
ফিজিক্স তুমি ছেড়ে দাও। ফিজিক্সের জটিল
জটিল ব্যাপার তোমার মোটা মাথায় ঢুকছে না সেটা আমি বুঝতে পারছি। ফিজিক্স ছেড়ে
তুমি মেডিকেল বা ল পড় গিয়ে। অন্তত পাস করতে পারবে।
আইনস্টাইন কী বলবে বুঝতে পারছে না। রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে তার। অন্যায্য কথা সে সহ্য করতে পারে না।আইনস্টাইনকে চুপ করে থাকতে দেখে পারনেট ভাবলেন আইনস্টাইন সম্ভবত মেনে নিয়েছে তাঁর কথা।বললেন,
-কী মেডিকেলে চলে যাবে? আমি সুপারিশ
করে দিতে পারি। শুধু শুধু ফিজিক্সের অপমান তুমি কেন করবে? ফিজিক্স
তোমার মত মাথামোটা ছেলেদের জন্য নয়। কি, সাবজেক্ট
চেঞ্জ করবে?
-না স্যার, মেডিকেল বা ল পড়ার মত
মেধা আমার নেই। আমি ফিজিক্সেই চেষ্টা করে দেখি –যদি পাস করতে
পারি।
পারনেট নিজেকে খুব অপমানিত মনে করলেন। মনে মনে বললেন, পাস
তোমাকে করাচ্ছি বেয়াদপ ছেলে!
পরীক্ষার রেজাল্টে দেখা গেলো আইনস্টাইন প্রফেসর ওয়েবারের সবগুলো ল্যাব সেশানেই
পেয়েছে ছয়ের মধ্যে ছয়, কিন্তু জিন পারনেটের ল্যাব সেশানে পেয়েছে ছয়ের মধ্যে এক। পারনেটের ক্লাসে
আইনস্টাইনের চেয়ে কম আর কেউ পায়নি।
মিলেইভা এখনো নভি সাদ থেকে ফেরেনি। চিঠিতে যোগাযোগ হয় নিয়মিত। এদিকে বাড়িওয়ালীর মেয়ে সুজানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আইনস্টাইনের। সুজানকে নিয়ে বেড়াতে যায় এখানে সেখানে। আইনস্টাইন ব্যায়াম করতে পছন্দ করে না, কিন্তু হাঁটতে বা পাহাড়ে উঠতে ভালো লাগে তার। সুজানকে নিয়ে জুরিখের পাহাড়ি পথে অনেকগুলো বিকেল কাটিয়েছে সে। ঘরের কাছেই জুরিখ হ্রদ। হ্রদে ছোটখাট নৌকা চালায় অনেকে। একদিন নৌকা চালানো শুরু করলো আইনস্টাইন। একদিন চালিয়েই নেশা হয়ে গেলো তার। কয়েকদিন পর সুজানকে নিয়েই নৌকা ভাসায় জুরিখ হ্রদের জলে। যখন বাতাস কমে যায়, নৌকায় বসেই আইনস্টাইন কিছু গবেষণার কাজ করে ফেলে। একটা ছোট্ট নোটবুক তার সাথে থাকে সবসময়। সুজান দেখেছে অনেক সময় পিয়ানো বাজাতে বাজাতেও হঠাৎ বাজনা থামিয়ে নোটবুকে কিছু টুকে রাখছে আইনস্টাইন।
একদিন এমনিতে মজা করার জন্য পাইপ ধরায় আইনস্টাইন। কিন্তু ওই ধরানোটাই কাল হলো তার। পাইপ আর ছাড়তে পারেনি সে। পলিটেকনিকেলের আশেপাশের কফিশপে আইনস্টাইন আর গ্রোসম্যান ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করে ফিজিক্স ও অন্যান্য বিষয়ে। পাইপ টানে আর কফি খায়। কফি খেতে দারুণ ভালোবাসে আইনস্টাইন। গ্যালন গ্যালন কফি খেতে পারে সে। কফি আর প্যাস্টি দিয়েই পেট ভরায় সে।
গ্রোসম্যানের মেজর সাবজেক্ট গণিত, আর আইনস্টাইনের ফিজিক্স। ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিক্স নিয়েও তর্ক হয় দুজনের মধ্যে। আইনস্টাইন মনে করে গণিত হলো জাস্ট একটি যন্ত্র- যেটা দিয়ে বিজ্ঞানের কলকব্জা খুলে পরীক্ষা করে আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। ফিজিক্সের জন্য গণিতের দরকার আছে। কিন্তু গণিত নিজে নিজে খুব একটা কাজের কিছু নয়। গ্রোসম্যান সহজে মেনে নেয়না আইনস্টাইনের কথা। সে ঠাট্টা করে বলে,
-আরে ফিজিক্স তো ম্যাথের চেয়ে দরকারী হবেই। এই দ্যাখোনা, ফিজিক্স
পড়ার আগে আমি টয়লেটে যেতে ভয় পেতাম। টয়লেট থেকে একজন বেরিয়ে
আসার পর টয়লেটে গিয়ে বসলে মনে হতো জীবাণু আক্রমণ করবে আমাকে। কিন্তু ফিজিক্স
পড়ার পর জানলাম, না জীবাণু নয়, টয়লেটের সিট গরম
হয়ে যায় তো নিম্মাঙ্গের তাপ পরিবাহিতার কারণে। ফিজিক্স না পড়লে
কি আমি কখনো জানতে পারতাম, টয়লেটের সিট কেন গরম হয়?
বসন্তকালীন ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় আইনস্টাইন মিলেইভার একটি ছবি সাথে নিয়ে গেলো মাকে দেখাবার জন্য। পলিন অনেকক্ষণ ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘খুব চালাক মেয়ে’! আইনস্টাইন বুঝতে পারে না এটা কি প্রশংসা, নাকি অন্যকিছু।
ফেডারেল পলিটেকনিকের শেষ বর্ষে এসে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লেন আইনস্টাইন। হতাশাটা এসেছে মূলত প্রফেসর ওয়েবারের গবেষণার হাল দেখে। ওয়েবারের ল্যাব দেখে খুশি হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু দেখলেন ওয়েবার সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও গবেষণার তেমন কোন খবরই রাখেন না। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম সংক্রান্ত কোন গবেষণাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। মাত্র কয়েকবছর আগে হেনরিখ হার্জ ম্যাক্সওয়েলের ইলেকট্রোম্যাগনেটিজমের পরীক্ষামূলক প্রমাণ করেছেন। সেসময় ওয়েবার ব্যস্ত ছিলেন তাঁর ল্যাব তৈরির কাজে। ফলে কোন খবর রাখতে পারেননি, এবং একবার পিছিয়ে পড়ার পর আর তাল রাখতে পারেননি আধুনিক গবেষণার সাথে। ওয়েবার তাঁর সিলেবাসের কোথাও ম্যাক্সওয়েল বা হার্জের কোন গবেষণাকে স্থান দেননি।
আইনস্টাইন ওয়েবারকে এগুলো বলতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরে এসেছেন। আইনস্টাইন
দেখছেন, ওয়েবারের ক্লাসে ফিজিক্সের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কেও তেমন কোন ধারণা তিনি
দেননি। পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে ভালো করতে হলে পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোতো
জানতে হবে। ওয়েবার তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানকেও খুব একটা গুরুত্ব দেননি। ওয়েবার শুধু
বৈজ্ঞানিক পরিমাপের খুঁটিনাটি ও ইলেকট্রোটেকনোলজি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আইনস্টাইন ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছেন ওয়েবারের প্রতি। ওয়েবারের ক্লাসেও এখন নিয়মিত
যান না। নিজে নিজে পড়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন সমসাময়িক গবেষণাগুলো।
ওয়েবার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন। আইনস্টাইনকে তিনি স্নেহ করেন। ভেবেছিলেন আইনস্টাইন তাঁর কথামত কাজ করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন স্বাধীনচেতা। এখন ওয়েবারের মনে হচ্ছে, জিন পারনেটের কথা খুব একটা মিথ্যা নয়। আইনস্টাইন ছেলেটা বেয়াদব। একদিন আইনস্টাইনের ওপর রেগে গিয়ে বললেন ওয়েবার,
-আইনস্টাইন, তুমি খুব ব্রিলিয়্যান্ট তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তোমার
একটি মারাত্মক সমস্যা আছে। সেটা কী জানো? তোমাকে কেউ কিছু শেখাতে পারে না। তুমি
কারো কথা শোন না, নিজেকে বড় বেশি বুদ্ধিমান মনে করো তুমি!
আইনস্টাইন বুঝতে পারেন ওয়েবারের সাথে সুসম্পর্কের শেষ এখানেই। তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা বিষয়ে কোন সাহায্য তিনি ওয়েবারের কাছে পাবেন না। কার কাছে যাবেন? ডিপার্টমেন্টে আছেন প্রফেসর মিনকৌস্কি। তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত অনেকগুলো কোর্স পড়ান মিনকৌস্কি। আইনস্টাইন সে কোর্সগুলোর যে কয়টা নেয়া যায় তার সবগুলো নিয়েছে। কিন্তু দেখা গেলো মিনকৌস্কিও তাঁর গাণিতিক পদ্ধতিগুলোর সাথে বাস্তব পদার্থবিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করছেন না। বাস্তব কোন উদাহরণ না দেখিয়েই মিনকৌস্কি তাঁর গাণিতিক পদ্ধতি বর্ণনা করে চলেছেন। আইনস্টাইন এখানেও হতাশ হয়ে নিজে নিজেই পড়তে শুরু করলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের সমসাময়িক গবেষণাগুলো। নিজে নিজেই তিনি পড়ছেন হারম্যান হেলমহোলজ(Hermann Helmholz), আর্নস্ট ম্যাক(Ernst Mach), রুডলফ কার্শফ(Rudolf Kirchhoff), হেনরিখ হার্জ(Heinrich Hertz), জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল(James Clerk Maxwell) ও পল ড্রুডির(Paul Drude) বই।
আইনস্টাইন বন্ধু মাইকেল বেসোর দেয়া আর্নেস্ট ম্যাকের বই ‘দি সায়েন্স অব মেকানিক্স (The Science of Mechanics)পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। এই বইতেই আইনস্টাইন প্রথম পড়লেন যে নিউটনের সূত্রগুলো দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায় না। আর স্থান ও সময় আলাদা আলাদা নাও হতে পারে। সময়ের সাথে স্থানের ধারণা বদলে যেতে পারে। কার্শফও নিউটনের সূত্রগুলোর সর্বাত্মক প্রয়োগের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আইনস্টাইনের চিন্তায় স্থান করে নিচ্ছে স্থান ও কালের পরিবর্তন সংক্রান্ত জটিল তত্ত্ব।
নিজে নিজে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে ক্লাস একেবারেই করা হচ্ছে না আইনস্টাইনের। কিন্তু পাস তো করতে হবে। আইনস্টাইন ভাবেন, ডিগ্রিটা কোন রকমে নেবার পর পদার্থবিজ্ঞানের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আপাতত পরীক্ষাপাসের একটা ব্যবস্থা করা যাক। বন্ধু গ্রোসম্যানের ক্লাসনোট তার ভরসা। এদিকে মিলেইভাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন থার্ড ইয়ারের মিড টার্মের। আইনস্টাইন বেশিরভাগ সময় মিলেইভার বাসাতেই কাটাচ্ছেন। দুজন একসাথে পড়তে বসেন। কিন্তু আইনস্টাইন বড় বেশি খাটান মিলেইভাকে। ভালোবাসার খাতিরে আইনস্টাইনের এ আবদার সহ্য করেন মিলেইভা।
গ্রীষ্মের ছুটি ছয় সপ্তাহ। আইনস্টাইন এবার ছুটি কাটাচ্ছেন জুরিখের কাছেই মেটামেনেস্টেটেনে(Mettmenstetten)। মিলান থেকে তাঁর মা ও বোন আসবেন সেখানে। আইনস্টাইন ট্রেনে চেপে চলে গেলেন মেটমেনেস্টেনে। মিলেইভা চলে গেছেন তাঁর মা-বাবার কাছে। অক্টোবরে তাঁর মিডটার্ম পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাস করতেই হবে তাঁকে।
হোটেল পেনশান প্যারাডাইসে উঠেছেন পলিন ও মায়া। আইনস্টাইন যোগ দিলেন সেখানে। সাথে অনেকগুলো বই নিয়ে গেছেন আইনস্টাইন। ছয় সপ্তাহে অনেক কিছু পড়ে ফেলার পরিকল্পনা আছে তাঁর। একটা রুটিন তৈরি করেছেন তিনি। সকালে হোটেলে বসে পড়াশোনা করবেন, বিকেলে ঘুরে বেড়াবেন আর সন্ধ্যায় বেহালা বাজাবেন। হোটেলের মালিক রবার্ট মার্কওয়েলারের(Robert Markwaller) সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আইনস্টাইনের। মার্কওয়েলের সাথে পাহাড়ে উঠলেন কয়েকদিন। আর কয়েকদিন বেরোলেন ছোটবোন মায়ার সাথে। এখান থেকে কাছেই মাউন্ট স্যান্টিস। আরাউয়ের স্কুলে পড়ার সময় এই পাহাড় থেকেই পড়তে পড়তে কোনরকমে প্রাণে বেঁচেছিলেন আইনস্টাইন। এবার মায়াকে নিয়ে আবার উঠলেন মাউন্ট স্যান্টিসে।
আগে মা আর বোনের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করার পরও কথা ফুরোত না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের সঙ্গে গল্প করতে আর আগের মত ভালো লাগছে না। মা আর বোনকে কেমন যেন বোরিং মনে হচ্ছে। মিলেইভাকে খুব মিস করছেন আইনস্টাইন। মিলেইভাকে হোটেলের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চিঠি লেখেন আইনস্টাইন। হোটেলের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশও মাঝে মাঝে অসহ্য লাগছে আইনস্টাইনের। তাঁর মায়ের বেশ কিছু বন্ধু জুটেছে এই হোটেলে। এই মহিলারা দলবেঁধে রুমে আসেন। তাদের গল্পের বেশিরভাগ জুড়েই থাকে পরচর্চা। ভালো লাগে না আইনস্টাইনের। আরো মেজাজ খারাপ হয়ে যায় যখন মা তাঁকে অনুরোধ করেন বন্ধুদের বেহালা বাজিয়ে শোনাতে। প্রথম কয়েকদিন বেহালা বাজিয়ে শুনিয়েছেন, কিন্তু দুদিন পরেই বিরক্ত হয়ে গেছেন তিনি।
এই বিরক্তির মাঝেও সামান্য আনন্দের বাতাস গায়ে লাগে- যখন হোটেল মালিক রবার্ট মার্কওয়েলার তাঁর শ্যালিকা সপ্তাদশী অ্যানার সাথে আইনস্টাইনের পরিচয় করিয়ে দেন। সন্ধ্যেবেলা মায়ের বান্ধবীরা আসতে শুরু করলেই আইনস্টাইন রুম থেকে বেরিয়ে চলে যান অ্যানা স্মিডের ঘরে। অ্যানার সাথে খুনসুটি করতে বেশ ভালো লাগে আইনস্টাইনের। অ্যানা আইনস্টাইনের অটোগ্রাফ চাইলে আইনস্টাইন তার খাতায় লিখলেন,
ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে তুমি
কী লিখি তোমার খাতায়
মনে আসে অনেক কিছু
চুমু দিলে তোমার মুখে
রাগ করে কেঁদে ফেলো না,
কঠিন শাস্তি সেটাই হবে
চুমুর বদলে চুমু দিলে।
এই লেখাটা মনে রেখো
স্মৃতি করে ধরে রেখো
দুষ্টু বন্ধু তোমার আমি
আলবার্ট আইনস্টাইন।
এতকিছুর মধ্যেও আইনস্টাইন হার্জের ইলেকট্রোডায়নামিক্সের বই পড়ছেন মনযোগ দিয়ে। হার্জের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ থিওরির সাথে ইথারের সম্পর্কের ব্যাপারে আইনস্টাইন একমত হতে পারছেন না। আইনস্টাইনের মনে ইথারের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ জাগতে শুরু করেছে। তাঁর চিন্তাভাবনার অনেক কিছুই তিনি মিলেইভাকে লিখে জানান। মিলেইভা এখনো তাঁদের খামারবাড়িতে বসে পরীক্ষার পড়া তৈরি করছেন।
একদিন অন্যরকম একটি ব্যাপার ঘটলো। আইনস্টাইন আরাউ থেকে একটি চিঠি পেলেন হোটেলের ঠিকানায়। চিঠিটি লিখেছেন আরাউয়ের জুলিয়া নিগলি(Julia Niggli)। জুলিয়ার সাথে আইনস্টাইনের পরিচয় হয়েছিলো আরাউয়ের স্কুলে পড়ার সময়। জুলিয়া আইনস্টাইনের চেয়ে প্রায় ছয় বছরের বড়। আরাউয়ে থাকতে জুলিয়ার পিয়ানোর সাথেও বেশ কয়েকদিন বেহালা বাজিয়েছিলেন আইনস্টাইন। জুলিয়ার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো তাঁর। সে সময়ের বন্ধুত্বের সূত্রে জুলিয়া আইনস্টাইনকে চিঠি লিখেছেন। আইনস্টাইন আশ্চর্য হয়ে দেখছেন জুলিয়া চিঠিতে কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপারে আইনস্টাইনের পরামর্শ চেয়েছেন। জুলিয়ার সাথে একজন বয়স্ক লোকের প্রেম চলছে বেশ কিছুদিন থেকে। এখন লোকটি জুলিয়াকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। বিয়ে করাটা উচিত হবে কিনা জানতে চেয়েছেন জুলিয়া। বিশ বছরের আইনস্টাইনের পরামর্শ দিচ্ছেন ছাব্বিশ বছরের জুলিয়া নিগলিকে। আইনস্টাইন লিখলেন, কারো কাছ থেকে সুখের প্রত্যাশা করা উচিত হবে না। এমন কি যাকে ভালোবাসে তার কাছ থেকেও নয়। যে মানুষটি আজ তাঁকে ভালোবাসে, কালই হয়তো সে বদলে যাবে। আজ যাঁকে খুব বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে কালই হয়তো সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। আইনস্টাইন চিঠিটি লেখার সময় হয়তো মেরির সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা ভেবেছিলেন। মেরির সাথে ধরতে গেলে তিনি তো বিশ্বাসঘাতকতাই করেছেন।
জুলিয়া আইনস্টাইনকে আরাউ যাবার নিমন্ত্রণ করেছেন। আইনস্টাইনেরও খুব ইচ্ছে একবার জুলিয়ার সাথে দেখা করে আসেন। কিন্তু মাকে কীভাবে বলেন যে আরাউতে যাচ্ছেন জুলিয়ার সাথে দেখা করতে। আরাউর মেরির সাথে সম্পর্ক হবে ভেবে মা কত খুশি হয়েছিলেন। আর আইনস্টাইন সে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছেন। মিলেইভাকে মা মেনে নিতে পারছেন না। এর ভেতর আবার জুলিয়া নিগলির কথা জানতে পারলে সাংঘাতিক কান্ড ঘটবে। তারচেয়ে অন্যকিছু ছুঁতো খুঁজে বের করতে হবে। উপায় একটি পেয়েও গেলেন। আইনস্টাইন জানতে পেরেছেন আরাউতে ইয়োস্ট উইন্টেলারের বাড়িতে এখন প্রফেসর হাব এসেছেন ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে। প্রফেসর হাবের সাথে দেখা করতে যাবার কথা বললে মা কিছু মনে করবেন না।
কিন্তু আরাউ যাবার পথে আরেকটি ব্যাপারে কিছুটা টেনশান লাগছে আইনস্টাইনের। যদি আরাউতে গিয়ে মেরির সাথে দেখা হয়ে যায়! মেরি এখন আরাউ থেকে কিছুটা দূরে ওল্ডবার্গের একটি স্কুলে মাস্টারি করেন। আইনস্টাইন মেরির সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার পর আর দেখা হয়নি তাঁদের। এখন যদি মেরির সাথে দেখা হয়ে যায়? কিছুটা টেনশান নিয়ে আরাউতে পৌঁছে জানতে পারলেন মেরি এখন আরাউতে নেই। খুশি হয়ে জুলিয়ার সাথে দেখা করলেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের ইচ্ছে ছিলো জুলিয়ার পিয়ানোর সাথে কিছুক্ষণ বেহালা বাজাবেন। কিন্তু জুলিয়ার আপাতত সংগীতের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। তিনি ব্যস্ত তাঁর প্রেমের ব্যাপারে আইনস্টাইনের পরামর্শ নিতে। আইনস্টাইন জুলিয়াকে পরামর্শ দিলেন বিয়ে না করতে। জুলিয়া আইনস্টাইনের পরামর্শ শুনেছিলেন। তিনি সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন।
সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখে আইনস্টাইন, পলিন ও মায়া ফিরে এলেন মিলানে। কয়েক সপ্তাহ পরেই মিলেইভার মিডটার্ম পরীক্ষা। মিলেইভা এখনো জুরিখে ফেরেননি। মায়া ঠিক করেছে আরাউতে টিসার্চ কলেজে পড়তে যাবে। থাকবে উইন্টেলারদের বাড়িতে। আইনস্টাইন মায়াকে পৌঁছে দেয়ার জন্য আরাউতে যাবেন। কিন্তু এবারও খুব টেনশান হচ্ছে তাঁর। কীভাবে তিনি উইন্টেলারদের বাড়িতে যাবেন? মেরি যে এবারেও সেখানে থাকবে না তার নিশ্চয়তা কী! মায়াকে এসব বলাও যাচ্ছে না। পরীক্ষার অজুহাতে আইনস্টাইন দিনে দিনেই ফিরে আসবেন বলে ঠিক করলেন। মেরি ছিলো না বাড়িতে। আইনস্টাইন মায়াকে উইন্টেলারদের বাড়িতে রেখেই ফিরে এলেন মিলানে।
মিডটার্ম পরীক্ষায় খুব একটা ভালো করতে পারেননি মিলেইভা, কোনরকমে পাস
করেছেন। এখন তিনি আইনস্টাইনের সাথেই ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষায় বসতে পারবেন।
জুরিখে ফিরে এসে আইনস্টাইন সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য দরখাস্ত করলেন। এটার জন্য তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গত কয়েক বছর থেকে। দরখাস্তের জন্য প্রতি মাসে পঁচিশ ফ্রাঁঙ্ক করে জমাচ্ছিলেন তিনি। অক্টোবর মাসে দরখাস্ত পাঠালেন। নভেম্বর মাসে জুরিখের পুলিশ এসে তদন্ত করে পুলিশ রিপোর্ট জমা দিলো।
আইনস্টাইন ও মিলেইভার এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা হচ্ছে আইনস্টাইনের মা পলিন। তিনি কিছুতেই তাঁদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারছেন না। ক্রিস্টমাস উপলক্ষে আইনস্টাইন বাড়িতে গেলে পলিন আইনস্টাইনকে শুনিয়ে শুনিয়ে মিলেইভা সম্পর্কে পরোক্ষভাবে অনেক আজেবাজে মন্তব্য করেছেন। আইনস্টাইন মায়ের সাথে এখনই এ ব্যাপারে মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না বলে কোনরকমে সহ্য করেছেন।
No comments:
Post a Comment