১৯৩৪
আইনস্টাইনের আমেরিকান জীবন পুরোপুরি শুরু হয়েছে। আমেরিকান বুদ্ধিজীবী
ও রাজনৈতিক নেতাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছেন আইনস্টাইন। মাথা ঘামাতে
শুরু করেছেন বিশ্বরাজনীতির সাথে সাথে আমেরিকান রাজনীতি নিয়েও। জানুয়ারির শেষে
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেলট (Franklin D.Roosevelt)হোয়াইট হাউজে ডিনারে
আমন্ত্রণ জানালেন আইনস্টাইনকে। আইনস্টাইন হোয়াইট হাউজে
গেলেন প্রেসিডেন্টের সাথে ডিনার করতে। হেলেন ডুকাস আইনস্টাইনকে
অনুরোধ করেছিলেন অন্তত একদিনের জন্য হলেও মোজা পরতে। আইনস্টাইন রাজী
হননি। মোজাছাড়া জুতা পরেই তিনি হোয়াইট হাউজে ডিনার সারলেন, রাতে
থেকেও গেলেন হোয়াইট হাউজের গেস্টরুমে।
ক্রমশ সামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন আইনস্টাইন। জার্মানি থেকে
অনেক বিজ্ঞানী পালিয়ে আসছেন আমেরিকায়। তাঁদের আশ্রয় দেয়ার জন্য
তহবিল সংগ্রহে নেমে পড়লেন আইনস্টাইন। নিউইয়র্কে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হলো- যেখানে
বেহালা বাজালেন আইনস্টাইন।
আর্থিকভাবে আইনস্টাইন এখন অনেক সঙ্ঘত। বিদেশী ব্যাংকে
আগেই কিছু সঞ্চয় ছিলো তাঁর। এখন প্রিন্সটনে যে বেতন পাচ্ছেন তা যে কোন আমেরিকান প্রফেসরের
বেতনের প্রায় দ্বিগুণ। আমেরিকার অর্থনীতির এরকম মন্দা সময় ধরতে গেলে আইনস্টাইন প্রাচুর্যের
ভেতর আছেন। তার ওপর কোথাও লেকচার দিলে যে সম্মানী পান- তার পরিমাণও স্বাভাবিকের
চেয়ে অনেক বেশি। নিজের জন্য খুব কমই খরচ হয় আইনস্টাইনের। কিন্তু এলসার
খরচ নিয়ন্ত্রণহীন। অভিজাত চালচলন ও বিলাসী দ্রব্যের প্রতি এলসার আকর্ষণ তীব্র। এখন আইনস্টাইনের
উপার্জন বেড়ে যাওয়াতে এলসার চাহিদাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
এখন আবার শান্তিবাদী হয়ে গেছেন আইনস্টাইন। তিনি মনে করেন
একমাত্র ওয়ার্লড গভর্নমেন্ট পদ্ধতিই পারে যুদ্ধ বন্ধ করতে। তার মানে আইনস্টাইন
চাচ্ছেন পৃথিবীতে আলাদা আলাদা কোন রাষ্ট্র থাকবে না, সবাই হবে বিশ্বনাগরিক।
মে মাসে প্যারিস থেকে খবর এলো আইলস গুরুতর অসুস্থ। আইনস্টাইন কিছুতেই
আর ইউরোপে যাবেন না ঠিক করেছেন। এলসা ছুটে গেলেন প্যারিসে-মুমুর্ষু মেয়ের কাছে।কিন্তু কোন ফল
হলো না। জুলাই মাসে আইলস মারা গেলেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।
এদিকে আমেরিকায় আইনস্টাইন দীর্ঘ গরমের ছুটি কাটালেন রোড আইল্যান্ডের(Rhode Island) সৈকতে। সাথে ছিলেন তাঁর বার্লিনের ডাক্তার বন্ধু গুস্তাভ বাকি (Gustav Bucky)ও তার পরিবার। সমুদ্রের ধারে অলস বসে থেকে এবং মাঝে মাঝে নৌকায় চড়ে কাটলো
কয়েকমাস।
বছরের শেষের দিকে মার্গট ও তার স্বামী দিমিত্রি চলে এলো প্রিন্সটনে। আইলসকে হারিয়ে
তাঁর স্বামী রুডলফ কেইজার ইউরোপেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। নেদারল্যান্ডে
চলে গেলেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিন তাঁর অপছন্দের সবাইকে মোটামুটি শেষ করে ফেলেছেন। জার্মানিতে হিটলারও
সেরকম একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে নাৎসি বাহিনীতে শুদ্ধি-অভিযান
চালালেন। বেশ কিছু নাৎসি সেনাকে গুলি করে মারা হলো। বেশ কিছু নাৎসি
অফিসারকে হত্যা করলেন হিটলার যাদের তিনি বিশ্বাস করতেন না। আর অনেক নির্দোষ
সৈনিককে হত্যা করলেন সেনাবাহিনীতে তাঁর একাধিপত্য নিষ্কন্টক করার জন্য। এসময় প্রেসিডেন্ট
পল ভন হিন্ডারবুর্গ মারা গেলে হিটলার নিজেকে জার্মানির ফুহরার (Fuhrer)বা ‘সর্বময় ক্ষমতার মালিক’ ঘোষণা
করলেন। জার্মানির সব সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির শ্রদ্ধা আদায় করার জন্যও ব্যস্ত হয়ে
পড়লেন তিনি। স্যালুট দেয়ার সময় চিৎকার করে ‘হেইল হিটলার’ বা ‘হিটলারের জয়’ বলে চিৎকার
করাটা নাৎসি বাহিনীতে আগেই বাধ্যতামূলক ছিলো। এখন সারা জার্মানিতে
তা নিয়ম করে দেয়া হলো। জার্মানির লোকেরা ‘হেইল হিটলার’ বলে স্যালুট করতে শুরু করলো, পরস্পর কুশল বিনিময় করার সময়ও ‘হেইল হিটলার’ বলা অনেকটা
বাধ্যতামূলক হয়ে গেলো। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর এনগেলবার্ট ডলফুস অস্ট্রিয়াকে জার্মানির
সাথে যুক্ত হয়ে যাবার হিটলারি প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করায় নাৎসি বাহিনী ডলফুসকে
হত্যা করে। তারপরও হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে নিতে পারেনি এখনো।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের পাঁচটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ
পেপারঃ১৯৪ “The World as I See It” প্রকাশকঃ
Covici-Friede,নিউইয়র্ক (১৯৩৪)। পদার্থবিজ্ঞান,জনপ্রিয়
বিজ্ঞান,বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়, ইহুদি প্রসঙ্গ,ইত্যাদি বিষয়ে আইনস্টাইনের বিভিন্ন
প্রবন্ধ,বিবৃতি, বক্তৃতা ইত্যাদির
সংকলন এই বই। পরে এই বইয়ের অনেকগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
পেপারঃ১৯৫ “Education and World Peace.” Progressive
Education,বর্ষ ১১ (১৯৩৪), পৃষ্ঠাঃ৪৪০।নভেম্বরের ২৩ তারিখে নিউইয়র্কে আয়োজিত ‘প্রোগ্রেসিভ
এডুকেশান এসোসিয়েশান’-এর সম্মেলনে আইনস্টাইনের এই বাণী পাঠ করা
হয়। পরের দিন নিউইয়র্ক টাইমসে তা প্রকাশিত হয়। আইনস্টাইন বলেন, আমেরিকা
এখন অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। সেরকম কোন বহিঃশত্রুর
আক্রমণের সম্ভাবনা নেই এখানে। তাই আমেরিকার স্কুলগুলোতে শান্তিবাদী পড়াশোনার ব্যবস্থা করা
উচিত। আমেরিকার ছেলেমেয়েদের মিলিটারি কায়দায় লেখাপড়া শেখানোর কোন মানে হয়না। মিলিটারি যদি
রাখতেই হয় তা দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রাখা যেতে পারে, কিন্তু
কিছুতেই অন্যদেশকে আক্রমণ করার জন্য নয়।
পেপারঃ১৯৬ “Presentation of Semivectors as Vectors of a Particular
Differentiation Character” (সহলেখকঃওয়ালথার মেইয়ার)। Annals of
Mathematics, সংখ্যা ৩৫ (১৯৩৪), পৃষ্ঠাঃ১০৪-১১০। এ গবেষণাপত্রে
ওয়ালথার মেইয়ার ও আইনস্টাইন সেমি-ভেক্টরকে বিশেষ পর্যায়ে ভেক্টরের মত ব্যবহার
করার পদ্ধতি আলোচনা করেছেন। এটিও একটি জটিল গাণিতিক পেপার।
পেপারঃ১৯৭ “Introduction,” লিওপার্ড ইনফেল্ডের(Leopard
Infeld) দি ওয়ার্ল্ড ইন মডার্ন সায়েন্স(The World in
Modern Science) বইয়ের ভূমিকা। জার্মান ও ইংরেজি
উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত হয়। প্রকাশকঃGollancz লন্ডন (১৯৩৪)।
পেপারঃ১৯৮ “Obituary for Paul Ehrenfest.” In Almanak van het
Leidsche Studencorps,ডয়েসবুর্গ(Doesburg),লিডেন (১৯৩৪)। ইউনিভার্সিটি
অব লিডেনের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর পল ইরেনফেস্ট ছিলেন আইনস্টাইনের বন্ধু। ১৯১২ সালে পরিচয়ের
পর থেকেই তাঁরা বন্ধু। আইনস্টাইনের দুঃসময়ে ইরেনফেস্ট নানাভাবে চেষ্টা করেছেন নেদারল্যান্ডের
কোন ইউনিভার্সিটিতে আইনস্টাইনের জন্য স্থায়ী কোন চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা। ইরেনফেস্টের
ছেলে ভ্যাসিক জন্ম থেকেই ডাউন সিন্ড্রোমে (Down’s syndrome)আক্রান্ত। ষোল বছর ধরে
ইরেনফেস্ট সহ্য করেছেন ছেলের কষ্ট। কিন্তু এবছর সব আত্মবিশ্বাস হারিয়ে তিনি ছেলেকে হত্যা করেন। তারপর আত্মহত্যা
করেন। আইনস্টাইন ইরেনফেস্টের স্মৃতিচারণ করে এই বিবৃতি দেন।
১৯৩৫
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের কাছে মার্সার স্ট্রিটের ১১২ নম্বর বাড়িতে
উঠে এসেছেন আইনস্টাইন। এরপর এই বাড়িতেই ছিলেন আমৃত্যু। ইনস্টিটিউটের
নব নির্মিত ভবন থেকেও বাড়িটি বেশ কাছে। আইনস্টাইন বাড়ি থেকে হেঁটেই
অফিসে যান,
কারণ তিনি গাড়ি চালানো শেখেননি কোনদিন।
আইনস্টাইনরা আমেরিকায় এসেছিলেন ভিজিটর ভিসায়। কিন্তু তাঁদের
মূল উদ্দেশ্য আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করা। তখন নাগরিকত্বের জন্য দরখাস্ত
করতে হলে আমেরিকার বাইরে অন্য কোন দেশে গিয়ে দরখাস্ত করতে হতো। আইনস্টাইনরা
মে মাসে জাহাজে চেপে বারমুড়া চলে গেলেন। বারমুড়ায় নিযুক্ত আমেরিকান
রাষ্ট্রদূত আইনস্টাইনকে সমাদর করে নিয়ে গেলেন দূতাবাসে। সেখানে আমেরিকার
নাগরিক হবার জন্য দরখাস্তের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলেন পরিবারের সবার জন্য। রাষ্ট্রদূত আইনস্টাইনের
সম্মানে বিশাল এক পার্টির আয়োজন করলেন দূতাবাসে। নিয়ম অনুযায়ী
পাঁচ বছর পরে আইনস্টাইন আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন।
বারমুডা থেকে ফিরে আইনস্টাইন ম্যাসাচুসেটস গেলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে
সম্মানসূচক ডিগ্রি নেয়ার জন্য। তারপর গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গেলেন কানেক্টিকাট রাজ্যের ওল্ড
লাইম নামে একটি ঐতিহাসিক গ্রামে। কানেক্টিকাট নদীর মোহনায় বেশ আনন্দেই কাটলো আইনস্টাইনের গরমের
ছুটি।
ইউরোপের সারল্যান্ড জার্মানির সাথে যুক্ত হয়েছে। এখন তা দক্ষিণ-পশ্চিম
জার্মানি। ১৯১৯ সাল থেকে সারল্যান্ড ছিলো স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। নাৎসিরা ভার্সাই
চুক্তির ধার ধারছে না আর ।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার পর ফ্রান্স সহ আরো যে সব দেশকে
ক্ষতিপূরণ দেয়ার চুক্তি হয়েছিলো সব অস্বীকার করলো জার্মানি। জার্মানিতে বাধ্যতামূলক
মিলিটারি সার্ভিস চালু হয়েছে আবার। জার্মানির অর্থনীতি আস্তে আস্তে চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। হিটলার ইহুদিদের
জন্য ন্যুরেমবার্গ আইন পাস করেছেন। এই আইন অনুযায়ী জার্মানিতে ইহুদিরা সব ধরণের নাগরিক অধিকার
থেকে বঞ্চিত হবে। কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও তারা পাবে না। ইহুদিরা এখন
দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। ইহুদিদের থাকার জন্য আলাদা জায়গা করে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। আইন অনুযায়ী
কোন ইহুদি জার্মান আর্যদের সাথে বৈবাহিক বা কোন ধরণের সামাজিক সম্পর্কও রাখতে পারবে
না। আর যদি কোন ইহুদি
জার্মান আর্যদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে-তা হবে মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ।
সেপ্টেম্বরে আইনস্টাইন খবর পেলেন যে তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু মার্সেল গ্রোসম্যান
মারা গেছেন। আইনস্টাইনের প্রতিষ্ঠা পাবার পেছনে গ্রোসম্যানের ভূমিকা অনেক। পলিটেকনিকে পড়ার
সময় গ্রোসম্যানের ক্লাসনোট পড়েই পাস করেছেন আইনস্টাইন। গ্রোসম্যানের
সাহায্যেই আইনস্টাইন প্যাটেন্ট অফিসে চাকরি পেয়েছেন। গ্রোসম্যানের
মৃত্যুতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন আইনস্টাইন।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য পাঁচটি রচনাঃ
পেপারঃ১৯৯ “Appeal for Jewish Unity.”New Palestine,বর্ষ ২৫, সংখ্যা ৯ (১
মার্চ ১৯৩৫), পৃষ্ঠাঃ১। আমেরিকান জিউইস
কংগ্রেসের মহিলা শাখার উদ্যোগে আয়োজিত একটি সভায় আইনস্টাইন এ ভাষণটি দিয়েছিলেন। পৃথিবীর সব ইহুদিদের
ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান আইনস্টাইন।
পেপারঃ২০০ “Peace Must Be Waged.”Interview by
R.M.Bartlett.Survey Graphic,সংখ্যা ২৪ (১৯৩৫), পৃষ্ঠাঃ৩৮৪। সাংবাদিক বার্টলেটের
কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে আইনস্টাইন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মান জাতীয়তাবাদের
আলোকে যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন। আইনস্টাইন বলেন, আন্তর্জাতিকতার
প্রয়োজনে প্রত্যেক দেশকেই কিছু কিছু ছাড় দিতে হয়, প্রত্যেক
জাতিরই উচিত শুধুমাত্র নিজেদের জাতিসত্ত্বাকে সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে না
করে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই
উচিত আগ্রাসন এড়িয়ে চলা। আইনস্টাইন মনে করেন জাতি যত শিক্ষিত হবে, তারা
তত বুঝতে শিখবে। প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব।
পেপারঃ২০১ “Can Quantum-Mechanical Description Be Considered
Complete?” (সহলেখকঃবরিস পুডলস্কি ও ন্যাথান রোজেন)।Physical Review,সংখ্যা ৪৭ (১৯৩৫), পৃষ্ঠাঃ৭৭৭-৭৮০। কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যাপারে আইনস্টাইনের কোন অভিযোগ না থাকলেও
কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে তিনি কখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি। এ নিয়ে সরাসরি
কোন বিতর্কে তিনি জড়াননি, তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে সবসময় একটি সতর্ক নিরাপদ
দূরত্ব বজায় রেখেছেন। আইনস্টাইনের একজন তরুণ সহকর্মী ন্যাথান রোজেন এ নিয়ে একটি
গবেষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝান আইনস্টাইনকে। আইনস্টাইনের
আরেক সহকর্মী বরিস পুডলস্কি আইনস্টাইনের সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার
পর এ পেপারটির খসড়া তৈরি করেন। পরিমার্জন ও সংশোধনীর পরে আইনস্টাইন, পুডলস্কি
ও রোজেনের নামে পেপারটি প্রকাশিত হয়। কোন নির্দিষ্ট সিস্টেমে
দুটো কণা নির্দিষ্ট সময় ধরে পরস্পর বিক্রিয়া করার পর ঐ সিস্টেমের কী অবস্থা হবে তার
একটাই বাস্তব চিত্র পাওয়া উচিত। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে সিস্টেমটি উপস্থাপন
করলে একটি সম্পূর্ণ বাস্তবচিত্র পাওয়া যায়না। কারণ কোয়ান্টাম
মেকানিক্স সুনির্দিষ্ট ফলাফলের পরিবর্তে সম্ভাবনার কথা বলে। আইনস্টাইনের
মতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স একটি অসম্পূর্ণ পদ্ধতি।
পেপারঃ২০২ “The Particle Problem in the General Theory of Relativity.” (সহলেখকঃন্যাথান
রোজেন)Physical Review, সংখ্যা ৪৮ (১৯৩৫),পৃষ্ঠাঃ৭৩-৭৭। ন্যাথান রোজেনের
সাথে লেখা এই গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন আণবিক পর্যায়ে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভি প্রয়োগের
ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পেপারঃ২০৩ “Elementary Derivation of the Equvalence of Mass and
Energy.”
J.W.Gibbs Lecture to the American Association for the Advancement of
Science,December 28,1934.Bulletin of the American Mathematical Society, সংখ্যা ৪১ (১৯৩৫), পৃষ্ঠাঃ২২৩-২৩০। আমেরিকান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির আমন্ত্রণে আমেরিকান এসোসিয়েশান
ফর দি এডভানসমেন্ট অব সায়েন্স কনফারেন্সে আইনস্টাইন এ গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন। আইনস্টাইন এ
গবেষণাপত্রে বস্তুর ভর ও শক্তির সাম্যের প্রাথমিক সমীকরণ প্রতিপাদন করেন।
১৯৩৬
মার্সার স্ট্রিটের নতুন বাড়িটি দামী দামী আসবাবপত্রে সাজিয়েছিলেন এলসা। কিন্তু বেশিদিন
তা উপভোগ করতে পারলেন না। কিডনির সমস্যা দেখা দিলো তাঁর, হৃৎপিন্ড
ও যকৃতের অবস্থাও ভালো নয়। পুরো একটি বছর কিছুদিন বাড়িতে আর কিছুদিন নিউইয়র্কের হাসপাতালে
ধুঁকতে ধুঁকতে ডিসেম্বরের ২০ তারিখে মারা গেলেন এলসা। এলসার অসুখের
সময় খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু এলসার মৃত্যুর পর
বেশ দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন তিনি। বাড়িতে তিনি কখনো একা নন। এলসার ছোটমেয়ে
মার্গটের সাথে ডিমিত্রির বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে।
ডিমিত্রি সাংবাদিক হিসেবে সফল হতে না পেরে আইনস্টাইনের একান্ত ব্যাক্তিগত জীবন
নিয়ে একটি বই লিখে খ্যাতিলাভ করতে চেয়েছিলেন। আইনস্টাইন তাঁর
ব্যক্তিগত জীবন লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে সবসময় সচেষ্ট। তাঁর খুব কাছের
মানুষ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয় অনেককিছু। ডিমিত্রি আইনস্টাইনের
পরিবারে ঢুকে খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই মার্গটের সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন তাঁকে। আইনস্টাইনের
ওপর একটি বই লিখেছেন এখন, কিন্তু খুব বেশি ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে লেখা বইটি আইনস্টাইন
পছন্দ করেননি। তিনি বইটি থেকে অনেক কিছু বাদ দিতে বাধ্য করেন ডিমিত্রিকে। ডিমিত্রি দেখলেন
আইনস্টাইনের পরিবারের একজন হয়ে থেকে কোন লাভ নেই তাঁর। তিনি মার্গটের
সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালেন। মার্গট তাতে খুশিই হয়েছেন। তিনি এখন আইনস্টাইনের
বাড়িতেই থাকেন। আইনস্টাইনকে তিনি নিজের বাবার মতই ভালোবাসেন।
আমেরিকায় এসে আইনস্টাইনের সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হচ্ছে ভাষা নিয়ে। ইংরেজি মোটামুটি
পড়তে ও বুঝতে পারেন, কিন্তু বলতে পারেন না। ছোট ছোট বাক্য
ইংরেজিতে লিখতে ও বলতে পারেন এবং ইংরেজিতে লিখিত বক্তৃতা পড়তেও তেমন কোন অসুবিধা হয়
না। কিন্তু ইংরেজিতে
কথা বলতে গেলেই সমস্যা হয়। কথাবার্তা তাই জার্মান ভাষাতেই চালান তিনি। বেশিরভাগ চিঠিও
জার্মান ভাষাতেই লেখেন। পরে হেলেন ডুকাস বা অন্যকেউ তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেন।
ফ্রান্সের সীমান্তে রাইনল্যান্ড (Rhineland)নামে একটি জায়গা বিনা বাধায়
দখল করে নেয় জার্মান সৈন্যরা। ভার্সাই চুক্তির পর থেকে ফ্রান্সের এই সীমানায় প্রতিরক্ষা
ব্যবস্থা ছিলো দুর্বল। হিটলারের সৈন্যরা সহজেই দখল করে নিলো রাইনল্যান্ড। মার্চের ২৯ তারিখে
জার্মানির বিদেশ-নীতি ও অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য গণভোটে
আশ্চর্যজনকভাবে শতকরা ৯৮।৮ ভাগ ভোটারের সমর্থন লাভ করেন হিটলার। ইউরোপের অনেক
দেশেই হিটলারের নাৎসি বাহিনীর প্রতি সমর্থন বাড়ছে। হিটলারের থার্ড
রাইখে (Third
Reich)যোগ দিতে চাচ্ছে বেশ কিছু দেশ। হিটলার বলপ্রয়োগে
হলেও ইউরোপে জার্মানির একাধিপত্য বিস্তার করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ
নিতে বদ্ধপরিকর।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের পাঁচটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ
পেপারঃ২০৪ “Some Thoughts Concerning Education.” (জার্মান
থেকে ইংরেজিতে অনুবাদঃলিন্ডা অ্যারোনেট)।School and Society, সংখ্যা ৪৪ (১৯৩৬), পৃষ্ঠাঃ৫৮৯-৫৯২। আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার তিনশ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্টেট ইউনিভার্সিটি
অব নিউইয়র্কের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আইনস্টাইন উচ্চশিক্ষার স্বরূপ ও উদ্দেশ্য বিষয়ে
বক্তৃতা দেন। তিনি জার্মান ভাষায় বক্তৃতাটি লিখেছিলেন। লিন্ডা অ্যারোনেট
তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেন। সমাবর্তনে আইনস্টাইন বক্তৃতার ইংরেজি অনুবাদ পড়েন। আইনস্টাইন বলেন, শিক্ষার
মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানব উন্নয়ন। শিক্ষা মানুষকে উন্নত করবে
চিন্তায় ও চেতনায়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখবে। সুশিক্ষিত মানুষ
নিজের সমাজকে উন্নত করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের ওপর বলপ্রয়োগ কড়া, ভয়ভীতি
দেখিয়ে পড়া আদায় করার চেষ্টা বন্ধ করা উচিত। কারণ ওরকম মিলিটারি
কায়দায় আর যাই হোক সত্যিকারের শিক্ষালাভ সম্ভব নয়।
পেপারঃ২০৫ “Freedom of Learning.”Science,সংখ্যা ৮৩ (১৯৩৬), পৃষ্ঠাঃ৩৭২-৩৭৩। আইনস্টাইন চিরকালই স্বাধীন শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ
করেছেন। এ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন শিক্ষার্থীর চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা না থাকলে প্রকৃত
শিক্ষা লাভ সম্ভব নয়। তিনি মিলিটারি কায়দায় শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেন।
পেপারঃ২০৬ “Physics and Reality.” Journal of the
Franklin Institute,সংখ্যা ২২১ (মার্চ ১৯৩৬),
পৃষ্ঠাঃ৩১৩-৩৪৭। আইনস্টাইনকে
১৯৩৫ সালের ফ্র্যাঙ্কলিন মেডেল দেয়া হয়েছে। ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউটের
জার্নালে প্রকাশিত এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে
আলোকপাত করেন। আইনস্টাইন বলেন, অনেকগুলো পারমাণবিক সিস্টেমের সামগ্রিক একটি গড়চিত্র পাওয়ার
জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স কার্যকরী হতে পারে, কিন্তু কোন সিস্টেমের
পূর্ণাঙ্গ বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ কোয়ান্টাম
মেকানিক্স সুনির্দিষ্ট করে কিছু না বলে কেবল পরিসংখ্যানভিত্তিক সম্ভাবনা নির্দেশ করে।
পেপারঃ২০৭ “The Two-Body Problem in General Relativity.” Physical Review, সংখ্যা ৪৯ (১৯৩৬), পৃষ্ঠাঃ৪০৪-৪০৫। (সহলেখকঃন্যাথান রোজেন)। এ গবেষণাপত্রে
রোজেন ও আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটিতে দুইটি বস্তুর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
বিশ্লেষণ করেন।
পেপারঃ২০৮ “Lens-like Action of a Star by Deviation of Light in
the Gravitational Field.”Science,সংখ্যা ৮৪ (১৯৩৬), পৃষ্ঠাঃ৫০৬-৫০৭। এ গবেষণাপত্রে
অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে নক্ষত্রের আলোর বিচ্যুতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
No comments:
Post a Comment