১৯০১
জানুয়ারিতে জুরিখে ফিরেই প্রফেসর ক্লেইনারের সাথে পিএইচডি থিসিসের কাজ শুরু
করলেন আইনস্টাইন। ক্যাপিলারিটি বিষয়ে দ্বিতীয় একটি গবেষণাপত্রের কাজ শুরু করেছেন। কাজের মাঝে ডুবে
থাকতে পারলে পৃথিবীর অন্য কোন সমস্যা কাবু করতে পারেনা আইনস্টাইনকে।
ফেব্রুয়ারি মাসে ইমিগ্রেশান অফিস থেকে চিঠি পেলেন তিনি। তাঁর গোয়েন্দা
রিপোর্ট জমা হয়েছে অফিসে। আরেকটি সাক্ষাৎকারের জন্য তাঁকে ইমিগ্রেশান অফিসে যেতে হলো। ফেব্রুয়ারি মাসের
২১ তারিখে সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব লাভ করলেন আইনস্টাইন। জার্মানির নাগরিকত্ব
ত্যাগ করার পর থেকেই তিনি সুইস নাগরিক হবার স্বপ্ন দেখেছেন। নাগরিকত্ব লাভের
ফি জমা করেছেন গত কয়েকবছর ধরে। এখন তাঁর সঞ্চয়ের সবটুকুই প্রায় শেষ হয়ে গেলো।
আইনস্টাইন ১৮৯৬ সালেই তাঁর জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন। জার্মানির তৎকালীন
চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক আর সম্রাট কাইজার উইলহেলম এর শাসনে দেশটি কড়াকড়ি রকমের
মিলিটারি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। দেশের পুরুষ নাগরিকদের বাধ্যতামূলক মিলিটারি ট্রেনিং
নিতে হয় জার্মানিতে। আইনস্টাইন সেটা সহ্য করতে পারেননি। পাঁচবছর দেশহীন থাকার পর
এখন সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে আইনস্টাইনের মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে
সুন্দর দেশ সুইজারল্যান্ড।
সুইজারল্যান্ডের নাগরিক হবার তিনসপ্তাহ পরেই আইনস্টাইনকে মিলিটারি
সার্ভিসের জন্য রেজিস্ট্রেশান করতে হলো। অথচ মিলিটারি সার্ভিস পছন্দ করেন না বলেই
তিনি জার্মান নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। কিন্তু এখন মিলিটারি সার্ভিসকেও তাঁর ভালো মনে
হচ্ছে। কিছু না করার চেয়ে মিলিটারিতে কাজ করাও অনেক ভালো। তাছাড়া তিনি এখনো মনে
করেন সুইজারল্যান্ডের মিলিটারি সার্ভিস আর জার্মানির মিলিটারি সার্ভিসে পার্থক্য
আছে। মার্চের ১৩ তারিখে তাঁর মেডিকেল টেস্ট হলো। মেডিকেল টেস্টে তাঁকে মিলিটারি
সার্ভিসের জন্য আনফিট ঘোষণা করা হলো।
মিলিটারি রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, সেদিন আইনস্টাইনের শারীরিক উচ্চতা ১৭১.৫
সেন্টিমিটার, বুকের মাপঃ ৮৭ সেন্টিমিটার, উর্ধ্ববাহুর মাপঃ ২৮ সেন্টিমিটার,
অসুস্থতা বা শারীরিক অসংগতিঃ পায়ের গঠন অতিরিক্ত সমতল, পায়ে অতিরিক্ত ঘাম হয়,
পায়ের ভ্যারিকোস ভেইনস(varicose veins)। পায়ের অতিরিক্ত ঘামের কারণে আইনস্টাইন মোজা
পরতে পারতেন না, এবং সারাজীবন মোজা ছাড়াই জুতা পরেছেন।
মিলিটারিতে চাকরি করা থেকে বেঁচে গেলেও তারজন্য অতিরিক্ত মিলিটারি ট্যাক্স
দিতে হয়েছে আইনস্টাইনকে। এখন ভাবনা হচ্ছে অর্থনৈতিক। চাকরি একটা না পেলে তো নিজেরই
চলছে না। কোন চাকরি ছাড়া জুরিখে বসে থাকার চেয়ে ভাবলেন মিলানে বাড়িতে চলে যাওয়াই
ভালো। সেখানে অন্তত খাবার জুটবে। ভেবেছিলেন মিলানে যাবার আগে থিসিসটা শেষ করতে
পারবেন। কিন্তু কাজ এগোচ্ছে না। এদিকে মিলেইভার সাথেও ওয়েবারের সম্পর্ক ভালো
যাচ্ছে না। আবার পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন মিলেইভা।
মার্চের ২৩ তারিখে আইনস্টাইন মিলানে ফিরে গেলেন। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র
প্রকাশিত হয়েছে কয়েকদিন আগে। রিসার্চ পেপারের কপি হাতে নিয়ে আইনস্টাইন আশা করেছেন
এবার হয়তো একটি চাকরি পাওয়া যাবে। তিনি পেপারের একটি কপি পাঠালেন বোলজম্যানের
কাছে। আরেকটি কপি পাঠালেন লিপজিগ ইউনিভার্সিটির ফিজিক্যাল কেমিস্ট ফ্রেডরিখ অস্টওয়াল্ডের(Friedrich
Ostwald) কাছে। আইনস্টাইন অস্টওয়াল্ডের কাছে লিখলেন যে অস্টওয়ান্ডের ক্যাপিলারিটি
বিষয়ক গবেষণা তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ক্যাপিলারিটি বিষয়ে পেপারটি লিখতে। কিন্তু এই
তোষামোদে কোন কাজ হলো না। আইনস্টাইনের চিঠির কোন উত্তরই দিলেন না অস্টওয়াল্ড। আইনস্টাইন দমলেন
না। একের পর এক দরখাস্ত
পাঠাচ্ছেন গটিনজেন(Gottingen) ইউনিভার্সিটিতে, স্টুটগার্ট(Stuttgart)
ইউনিভার্সিটিতে, ভেনিস (Venice) ইউনিভার্সিটিতে, বোলোগনা(Bologona) ইউনিভার্সিটিতে, পিসা (Pisa) ইউনিভার্সিটিতে। গটিনজেনের প্রফেসর এডোয়ার্ড রিকি (Eduard Riecke)দুজন সহকারীর জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু আইনস্টাইনের
দরখাস্ত তিনি বিবেচনা করেননি। কারণ তিনি ডক্টরেট ডিগ্রিধারী লোক চেয়েছেন।
খুব সহসা কোন চাকরি হবে এরকম আশা এখন আর করতে পারছেন না আইনস্টাইন। প্রফেসর অসওয়াল্ডের
কাছ থেকে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করেও কোন উত্তর না পেয়ে আরেকটি চিঠি পাঠালেন অসওয়াল্ডকে। কিন্তু এবারেও
কোন উত্তর পেলেন না। এদিকে আইনস্টাইনের অজান্তে অসওয়াল্ডকে আরেকটি চিঠি লিখেছেন
আইনস্টাইনের বাবা।
চিঠিতে হারম্যান আইনস্টাইন লিখেছেন,
চিঠিতে হারম্যান আইনস্টাইন লিখেছেন,
মাননীয় প্রফেসর অসওয়াল্ড,
কোন চাকরি না পেয়ে বর্তমানে আমার পুত্র আলবার্ট খুবই অসুখী এবং প্রতিদিনই তার মনোবল কমে
যাচ্ছে। তার কর্মজীবন শুরু করার আগেই সে হতাশ হয়ে পড়েছে। আমরা নিতান্ত
গরীব মানুষ। তার কোন চাকরি না থাকাতে সে নিজেকে আমাদের বোঝা বলে মনে করছে। এমতাবস্থায় আপনি
যদি দয়া করে তাকে সামান্য একটু উৎসাহ দিয়ে একটি চিঠি দিতেন, সে তার
হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারতো বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রফেসর অসওয়াল্ড আইনস্টাইনের বাবার চিঠিরও কোন উত্তর দেননি। আইনস্টাইন হতাশ
হয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, কেন তাঁকে কেউ চাকরি দিতে চাচ্ছেন না। তাঁর মনে হচ্ছে
রেফারি হিসেবে প্রফেসর ওয়েবার সম্ভবত ভালো রিপোর্ট দিচ্ছেন না তাঁর সম্পর্কে। তিনি সিভি থেকে
রেফারি হিসেবে ওয়েবারের নাম বাদ দিলেন রেফারি হিসেবে। কিন্তু তাতেও
কোন লাভ হলোনা। তবে কি তিনি ইহুদি বলেই চাকরি পাচ্ছেন না? মিলেইভা তো মনে করেন,
আইনস্টাইন একে ইহুদি, তার ওপর তাঁর ঠোঁটকাটা
স্বভাবের কারণেই চাকরি পাচ্ছেন না। জার্মানিতে এন্টি-সিমেটিজম
দানা বাঁধছে ঠিক, কিন্তু তা বলে একটা চাকরিও পাবেন না তিনি?
তাঁর বন্ধু এহরাতও তো ইহুদি। এহরাতের তো চাকরি
পেতে সমস্যা হয়নি। আইনস্টাইনের শিক্ষক মিনকৌস্কিও তো ইহুদি। তবে সমস্যাটি
কোথায়?
এতসব সমস্যার মাঝেও আইনস্টাইনের মা মিলেইভার নামে আজেবাজে কথা বলেই
যাচ্ছেন। আইনস্টাইন সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে পড়াশোনায় ডুবে থাকেন। মিলেইভা এখন
জুরিখে, তিনি মিলানে। মিলেইভাকে চিঠিতে আইনস্টাইন প্রায়ই লেখেন যে মিলেইভাকে ছেড়ে
তিনি থাকতে পারছেন না, মিলেইভাকে ছাড়া কোন কাজ তিনি করতে পারছেন না। কিন্তু
কথাগুলো মনে হচ্ছে শুধুই কথার কথা। কারণ দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন মিলেইভাকে ছাড়াই
অনেক কাজ করে ফেলেছেন। ক্যাপিলারিটি বিষয়ে আরো একটি পেপার লেখার কাজ অনেকদূর এগিয়ে
রেখেছেন। মলিকিউলার ফোর্স নিয়ে গবেষণা করছেন। ইথার আর রিলেটিভ মোশান নিয়েও গবেষণা
চলছে। বন্ধু মাইকেল বেসোর সঙ্গে এ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনাও করছেন।
এর মধ্যে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম থিওরির ওপর গবেষণাপত্রটি চোখে পড়েছে
আইনস্টাইনের। প্ল্যাঙ্কের নতুন তত্ত্বটি গ্রহণ করতে কষ্ট হচ্ছে আইনস্টাইনের, আবার
একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছেন না। তত্ত্বটি নতুন করে ভাবাচ্ছে আইনস্টাইনকে। থিওরি অব
মেটাল নিয়ে পল ড্রুডির পেপারটা নিয়েও ভাবছেন আইনস্টাইন। শত হতাশার মাঝে
পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করলেই যেন তিনি কিছুটা হতাশামুক্ত হতে পারেন।
ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান পত্রের স্রোতের মাঝে একটি অন্যরকম চিঠি পেলেন
আইনস্টাইন। বন্ধু মার্সেল গ্রোসম্যানকে তিনি তাঁর হতাশার কথা জানিয়েছিলেন।
গ্রোসম্যানের বাবার যথেষ্ঠ প্রভাব প্রতিপত্তি আছে সুইজারল্যান্ডে। গ্রোসম্যান তাঁর
বাবাকে বলেছেন আইনস্টাইনের অবস্থার কথা। গ্রোসম্যানের বাবা বার্নের প্যাটেন্ট
অফিসের ডিরেক্টর ফ্রেডরিখ হলারের সাথে কথা বলেছেন আইনস্টাইনের ব্যাপারে। বার্নের
প্যাটেন্ট অফিসে খুব সহসাই একজন লোক নেয়া হবে। আইনস্টাইন যদি দরখাস্ত করেন, তবে
চাকরিটি হবার সম্ভাবনা আছে। গ্রোসম্যানের চিঠিতে এখবর পেয়ে মনে হলো এতদিন পরে একটু
আলো দেখা গেলো সীমাহীন অন্ধকারে। আইনস্টাইন গ্রোসম্যানের প্রতি কীভাবে কৃতজ্ঞতা
জানাবেন বুঝতে পারছেন না। সে মুহূর্তেই চিঠি লিখতে বসে গেলেন। লিখলেন, “বন্ধু, তুমি
যে তোমার ভাগ্যহীন পুরনো বন্ধুর কথা মনে রেখেছো তা আমি কখনোই ভুলবো না। আমি তোমার
সুপারিশের অমর্যাদা করবো না কিছুতেই”।
প্যাটেন্ট অফিসের চাকরিটির জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হয় জানেন না আইনস্টাইন।
তবুও তো একটা আশা অন্তত থাকলো যে চাকরিটি হবে। পরেরদিন আরেকটি চিঠি পেলেন
আইনস্টাইন। চিঠিটি লিখেছেন উইন্টারথুর টেকনিক্যাল হাইস্কুলের শিক্ষক জ্যাকব
রেবস্টেইন(Jacob Rebstein)। রেবস্টেইন লিখেছেন তিনি মিলিটারি ট্রেনিং এ যাচ্ছেন মে
থেকে জুলাই পর্যন্ত। এ সময়টুকুর জন্য শিক্ষকের পদটি নিতে যদি আইনস্টাইন রাজি
থাকেন, তাহলে তিনি খুব খুশি হন। আইনস্টাইন খুশি ও অবাক হয়ে গেলেন। এই পদের জন্য
দরখাস্ত করা তো দূরের কথা, এই খন্ডকালীন পদটির কথা জানতেনও না তিনি। পরে আইনস্টাইন
জেনেছেন, তাঁর বন্ধু এহরাত তাঁর জন্য সুপারিশ করেছেন। আইনস্টাইন প্রচন্ড খুশি এখন।
চাকরি এখন হাতে এসে ধরা দিতে শুরু করেছে। মিলেইভাকে তিনি লিখেছেন কেমো হ্রদে চলে
আসার জন্য। চাকরি পাবার আনন্দটা দুজনে মিলে উপভোগ করবেন তাঁরা।
এপ্রিলের শেষের দিকে মিলেইভা কোমোতে এসে আইনস্টাইনের সাথে যোগ দিলেন।
আইনস্টাইন আগে থেকেই অপেক্ষা করেছিলেন সেখানে। আইনস্টাইন দারুন খুশি এখন। দুজন
মিলে কোমো শহর ঘুরে বেড়ালেন। ক্যাফেতে বসে আইনস্টাইনের প্রিয় কফি আর প্যাস্ট্রি
খেলেন। পরে একটি নৌকা ভাড়া করে কোমো হ্রদে ঘুরে বেড়ালেন। একটি উঁচু পাহাড়ে উঠলেন দুজন।
পাহাড়টি এতই উঁচু যে এখনো বরফ গলেনি সেটার চুড়োয়। স্লেজ গাড়িতে চললেন তারা দুজন।
ছোট্ট স্লেজ গাড়িতে দুজনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসতে হয়। মধুচন্দ্রিমা যাপনকারীদের
জন্যই ওই স্লেজগাড়িগুলো তৈরি। গাড়ির চালক মনে করেছেন আইনস্টাইন ও মিলেইভা
মধুচন্দ্রিমায় এসেছেন। তাঁরা নিজেরাও হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে তাঁরা এখনো বিয়ে
করেননি।
কয়েকদিন কোমোতে কাটিয়ে এসে মিলেইভা ফিরে গেলেন জুরিখে, আর আইনস্টাইন যোগ
দিলেন উইন্টারথুর টেকনিক্যাল স্কুলে। পড়াতে বেশ ভালোই লাগছে আইনস্টাইনের। সপ্তাহে
ত্রিশ ঘন্টা ক্লাস নিতে হয় তাঁকে। প্রতি রবিবার জুরিখে গিয়ে মিলেইভার সাথে সময়
কাটিয়ে আসেন। আইনস্টাইনের সব হতাশা যেন কয়েকদিনেই কেটে গেছে।
এসময় আইনস্টাইন বাবার কাছ থেকে একটি চিঠি পেলেন। আরাউতে মায়ার
পড়ালেখার খরচ বাবদ মাসে ত্রিশ ফ্রাঙ্ক করে দিতে লিখেছেন বাবা। আইনস্টাইন জানেন
মাসে এতটাকা জোগাড় করা বেশ কষ্টকর হবে তাঁর জন্য। কিন্তু বাবাকে
তিনি না বলতে পারলেন না। বাবা লিখেছেন তাঁর ব্যবসা এখন দেউলিয়া হবার পথে। কিছুদিন পরে
সত্যিই দেউলিয়া ঘোষণা করা হলো হারম্যান আইনস্টাইনের ব্যবসা। বাবার ব্যবসার
চেয়েও তাঁর ভেঙে পড়া শরীরের কথা ভাবছেন আইনস্টাইন।
এরমধ্যে এক রবিবার জুরিখে মিলেইভার মুখোমুখি হতেই মিলেইভা বললেন,”আমি সন্তানসম্ভবা”। আইনস্টাইনের
মুহূর্তেই মনে পড়লো তাঁর মায়ের কথা। মিলেইভার অসুবিধার চেয়েও তাঁর মনে হচ্ছে মা জানতে পারলে কী
হবে। মায়ের কাছে তিনি
বলেছিলেন তাঁরা এরকম কিছু করছেন না। এখন কী হবে? এটা জানাজানি হয়ে গেলে তাঁর বন্ধু গ্রোসম্যানই
বা কী ভাববেন? প্যাটেন্ট অফিসের চাকরিটি যদি ব্যক্তিগত চরিত্রের
খুঁত দেখিয়ে আইনস্টাইনকে না দেয়? মিলেইভাকে তো এসব বলা যাবে
না। মিলেইভাকে আশ্বস্ত করতে হবে। আইনস্টাইন চিন্তা করছেন যে কোন একটা চাকরি তাঁকে এখন পেতে
হবে। মিলেইভাকে বিয়ে
করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ সমাজে কুমারী মায়েদের কোন সম্মানজনক স্থান নেই।
মিলেইভাও বুঝতে পারছেন তাঁদের এই খবর গোপন রাখতে হবে। মাত্র কয়েকমাস পরেই
মিলেইভার ফাইনাল পরীক্ষা। এসময় শারীরিক জটিলতার কারণে তিনি পড়াশোনাও ঠিকমত করতে
পারছেন না। আর মানসিক দুশ্চিন্তা তো আছেই।
মিলেইভার খবরটা শোনার পরপর যেরকম একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছিলো আইনস্টাইনের
মনে, কয়েক সপ্তাহ পরে দেখা গেলো সেরকম অস্থিরতা আর নেই তাঁর। আইনস্টাইন স্থির করে
রেখেছেন একটা চাকরি পেলেই তিনি মিলেইভাকে বিয়ে করবেন। গ্রোসম্যান তো বলেই রেখেছেন
প্যাটেন্ট অফিসে তাঁর চাকরি হচ্ছেই। কিন্তু চাকরিটির জন্য এখনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও
দেয়া হয়নি। আর কতমাস অপেক্ষা করতে হবে কেউ জানেনা। এখানে উইন্টারথুরের চাকরিটি শেষ
হয়ে যাবে জুলাইতে। তারপর? আইনস্টাইন আবার চাকরির দরখাস্ত করতে শুরু করলেন।
জার্মান পদার্থবিদ ফিলিপ লেনার্ডের (Philipp Lenard)সদ্য প্রকাশিত একটি
পেপার পড়ে ভীষণ আলোড়িত আইনস্টাইন। লেনার্ড
আলট্রাভায়োলেট রে প্রয়োগ করে ক্যাথোড রে সৃষ্টির পরীক্ষার বর্ণনা দিয়েছেন এই
গবেষণাপত্রে। লেনার্ড দেখিয়েছেন, একটি ধাতব বস্তুর ওপর আলট্রাভায়োলেট রে প্রয়োগ
করে ক্যাথোড রে সৃষ্টি করা সম্ভব। ক্যাথোড রে হলো মূলত ইলেকট্রন গুচ্ছ। পরীক্ষায়
দেখা যাচ্ছে, ধাতুর ওপর থেকে যে ইলেকট্রনগুলো বেরিয়ে আসছে তাদের শক্তির ওপর
আলট্রাভায়োলেট রের উজ্জ্বলতা বা তীব্রতার কোন প্রভাব নেই। নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘের
আলট্রাভায়োলেট রে প্রয়োগে যে ইলেকট্রনগুলো বেরিয়ে আসছে তাদের সবার গতি সমান।
আলট্রাভায়োলেট রের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন করে ইলেকট্রনের গতিরও পরিবর্তন করা
সম্ভব হচ্ছে। আইনস্টাইন মনে করছেন পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য নতুন
আবিষ্কার। এর কয়েকবছর পরে আইনস্টাইন লেনার্ডের এই আবিষ্কার থেকেই তাঁর
ফটোইলেকট্রনিক ইফেক্ট সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এসময় থিওরি অব মেটালের ওপর প্রফেসর ড্রুডির একটি পেপার প্রকাশিত হয়েছে।
ড্রুডির পেপারটি পড়ে আইনস্টাইন নিজের একটি থিওরি নিয়ে ভাবছিলেন। ড্রুডির পেপারে
দুটো ভুল দেখতে পেলেন আইনস্টাইন। ড্রুডির মতে ধাতব পদার্থের ভেতর ইলেকট্রন গুলো
একধরণের ইলেকট্রন গ্যাস তৈরি করে। এখন তিনি মনে করছেন ধাতুর মধ্যে পজিটিভ ও
নেগেটিভ দুধরনের চার্জই থাকতে পারে। কিন্তু পরীক্ষায় দেখা গেছে শুধুমাত্র নেগেটিভ
চার্জই থাকতে পারে। আইনস্টাইন এই ভুলটা চিহ্নিত করলেন। দ্বিতীয় ভুলটি বোলজম্যানের
স্ট্যাটিস্টিক্সের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ড্রুডি বোলজম্যানের স্ট্যাটিস্টিক্স
ব্যবহার করেছেন তাঁর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায়। আইনস্টাইন এই ভুলত্রুটি উল্লেখ করে
প্রফেসর ড্রুডিকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির শেষে এটিও লিখলেন যে বর্তমানে তিনি একটি
চাকরি খুঁজছেন। ড্রুডি যদি কোন সহকারী নিয়োগ করেন, তাহলে আইনস্টাইনকে বিবেচনা করে
দেখতে পারেন।
আইনস্টাইন নিশ্চিন্ত ছিলেন যে চাকরি না দিলেও অন্তত থিওরির ভুলদুটো স্বীকার
করবেন প্রফেসর ড্রুডি। অনেকদিন পরে ড্রুডি আইনস্টাইনের চিঠির জবাব দিলেন। ড্রুডি
তাঁর পেপারের সমালোচনা পছন্দ করেননি। তিনি লিখেছেন, “একজন
প্রতিষ্ঠিত প্রফেসর আমার তত্ত্বের সাথে একমত। আমার আর কারো পরামর্শের দরকার নেই”।
আইনস্টাইন ভীষণ রেগে গেলেন। রাগের চোটে হম্বিতম্বি করতে লাগলেন যে প্রফেসর
ড্রুডির তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে তিনি ড্রুডির ক্যারিয়ারই নষ্ট করে দেবেন। কিন্তু ওই
আস্ফালনই সার। আইনস্টাইন ড্রুডির পেপারের সমালোচনা করে কোন লেখাই প্রকাশ করতে
পারেননি। করবেন কীভাবে? ইউরোপের সবচেয়ে মানী জার্নাল অ্যানালান ডার ফিজিকের
সম্পাদক হলেন প্রফেসর ড্রুডি। আইনস্টাইন বুঝতে পারছেন সায়েন্টিফিক রিসার্চও কিছু
প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দী। একাডেমিক জগতে প্রতিষ্ঠা না থাকলে বৈজ্ঞানিক সত্যও
প্রতিষ্ঠা করা কঠিন।
মিলেইভার কথা চিন্তা করে আইনস্টাইনের মনে হচ্ছে যে কোন ধরণের চাকরিই তিনি
করতে প্রস্তুত। কিন্তু মিলেইভা তাঁর জন্য আইনস্টাইনকে ছোট হতে দেবেন না কিছুতেই।
তিনি বুঝতে পারছেন ড্রুডির চিঠিতে আইনস্টাইন অপমানিত বোধ করছেন। মিলেইভা
আইনস্টাইনকে লিখলেন, “তোমার যোগ্যতার চেয়ে ছোট কোন চাকরি তুমি করবে না। আমি সব
কষ্ট সহ্য করতে পারলেও তোমার মেধার অবমূল্যায়ন সহ্য করতে পারবো না।
মিলেইভার দিন ভালো যাচ্ছে না। আর দুসপ্তাহ পরেই পলিটেকনিকে তাঁর ফাইনাল
পরীক্ষা। অথচ সেরকম প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। মাথার মধ্যে রাজ্যের দুশ্চিন্তা, পেটে
সন্তান, আর ল্যাবে প্রফেসর ওয়েবারের সাথে প্রতিদিন মনোমালিন্য হচ্ছে। ওয়েবারের
সাথে থিসিসও শেষ হয়নি তাঁর।
জুলাই মাসের ১৫ তারিখে উইন্টারথুর টেকনিক্যাল স্কুলের চাকরি শেষ হয়ে গেলো
আইনস্টাইনের। কী করবেন তিনি এখন। যদিও মিলেইভাকে প্রতিটি চিঠিতেই লেখেন যে তাঁকে ছেড়ে
থাকতে পারছেন না তিনি, কিন্তু এখন জুরিখে মিলেইভার কাছে না গিয়ে আইনস্টাইন চলে
গেলেন মেটমেনস্টেনের হোটেল প্যারাডাইসে। সেখানে মা ও
বোনের সাথে যোগ দিলেন আইনস্টাইন।
মায়া এবার ভালো করে কথাও বলছেন না আইনস্টাইনের সাথে। আরাউতে উইন্টেলার
পরিবারে থাকতে থাকতে মেরির সব কথা শুনেছেন মায়া। তাঁর দাদা মেরি
উইন্টেলারকে কষ্ট দিয়েছেন। এখন মিলেইভাকেও সেরকম কষ্ট দেবেন না নিশ্চয়তা কী। মায়া অবশ্য জানেন
না যে মিলেইভা সন্তানসম্ভবা। জানলে এসময় মিলেইভার পাশে না থেকে এখানে এসে মা ও বোনের সাথে
ছুটি কাটানোর জন্য আইনস্টাইনকে নিশ্চয় ক্ষমা করতেন না মায়া।
জুলাইয়ের শেষে মিলেইভার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। ক্লাসের সবাই
পাস করে গেছেন, কিন্তু মিলেইভা এবারো পাস করতে পারলেন না। তিনি ভাবতে পারছেন
না মা বাবার কাছে মুখ দেখাবেন কী করে। তাঁর বাবা কত স্বপ্ন দেখেন
তাঁকে নিয়ে। তাঁর জন্য স্পেশাল পারমিশন এনে দিয়েছেন বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার জন্য। আর তিনি বাবার
সম্মানটুকুও রাখতে পারলেন না। তার ওপর তিনি এখন আইনস্টাইনের সন্তান ধারণ করেছেন। কী চোখে দেখবেন
এখন তাঁকে তাঁর বাবা-মা? আইনস্টাইন মিলেইভার ফেলের খবর
শুনলেন। সান্ত্বনার সুরে বললেন আবার পরীক্ষা দেয়ার কথা। কিন্তু মিলেইভা
জানেন তাঁর পড়াশোনা এখানেই শেষ।
বাড়ি চলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন মিলেইভা। খুবই হতাশ তিনি। আইনস্টাইনকে
অনুরোধ করলেন যেন তিনি মিলেইভার বাবা-মাকে একটি চিঠি লিখে দেন যে সহসাই তিনি
মিলেইভাকে বিয়ে করবেন। আইনস্টাইন মিলেইভার কথামত চিঠি লিখলেন মিলেইভার বাবা-মাকে।
বাড়িতে মিলেইভার অবস্থানটাই নড়বড় হয়ে গেছে এখন। মিলেইভা নভি
সাদে পৌঁছানোর কয়েকদিন আগে আইনস্টাইনের চিঠিটি পেয়েছেন মিলেইভার বাবা-মা। মিলেইভার মা
মারিয়া ভীষণ রেগে আছেন আইনস্টাইন আর মিলেইভার ওপর। মিলেইভার সন্তানধারণের
কথা তাঁরা জেনেছেন আইনস্টাইনের চিঠিতে। এবার মিলেইভার মুখে শুনলেন
তাঁর ফেল করার খবর। এমন কষ্ট আর কোনদিন পাননি মিলেইভার মা বাবা।
কদিন পরে তাঁদের ক্ষোভের আগুনে পেট্রোল ঢেলে দিলো মিলান থেকে আসা একটি চিঠি। আইনস্টাইনের
মা পলিন মিলেইভার মা বাবাকে লিখেছেন মিলেইভা সম্পর্কে। অকথ্য ভাষায়
গালিগালাজ করেছেন তিনি চিঠিতে। মিলেইভার মা বাবাকেও ছেড়ে দেননি। মিলেইভার বাবা
মাইলোস সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। বর্তমানে সরকারের উচ্চপদে কর্মরত। আর্থিক অবস্থা
বিবেচনা করলে তাঁরা বেশ ধনী। আইনস্টাইনের পরিবারের চেয়ে অনেক উন্নত তাঁদের পরিবার। শুধুমাত্র মেয়ের
ভুলের কারণে আজ তাঁদের অপমান করতে
পারছেন আইনস্টাইনের মা। তবুও তো পলিন জানেন না যে মিলেইভা সন্তানসম্ভবা। জানলে চিঠির
ভাষা কেমন হতো তা কল্পনা করতেই শিউরে উঠেন মিলেইভা।
মিলেইভার বাবা-মা প্রতিজ্ঞা করেছেন যে আইনস্টাইনের সাথে কিছুতেই তাঁরা মিলেইভার বিয়ে দেবেন না।
মিলেইভার বাবা-মা প্রতিজ্ঞা করেছেন যে আইনস্টাইনের সাথে কিছুতেই তাঁরা মিলেইভার বিয়ে দেবেন না।
আইনস্টাইন এসব জানতে পারেন মিলেইভার চিঠিতে। কিন্তু মাকে
কী বলবেন তিনি। মিলেইভাকেও বা কী বলে সান্ত্বনা দেবেন। নভি সাদে গিয়ে
মিলেইভার সাথে দেখা করাও সম্ভব নয় আইনস্টাইনের। আইনস্টাইনকে
মিলেইভার বাবা-মা সহ্য করবেন না। মনের দুঃখে বান্ধবী
হেলেনকে লিখলেন আইনস্টাইনের মা সম্পর্কে, “মানুষ এরকম নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারে জানিনা। তিনি যেন ব্রত
নিয়েছেন যেভাবেই পারেন আমাকে শেষ করে ফেলবেন। তিনি শুধু আমার
জীবনই নষ্ট করে দিচ্ছেন না, নিজের ছেলের জীবনও নষ্ট করে ফেলছেন। মানুষ যে এরকম
খারাপ হতে পারে, আগে আমি জানতাম না”।
স্কুলের চাকরি শেষ হয়ে যাবার পরও আইনস্টাইন উইন্টারথুরের বাসাটি ছাড়েননি এখনো। এখান থেকেই আরেকটি
চাকরির চেষ্টা করছেন। শ্যাফুসেনে (Schaffhausen)একটা চাকরির বিজ্ঞাপন দেখলেন
একদিন। শ্যাফুসেন উইন্টারথুর থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে জার্মান সীমান্ত ঘেঁষে সুইজারল্যান্ডের
একটি গ্রাম। আইনস্টাইনের একবন্ধু কনরাড হ্যাবিশটের(Conrad Habicht) বাড়ি সেখানে। চাকরিটি হলো
স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ফেলকরা একজন ছাত্রকে পড়ানো। আইনস্টাইন হ্যাবিশটের
নাম রেফারি হিসেবে রেখে দরখাস্ত করলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই চাকরিটি
পেয়ে গেলেন তিনি।
উইন্টারথুরের পাট গুটিয়ে আইনস্টাইন চলে গেলেন শ্যাফুসেনে। ছাত্রের নাম
লুইস ক্যাহেন(louis Cahen)। ইংরেজ এই ছেলেটি গণিতে দুর্বলতার কারণে প্রবেশিকা পরীক্ষায়
ফেল করেছে। আইনস্টাইনের দায়িত্ব হলো লুইসকে অংক শেখানো। বেতন মাসে ১৫০
ফ্রাঙ্ক। আইনস্টাইন আর একটু বেশি বেতন আশা করেছিলেন। তবে এখানে থাকা
খাওয়া ফ্রি।
একটা প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুলের মতো ব্যবস্থা এখানে। স্কুলের ডিরেক্টর
জ্যাকব নুয়েশ(Jacob Nuesch) মিলিটারি মেজাজের মানুষ। জার্মান সীমান্তে
সুইস স্কুল চালাচ্ছেন জার্মানির মিলিটারির কায়দায়। আইনস্টাইন নুয়েশকে
পছন্দ করতে পারলেন না। আইনস্টাইনের তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো নুয়েশ পরিবারের
সাথে। এই ব্যাপারটিও পছন্দ হলো না আইনস্টাইনের। কিন্তু আপাতত
কিছু করার নেই এ ব্যাপারে।
ছাত্র লুইসের সাথে খুব সহজেই ভাব হয়ে গেলো আইনস্টাইনের। লুইসও আইনস্টাইনকে
পছন্দ করে ফেললো। আইনস্টাইন হাসিখুশি মেজাজে নতুন পদ্ধতিতে গণিত শেখাচ্ছেন লুইসকে। এর আগে লুইস
মিলিটারি মেজাজের মাস্টারই দেখেছে বরাবর। সম্পূর্ণ অন্যরকম আইনস্টাইনকে
পেয়ে সে খুব খুশি। জানা গেলো লুইসও পছন্দ করে না ডিরেক্টর জ্যাকব নুয়েশকে।
আইনস্টাইন মিলেইভাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন এখানের চাকরির কথা। কয়েকদিন পরে
মিলেইভার চিঠি এলো। মিলেইভা আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে চান। তিনি লিখেছেন
বাবার বাড়ি ছেড়ে আইনস্টাইনের কাছে চলে আসতে ইচ্ছে করছে তাঁর। কিন্তু বাবা
তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কারণ তাঁরা কেউই এখন আইনস্টাইনকে পছন্দ করছেন না। তাই মিলেইভা
ঠিক করেছেন আইনস্টাইন যেখানে আছেন এখন, সেখান থেকে বারো মাইল দূরে স্টেইন-আম-রেইন (Stein am Rhein) নামে একটি গ্রামে এসে
থাকবেন। আইনস্টাইন যেন অবশ্যই সেখানে যান।
এ পর্যন্ত মিলেইভাকে লেখা প্রতিটি চিঠিতে আইনস্টাইন লিখেছেন, মিলেইভাকে
দেখার জন্য তিনি অস্থির হয়ে আছেন, মিলেইভাকে ছাড়া তিনি কিছুই
করতে পারছেন না, তাঁর দিন কাটছে না মিলেইভাকে কবে দেখতে পাবেন
এই আশায়, ইত্যাদি। কিন্তু এখন প্রায়
সাতমাসের অন্তঃস্বত্তা মিলেইভা বাড়ি থেকে পালিয়ে আইনস্টাইনের কর্মস্থল থেকে মাত্র বারো
মাইল দূরে এসে অপেক্ষা করছেন আইনস্টাইনের জন্য। অথচ আইনস্টাইন
মিলেইভাকে দেখতে গেলেন না একবারও। মিলেইভা চিঠির পর চিঠি লিখছেন। মিলেইভা চলে
আসতে পারতেন আইনস্টাইনের কাছে। কিন্তু আইনস্টাইনের চাকরির ক্ষতি হবে ভেবে মিলেইভা তা করছেন
না। আইনস্টাইন নানারকম
অজুহাত দেখাচ্ছেন দেখা না করার। একবার লিখলেন তাঁর কাছে গাড়ি ভাড়ার টাকা নেই। মিলেইভা টাকাও
পাঠাতে চেয়েছেন। কিন্তু আইনস্টাইন দেখা করেন নি। অনেকদিন অপেক্ষা করার পর
মিলেইভা ফিরে গেছেন মা-বাবার কাছে।
আইনস্টাইন তাঁর ডক্টরেট থিসিসের কাজ শুরু করেছেন। মলিকিউলার ফোর্সের
ওপর থিসিস লিখে নভেম্বরের ২৩ তারিখে তা পাঠিয়ে দিলেন জুরিখ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলফ্রেড
ক্লেইনারের কাছে। আইনস্টাইন জানেন না ক্লেইনার থিসিসটি গ্রহণ করবেন কিনা। থিসিসের একটি
অংশে আইনস্টাইন প্রফেসর ড্রুডি ও বোলজম্যানের থিওরির সমালোচনা করেছেন। তা নিয়ে ক্লেইনারের
কী প্রতিক্রিয়া হবে আইনস্টাইন জানেন না। ক্লেইনার সম্পর্কে আইনস্টাইন
খুব একটা উঁচু ধারণা পোষণ করেন না।
এদিকে আইনস্টাইন জানতে পেরেছেন লুইসকে পড়ানোর জন্য লুইসের মা বছরে চারহাজার
ফ্রাঙ্ক করে দিচ্ছেন ডিরেক্টর নুয়েশকে। অথচ নুয়েশ কিনা তাঁকে দিচ্ছেন
মাসে মাত্র দেড়শো ফ্রাঙ্ক! বছরে ২২০০ ফ্রাঙ্ক মেরে দিচ্ছেন নুয়েশ!
আইনস্টাইনের মনে হলো নুয়েশ একজন প্রতারক। তিনি নুয়েশকে
জব্দ করতে চাইলেন। একদিন বললেন,
-মিস্টার নুয়েশ, এখন থেকে আমি বাইরে
রেস্টুরেন্টে খাবো। বিল যা আসে আপনি মিটিয়ে দেবেন।
-সেটা হবে না। যা ঠিক করা আছে, সে নিয়মেই
চলবে। আপনাকে আমার বাড়িতেই খেতে হবে।
-তাহলে আমাকে অন্য চাকরিতে যোগ দিতে হবে। আপনার বাড়িতে
খেয়ে আমার পোষাচ্ছে না।
আইনস্টাইন অন্য চাকরির কথা বলে ফেলেছেন নুয়েশকে ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু নুয়েশ যদি অন্য চাকরি দেখতে বলেন, আইনস্টাইন বিপদে পড়বেন। চাকরির বাজারে এখন কোন আশা নেই আইনস্টাইনের। প্যাটেন্ট অফিসের চাকরিটির জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে চাকরির আশা ছেড়েই দিয়েছেন তিনি। নুয়েশ আইনস্টাইনের কথায় হয়তো ভয় পেয়েছেন। তিনি মেনে নিয়েছেন আইনস্টাইনের কথা। আইনস্টাইন ভাবছেন এভাবে হলেও কিছু টাকা খসানো যাচ্ছে নুয়েশের কাছ থেকে।
দুদিন পরেই আইনস্টাইন বন্ধু গ্রোসম্যানের চিঠি পেলেন। গ্রোসম্যান জানাচ্ছেন, প্যাটেন্ট
অফিসের চাকরিটির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় পাঠানো হয়েছে। দুদিন পরে ফেডারেল
গেজেটে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। প্রার্থীর যোগ্যতা চাওয়া
হয়েছে আইনস্টাইনের যা যা আছে ঠিক তাই। আইনস্টাইন বুঝতে পারছেন
গ্রোসম্যানের বাবার সুপারিশে আইনস্টাইনের কথা মাথায় রেখেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করা
হয়েছে। প্যাটেন্ট অফিসে এর আগে কোন পদার্থবিদ নিয়োগ করা হয়নি। আইনস্টাইন চাকরির
দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন।
চাকরিটি হবে সে ব্যাপারে তিনি একপ্রকার নিশ্চিন্ত হলেও চাকরিটি হাতে আসতে এখনো
বেশ কয়েকমাস অপেক্ষা করতে হবে। তিনি ছাত্র লুইসের সাথে পরামর্শ করলেন। প্যাটেন্ট অফিসে
যোগ দিয়ে বার্নে চলে গেলে লুইসও যাবে আইনস্টাইনের সাথে। অফিসের পরে আইনস্টাইন
পড়াবেন লুইসকে। লুইসের মা নুয়েশকে যে টাকাটা দেন- তখন তা আইনস্টাইনকে দেবেন। লুইসও খুব খুশি
এ প্রস্তাবে। সে তার মাকে জানালো ব্যাপারটা। কিন্তু লুইসের মা এ প্রস্তাবে
রাজী নন। লুইসের বাবাকে সম্প্রতি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। লুইসের মা লুইসের
বাবার সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তনই চান না।
আইনস্টাইন খুব হতাশ হয়ে পড়লেন লুইসের মায়ের সিদ্ধান্তের কথা জেনে। এদিকে জ্যাকব
নুয়েশ আইনস্টাইনের ওপর খুব অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছেন। তিনি দেখেছেন
আইনস্টাইনের শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতি ভীষণ এলোমেলো। কোন ধরণের শৃঙ্খলা
নেই আইনস্টাইনের। ছাত্রের সাথে শিক্ষকসুলভ দূরত্ব বজায় রাখেন না আইনস্টাইন। নুয়েশ আইনস্টাইনের
বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছেন।
বেশ কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করার পরেও প্রফেসর ক্লেইনারের কাছ থেকে থিসিস সংক্রান্ত
কোন সিদ্ধান্ত না পেয়ে আইনস্টাইন জুরিখ যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ডিসেম্বরের ১৯
তারিখে তিনি জুরিখে রওনা হলেন। ইচ্ছে আছে ক্লেইনারের সাথে মুখোমুখি আলোচনা করবেন থিসিস বিষয়ে। আইনস্টাইন থিসিসটি
লিখেছেন মলিকিউলার ফোর্স ও গ্যাসের গতিতত্ত্ব প্রসঙ্গে। কিন্তু তিনি
অন্যান্য বিষয়েও কাজ করছেন। ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সমস্যা নিয়ে ভাবছেন অনেকদিন থেকে। ইলেক্ট্রিক ও
ম্যাগনেটিক মোশানকে তাঁর মনে হচ্ছে রিলেটিভ মোশান। মানে একেক জনের
কাছে একেক রকম মনে হতে পারে কোন বস্তুর গতি। কিন্তু নিউটন সহ আরো অনেকে
পরম গতির কথা বলে গেছেন। পরম গতির অর্থ হলো সবার কাছে একই রকম মনে হবে এই গতি। কিন্তু আইনস্টাইন
তা মেনে নিতে পারছেন না।
প্রফেসর ক্লেইনারের সাথে দেখা করলেন আইনস্টাইন। ক্লেইনার এখনো
তাঁর থিসিসটি পড়েও দেখেননি। তবে আইনস্টাইনকে তিনি কথা দিয়েছেন ক্রিস্টমাসের ছুটিতে তিনি
থিসিসটি পড়ে দেখবেন। আইনস্টাইন গতিশীল বস্তুর ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স প্রসঙ্গে নিজের
ধারণার কথা ব্যাখ্যা করলেন ক্লেইনারের কাছে।ক্লেইনার আইনস্টাইনকে উৎসাহ দিয়ে বললেন পেপার
লিখে প্রকাশ করতে। আইনস্টাইন চাকরির ব্যাপারেও কথা বললেন। ক্লেইনারের হাতে
কোন চাকরি নেই, তবে তিনি আইনস্টাইনের রেফারি হতে রাজী হয়েছেন। ক্লেইনার সম্পর্কে
আইনস্টাইনের ধারণা বদলে গেলো। এখন আইনস্টাইনের মনে হচ্ছে ক্লেইনার একজন উঁচুমানের মানুষ। আইনস্টাইন আশা
করছেন ক্লেইনার তাঁর থিসিসটি গ্রহণ করবেন। আইনস্টাইন এখন ডক্টর আইনস্টাইন
হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
ইলেকট্রোডায়নামিক্সের পেপারটি লিখে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আইনস্টাইন। ক্রিস্টমাসের
ছুটি শ্যাফুসেনেই কাটালেন তিনি। তবে ক্রিস্টমাসের দিন মেটমেনস্টেটেনে গিয়ে মায়ার সাথে দেখা
করলেন। মায়া এখনো জানেননা যে মিলেইভা সন্তানসম্ভবা। মিলেইভার প্রতি
একধরণের মমত্ববোধ জন্মেছে মায়ার। উইন্টেলার পরিবারে থাকতে থাকতে মেরির ভাই পল উইন্টেলারের
প্রেমে পড়েছেন মায়া। তিনি এখন প্রেমিকার মন বোঝেন। আইনস্টাইনের
মা যখন মিলেইভার নামে আজে বাজে কথা বলতে শুরু করেন, প্রতিবাদ করেন মায়া। পলিন এবার মায়ার
ওপরও রেগে যান। কিন্তু সব রাগ গিয়ে পড়ে মিলেইভার ওপর। পলিনের মনে হচ্ছে, মিলেইভা
এখন মায়াকেও কেড়ে নিচ্ছেন তাঁর কাছ থেকে।
প্রকাশনা
আইনস্টাইনের প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এ বছর।
পেপার-১- “Conclusions Drawn from
the Phenomenena of Capillarity”, Annalen der Physik,সংখ্যা ৪ (১৯০১),
পৃঃ ৫১৩-৫২৩। আইনস্টাইন তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধের তারিখ দিয়েছিলেন ১৩
ডিসেম্বর ১৯০০। কিন্তু পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯০১ সালের মার্চ মাসে।
থার্মোডায়নামিক্স ও আণবিক তত্ত্ব ব্যবহার করে তিনি দেখিয়েছিলেন খুব ছোট
ব্যাসার্ধের নলের ভেতর প্রকৃতিকে সহজলভ্য তরল পদার্থগুলোর অন্তঃআণবিক শক্তি কীভাবে
কাজ করে।
No comments:
Post a Comment