পৃথিবীতে
শুধুমাত্র একজন বিজ্ঞানীর নাম বলতে বললে বেশির ভাগ মানুষ যে নামটি বলেন তা হলো
আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মতো
এত বেশি প্রচার আর কোন তত্ত্বই পায়নি এখনো। তাঁর E=mc2
সমীকরণটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি আর চিরায়ত জীবনাচরণে
একটা বিরাট জায়গা জুড়ে আছেন, তেমনি বিজ্ঞানের জগত জুড়ে আছেন আইনস্টাইন।
বিজ্ঞানী
আলবার্ট আইনস্টাইনকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি। কিন্তু ব্যক্তি আইনস্টাইনের অনেকগুলো
দিক আমাদের কাছে অজানা রয়ে গিয়েছিল অনেকদিন। আইনস্টাইন নিজের একান্ত ব্যক্তিগত
ঘটনাগুলো কখনোই প্রকাশ করতে চাননি। আইনস্টাইনের মৃত্যুর পরেও তাঁর সেক্রেটারি
হেলেন ডুকাস অনেক চেষ্টায় গোপন করে রেখেছিলেন আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত জীবনের
অনেকগুলো দিক। আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত প্রেম ভালবাসার সম্পর্কের টানাপোড়ন ইত্যাদি
কোন কিছুই জানা যায়নি এতদিন। ১৯৮৭ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি ও হিব্রু
ইউনিভার্সিটির ‘আইনস্টাইন আর্কাইভ’ গবেষকদের জন্য খুলে দেয়া হলে প্রকাশিত হতে থাকে
ব্যক্তি আইনস্টাইনের অনেকগুলো
অজানা দিক।
ভালোবাসা প্রসঙ্গে আইনস্টাইন নিজের
সম্পর্কে লিখেছেন - "অবশ্যই কাউকে না কাউকে ভালোবাসতে হয় আমার"। আসলেই
তাই - আইনস্টাইন তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে অনেককেই ভালোবেসেছেন এবং তাঁকেও
গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন অনেকেই। তবে সবার ভালোবাসার প্রতি যথোচিত সম্মান তিনি দিতে
পেরেছিলেন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। মেরি, মিলেইভা, এলশা, হেলেন - অনেক নারী এসেছেন আইনস্টাইনের জীবনে বিভিন্ন
সময়ে। কৈশোরেই পেয়েছেন প্রথম প্রেমের স্বাদ। ১৮৯৫ সালের এক মন-খারাপ করা বিকেলে
প্রথম দেখা হলো আলবার্ট ও মেরির। মেরি উইন্টেলার - আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম
প্রেমিকা।
১৮৯৫ সালের অক্টোবরের ২৬ তারিখ আরাউ
স্কুলের থার্ড গ্রেড অর্থাৎ দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ষোল বছরের আলবার্ট। আরাউ
জুরিখের কাছে একটা ছোট্ট শহরতলী। আলবার্টের এখানে আসার পেছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস
আছে। বছর দুয়েক আগেও মা-বাবা আর বোনের সাথে মিউনিখের বাড়িতে বেশ আনন্দেই দিন
কাটছিলো আলবার্টের। কিন্তু তার বাবা হারম্যান আইনস্টাইনের ইলেকট্রিক্যাল
ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। বাধ্য হয়ে তাঁর বাবা মা ও বোন
মায়াকে নিয়ে ইতালির মিলানে চলে গেলেন ১৮৯৩ সালে।
আলবার্টকে তাঁরা মিউনিখে তাঁদের এক
আত্মীয়ার বাসায় রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ আলবার্ট ইতালিয়ান ভাষা জানে না বলে
ওখানের স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না। তাছাড়া মিউনিখের স্কুলের পড়া শেষ হবার পর
আলবার্টকে ইউরোপের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ জুরিখের পলিটেকনিকে পড়ানোর ইচ্ছে তার মা-বাবার।
কিন্তু মা-বাবা আর বোনকে ছাড়া
মিউনিখের আত্মীয়ের বাড়িতে একা একা থাকতে মোটেও ভাল লাগছিলো না আলবার্টের। তাছাড়া
স্কুলেও ভালো লাগছে না তার। মিলিটারি স্টাইলের টিচাররা যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেন
আলবার্টকে। ইহুদি পরিবারের ছেলে হওয়াতে তাকে অপমান করা হয় আরো বেশি। কোন রকমে
চোখ-কান বুজে বছর খানেক সহ্য করার পর আর পারা গেলো না। ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বরে
মিউনিখ থেকে পালিয়ে চলে গেল মিলানে মা-বাবার কাছে।
আলবার্টের এরকম স্কুল থেকে পালিয়ে
আসাতে ভীষণ রেগে গেলেন মা পলিন আইনস্টাইন। তিনি আলবার্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ
চিন্তিত। তিনি পলিটেকনিকের ভর্তি-পদ্ধতি সম্পর্কে খবর নিতে শুরু করলেন। জুরিখের
ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি - সংক্ষেপে পলিটেকনিক - ইউরোপের সেরা বিজ্ঞান ও
কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া এত সহজ নয়। ছেলের মেধা আছে
তা পলিন জানেন, কিন্তু শুধু ঘরে বসে পড়াশোনা করেই সে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে যাবে
সে আশা কিছুটা দুরাশা। তাছাড়া স্কুল পাসের সার্টিফিকেট ছাড়া তাকে ভর্তি পরীক্ষায়
বসার সুযোগও তো দেবে না।
পলিন
চেষ্টা করতে লাগলেন ছেলের ভর্তির ব্যাপারে কী করা যায়। আঠারো বছরের আগে পলিটেকটিকে
ভর্তি করানো হয় না। আলবার্টের বয়স মাত্র ষোল। পলিন তাঁর প্রভাবশালী বন্ধুদের কাজে
লাগিয়ে বয়সের ব্যাপারে কিছুটা ছাড় পাবার আশ্বাস পেলেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় পাস
না করতে পারলে কিছুতেই ভর্তি করানো সম্ভব নয়।
১৮৯৫ সালের অক্টোবরে ভর্তি পরীক্ষা
হলো। বিজ্ঞান ও গণিত অংশে খুবই ভাল করেছে আলবার্ট। কিন্তু ইতিহাস, ভাষা ইত্যাদি
সাধারণ অংশে এতই খারাপ করেছে যে দুটো অংশ মিলিয়ে সে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করলো। এখন
কী করা? পলিটেকনিকের পরিচালক পরামর্শ দিলেন কাছের কোন স্কুল থেকে হাইস্কুলের পড়াটা
শেষ করিয়ে পরের বছর আবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য।
আলবার্টের আরাউ স্কুলে ভর্তি হবার পেছনে
এই হলো ইতিহাস। আরাউ স্কুলের শিক্ষক ইয়োস্ট উইন্টেলারের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার
ব্যবস্থা হয়েছে আলবার্টের। মা-বাবার কাছে থাকা সম্ভব হচ্ছে না আলবার্টের। শুরুতে
তাই মনটা খুবই খারাপ ছিল তার। কিন্তু যখন দেখলো ইয়োস্ট উইন্টেলার এবং তার পরিবারের
সবাই খুব আন্তরিক - আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করলো আলবার্টের। ইয়োস্ট
উইন্টেলারের স্ত্রীর নাম পলিন। নিজের মায়ের নামের সাথে মিল দেখে আলবার্ট তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকতে শুরু
করলো। পলিনও আলবার্টকে মাতৃস্নেহে আপন করে নিলেন। উইন্টেলারদের চার ছেলে তিন মেয়ে।
সবচেয়ে ছোট মেয়েটি অষ্টাদশী, ভীষণ সুন্দরী - নাম মেরি।
মেরি
শুরুতে আলবার্টকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিল। হ্যান্ডসাম বিষন্ন এই
কিশোরটি একা একা ঘরে বসে বেহালায় করুণ সুর তোলে। বড়ই মায়া লাগে মেরির। সে
আলবার্টের ঘরে যায়। তার ঘর গুছিয়ে রাখা, জামা-কাপড় পরিষ্কার করা এসব। আলবার্টের
বেহালার হাত সত্যিই ভালো। হবে নাই বা কেন? পাঁচ বছর বয়স থেকেই ছেলেকে পেশাদার
বেহালা শিক্ষকের কাছে বেহালা বাজানো শেখাতে শুরু করেছিলেন পলিন আইনস্টাইন। আর মেরি
উইন্টেলারও চমৎকার পিয়ানো বাজায়। আলবার্টের সাথে মেরির ভাব হতে দেরি হলো না। কয়েকদিনের
মধ্যেই তারা দু’জনে বেহালা ও পিয়ানোর যুগলবন্দী
বাজানো শুরু করলো। শুরু হলো তাদের প্রেমেরও যুগল-বন্দী।
মেরির
সেবা-যত্ন-ভালোবাসায় আলবার্ট তো মহাখুশি। উচ্ছসিত হয়ে মেরির কথা জানিয়ে মাকে চিঠি
লেখে সে। ছেলে আনন্দে আছে জেনে আলবার্টের মাও খুব খুশি। মেরির প্রতি কৃতজ্ঞতা
জানিয়ে মেরিকেও একটা চিঠি লেখেন পলিন আইনস্টাইন।
মেরি
পলিনের চিঠি পেয়ে মনে করলো অভিভাবক পর্যায় থেকে তাদের প্রেমের স্বীকৃতি পাওয়া
গেলো। তারপর কিছুদিন শুধু প্রেম আর প্রেম। আরাউয়ের জুরা পাহাড়ে, আরি নদীর ধারে,
বিস্তীর্ণ প্রান্তরে মেরির হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ালো আলবার্ট। মেরি আলবার্টের
চেয়ে বয়সে দু’বছরের বড় হলেও আলবার্টের মজবুত
শারীরিক গড়নের কারণে আলবার্টকেই অনেক বড় দেখায় মেরির পাশে। আলবার্ট মেরিকে
বাচ্চাদের মত ‘আমার ছোট্ট সোনা’ বলে ডাকে।
পরের
বছর এপ্রিলে কিছুদিনের ছুটিতে মা-বাবার কাছে বেড়াতে মিলানে গেলো আলবার্ট। মায়া ও
পলিন মেরি ও আলবার্টের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। সমানে ক্ষেপাচ্ছে আলবার্টকে। পলিন
মেরিকে না দেখেই পছন্দ করে ফেলেছেন ছেলের বৌ হিসেবে। আলবার্ট প্রায় প্রতিদিনই চিঠি
লেখে মেরিকে। কী কবিত্বময় সে চিঠির ভাষা - “আমার ছোট্ট পরী, ……..,
সারা পৃথিবী আমার জন্য
যা করেছে তুমি করেছো তার চেয়ে বেশি। তুমি আমার সূর্যালোক …..”
ছুটির
পর আলবার্ট ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের পরীক্ষা শুরু হলো। ভালোভাবে পাশ
করলো আলবার্ট। এবার পলিটেকনিকের ভর্তি পরীক্ষাতেও কোন সমস্যা হলো না। জুরিখের
পলিটেকনিকে ভর্তি হলো আলবার্ট। ১৮৯৬’র অক্টোবর থেকে
তার ক্লাস শুরু। সেখানে যাবার আগে মেরির সাথে অনেক রঙিন স্বপ্নের জাল বুনে, দু’জনের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে আরাউ থেকে চলে গেল
আলবার্ট।
জুরিখের
পলিটেকনিকে ক্লাস শুরু হলো আলবার্টের। তাদের গ্রুপে মোট পাঁচজন শিক্ষার্থীর চারজন
ছেলে এবং একজন মেয়ে। মেয়েটিরও আলবার্টের মত ফিজিক্স মেজর, বাকিদের সবারই ম্যাথ্স
মেজর। আলবার্ট তার এতদিনের শিক্ষাজীবনের কোথাও কোন মেয়ে সহপাঠী দেখেনি। এই
পলিটেকনিকেও আর কোন মেয়ে চোখে পড়েনি তার। ইউরোপে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ তখনো
মসৃণ হয়নি। পাঁচজনের ক্লাসে পরস্পর বন্ধু হতে সময় লাগলো না আলবার্টের। মার্সেল
গ্রসম্যান, ইয়াকব এহ্রাত ও লুই কলরোস বেশ ভাল বন্ধু হয়ে গেল আলবার্টের। কিন্তু
মেয়েটি - মিলেইভা মেরিক - ভীষণ চুপচাপ, কারো সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, চোখ তুলে
তাকায়ও না কারো দিকে।
আলবার্ট
ভালো করে লক্ষ্য করে মেয়েটিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মত সুন্দরী সে নয়। খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে হাঁটে। মাথার কালো চুলে কোনরকম যত্নের ছাপ নেই। ক্লাসের সব ছেলেরাই দেখে
মেয়েটিকে। একজন মাত্র মেয়ে ক্লাসে থাকলে তাকে সহপাঠির চেয়ে মেয়ে হিসেবেই দেখতে
অভ্যস্ত ছেলেরা। আলবার্ট একটু বেশি পরিমাণেই লক্ষ্য করছে মিলেইভাকে। মেরির শারীরিক
সৌন্দর্যের সাথে কোন তুলনাই চলে না মিলেইভার। তবে কেন এত আকর্ষণ অনুভব করছে
আলবার্ট? পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতে তুখোড় মিলেইভা। ঠিক এই কারণেই কি এত আকর্ষণ?
কিন্তু একবার চোখ তুলে আলবার্টের দিকে তাকাচ্ছেও না সে। পড়াশোনার বাইরে কি আর কোন
কিছুতেই আগ্রহ নেই মিলেইভার?
না,
পড়াশোনার বাইরে আর কোন কিছু নিয়ে ভাবতে চায় না মিলেইভা মেরিক। সে জানে পলিটেকনিকে
ভর্তি হবার জন্য তাকে কী কষ্ট করতে হয়েছে। পলিটেকনিকের ইতিহাসে এই ১৮৯৬ সাল
পর্যন্ত তার আগে আর মাত্র চারজন মেয়ে এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। শুধু
এখানে কেন সার্বিয়ার জাগরেভ রয়েল ক্লাসিক্যাল স্কুলে পড়তেও তাকে অনেক কষ্ট করতে
হয়েছে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজ্যে সে-ই প্রথম মেয়ে যে ছেলেদের সাথে একই ক্লাসে
বসে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে ১৮৯১ সালে।
পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর
পরেও স্কুলে ভর্তি হবার জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিলো তখনকার ষোড়শী মিলেইভাকে।
তার বাবা মিলোস মেরিক একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা না হলে হয়তো এই বিশেষ
অনুমতি পাওয়া সম্ভব হতো না। তখন থেকেই মিলেইভার স্বপ্ন একদিন অনেক বড় হবে সে।
সরবোর্ন ইউনিভার্সিটির মেরি স্ক্লোদভস্কা তার আদর্শ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে
মিলেইভা - সারাজীবন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা করে যাবে। কোনদিনও বিয়ে করবে না।
মেয়েরাও যে ছেলেদের মতো যে কোন পেশায় ভালো করতে পারে তা সে দেখিয়ে দেবে।
স্কুলের
পড়াশোনা শেষ করে মিলেইভা ভেবেছিল ডাক্তার হবে। স্কুলের সব পরীক্ষায় তার রেজাল্ট
অসাধারণ। জুরিখ ইউনিভার্সিটির মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হতে কোন সমস্যাই হলো না। ১৮৬৭
সাল থেকেই জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে মেয়েরা ভর্তি হবার সুযোগ পাচ্ছে।
১৮৯৬
সালের জুন মাসে মিলেইভা তার মেডিকেলের পড়াশোনা শুরু করলো। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই সমস্যা
দেখা দিলো। মেডিকেলের ক্লাসে সে ছাড়া আর কোন মেয়ে নেই। ক্লাসের ছেলেরা নানাভাবে
বিরক্ত করতে শুরু করলো তাকে। কনজেনিটাল হিপ ডিফরমিটির কারণে তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
হাঁটতে হয়। সেটা নিয়েও বিদ্রুপ করে ছেলেরা যারা নাকি মেডিকেল কলেজে পড়তে এসেছে
ডাক্তার হবার জন্য। মিলেইভা সর্বশক্তি দিয়ে সহ্য করে যেতে চাইলো, কিন্তু যখন
এনাটমির ব্যবচ্ছেদ ক্লাসে তার নারীশরীর নিয়ে ছাত্রদের নোংরা আলোচনায় শিক্ষকরাও যোগ
দিতে শুরু করলেন তখন আর পারলো না সে। ছেড়ে দিল মেডিকেলের পড়াশোনা। অক্টোবরে এসে
ভর্তি হয়েছে পলিটেকনিকে। ভর্তি পরীক্ষা পাস করতে কোন অসুবিধে হয়নি তার। কিন্তু এখন
তার ভয় হচ্ছে ক্লাসে একমাত্র মেয়ে হওয়াতে এখানেও যদি ছেলেদের টিটকিরি সহ্য করতে
হয়! তাই সে ঠিক করেছে কারো সাথে কথাই বলবে না, কারো দিকে তাকাবেও না।
আলবার্ট
জানতে পেরেছে মিলেইভা তার চেয়ে বয়সে সাড়ে তিন বছরের বড়। তাতে কিছু যায় আসে না।
মেরিও তার চেয়ে দু’বছরের বড়। মেরিকে সে এখনো আবেগপূর্ণ
চিঠি লিখে যাচ্ছে বটে - কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা কেমন যেন রুটিন-কাজ হয়ে যাচ্ছে।
মনের সাড়া ঠিক আগের মত নেই। তবুও সে মিলেইভার ব্যাপারে কিছুই জানায় না মেরিকে।
নিজের ময়লা জামা-কাপড় এখনো আগের মতই মেরিকে পার্সেল করে দেয়, আর মেরি সযত্নে
পরিষ্কার করে পাঠিয়ে দেয় তার কাছে।
প্রথম
বার্ষিক পরীক্ষায় দেখা গেলো মিলেইভা ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট হয়ে গেছে। আলবার্ট
বুঝতে পারলো এই মেয়ের মন জয় করতে হলে আবেগ দিয়ে কাজ হবে না। গণিত আর
পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনা শুরু করে দিলো মিলেইভার সাথে। পদার্থবিজ্ঞানে আলবার্টের
চিন্তা-ভাবনার স্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা ইতোমধ্যেই খেয়াল করেছে মিলেইভা। আস্তে আস্তে
আলাপ শুরু হলো দু’জনের। ক্রমশ দু’জনই বুঝতে পারে তাদের মধ্যে একটা ভালোলাগা তৈরি
হচ্ছে।
১৮৯৭
সালের সেকেন্ড সেমিস্টারের মাঝামাঝি মিলেইভা জানালো যে সে হাইডেলবার্গ
ইউনিভার্সিটিতে চলে যাচ্ছে। ভীষণ অবাক হলো আলবার্ট। মিলেইভার সাথে পরিচয়ের পর থেকে
গত এক বছর ধরে সে মিলেইভাকে নিয়ে ভেবেছে। মেরি উইন্টেলারের সাথে মিলেইভা মেরিকের
তুলনা করে দেখেছে সে। মিলেইভার মধ্যে যে জ্ঞান ও বুদ্ধির দীপ্তি সে দেখছে মেরির
মধ্যে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। শুরুতে মেরিকে কিছু না জানালেও কিছুদিন আগে মেরির মাকে
সে জানিয়ে দিয়েছে যে মেরির সাথে সে আর প্রেমের সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছে না। একথা
শোনার পর মেরি যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আলবার্ট পারলো এমন
বিশ্বাসঘাতকতা করতে! অনেক দিন থেকে আলবার্টের কোন চিঠিপত্র না পেয়ে আলবার্টের
অসুখ-বিসুখ হয়েছে ভেবে মেরি দুশ্চিন্তা করছিল। আলবার্টের খবরের জন্য মেরি
আলবার্টের মায়ের কাছে চিঠি লিখেছে। উত্তরে পলিন জানিয়েছিলেন - আলবার্ট সুস্থ আছে,
তবে সে চিঠি লেখার ব্যাপারে ভীষণ অলস। মেরি ভেবে পায় না - যে আলবার্ট একসময়
প্রতিদিন চিঠি লিখতো সে কীভাবে এত অলস হয়ে গেলো। পাগলের মত হয়ে গেল মেরি।
No comments:
Post a Comment