১৯৪২
আমেরিকার জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থার(Douglas MacArthur) পূর্ব-রণাঙ্গনের কমান্ডার ইন চিফ নিযুক্ত হয়েছেন। আর জেনারেল ডোয়াইট
আইজেনহাওয়ার (Dwight D.Eisenhower) দায়িত্ব পেয়েছেন ইউরোপের। জাপানিরা এশিয়ার
বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে। তারা জাভা সাগরে
আমেরিকার যুদ্ধজাহাজকে হটিয়ে দিয়েছে। জাপানিরা ফিলিপাইনের ব্যাটান(Bataan) অঞ্চল দখল করে সত্তর হাজার আমেরিকান ও ফিলিপিনো সৈন্যের ওপর অকথ্য নির্যাতন
চালায়। জাপানিরা যুদ্ধবন্দী সৈন্যদের প্রায় ষাট মাইল দূরত্ব হাঁটিয়ে নিয়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্র
থেকে উত্তরাঞ্চলের একটি ক্যাম্পে। শতকরা দশভাগ সৈন্য হাঁটতে হাঁটতেই মারা যায়। জার্মানি ও পোলান্ডে
নাৎসি ক্যাম্পে ইহুদি ও স্লাভদের ধরে এনে হত্যা করা হচ্ছে।
আমেরিকায় জাপানি বংশদ্ভূত আমেরিকান নাগরিকদের ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু হলো। জাপানি-আমেরিকানদের
যারা আমেরিকায় জন্মেছেন বা যাঁদের আমেরিকান পাসপোর্ট আছে তাঁদের সবাইকে আমেরিকার মূল
ভূখন্ড থেকে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে দশটি ডিটেনশান ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। ইটালিয়ান-আমেরিকানদেরও
অনেকটা সেরকম আলাদা করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া ইটালিয়ানদের নিয়ে
ইটালিয়ান-আমেরিকান সৈন্যদল গঠন করে ইটালিতে পাঠানো হয়েছে ইটালিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
জয় করার জন্য।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের দুটো উল্লেখযোগ্য রচনাঃ
পেপারঃ২২৯ “The Common Language of Science.” Advancement of
Science, বর্ষ ২,সংখ্যা ৫(১৯৪২), পৃষ্ঠাঃ১০৯। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরের
২৮ তারিখে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের কনফারেনসে আইনস্টাইনের
যে বেতার-ভাষণটি প্রচার করা হয়,তা এই প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত
হয়।
পেপারঃ২৩০ “Demonstration of the Non-existence of Gravitational
Fields with a Non-vanishing Total Mass Free of Singularities.” Tucuman Universidad
Nacional ,Revista,ser.A, বর্ষ ২ (১৯৪২),
পৃষ্ঠাঃ১১-১৫। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের
২৯ তারিখে প্রিন্সটনে অনুষ্ঠিত আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি ও আমেরিকান এসোসিয়েশান অব
ফিজিক্স টিচার্সের যুগ্ম-সম্মেলনে আইনস্টাইন “Solutions of the
finite mass of the gravitational equations” শীর্ষক বক্তৃতা দেন। সে বক্তৃতার
ভিত্তিতে এ গবেষণাপত্রটি রচিত হয়েছে।
১৯৪৩
ইউরোপে প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। জার্মানি ও পোলান্ডে শত শত কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে ইহুদিনিধন
চলছে। আমেরিকানরা পারমাণবিক বোমা বানানোর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। আমেরিকান নৌবাহিনীতে
বিস্ফোরক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়মিত কাজ শুরু করেছেন আইনস্টাইন। এজন্য দৈনিক
পঁচিশ ডলার করে সম্মানী পান তিনি।
বার্ট্রান্ড রাসেল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে এসেছেন। আইনস্টাইনের
বাড়িতে এসে দেখা করেছেন আইনস্টাইনের সাথে। এখন প্রতি সপ্তাহে তাঁরা
বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করেন।
প্রকাশনা
এবছর আইনস্টাইন মাত্র একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
পেপারঃ২৩১ “Nonexistence of Regular Stationary Solutions of
Relativistic Field Equations.” Annals of Mathematics, বর্ষ ৪৪
(১৯৪৩), পৃষ্ঠাঃ১৩১-১৩৭। সহলেখকঃউলফগ্যাং পাউলি। আইনস্টাইন ও
পাউলি এ গবেষণাপত্রে রিলেটিভিস্টিক ফিল্ড ইকোয়েশান বিষয়ে আলোচনা করেন।
১৯৪৪
আমেরিকায় যুদ্ধের খরচ জোগানোর জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সবাই সাধ্যমত
চাঁদা দিচ্ছেন। যুদ্ধের বন্ড চালু করা হয়েছে। আইনস্টাইন কিছু একটা করতে চাইলেন এ ব্যাপারে। তাঁর কাছে টাকা
নেই, তাই তাঁকে অনুরোধ করা হলো তাঁর বিখ্যাত রিলেটিভিটি পেপারটির মূল পান্ডুলিপি
নিলামে বিক্রি করে টাকাটা যুদ্ধ-তহবিলে দান করতে। কিন্তু আইনস্টাইন
পান্ডুলিপিটি সংরক্ষণ করেননি। তিনি প্রকাশিত বিখ্যাত পেপারটি নিজের হাতে লিখে দিলেন আবার। এবং পান্ডুলিপিটির
সাথে আরো একটি পেপারের পান্ডুলিপি নিলামে বিক্রি করার অনুমতি দিলেন। ফেব্রুয়ারিতে
নিলাম হলো। রিলেটিভিটি পেপারের পান্ডুলিপির দাম উঠলো পঁয়ষট্টি লাখ ডলার, আর দ্বিতীয়
পান্ডুলিপিটির দাম উঠলো পঞ্চাশ লাখ ডলার। আইনস্টাইন পুরো
টাকাটাই যুদ্ধতহবিলে দান করলেন। আর যাঁরা পান্ডুলিপি দুটো কিনেছিলেন, তাঁরা
পান্ডুলিপি দুটো লাইব্রেরি অব কংগ্রেসকে দান করে দিলেন।
যুদ্ধের জন্য আমেরিকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে শতকরা তিনভাগেরও বেশি। ইউরোপ,এশিয়া
প্যাসিফিক আর উত্তর আফ্রিকায় এখনো যুদ্ধ চলছে। অক্ষশক্তি ও
মিত্রশক্তি উভয়পক্ষেই ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। ফ্রান্সের উপকূলে সাতহাজার
যুদ্ধজাহাজ ও চারহাজার যুদ্ধবিমানের অবিরাম সংঘর্ষ চলছে।
জার্মানির সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাঁদের অনেকেই
যুদ্ধ চাচ্ছেন না। কিন্তু হিটলার বেঁচে থাকতে যুদ্ধ থামার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই জার্মান
মিলিটারির একটা অংশ হিটলারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেন। একটি ব্রিফকেসে
বোমা রেখে তা হিটলারের প্রবেশ পথে রেখে দেয়া হলো। কিন্তু বোমাটি
বিস্ফোরিত হলেও হিটলারের তেমন কিছু হলো না। সামান্য আহত হয়ে হিটলার
ভয়ানক হিংস্র হয়ে ওঠলেন। জার্মান ফিলড মার্শাল এরউইন রোমেল হিটলারকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রের
কথা জানতেন,
কিন্তু নিজে পরিকল্পনায় অংশ নেননি। কিন্তু হিটলার
জেনে গেলেন ষড়যন্ত্রের প্রতি রোমেলের সমর্থনের কথা। ফিলড মার্শাল
রোমেল বুঝতে পারলেন তাঁর আর নিস্তার নেই। হিটলারের ভয়ে তিনি আত্মহত্যা
করলেন।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের সাতটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ
পেপারঃ২৩২ “Gandhi’s Statemanship.”In Mahatma Gandhi:Essays and Reflections on His Life
and Work,সম্পাদনাঃএস রাধাকৃষ্ণন,প্রকাশকঃ
Allen and Unwin,লন্ডন (১৯৪৪)। আইনস্টাইন মহাত্মা
গান্ধীর অহিংসানীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর প্রতি ছিলো
তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। গান্ধীর ৭০তম জন্মদিনে আইনস্টাইন এ প্রবন্ধটি লিখে গান্ধীকে
উৎসর্গ করেছিলেন। পরে তা মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও কর্মের ওপর প্রকাশিত বইতে প্রকাশিত হয়।
পেপারঃ২৩৩ “The Arabs and Palestine”.Princeton Herald, (১৪ ও ২৮ এপ্রিল,১৯৪৪)। প্যালেস্টাইনে
আরবদের সাথে ইহুদিদের সম্পর্ক নিয়ে লিখিত এই প্রবন্ধে আইনস্টাইন সুস্পষ্টভাবে মত প্রকাশ
করেছেন যে আরবদের জন্য প্যালেস্টাইনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকা উচিত।
পেপারঃ২৩৪ “To the Heroes of the Battle of the Warsaw Ghetto.”Bulletin of the Society
of Polish Jews,নিউইয়র্ক (১৯৪৪)। নিউ ইয়র্কে বসবাসরত
পোলিশ ইহুদিদের সমিতির বুলেটিনে প্রকাশিত এই সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে আইনস্টাইন ইউরোপের
ইহুদি হত্যাযজ্ঞের জন্য জার্মানির সব মানুষকেই দায়ী করেন। আইনস্টাইন বলেন,হিটলারের
বক্তৃতা ও বইতে পরিষ্কার করে উল্লেখ আছে যে তিনি ক্ষমতায় গেলে ইহুদিদের বিনাশ করার
ব্যবস্থা করবেন। তা সত্ত্বেও জার্মানির মানুষ হিটলারকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত
করে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সুতরাং ইহুদি হত্যার জন্য তাঁরা সকলেই দায়ী।
পেপারঃ২৩৫ “Remarks on Bertrand Russell’s Theory of Knowledge.” পল শিপ(Paul
A. Schipp)্সম্পাদিত The Philosophy of Bertrand Russell বইতে প্রকাশিত। প্রকাশকঃ ওপেন কোর্ট, লা সালি (১৯৪৪)। বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কথা উল্লেখ
করে আইনস্টাইন দার্শনিক ভাবনার উৎপত্তি ও বস্তুবাদী ধারণার সাথে দার্শনিক ধারণার সম্পর্ক
নিয়ে আলোচনা করেন।
পেপারঃ২৩৬ “The Ethical Imperative.”Opinion,সংখ্যা ১০ (মার্চ ১৯৪৪), পৃষ্ঠাঃ১০। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন মানুষের নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রয়োজনীয়তা
ব্যাখ্যা করেছেন।
পেপারঃ২৩৭ “Bivector Fields I”.সহলেখকঃভ্যালেন্টাইন বার্গম্যান। Annals of
Mathematics,বর্ষ ৪৫ (১৯৪৫),পৃষ্ঠাঃ১-১৪। গাণিতিক পদার্থবিদ
ও প্রতিভাবান পিয়ানোবাদক ভ্যালেন্টাইন বার্গম্যান (Valentine Bargmann ছিলেন
প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের গবেষণা-সহকারী।আইনস্টাইন বার্গম্যানের
স্ত্রী সোনিয়া বার্গম্যান (Sonja Bargmann)আইনস্টাইনের বিখ্যাত বই
‘আইডিয়াস এন্ড ওপিনিয়নস’ বইয়ের যে প্রবন্ধগুলো মূল জার্মানিতে ছিলো
তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
পেপারঃ২৩৮ “Bivector Fields II.”Annals of
Mathematics, বর্ষ ৪৫(১৯৪৪),পৃষ্ঠাঃ১৫-২৩।ভ্যালেন্টাইন বার্গম্যানের সাথে লেখা দুই খন্ডের এই গবেষণাপত্রে
ইউনিফায়েড থিওরিতে ব্যবহারপযোগী বাই-ভেক্টর ফিল্ড সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
১৯৪৫
ইউরোপে যুদ্ধ চলছে এখনো। ম্যানহাটান প্রজেক্টে ঠিক কী হচ্ছে তা জানার উপায় নেই আইনস্টাইনের। কারণ প্রজেক্টটি
অতি গোপনীয়। এসময় লিও শিলার্ড এলেন আইনস্টাইনের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। লিও শিলার্ডের
ড্রাফট করে দেয়া চিঠি পাঠিয়েই আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজভেলটকে পারমাণবিক বোমা বানানোর
জন্য উদ্বৃত্ত করেছিলেন। এখন আইনস্টাইন বা লিও শিলার্ড কেউই জানেন না পারমাণবিক বোমা
প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলে তার ফল হতে পারে মারাত্মক। আইনস্টাইন চিন্তিত
হয়ে পড়লেন। লিও শিলার্ডের অনুরোধে আইনস্টাইন আরেকটি চিঠি লিখলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেলটকে। আইনস্টাইন প্রেসিডেন্টকে
অনুরোধ করলেন যেন তিনি লিও শিলার্ডসহ আরো বিজ্ঞানীদের সাথে একটি বৈঠক করেন। পারমাণবিক বোমা
বানাচ্ছেন যে বিজ্ঞানীরা তাঁদের সাথে প্রজেক্ট যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন সে রাজনীতিবিদ
ও মিলিটারিদের সমন্বয় থাকা খুবই দরকার। মার্চে চিঠিটি পাঠালেন আইনস্টাইন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট
রুজভেলট তাঁর চিঠিটি পড়ার সময় করতে পারেননি। এপ্রিলের বারো তারিখে প্রেসিডেন্ট
রুজভেলট মারা যান। রুজভেলটের পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান প্রেসিডেন্ট
হিসেবে শপথ নিলেন।
ইউরোপে জার্মানি ও ইটালি আর টিকে থাকতে পারছে না। এপ্রিলের ত্রিশ
তারিখে হিটলার আত্মহত্যা করেন। মে মাসের সাত তারিখে জার্মানি আত্মসমর্পণ জিরে। মে মাসের আট
তারিখে ‘ভিক্টরি ওভার ইউরোপ’ বা ভি-ই দিবস
ঘোষণা করা হয়। তবে জাপান কিন্তু এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
জুলাই মাসের ষোল তারিখে নিউ ম্যাক্সিকোর আলামোগোরডো (Alamogordo)মরুভূমিতে প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ম্যানহাটান প্রজেক্ট
সফল ভাবে শেষ হয়। জাপানের জন্য দুটো পারমাণবিক বোমা তৈরি করার কাজ শেষ। আগস্টের ছয় তারিখে
জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর নিক্ষেপ করা হয় পারমাণবিক ইউরেনিয়াম-২৩৫ বোমা
‘লিটল বয়’। এর তিনদিন পর জাপানের নাগাসাকি শহরের ওপর বিস্ফোরণ ঘটানো
হয় আরেকটি পারমাণবিক প্লুটোনিয়াম-২৩৯ বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’। দুটো বোমার আঘাতে
আগুন,তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ও শব্দপ্রবাহে প্রায় সত্তর হাজার মানুষ সাথে সাথে মারা
যান। পরে আরো হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে। আগস্টের ১৪ তারিখে
জাপান আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায়। নাৎসি বাহিনীর
কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের গ্যাসচেম্বার,পারমাণবিক বোমার আঘাত সব মিলিয়ে প্রায়
পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
আইনস্টাইন এবছর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর এডভান্সড স্টাডি থেকে
অবসর গ্রহণ করলেন। অফিসিয়ালি তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর। অবসর নিলেও ইনস্টিটিউটের
ফুলড হলে (Fuld
Hall)আইনস্টাইনের অফিসটি আইনস্টাইনেরই থাকলো। আমৃত্যু তিনি
ব্যবহার করেছেন এই অফিস।
ডিসেম্বরের দশ তারিখে নিউইয়র্কের এস্টর হোটেলে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের সম্মানে
একটি ভোজসভার আয়োজন করা হয়। সেখানে আইনস্টাইন পারমাণবিক বোমা তৈরি ও তার ব্যবহার করে
পদার্থবিজ্ঞানীরা যে বিধ্বংসী শক্তির পথ খুলে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে
তারজন্য মূল্য দিতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এখানেই আইনস্টাইন
বলেন, “যুদ্ধে জয়লাভ
হয়েছে, কিন্তু শান্তি অর্জিত হয়নি (The war is won,but the peace is
not.)”
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের ছয়টি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ
পেপারঃ২৩৯ “Einstein on the Atomic Bomb.”সম্পাদনাঃরেমন্ড
সুইং।
Atlantic Monthly,সংখ্যা ১৭৬ (নভেম্বর ১৯৪৫),
পৃষ্ঠাঃ৪৩-৪৫। একই শিরোনামে
নিউইয়র্ক টাইমসেও প্রকাশিত হয়েছে ২৭ অক্টোবর ও ২৯ অক্টোবর তারিখে। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন
বিশ্ব-সরকার (World Government)ব্যবস্থার ধারণা দেন। পারমাণবিক যুগের
সূচনা যখন হয়ে গেছে আর পৃথিবী যখন এর মধ্যেই দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে-সেখানে
শান্তি প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ নয়। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান যুদ্ধাস্ত্র
নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইনস্টাইন মনে করেন একটি বিশ্ব-সরকার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিনটি বৃহৎশক্তি
আমেরিকা,সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের মিলিটারী বাহিনী নিয়ে এই সরকারের শক্তি গঠিত
হবে। পৃথিবীর কোন দেশে যদি কোন সমস্যা দেখা দেয়, বিশ্ব-সরকার তা সমাধান করবে। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার
পর রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স আইনস্টাইনের বিশ্ব-সরকার ধারণার কঠোর সমালোচনা
করে।
পেপারঃ২৪০ “On the Cosmological Problem.” American Scholar, সংখ্যা ১৪ (১৯৪৫), পৃষ্ঠাঃ১৩৭-১৫৬। সংশোধনীঃ পৃষ্ঠাঃ ২৬৯। আইনস্টাইন এ
গবেষণাপত্রে তাঁর জেনারেল থিওরি ও কসমোলজি প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।
পেপারঃ২৪১ “Generalization of the Relativistic Theory of
Gravitation.”
Annals of Mathematics, বর্ষ ৪৬,সংখ্যা ২
(১৯৪৫), পৃষ্ঠাঃ৫৭৮-৫৮৪। এ গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন গ্র্যাভিটেশানের রিলেটিভিস্টিক থিওরির
একটি সমন্বিত সাধারণরূপ পাবার চেষ্টা করেছেন। ইউনিফায়েড থিওরি
প্রতিষ্ঠা করার নানামুখী চেষ্টার এটাও একটি রূপ।
পেপারঃ২৪২ “Influence of the Expansion of Space on the Gravitation
Fields Surrounding Individual Stars.” Review of Modern Physics, সংখ্যা ১৭
(১৯৪৫), পৃষ্ঠাঃ১২০-১২৪। সংশোধন ও সংযোজনঃ সংখ্যা ১৮ (১৯৪৫),
পৃষ্ঠাঃ১৪৮-১৪৯। সহলেখকঃ আর্নস্ট
স্ট্রাউস। আর্নস্ট স্ট্রাউস ছিলেন প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের সহযোগী গবেষক। আইনস্টাইন তাঁর
সাথে এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। মহাকাশে একটি নক্ষত্রের ওপর প্রসারমাণ স্পেসের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের
প্রভাব কীরূপ হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ গবেষণাপত্রে।
পেপারঃ২৪৩ “A Testimonial from Prof. Einstein.” জ্যাকস
হ্যাডামার্ডের (Jacques Hadamard) An Essay on the Psychology of Invention
in the Mathematical Mind বইয়ের ১৪২-১৪৩
পৃষ্ঠায় প্রকাশিত। প্রকাশকঃ প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, প্রিন্সটন,
নিউজার্সি (১৯৪৫)। ফ্রান্সের গণিতবিদ
জ্যাকস হ্যাডামার্ড গণিতবিদদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে তার ওপর একটি জরিপ করেন। সে জরিপের প্রশ্নমালা
তিনি আইনস্টাইনকেও পাঠান। আইনস্টাইনের সে প্রশ্নমালার উত্তরের ওপর ভিত্তি করে এ প্রবন্ধটি
রচিত হয়েছে।
পেপারঃ২৪৪ “On Harnessing Solar Energy.” নিউ ইয়র্ক
টাইমস (১৪ আগস্ট,১৯৪৫)। সৌরশক্তির সম্ভাবনার
ওপর আইনস্টাইন এ প্রবন্ধটি লেখেন নিউইয়র্ক টাইমসের জন্য।
১৯৪৬
যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে পারমাণবিক বোমা ও তার ব্যবহার নিয়ে আইনস্টাইন খুব চিন্তিত
হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন আবার পুরোদস্তুর শান্তিবাদী হয়ে গেছেন। তিনি বিশ্বাস
করেন পৃথিবীব্যাপী আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিশ্ব-সরকার
ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। আবার মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের প্রতিও খুব শ্রদ্ধা
তাঁর। তিনি মনে করেন, পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ যদি অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে,
তবে তা যথেচ্ছ ব্যবহারও করতে পারবে। আর অস্ত্র ব্যবহারের
সুযোগ থাকলে পৃথিবীতে শান্তি কখনোই আসবে না। এজন্য বিশ্ব-সরকার
ব্যবস্থা দরকার যারা সারাপৃথিবীর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে। আলাদা আলাদা
সেনাবাহিনী না থাকলে যুদ্ধ লাগারও কোন সম্ভাবনা থাকবে না। বিশ্ব-সরকার
ব্যবস্থার পক্ষে প্রচার চালাতে শুরু করলেন আইনস্টাইন।
এবছরই টাইম ম্যাগাজিন আইনস্টাইনের ওপর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আমেরিকার পারমাণবিক
বোমার সুপার ফাদার অভিধা দেয়া হয়েছে তাঁকে। আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণকেই দায়ী
করা হচ্ছে পারমাণবিক বোমার মূল সূত্র হিসেবে। পারমাণবিক বৈজ্ঞানিকদের
একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য হলো পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ
করা ও শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। আইনস্টাইন এই
সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। প্যালেস্টাইনে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন
আইনস্টাইন। জার্মানির ব্যাপারে আইনস্টাইনের অবস্থান খুবই কঠোর। তিনি মনে করেন
জার্মানির সাথে তাঁর সব সম্পর্ক শেষ।
এসময় তাঁর বোন মায়া জেনেভায় তাঁর অসুস্থ স্বামীর কাছে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ
হার্টস্ট্রোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। আইনস্টাইন যখনই সময় পান ছোটবোনের সেবাযত্ন করেন। ঘুমোতে যাবার
আগে মায়াকে বই পড়ে শোনান আইনস্টাইন। মায়া ও আইনস্টাইনকে দেখতে এখন প্রায় একই রকম লাগে।
প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের পাঁচটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ
পেপারঃ২৪৫ “SocialObligation of the Scientist.” রেইবার্ন(R.Raeburn)
সম্পাদিত Treasury for the Free World সংকলনে
প্রকাশিত। প্রকাশনাঃ আর্কো, নিউইয়র্ক (১৯৪৬)। সাম্প্রতিক মুক্তবিশ্বের
ধারণা সম্পর্কে একষট্টি জন পৃথিবীবিখ্যাত মনিষীর মতামত সংকলিত হয়েছে এই বইতে। বইটির প্রস্তুতিকালে
জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হয়। ফলে বিশ্বপরিস্থিতি হঠাৎ ভীষণ বদলে যায়। বইতে আইনস্টাইনের
প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছে প্রশ্নোত্তর আকারে। আইনস্টাইনকে একটি প্রশ্নমালা
দেয়া হয়েছিলো, তিনি প্রশ্নগুলোর নিচে উত্তর লিখেছেন। ১।বিশ্ব-সহযোগিতায়
বিজ্ঞানীদের অবদানের স্বীকৃতি কীভাবে পাওয়া যেতে পারে? উঃ
একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করতে হবে যে কমিটি পৃথিবীর সবদেশের মিলিটারি ব্যবস্থা তদারক
করবে। ২। রাজনৈতিক ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মাথাঘামানো কি উচিত? উঃপ্রত্যেক
নাগরিকেরই উচিত নিজের মতামত ব্যক্ত করা। ৩। পদার্থবিজ্ঞান
ও গণিতের উন্নতির সাথে সামাজিক উন্নতির কোন সম্পর্ক আছে কি? উঃ হ্যাঁ,
আছে। কারণ বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। ৪। নাৎসিবাদ পৃথিবীর
যে ক্ষতি করে গেছে, তা থেকে উত্তরণের কোন উপায় আছে কি? উঃ জার্মানদের ধরে ধরে মেরে ফেলা বা বন্দী করে রাখা হয়তো সম্ভব হবে,
কিন্তু তাদেরকে আবার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চিন্তা করতে শেখানো
অদূর ভবিষ্যতে অসম্ভব।
পেপারঃ২৪৬ “To the Jewish Students.” Aufbau, বর্ষ ১২, সংখ্যা ১ (১৯৪৬),
পৃষ্ঠাঃ১৬। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন ইহুদি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কঠোর পরিশ্রমী
হবার আহ্বান জানান।
পেপারঃ২৪৭ “Generalization of the Relativistic Theory of
Gravitation.”
Annals of Mathematics, বর্ষ ৪৭ (১৯৪৬),
পৃষ্ঠাঃ৭৩১-৭৪১। এ গবেষণাপত্রে
আইনস্টাইন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে ইউনিফায়েড থিওরিতে উত্তরণের আরো একবার
চেষ্টা চালান।
পেপারঃ২৪৮ “Elementary Derivation of the Relativitic Theory of
Gravitation.”
Technion Journal, সংখ্যা ৫ (১৯৪৬),
পৃষ্ঠাঃ ১৬-১৭। এ সংক্ষিপ্ত
পেপারে আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটি থিওরির কিছু মৌলিক বিষয় প্রতিপালন করেছেন।
পেপারঃ২৪৯ “E=mc2 The MostUrgent Problem of Our Time.”Science Illustrated, সংখ্যা ১ (এপ্রিল ১৯৪৬), পৃষ্ঠাঃ১৬-১৭। সাধারণ পাঠকের
জন্য আইনস্টাইন সহজ ভাষায় নিজের বিখ্যাত ভর ও শক্তির সমীকরণটি ব্যাখ্যা করেছেন এই প্রবন্ধে।
No comments:
Post a Comment