১৯১৭
জ্যোর্তিবিজ্ঞানের ওপর আইনস্টাইন তাঁর প্রথম পেপার প্রকাশ করেন এবছর। আইনস্টাইনের
প্রথম মহাবিশ্বের মডেল অনুসারে মহাবিশ্ব গোলকাকৃতির সাম্যবস্থায় (spherically symmetric)আছে।
বছরের শুরুতেই গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন আইনস্টাইন। প্রচন্ড অসুস্থ
হয়ে দুমাসের মধ্যেই প্রায় পঁচিশ কেজি ওজন কমে গেলো তাঁর। আইনস্টাইনের
অসুখে এলসা মোটামুটি খুশি হয়েই সেবাযত্ম করলেন আইনস্টাইনের। বার্লিনের সোনেবার্গ(Schoneberg)
ডিস্ট্রিক্টে এলসার বাড়ির সামনেই আইনস্টাইনের বাসা। সুতরাং এলসা
আইনস্টাইনের সাথেই থাকতে শুরু করলেন এসময়। কিছুটা সুস্থ হয়ে কয়েকমাস
কিছু কাজ করেছেন আইনস্টাইন। পরে ডিসেম্বরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবার তাঁর পেটে
আলসার ধরা পড়ে। বেশ কয়েকমাস বিছানায় কাটাতে হয় আইনস্টাইনকে।
এদিকে জুরিখে মিলেইভা ও এডোয়ার্ড দুজনই অসুস্থ। যুদ্ধের কারণে
হাসপাতালগুলো আহত সৈনিক আর মানুষে ভর্তি। সেই ভীড়েই মিলেইভা ও এডোয়ার্ড
কোনরকমে পড়ে আছে হাসপাতালে। হ্যান্সকে দেখার কেউ নেই জুরিখে। আইনস্টাইন এক
একসময় ভাবেন গিয়ে হ্যান্সকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন কিনা। কিন্তু মিলেইভার
সাথে ধরতে গেলে কোন সম্পর্কই নেই এখন, হঠাৎ করে ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে
গেলে মিলেইভা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে ভাবতে ভাবতে আর যাওয়া হয় না। হ্যান্স রয়ে
যায় জুরিখে মিলেইভার এক বান্ধবীর বাড়িতে। আইনস্টাইন তাঁর বেতনের অর্ধেকেরও
বেশি পাঠিয়ে দেন মিলেইভা ও ছেলেদের খরচের জন্য। ওদিকে আইনস্টাইনের
মাও অসুস্থ। তাঁর জন্যও টাকা পাঠাতে হয়। আইনস্টাইন সবাইকে কীভাবে খুশিতে রাখবেন সে ব্যাপারেও চিন্তিত
কিছুটা। যুদ্ধের কারণে বার্লিনে অনেক মানুষ এখন ঠিকমত খেতেও পাচ্ছে না। আইনস্টাইনের
অবশ্য সেরকম কোন সমস্যা হয়নি এখনো। তাঁর ও এলসার বন্ধুদের কাছ থেকে তিনি নিয়মিত খাবার সরবরাহ
পাচ্ছেন। তাঁর পেটের সমস্যার কারণে তিনি আবার যেকোন খাবার খেতেও পারেন না।
জুরিখে অনাত্মীয় বাড়িতে একা একা থাকতে থাকতেই হয়তো হ্যান্স আলবার্ট এখন অনেকটা নরম হয়ে গেছে। বাপের প্রতি
রাগটাও তার কমে গেছে কিছুটা। হ্যান্স আইনস্টাইনকে আবার চিঠি লিখতে শুরু করেছে।
অক্টোবর মাসে কাইজার উইলহেম ইনস্টিটিউটের কাজ শুরু হলো। আইনস্টাইন এ
প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানের গবেষণার উন্নয়ন এ প্রতিষ্ঠানের
প্রধান লক্ষ্য।
এবছর রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। ব্রিটেনে ব্যালফোর
(Balfour)ঘোষণা গৃহীত হয়েছে। এ ঘোষণা অনুযায়ী প্যালেস্টাইনে
একটি স্বাধীন ইহুদী রাষ্ট্র স্থাপনের ব্যাপারে ব্রিটেন রাজী হয়েছে।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য চারটি প্রকাশনাঃ
পেপারঃ৬৬ “On the Special and
General Theory of Relativity:A Popoular Account.”প্রকাশকঃ
Vieweg,Braunschweig,Germany(১৯১৭)। সাধারণ পাঠকের
জন্য স্পেশাল ও জেনারেল রিলেটিভিটি বিষয়ের এই বইটি লেখেন আইনস্টাইন। লেখার সময় তিনি
বুঝতে পেরেছেন যে তাঁর নিজের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব তিনি নিজেই সহজ করে বর্ণনা করতে পারছেন
না। কিন্তু করতেই
হবে মনোভাব নিয়ে বইটি লিখে শেষ করেন তিনি। বইটি খুব জনপ্রিয়তা পায়। ১৯১৭ থেকে ১৯২২
সালের মধ্যে বইটির চৌদ্দটি সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পৃথিবীর অনেক
ভাষায় বইটি অনুদিত হয়।
পেপারঃ৬৭ “Cosmological
Considerations in the General Theory of Relativity.” Koniglich Preussische
Akademie der Wissenschaften (Berlin).Sitzungsberichte(১৯১৭),পৃষ্ঠাঃ
১৪২-১৫২। এটি আইনস্টাইনের প্রথম জ্যোর্তিবিদ্যা
বিষয়ক গবেষণাপত্র। এ পেপারে জেনারেল রিলেটিভিটির ক্ষেত্রসমীকরণগুলোতে সাম্যতা
আনার জন্য আইনস্টাইন একটি “কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট” ব্যবহার
করেছেন। মহাবিশ্বকে একটি নির্দিষ্ট আয়তনের বদ্ধগোলক কল্পনা করেছেন আইনস্টাইন, মহাবিশ্ব
সংকুচিতও হচ্ছে না, বা প্রসারিতও হচ্ছে না। গ্যালাক্সি মিল্কি-ওয়ের
সাথে হিসেব করে মেলাতে গিয়ে দেখেন “কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট” হিসেবে
না রাখলে অভিকর্ষজ বলকে বাধা দেয়ার কিছু থাকছে না। ফলে মহাবিশ্বের
কাঠামোটাই ভেঙে পড়বে। আইনস্টাইন কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের ওপর জেনারেল রিলেটিভিটির
প্রথম প্রয়োগ করেন এই পেপারে। এ পেপার প্রকাশিত হবার বারোবছর পরে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট
উইলসন অবজারভেটরিতে কাজ করার সময় এডউইন হাবল (Edwin Hubble)পর্যবেক্ষণ
করে দেখেন যে গ্যালাক্সিগুলো পৃথিবী থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। হাবল ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের
সত্যতা প্রমাণ করেন। ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন বেলজিয়ামের
এক ধর্মযাজক জর্জিস লেমেইটার(Georges Lemaitre)। লেমেইটার এম-আই –টি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে
ডিগ্রি নিয়েছেন। ১৯৩১ সালে এডউইন হাবলের সাথে আইনস্টাইনের দেখা হবার পর আইনস্টাইন কসমোলজিক্যাল
কনস্ট্যান্টের ধারণা যে ভুল ছিলো তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “ওটা ছিলো আমার
জীবনের সবচেয়ে বোকার মত ভুল”। তখন একটি পেপার লিখে (পেপার ১৭১) তাঁর ভুল সংশোধন করেন। এখন একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে
অনেক বিজ্ঞানী আবার নতুন করে ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’-এর প্রয়োজনীয়তার
কথা বলছেন।
পেপারঃ৬৮ “On the Quantum Theory of Radiation.” Physikalische
Zeitschrift,সংখ্যা ১৮ (১৯১৭), পৃষ্ঠাঃ১২১-১২৮। ফোটনের ধর্ম
ও কাজের একটি বিস্তারিত বর্ণনা আছে এ পেপারে। আগের বছরও পেপারটি
অন্য একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (পেপার ৬৩)। এ পেপারে আইনস্টাইন
দেখান যে শক্তির স্থানান্তরের সম্ভাবনার কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করে খুব সহজেই তাপের
বিকিরণ সম্পর্কিত প্ল্যাঙ্কের সূত্র প্রতিপাদন করা যায়। শক্তির বিভিন্ন
স্থিতিশীল স্তরের মধ্যে বিকিরণের মাধ্যমে শক্তির আদানপ্রদানের সাধারণ পরিসংখ্যানের
নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেন আইনস্টাইন। শক্তিস্তরকে প্রভাবিত করে শক্তির বিকিরণের সম্ভাবনা পর্যালোচনা
করা হয় এ পেপারে। পরবর্তীতে আইনস্টাইনের এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে লেসার(Laser-Light
Amplification by the Stimulated Emission of Radiation) আবিষ্কৃত হয়।
পেপারঃ৬৯ “The Nightmare.” Berliner Tageblatt,২৫ ডিসেম্বর,১৯১৭। এই সংক্ষিপ্ত
প্রবন্ধে আইনস্টাইন গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা
করে এ পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করেছেন। বারোবছর ধরে
স্কুলে পড়াশোনা করার পর সকল শিক্ষার্থীকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করতে হয়। সে পরীক্ষায়
পাস না করতে পারলে তাদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ ওখানেই শেষ হয়ে যায়। আইনস্টাইন মনে
করেন- এ ব্যবস্থা কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নয়। স্কুলের শিক্ষকশিক্ষিকারা
বারোবছর ধরে যে ছাত্রছাত্রীদের দেখছেন, এ পরীক্ষা ছাড়াই তাঁরা তাদের অর্জিত জ্ঞানের
মূল্যায়ন করতে পারেন। শুধুমাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমেই কোন শিক্ষার্থীর অর্জিত
জ্ঞানের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এ পরীক্ষাব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের মেধার বিকাশে সহায়তা তো
করেই না, বরং তা তাদের মধ্যে একধরণের আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
১৯১৮
বছরের শুরুতে অসুস্থ আইনস্টাইন বিছানা থেকে উঠতেই পারেননি কয়েকমাস। তাঁর সহকর্মীরা
বিভিন্ন জার্নালে তাঁর পেপারগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এসময়। এপ্রিলের দিকে
কিছুটা সুস্থ হয়ে ডিপার্টমেন্টের কয়েকটি মিটিং এ অংশ নেন আইনস্টাইন। সেপ্টেম্বর থেকে
অবশ্য তিনি আবার নিয়মিত ক্লাস নিতে শুরু করেন।
আইনস্টাইন ও মিলেইভা মেরিকের বিয়েটা টিকে থাকার আর কোন সম্ভাবনা নেই। জুন মাসে আইনস্টাইন
মিলেইভার সাথে ডির্ভোস-চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বছরের শেষের
দিকে তাঁদের বিচ্ছেদের সমস্ত আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আদালত থেকে বিচ্ছেদের
অনুমতি পাবার শর্তগুলো পূরণ করতে বেশ কষ্টই হয়েছে আইনস্টাইনের। শুধুমাত্র শারীরিক
অসুস্থতার কারণে স্ত্রীকে ডিভোর্স করা যায় না। মিলেইভার এমন
কোন দোষও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। আদালতের শর্ত পূরণের জন্য আইনস্টাইন নিজেকে ব্যভিচারী ঘোষণা
করলেন। এজন্য কোর্টের খরচ ছাড়াও ব্যভিচারের জন্য জরিমানা হিসেবে বেশ মোটা অংকের টাকাও
খরচ হলো আইনস্টাইনের। সুইজারল্যান্ডের কোর্ট পরবর্তী দুবছরের মধ্যে আবার বিয়ে না
করার আদেশ দিলেন আইনস্টাইনকে। চূড়ান্ত পর্যায়ে বিচ্ছেদ হয়ে যাবার আগে আইনস্টাইন জুরিখে
গিয়ে মিলেইভা ও সন্তানদের সাথে দেখা করতে গেলেন। ছেলেরা বাধ্য
হয়ে মেনে নিচ্ছে তাদের মা-বাবার বিবাহ-বিচ্ছেদ।
নভেম্বরে কাইজার উইলহেলম ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান
হয়। জার্মানি ও অন্যান্য
দেশের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জার্মানির নতুন
সরকার গঠিত হবার শুরুতে আইনস্টাইন একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠার
সম্ভাবনার ব্যাপারে প্রচন্ড আশাবাদী ছিলেন। আইনস্টাইন বামপন্থী গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক
আদর্শের প্রতি নিজের সমর্থন ব্যক্ত করলেন।
এবছর জার্মানির হারম্যান ওয়েইল(Hermann Weyl) তাঁর ‘গ্র্যাভিটেশান
এন্ড ইলেকট্রিসিটি’ নামে গবেষণাপত্রে প্রথমবারের মত সমন্বিত
ক্ষেত্রতত্ত্ব (Unified Field Theory)প্রতিষ্ঠা করেন। এই পেপারে তড়িৎচুম্বকীয়
ক্ষেত্র ও অভিকর্ষজ ক্ষেত্র উভয়েই স্থানকালের ধর্ম হিসেবে প্রকাশিত হয়। পেপারটি আইনস্টাইনের
চোখে পড়ার সাথে সাথেই তিনি দেখলেন সেখানে বিরাট একটি ভুল আছে। এপ্রিলের ১৫
তারিখে আইনস্টাইন ওয়েইলকে লিখলেন, “স্থান ও কালের পরিমাপের যে পদ্ধতি এখানে দেখানো হয়েছে সেটি
ঠিক হলে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব তার গুরুত্ব হারাবে”। আইনস্টাইনের
যুক্তির বিরোধীতা করে অনেকবছর ধরে যুক্তিযুদ্ধ করেছেন ওয়েইল। কিন্তু শেষপর্যন্ত
আইনস্টাইনের যুক্তিই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ১৯২৯ সালে ওয়েইল তাঁর পেপারের
সংশোধনী প্রকাশ করেন। ভুল থাকা সত্ত্বেও ওয়েইলের পেপারটি ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সেদিনের
ধারণা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম হয়েছে আধুনিক গেইজ তত্ত্ব (Gauge Theory)।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য সাতটি রচনাঃ
পেপারঃ৭০ “On Gravitational Waves.” KOniglich Preussische
Akademie der Wissenschaften (Berlin).Sitzungsberichte(১৯১৮),
পৃষ্ঠা;১৫৪-১৬৭। জেনারেল রিলেটিভিটির
একটি উল্লেখযোগ্য অনুমান হলো অভিকর্ষজ তরঙ্গের অস্তিত্ব। এতদিন অভিকর্ষজ
তরঙ্গের অস্তিত্ব নিরূপণের কোন উপায় জানা ছিলো না। সম্প্রতি বেশ
কিছু ডিটেক্টর ডিজাইন করা হচ্ছে যা এরূপ তরঙ্গের উপস্থিতি নিরূপণ করতে পারবে।
পেপারঃ৭১ “On the Foundations of the General Theory of Relativity.” Annalen der Physik,সংখ্যা ৫৫ (১৯১৮), পৃষ্ঠাঃ২৪১-২৪৪। জেনারেল রিলেটিভিটির কিছু প্রধান প্রধান বিষয় ব্যাখ্যা করা
হয়েছে এ গবেষণাপত্রে।
পেপারঃ৭২ “Motives for Research.” Zur Max Planck’s sechzigsten
Geburtstag. Karlsruhe: C.F.Mullersche Hofbuchhandlung,(১৯১৮)। জার্মান পদার্থবিদ
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ষাটতম জন্মদিন উপলক্ষে ফিজিক্যাল সোসাইটি একটি স্পেশাল ফিজিক্স
মিটিং এর আয়োজন করে। আইনস্টাইন সেখানে সত্যিকারের বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে এই
বক্তৃতাটি দেন। ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনের থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের প্রফেসর ম্যাস্ক প্ল্যাংকের
কোয়ান্টাম থিওরির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে পুরো পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা। আইনস্টাইন ম্যাক্স
প্ল্যাংক সম্পর্কে বলেন, “একজন আদর্শ গবেষক বলতে যা বোঝায় তা হলেন ম্যাক্স প্ল্যাংক।প্ল্যাংকের বিজ্ঞান
সাধনার অনুপ্রেরণা আসে তাঁর অন্তর থেকে”।
পেপারঃ৭৩ “The Law of Energy Conservation in the General Theory
of Relativity.” Koniglich Preussische Akademie der Wissenschaften
(Berlin).Sitzungsberichte(১৯১৮), পৃষ্ঠা
৪৪৮-৪৫৯। জেনারেল রিলেটিভিটিতে শক্তির
সংরক্ষণশীলতা কীভাবে রক্ষিত হয় তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ গবেষণাপত্রে।
পেপারঃ৭৪ “Dialogue on Objections to the Theory of Relativity.” Die
Naturwissenschaften,সংখ্যা ৬ (১৯১৮),
পৃষ্ঠাঃ৬৯৭-৭০২। আইনস্টাইন এ
পেপারটি লেখেন সংলাপ আকারে। তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনাগুলোর উত্তর
দেন তিনি সংলাপ আকারে।
পেপারঃ৭৫ “On the Need for a National Assembly.” Published in Nathan
and Norden, Einstein on Peace.১৩ নভেম্বর,১৯১৮। জার্মানির অরাজনৈতিক শান্তিবাদী সংগঠন “বুন্ড নিউয়েস
ভ্যাটেরল্যান্ড(Bund Neues Vaterland) বা বি-এন-ভি আয়োজিত
জনসমাবেশে এ ভাষণটি দেন আইনস্টাইন। বি-এন-ভি রাজনৈতিক দলের জন্য সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি
করার কাজে নিবেদিত সংগঠন। উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার শুরু করে যে আইনস্টাইন একজন সন্ত্রাসী
কমিউনিস্ট।
পেপারঃ৭৬ “To the Society ‘A Guaranteed Subsistence for All”.১২ ডিসেম্বর, ১৯১৮। এটি এক পৃষ্ঠার
একটি গবেষণাপত্র। অস্ট্রিয়ান দার্শনিক ও উদ্ভাবক জোসেফ পপার-লিনকিয়াস(Josef
Popper-Lynkeus) সবার জন্য খাদ্য ও চাকরির ব্যবস্থা করার একটি প্রোগ্রামের প্রয়োজনীয়তার
কথা প্রচার করছিলেন। আইনস্টাইন পপারের প্রোগ্রামের প্রয়োজনীয়তার প্রতি সমর্থন
জানিয়ে এ ঘোষণাপত্রটি রচনা করেন। তবে পপার যে পদ্ধতিতে প্রোগ্রামটি সফল করার পরিকল্পনা করেছেন- আইনস্টাইন
তার বিরোধিতা করেন। কারণ আইনস্টাইনের মতে পপারের বাস্তবায়নের পদ্ধতিতে ভুল আছে।
১৯১৯
এ বছর আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বছরের শুরুতে
আইনস্টাইন এলসার এপার্টমেন্টে এসে উঠেছেন। এলসা আইনস্টাইনের জন্য থাকার
ও নিজস্ব পড়ারঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জানুয়ারির মাঝামাঝি আইনস্টাইন
ইউনিভার্সিটি অব জুরিখে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কয়েকটি লেকচার দেন। ফেব্রুয়ারির
চৌদ্দ তারিখে আইনস্টাইন ও মিলেইভার ডিভোর্স হয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইনস
ডেতে তাদের বিচ্ছেদ হওয়াটা কি তাদের কারো ইচ্ছাকৃত নাকি কাকতালীয় ঘটনা তা ঠিক জানা
যায়নি। ডিভোর্সের একটি উল্লেখযোগ্য শর্ত হলো ভবিষ্যতে আইনস্টাইন যদি নোবেল পুরষ্কার
পান, তাহলে পুরষ্কারের পুরো টাকাটাই সন্তানদের ভরণপোষণ বাবদ পাবেন মিলেইভা। আইনস্টাইন ও
এলসার বিয়ে হতে এখন আর কোন বাধা নেই। যদিও সুইজারল্যান্ডের আদালত আইনস্টাইনের বিয়ের ব্যাপারে দুবছরের
একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কিন্তু সে নিষেধাজ্ঞা জার্মানিতে খাটেনা। এলসা বিয়ের তোড়জোড়
শুরু করলেন।
এলসার বড়মেয়ে আইলসের বয়স এখন বাইশ আর ছোটমেয়ে মার্গটের বয়স বিশ। এখনো তারা তাদের
মায়ের সাথেই থাকে। এটি আসলে এলসার বাবার বাড়ি। এলসার মা-বাবাও
থাকেন এখানে। এলসার মা ফ্যানি আইনস্টাইনের মা পলিনের আপন বোন। সে হিসেবে এলসা
আইনস্টাইনের আপন মাসতুতো বোন। তবে আইনস্টাইনের কাছে এরকম সম্পর্কের কোন দাম আছে বলে মনে
হয়না। নইলে এলসার মেয়ে আইলস – যে কিনা তাঁর ভাগনি- এলসার সাথে বিয়ে হলে সম্পর্কে যে তাঁর মেয়ে হবে- তাকে কীভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেন আইনস্টাইন।
মিলেইভার সাথে যখন ডিভোর্সের আনুষ্ঠানিক কাজ এগোচ্ছে তখন আইনস্টাইন আইলসের দিকে
ঝুঁকে পড়েন। আইলসকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আইনস্টাইন। আইলস জানতো যে
তার মায়ের সাথে সম্পর্ক চলছে আইনস্টাইনের। আইলস প্রত্যাখ্যান করে আইনস্টাইনকে। এলসা ব্যাপারটি
জানতে পারার পরেও এ প্রসঙ্গে কিছু বলেননি আইনস্টাইনকে।
জুনের ছয় তারিখে এলসার সাথে আইনস্টাইনের বিয়ের দিন ধার্য হয়। বিয়ের চারদিন
আগে জুনের দুই তারিখে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণিত হয়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি
অবজারভেটরির পরিচালক, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্থার
এডিংটন (Arther Eddington) সূর্যের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের টানে
তারার আলো যে বেঁকে যায় তা পর্যবেক্ষণ করেন। সূর্যের পূর্ণগ্রহণের
ছবি থেকে প্রমাণিত হয় যে অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের টানে আলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। নভেম্বর মাসে
রয়েল সোসাইটি এডিংটনের পরীক্ষালব্ধ ফল প্রকাশ করলে আইনস্টাইন রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত
হয়ে যান। কারণ আইনস্টাইনের তত্ত্বটি সাধারণ মানুষের কাছে এতই দুর্বোধ্য যে সাধারণের কাছে
মনে হচ্ছে একমাত্র আইনস্টাইনই অন্যরকম একটি পৃথিবীকে দেখার ক্ষমতা রাখেন, একমাত্র
আইনস্টাইনই পারেন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বুঝতে। আইনস্টাইনকে
নিয়েও অনেক মিথের জন্ম হতে লাগলো, এবং তা লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হতে
লাগলো। আইনস্টাইনও সাংবাদিকদের সাথে নানারকম মজা করে তাঁর হঠাৎ খ্যাতিমান হয়ে যাওয়াটা
উপভোগ করলেন।
জুনের ছয় তারিখে আইনস্টাইন ও এলসার বিয়ে হয় খুবই ঘরোয়াভাবে। এলসার সাথে আইনস্টাইনের
সম্পর্কটা অনেকটাই প্লেটোনিক। আইনস্টাইনের আসলে এমন কাউকে দরকার ছিলো যাঁকে তাঁর কষ্টগুলোর
ভাগ দিতে পারবেন। এলসার মধ্যে সেরকম একটি মানসিক আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন আইনস্টাইন। বিয়ের পরেও তারা
আলাদা আলাদা ঘরেই থাকছেন। কারণ জ্ঞিজ্ঞেস করলে এলসা হেসে উত্তর দেন, আইনস্টাইনের
নাসিকা গর্জনের শব্দে তাঁর ঘুম হয়না।
আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন আইনস্টাইন। জিওনিস্ট আন্দোলনের
নেতা কুর্ট ব্লুমেনফেলড (Kurt Blumenfeld) আইনস্টাইনের বন্ধু। ইসরায়েলে ইহুদিদের
অধিকার আদায় ও একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সংগঠিত হচ্ছে জিওনিস্টরা। ব্লুমেনফেলডের
উৎসাহে আইনস্টাইন জিওনিজমের (Zionism )প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠলেন এবং
ইহুদীদের জন্য প্যালেস্টাইনে একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণার প্রতি নিজের
সমর্থন ব্যক্ত করলেন। বার্লিনে আসার আগ পর্যন্ত আইনস্টাইনের কাছে ব্যক্তিগত ধর্মীয়
পরিচয়টা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। পরে বার্লিনে তিনি জিওনিস্ট আন্দোলনকে সমর্থন করলেও নিজে
কোন জিওনিস্ট সংগঠনে যোগ দেননি এবং নিজেকে কখনো জিওনিস্ট হিসেবে পরিচয়ও দেননি।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য ছয়টি রচনাঃ
পেপারঃ৭৭ “Do Gravitational Fields Play an Essential Role in the
Structure of the Elementary Particles of Matter?” Koniglich Preussische
Akademie der Wissenschaften (Berlin). Sitzungsberichte (1919), পৃষ্ঠাঃ ৩৪৯-৩৫৬। প্রুসিয়ান একাডেমি
অব সায়েন্সের অধিবেশনে উপস্থাপিত এই পেপারে আইনস্টাইন গোলকাকৃতি স্থানের বাস্তবভিত্তি
ব্যাখ্যা করেন এবং তার সাথে জেনারেল রিলেটিভিটির ক্ষেত্রসমীকরণগুলোর সম্পর্ক আলোচনা
করেন। মহাজাগতিক সমস্যা ও পদার্থের পারমাণবিক গঠন নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে এ গবেষণাপত্রে।
পেপারঃ৭৮ “Comments on Periodical Fluctuations of Lunar
Longitude,Which So Far Appeared to be Inexplicable in Newtonian Mechanics”. Koniglich
Preussische Akademie der Wissenschaften (Berlin). Sitzungsberichte (১৯১৯), পৃষ্ঠাঃ৪৩৩-৪৩৬। নিউটনিয়ান মেকানিক্স
বা ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের সাহায্যে চাঁদের গতি ও গতিপথের পরিবর্তন ঠিকমত ব্যাখ্যা
করা যায় না। আইনস্টাইন চাঁদের গতির পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ওপর আলোচনা করেছেন এ গবেষণাপত্রে।
পেপারঃ৭৯ “A Test for the General Theory of Relativity.” Die
Naturwissenschaften, সংখ্যা ৭ (১৯১৯),
পৃষ্ঠাঃ৭৭৬। স্যার আর্থার এডিংটন জেনারেল রিলেটিভিটির যে পরীক্ষা করেন, আইনস্টাইন
সে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে সামান্য আলোচনা করেন এই ছোট্ট পেপারে।
পেপারঃ৮০ “Time,Space and Gravitation”. Times (London), ২৮ নভেম্বর, ১৯১৯। টাইমস পত্রিকার
অনুরোধে আইনস্টাইন এ পেপারটি লেখেন টাইমস পত্রিকার জন্য। তিনি জার্মান
ভাষাতেই লিখেছিলেন, টাইমসের অনুবাদক তা ইংরেজিতে অনুবাদ করার পরে প্রবন্ধটি
ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। জার্মানির সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানির
একজন বিজ্ঞানীর তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখার যে উদারতা ইংল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানীরা
দেখিয়েছেন সেজন্য আইনস্টাইন ইংল্যান্ড ও ইংরেজ বিজ্ঞানীদের প্রশংসা করেন। আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের
অনেকগুলো তত্ত্ব ও নীতির ব্যাখ্যাও করেন এ প্রবন্ধে যেগুলো তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্বে
ব্যবহৃত হয়েছে।
পেপারঃ৮১ “Induction and Deduction in Physics”. Berliner Tageblatt,
morning edition, sec-4. ২৫ ডিসেম্বর,১৯১৯। বিজ্ঞানে জার্মানদের
অবদান সম্পর্কে খ্যাতিমান জার্মান বিজ্ঞানীদের প্রবন্ধ সংকলন সিরিজে প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের
এই প্রবন্ধ। এখানে আইনস্টাইন মন্তব্য করেন, “কোন তত্ত্ব সত্যি কি মিথা তা আসলে কোনদিনই জানা যাবে না। কারণ আজকে যা
সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে”।
পেপারঃ৮২ “Immagination from the East”. Berliner
Tageblatt,morning edition, ৩০ ডিসেম্বর ১৯১৯। যুদ্ধের পর জার্মানির
অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। সেজন্য কট্টর জার্মান জাতীয়তাবাদীরা দায়ী করছে ইহুদিদের। তারা বলছে পূর্ব-ইউরোপ
থেকে ইহুদিরা জার্মানিতে আসছে বলেই জার্মানিতে সবধরণের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আইনস্টাইন এই
প্রবন্ধ লিখে ইহুদিদের বিরুদ্ধে অপবাদের প্রতিবাদ করেন।
পেপারঃ৮৩ “leo Arons as Physicist”. Sozialistische
Monatshete, সংখ্যা ৫২, দ্বিতীয় খন্ড
(১৯১৯), পৃষ্ঠাঃ১০৫৫-১০৫৬। পদার্থবিজ্ঞানী লিও অ্যারনের মৃত্যুতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে
এ প্রবন্ধটি লেখেন আইনস্টাইন। লিও অ্যারনের রাজনৈতিক আদর্শ ও সাহসের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা
করতেন আইনস্টাইন।
No comments:
Post a Comment