প্রতিবছর
ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে
অনুষ্ঠিত হয় নোবেল পুরষ্কার প্রদানের মহোৎসব। সুইডেনের রাজার কাছ থেকে নোবেল পদক ও
সনদ গ্রহণ করেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ীরা।
(একই দিনে নরওয়ের অস্লোয় অনুষ্ঠিত হয়
নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান।) অনুষ্ঠানে পুরুষরা পরেন বিশেষ ডিজাইনের
কালো স্যুটের সাথে সাদা বো-টাই, আর মহিলারা পরেন আনুষ্ঠানিক সান্ধ্যকালীন পোশাক। নোবেলবিজয়ীদের
মধ্যে যাঁরা সাধারণত আটপৌরে পোশাক পছন্দ করেন, তাঁরাও এ’দিনে এই বিশেষ
নোবেল-পোশাক পরেই পুরষ্কার নিতে যান। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নোবেল
পুরষ্কারের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো। মঞ্চে বসা নোবেলবিজয়ীদের মধ্যে
দেখা গেলো একজনের পোশাক সম্পূর্ণ অন্যরকম। কালো লম্বা গলাবদ্ধ কোটের সাথে সাদা সালোয়ার
পরনে, পায়ে জরির নাগরা জুতো, আর মাথায় সাদা পাগড়ি। হলভর্তি অতিথিদের সবার চোখ এই
অন্যরকম পোশাকের অন্যরকম মানুষটির দিকে- যাঁর নাম আবদুস সালাম - নোবেলবিজয়ী
পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম।
পদার্থবিজ্ঞানের
জগতে প্রফেসর আবদুস সালামের সত্যিকারের বিচরণ শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে যখন তিনি
কেমব্রিজে পড়তে আসেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৯- এই বত্রিশ বছর ধরে যাঁরা চেনেন তাঁকে,
পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে তাঁরা মোটেও অবাক হননি। কিন্তু সবাই খুব
অবাক হয়েছেন নোবেল পুরষ্কারের অনুষ্ঠানে তাঁর পোশাক দেখে। কারণ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা
সব ঋতুতেই প্রফেসর আবদুস সালাম দামী থ্রি-পিস স্যুট পরতে অভ্যস্ত। তাই বিশেষ দিনে
বিশেষ পোশাকের পেছনে এই বিজ্ঞানীর নিশ্চয়ই বড় কোন যুক্তি আছে।
প্রফেসর আবদুস সালাম জানেন তৃতীয়
বিশ্বের মানুষের কাছে নোবেল পুরষ্কারের মূল্য কতখানি। তিনি দেখেছেন পৃথিবীতে উন্নত-বিশ্ব
ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মাঝে সম্পদের বিশাল ব্যবধানের কারণে উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে
মেধাবী শিক্ষার্থীও উন্নত-বিশ্বের মেধাহীনদের চেয়েও পিছিয়ে পড়ে। তাই তিনি এই
অনুষ্ঠানে উন্নত বিশ্বের কাছে নিজের দেশের পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছেন পোশাকের
মাধ্যমে। শুধু তাই নয়- দু’দিন আগে দেয়া
তাঁর নোবেল বক্তৃতাতেও তিনি বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস ও
জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইসলামী পন্ডিতদের অবদানের কথা। নোবেল ভোজ-সভার বক্তৃতাতেও তিনি
কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করেছেন, তাঁর গবেষণার সাথে তাঁর গভীর ধর্মীয় বিশ্বাসের কথাও
উল্লেখ করেছেন, বলেছেন পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে তাঁর গর্বের কথা।
পোশাকের নাটকীয়তার গুরুত্ব ঠিক কতটুকু
তা জানার উপায় নেই। তবে এই নাটকীয়তার উপাদান জোগাড় করার জন্য তাঁকে বেশ কিছু কষ্ট
করতে হয়েছে। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে পাগড়ি পরেছিলেন- তাও অন্যের সাহায্যে। এত বছর পর পাগড়ি
পরতে গিয়ে দেখা গেলো- পাগড়ি কীভাবে পরতে হয় তা তিনি জানেনই না। সুইডেনের পাকিস্তান
দূতাবাসে খোঁজ নেয়া হলো। সেখানেও অফিসারদের কেউই স্বদেশী পোশাক পরেন না। সুতরাং
পাগড়ি কীভাবে পরতে হয় জানার প্রশ্নই ওঠে না। খুঁজতে খুঁজতে দূতাবাসের রাঁধুনিদের
মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল যে পাগড়ি পরতে জানে। তাকে নিয়ে আসা হলো প্রফেসর আবদুস
সালামের পাগড়ি বেঁধে দেয়ার জন্য। তার পরানোর ধরণ দেখে প্রফেসর সালাম বুঝতে পারলেন-
রাঁধুনিটি এসেছে পাকিস্তানের অন্য একটা প্রদেশ থেকে- যে প্রদেশের পাগড়ির প্যাঁচের
সাথে তাঁর নিজের প্রদেশের পাগড়ির প্যাঁচের মিল নেই। কিন্তু কী আর করা যাবে।
ভুল-পাগড়ি মাথায় নিয়েই হাজির হলেন নোবেল-অনুষ্ঠানে।
বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে
সাফল্যের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হলো নোবেল পুরষ্কার। এই পুরষ্কার পাবার পর রাতারাতি
বিখ্যাত হয়ে যান মানুষ- বিশেষ করে সেই মানুষ যদি হন পাকিস্তানের মত অনুন্নত দেশ
থেকে উঠে আসা কেউ। কিন্তু এই খ্যাতি লাভের পেছনে যে কী পরিমাণ সংগ্রাম জড়িত তা
মানুষটির ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার দিকে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়।
তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব
প্রদেশের একটি মফঃস্বল শহর ঝাং। আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই এই শহরের কেবল হির-রান্ঝার
প্রেম-কাহিনিটা ছাড়া। ঝাং এর বাসিন্দারা মনে করেন হির-রান্ঝার ঘটনা সত্যি এবং
তাদের এলাকাতেই ঘটেছিল। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষক, লেখাপড়া বিশেষ কেউ করেন নি।
পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না সেখানে। মাঝে মধ্যে শহর থেকে কেউ
এলে সাথে হয়তো সংবাদ-পত্র আসে। যারা সামান্য পড়তে জানেন তারা সেই পুরনো
সংবাদ-পত্রই পড়ে শোনান অন্যদের। গ্রামের সামান্য যে ক’টা পরিবারে
শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছিল- চৌধুরি পরিবার তাদের অন্যতম। সচ্ছলতা তাদের খুব একটা
ছিল না, তবে লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ ছিল খুব।
কথিত আছে চৌধুরিদের পূর্ব-পুরুষ সৈয়দ
বুধান ছিলেন রাজপুতনার হিন্দু। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তিনি চলে এসেছিলেন পাঞ্জাবে।
তারপর কেটে গেছে কয়েক শতাব্দী। বর্তমান চৌধুরি গুল মুহাম্মদ গ্রাম্য ডাক্তার। ভেষজ
চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নাম-ডাক আছে। তাঁর বড় ছেলে চৌধুরি গোলাম হোসেইন ১৮৯৯ সালে
খ্রিস্টান কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে প্রাদেশিক সরকারের জেলা স্কুল পরিদর্শক
হয়েছেন। ছোট ছেলে চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন গোলাম হোসেইনের চেয়ে চৌদ্দ বছরের ছোট।
মোহাম্মদ হোসেইন স্কুল পাস করে লাহোরের ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু
সঙ্গতির অভাবে লেখাপড়া শেষ না করেই গ্রামে ফিরে আসেন। কাজের সন্ধানে এখানে ওখানে
ঘুরে স্থানীয় ঝাং স্কুলে মাসে উনিশ রুপি বেতনে অতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন।
দু’বছর পর স্কুলে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়। তিনি ইংরেজি ও অংক পড়ান। পাশাপাশি
বাবার ডাক্তারি-বিদ্যাও কিছুটা শিখে নিয়েছেন। বাড়িতে ছোট একটা ভেষজ ঔষধালয়ও আছে।
১৯২২ সালে বিয়ে করেন চৌধুরি মোহাম্মদ
হোসেইন। বছর খানেকের মধ্যেই কন্যা সন্তানের বাবা হলেন তিনি। মেয়ের নাম রাখলেন
মাসুদা বেগম। কিন্তু মেয়ের জন্মের দেড় মাসের মাথায় তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। মহা
সমস্যায় পড়লেন চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন। দেড় মাসের শিশুর দেখাশোনা করা, ঘর-সংসার
সামলানো, তদুপরি মাত্র একত্রিশ বছরে বিপত্নিক হওয়া। সুতরাং আবার বিয়ে। ১৯২৫ সালের
মে মাসে চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন বিয়ে করলেন সরকারি ট্যাক্স অফিসার হাফিজ নবী বক্শ’র কন্যা হাজিরা
বেগমকে।
ঝাং থেকে ষাট মাইল দক্ষিণে শাহিওয়াল
জেলার হাফিজ নবী বক্শের পরিবারের সবাই খুব ধার্মিক। হাজিরা বেগমের ভাই বিশ বছর
ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন পশ্চিম আফ্রিকায়। ধর্মীয় প্রভাব চৌধুরি পরিবারে আগে
থেকেই ছিল। হাজিরা বেগমের সাথে বিয়ের পর সে প্রভাব আরো বাড়লো।
সামাজিক প্রথা অনুযায়ী প্রথম সন্তানের
জন্মের আগে শাহিওয়ালে বাপের বাড়িতে চলে এলেন হাজিরা বেগম। ১৯২৬ সালের ২৯ জানুয়ারি
এখানেই জন্ম হলো চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইনের দ্বিতীয় এবং হাজিরা বেগমের প্রথম সন্তান
আবদুস সালামের।
চল্লিশ দিন পর ছেলেকে নিয়ে ঝাং-এর
বাড়িতে ফিরলেন হাজিরা বেগম। মা-বাবার চোখের মণি আবদুস সালাম। দু’বছর বয়স হতে না
হতেই বাবা মোহাম্মদ হোসেইন ছেলেকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে নিজের সাথে নিয়ে যান।
ইতোমধ্যে সংসারে আরেকটা সন্তান এসে গেছে- আবদুস সালামের ছোটবোন হামিদা বেগম।
পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই হাজিরা বেগমের আরো ছয়টি ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়।
নয়জন ছেলে-মেয়ে ও নিজেদের নিয়ে এগারো
জনের বিরাট সংসারে খরচ বেড়েছে অনেক, কিন্তু আয় এখনো মাসে মাত্র উনিশ রুপি।
পরিবারের বড় ছেলে হবার কারণে হোক- বা লেখাপড়ায় খুব ভাল হবার কারণে হোক- আবদুস
সালাম তার অন্য-ভাইবোনদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে শুরু থেকেই। ছোটবোন
হামিদা বেগমের ওপর দায়িত্ব পড়লো আবদুস সালামের যখন যা দরকার তা জোগানোর। জামা-কাপড়
ধোয়া, বিছানা-করা থেকে শুরু করে সবকিছু গুছিয়ে রাখা। সন্ধ্যায় পড়তে বসার আগেই
আবদুস সালামের হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে হারিকেন জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে দেয় তার
ভাই-বোনেরা।
বাড়ি থেকে মাত্র আধ-কিলোমিটার দূরে ঝাং স্কুলেই
আবদুস সালামের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু। সাধারণত ছ’বছর বয়সে
ছেলেরা স্কুলে যেতে শুরু করে। (ঝাং অঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়া করার প্রয়োজনীয়তার কথা
তখনো ভাবেনি কেউ। আবদুস সালামের বোনেরাও লেখাপড়া করেনি।) কিন্তু আবদুস সালামের
বাবা ছেলের তিন বছর বয়স থেকেই বাড়িতে লেখাপড়া শেখানো শুরু করে দিয়েছেন। ফলে ১৯৩২
সালে ছয় বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবার বদলে আবদুস সালাম সোজা ক্লাস থ্রিতে গিয়ে
ভর্তি হলো।
আবদুস সালামের লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ
যত্নশীল তার বাবা মোহাম্মদ হোসেইন। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর তার বাবা স্কুলে
কী কী পড়া হয়েছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন। আর দারুণ উৎসাহ দিতেন তার মামা
যিনি পশ্চিম আফ্রিকায় এক সময় ইসলাম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। ইংরেজি আর অংকের পাশাপাশি
ইসলামী শিক্ষাও চললো সমান তালে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে শুনতে শুনতে ছোটবেলাতেই কোরান
পড়তে শিখে গেলেন আবদুস সালাম।
স্কুলের সব পরীক্ষায় চমৎকার ফলাফল করে
সব শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল আবদুস সালাম। কিন্তু তার বাবা জানতেন ঝাং স্কুলে
উঁচু ক্লাসে পড়ানোর উপযুক্ত ভালো ইংরেজি শিক্ষক নেই। ভালো ইংরেজি না জানলে জীবনে
বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ঠিক করলেন ক্লাস নাইন থেকে ছেলেকে লাহোরের
সেন্ট্রাল মুসলিম মডেল স্কুলে ভর্তি করে দেবেন। ছেলের রেজাল্ট ভালো। সুতরাং ভর্তি
হতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়।
১৯৩৮ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন
ছেলেকে নিয়ে গেলেন মডেল স্কুলের হেডমাস্টারের কাছে। হেডমাস্টার ভালো করে তাকিয়ে
দেখলেন আবদুস সালামের দিকে। তার মাথায় লাল রুমি টুপি দেখে চিন্তিত হয়ে উঠলেন তিনি।
যতই ভালো ছাত্র হোক এরকম অচল পোশাকের আন-স্মার্ট ছেলে তাঁর ‘মডার্ন’ স্কুলে বড়ই
বেমানান। মডার্ন স্কুলে ভর্তি হওয়া হলো না আবদুস সালামের। চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন
ছেলেকে নিয়ে গেলেন ঝাং সরকারি উচ্চ-মাধ্যমিক কলেজের স্কুল শাখায়। এখানে বেশির ভাগ
ছাত্র হিন্দু।
নতুন স্কুলের প্রথম পরীক্ষাতেই আবদুস
সালাম প্রথম হলো। মোট ৭০০ নম্বরের মধ্যে ৫৯১ নম্বর পেয়ে মাসে ছয় রুপি বৃত্তি ও দুই
রুপি বুক-প্রাইজ পেলো। তাদের সংসারে এই ছয় রুপিও অনেক। অচিরেই স্কুলের শিক্ষকদের
প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলো আবদুস সালাম। এখানেই বিজ্ঞানের ক্লাসে বসে আবদুস সালাম প্রথম
শোনে মৌলিক বলের কথা। তবে একটু অন্যভাবে।
তাদের বিজ্ঞান শিক্ষক শুরুতে বললেন
মহাকর্ষ বলের কথা। নিউটনের তত্ত্ব ততদিনে ঝাং এর মত মফস্বল শহরেও ঢুকে পড়েছে।
মহাকর্ষ বল ব্যাখ্যা করার পর শিক্ষক বললেন চুম্বকত্ব সম্পর্কে। একটা চুম্বক দেখিয়ে
তার লোহাকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা দেখালেন, উত্তর-দক্ষিণ মেরুর দিকে তার অবস্থানের
কথা বললেন, সমমেরুতে বিকর্ষণ আর বিপরীত মেরুতে আকর্ষণের কথাও বাদ গেলো না। বিদ্যুৎ
সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, “বিদ্যুৎ! আহা!!
বিদ্যুৎ এমন একটা বস্তু যা ঝাং শহরে থাকে না। এটা থাকে এই প্রদেশের রাজধানীতে।
এখান থেকে একশ’ মাইল পূর্বে- লাহোরে”।
মাস্টার সাহেব ঠিকই বলেছিলেন। ঝাং
শহরে বিদ্যুৎ এসেছিল আরো চার বছর পর, আবদুস সালামের বয়স তখন ষোল। নিউক্লিয়ার বল
সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিজ্ঞানের মাস্টার বলেছিলেন, “নিউক্লিয়ার বল
এমন এক ধরনের বল যা শুধু ইউরোপে আছে। ইন্ডিয়ায় তা থাকে না। সুতরাং নিউক্লিয়ার বল
নিয়ে চিন্তা করার কোন দরকার নেই আমাদের”। সেদিন যে
শিক্ষক নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কে ভাবতে মানা করেছিলেন তিনি কি জানতেন যে পরবর্তীতে
তাঁরই ছাত্র আবদুস সালাম নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কিত অনেক তত্ত্বের মৌলিক ধারণা বদলে
দেবেন?
১৯৪০ সালে আবদুস সালামের মেট্রিক
পরীক্ষা। এ নিয়ে বাবা মোহাম্মদ হোসেইনের চিন্তার শেষ নেই। ছেলে যাতে পরীক্ষায় খুব
ভালো রেজাল্ট করতে পারে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। ছেলের হাতের লেখা তেমন
সুন্দর নয়- তাই ছেলেকে বাধ্য করলেন দিন রাত লেখা অনুশীলন করতে। ব্যবহারিক বিজ্ঞান
ও জ্যামিতিতেও কিছুটা দুর্বল আবদুস সালাম। একজন শিখ শিক্ষক আবদুস সালামকে বিনা
পারিশ্রমিকে প্রাইভেট পড়ালেন পরীক্ষার আগে। পরীক্ষা বেশ ভালোই হলো। রেজাল্টের দিন
বাবার স্কুলের অফিসে বসে অপেক্ষা করছিলো আবদুস সালাম। লাহোর থেকে পরীক্ষার ফলাফলের
সংবাদ-পত্র এলো দুপুরের ট্রেনে। কিন্তু তার আগেই অভিনন্দন বার্তা সহ টেলিগ্রাম
পৌঁছে গেলো স্কুলে। আবদুস সালাম ফার্স্ট স্ট্যান্ড করেছে- প্রথম হয়েছে সারা
লাহোরের মধ্যে। সাইকেলে চেপে বাড়ি ফেরার পথে পুরো ঝাং শহর অভিনন্দন জানালো তাদের
কৃতি ছাত্রকে। পরদিন সংবাদপত্রে ছবি বেরোল চৌদ্দ বছর বয়সী কিশোর আবদুস সালামের-
চোখে চশমা, মাথায় পাগড়ি। বহুবছর পর নোবেল পুরষ্কার নেবার সময় এরকম পাগড়ির কথাই
তাঁর মনে হয়েছিল।
মেট্রিকে প্রথম হয়ে আবদুস সালাম
সরকারি বৃত্তি পেলো মাসিক বিশ রুপি। আর আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পেলো মাসিক
তিরিশ রুপি বৃত্তি।
আবদুস সালামের পরিবারের আহমদিয়া হবার
ইতিহাস খুব সাধারণ। আবদুস সালামের জ্যাঠা চৌধুরি গোলাম হোসেইন সর্বপ্রথম আহমদিয়া
সম্প্রদায়ের অনুসারী হন। পরে ১৯১৪ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন যখন লাহোরের
ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন- তখন ক্লাসের বন্ধুরা তাঁকে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে
অংশ নেয়ার জন্য বলেন। নিজের বড় ভাই আহমদিয়া হলেও মোহাম্মদ হোসেইন তখনো আহমদিয়াদের
অনুসারী হন নি। তা’বলে ব্যক্তিগত ভাবে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে কোন মতামতও তাঁর
ছিল না। কিন্তু একটা আন্দোলন হচ্ছে দেখে তাঁর কৌতূহল হল আহমদিয়াদের সম্পর্কে
জানার। নিজের চোখে সব দেখার জন্য তিনি চলে গেলেন কাদিয়ান- যেখান থেকে আহমদিয়া
সম্প্রদায়ের উৎপত্তি। তিনি যখন কাদিয়ানে পৌঁছলেন তখন মসজিদে ধর্ম-বক্তৃতা
দিচ্ছিলেন আহমদিয়াদের খলিফা মির্জা নুরুদ্দিন। চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন আহমদিয়াদের ‘নিজের মনের
শয়তানের বিরুদ্ধে মানসিক জিহাদ-ই আসল জিহাদ’ জাতীয় আদর্শে
মুগ্ধ হয়ে আহমদিয়াদের অনুসারী হয়ে গেলেন। আবদুস সালাম চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইনের
ছেলে হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রেই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
মেট্রিক পাসের পর আবদুস সালাম গণিত ও
বিজ্ঞানের লাইনে যাবে নাকি ভাষা ও সাহিত্যের দিকে যাবে তা নিয়ে কিছুটা
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন মোহাম্মদ হোসেইন। ছেলে তাঁর সব বিষয়েই ভাল। কিছু ভবিষ্যতের
কথা তো চিন্তা করতে হবে। ভবিষ্যত মানে একটা ভালো চাকরি। কোন্ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা
নিলে ভালো চাকরি পেতে সুবিধা হবে সেটাই বিবেচ্য। অনেকের কাছ থেকে পরামর্শও নিলেন এ
ব্যাপারে। ঠিক হলো আবদুস সালাম গণিত ও বিজ্ঞানের লাইনেই এগোবে।
ঝাং সরকারি কলেজে আরো দু’বছর কাটলো।
১৯৪২ সালের এফ-এ পরীক্ষায় ৬৫০ নম্বরের মধ্যে ৫৫৫ নম্বর পেয়ে সমগ্র পাঞ্জাবের মধ্যে
প্রথম হলো আবদুস সালাম। মাসিক বৃত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ালো সরকার থেকে তিরিশ রুপি,
আর আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পয়ঁতাল্লিশ রুপি।
এই সময় মোহাম্মদ হোসেইনের চাকরিতে
বিরাট পদোন্নতি হয়। তিনি পাঞ্জাব সরকারের শিক্ষা দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিযুক্ত
হন। ঝাং থেকে একশ’ মাইল দূরে মুলতানে তাঁর নতুন কর্মস্থল। মাসিক বেতন বেড়ে
দাঁড়ালো ২৫০ রুপি। আবদুস সালামের মা-বাবা ভাই-বোন সবাই মুলতানে চলে গেলেন। আবদুস
সালাম ভর্তি হলেন লাহোর সরকারি কলেজে বি-এ ক্লাসে।
প্রথমবারের মত বাড়ির বাইরে হোস্টেলে
থাকতে এসে বুঝলেন যে এতদিন বাড়িতে ছোট ভাই-বোনেরা সব কিছু হাতের কাজে এগিয়ে দিতো-
এখন থেকে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। তবে কিছুটা স্বাধীনতার স্বাদও পেলেন। দাবা
খেলা শিখে ফেললেন। হোস্টেলের অন্য ছেলেদের দাবায় হারানোর জন্য দাবার পেছনে অনেক
সময় দিতে শুরু করলেন। কথাটা কীভাবে যেন বাবার কানে পৌঁছে গেল। তিনি কড়া ধমক দিয়ে
চিঠি লিখলেন- ‘এরকম সময় নষ্ট করে ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না’।
লাহোর সরকারি কলেজে গণিতের প্রফেসর
সর্বদমন চাওলার সংস্পর্শে এসে গণিতের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মালো আবদুস সালামের।
প্রফেসর চাওলা কেমব্রিজের বিখ্যাত গণিতবিদ প্রফেসর জন লিটলউড ও প্রফেসর গডফ্রে
হার্ডির অধীনে পি-এইচ-ডি করেছেন। এই প্রফেসর হার্ডি-ই গণিতের কিংবদন্তী রামানুজনকে
বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। প্রফেসর চাওলা গণিতের ক্লাসে রামানুজনের গাণিতিক
সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতেন সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে।
আবদুস সালাম সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেন এই গণিত-চক্রে। অনেক নতুন নতুন সমস্যার সমাধান
করে গণিতে তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ রাখলেন।
গণিতের পাশাপাশি উর্দু আর ইংরেজি
সাহিত্যের প্রতিও তাঁর ভালবাসা। এসময় সাহিত্য চর্চার দিকেও ঝোঁক গেলো তাঁর।
গালিবের উপর তাঁর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো ‘আব্দি দুনিয়া’য়। ইংরেজিতে
অস্কার ওয়াইল্ড, টি ই লরেন্স-ও পড়ছেন। সতেরো বছরের তরুণ হৃদয়ে প্রেমের দোলা লাগলো
এ-সময়।
কলেজের প্রিন্সিপাল জি-ডি-সন্ধি’র দুই মেয়ে
উর্মিলা আর সনু’র রূপে তখন সারা কলেজ মুগ্ধ। আবদুস সালাম উর্মিলার
প্রেমে পড়ে গেলেন। অবশ্য এক তরফা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন- উর্মিলা ছাড়া আর
কাউকেই বিয়ে করবেন না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো উর্মিলার প্রেমে
হাবুডুবু খাচ্ছেন এমন তরুণের সংখ্যা অনেক। ছাত্রদের পাশাপাশি কিছু তরুণ শিক্ষকও
রয়েছেন প্রেমিকের দলে- প্রফেসর সিরাজুদ্দিন এগিয়ে আছেন সে ক্ষেত্রে। কাজের অজুহাতে
যখন তখন প্রিন্সিপালের বাসায় যাতায়াত করছেন প্রফেসর সিরাজুদ্দিন। আবদুস সালাম
দেখলেন উর্মিলার নাগাল পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় কিছুতেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে
পড়াশোনায় মন দিলেন।
১৯৪৪ সালের বি-এ পরীক্ষার ফলাফলে
পাঞ্জাবে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে প্রথম হলেন আবদুস সালাম। বি-এ পরীক্ষার বিষয়গুলোর
পাশাপাশি অতিরিক্ত ইংরেজি বিষয়ে অনার্সের পরীক্ষাও দিয়েছিলেন আবদুস সালাম। রেকর্ড
মার্ক পেয়ে ইংরেজিতে অনার্স পেলেন তিনি। সরকারি ও আহমদিয়া একাডেমি মিলিয়ে মাসিক
বৃত্তির পরিমাণ দাঁড়ালো ১২০ রুপি। এবার আবদুস সালাম ইংরেজি বা গণিত যে কোন বিষয়ে
মাস্টার্স করতে পারেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না ঠিক কোন্ লাইনে যাওয়া উচিত। আবদুস
সালামের বাবার প্রচন্ড ইচ্ছে ছেলে আই-সি-এস অফিসার হবে।
স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে পুরোদমে।
ভারতের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অখন্ড স্বাধীন ভারত হোক, কিংবা আলাদা
পাকিস্তান রাষ্ট্র হোক, ইংরেজ বিদায় নিলেই প্রশাসন চালানোর জন্য যথেষ্ট ভারতীয় বা
পাকিস্তানী অফিসার লাগবে। আই-সি-এস পাস করতে পারলে আর পেছনে তাকাতে হবে না। কিন্তু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার কারণে আই-সি-এস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে আছে অনির্দিষ্ট কালের
জন্য। আবদুস সালাম ভেবে দেখলেন আই-সি-এস পরীক্ষার জন্য যে সব বিষয় পড়তে হবে তা
তিনি পরীক্ষার আগে নিজে নিজে পড়ে নিতে পারবেন। আপাতত গণিত নিয়ে মাস্টার্স পড়া যাক।
প্রফেসর চাওলার তত্ত্বাবধানে শুরু হলো শুরু হলো আবদুস সালামের গণিতে মাস্টার্সের
পাঠ।
এর মধ্যে সাংগঠনিক কাজেও দারুণ দক্ষতা
অর্জন করে ফেলেছেন আবদুস সালাম। পরবর্তী জীবনে তাঁর বিশ্ব-মানের সাংগঠনিক দক্ষতার
পরিচয় আমরা পেয়েছি। আবদুস সালাম লাহোর কলেজ ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। কলেজ
ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদকের কাজও করলেন। ১৯৪৫ সালে তাঁর ইংরেজি ছোটগল্প ‘হোয়াইট আর্ম’ প্রকাশিত হলো
এই কলেজ ম্যাগাজিনে। ১৯৪৬ সালের এম-এ পরীক্ষায় ৬০০ নম্বরের মধ্যে ৫৭৩ নম্বর পেয়ে
পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেললেন আবদুস সালাম।
এত ভালো রেজাল্ট করার কারণে ইন্ডিয়ান
রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে চাকরির অফার পেলেন আবদুস সালাম। কিন্তু
রেলওয়ের চাকরির সামাজিক মর্যাদা আই-সি-এসের ধারে-কাছেও নয়। আবদুস সালামের বাবা
শুনেই নাকচ করে দিলেন। তাছাড়া আবদুস সালামের চোখে ইতোমধ্যেই পুরু লেন্সের চশমা উঠে
গেছে। রেলওয়ের চাকরিতে এরকম চোখ নিয়ে কাজ করা যায় না।
এসময় কিছু ব্যাপার ঘটলো যা আবদুস
সালামের ভাষায় ‘দৈবঘটন’। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। এর
নেতৃত্বে ছিলেন ইন্ডিয়ান কংগ্রেস পার্টির পাঞ্জাব প্রতিনিধি খাইজার হায়াত তিওয়ানা।
প্রায় দেড় লাখ রুপি সংগৃহিত হয় ঐ তহবিলে। যুদ্ধ শেষ হবার পরে দেখা গেলো তহবিলে বেশ
কিছু টাকা রয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হলো ঐ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবের দরিদ্র কৃষক পরিবারের
মেধাবী ছেলেদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঁচটি বৃত্তি দেয়া হবে। মেধার
প্রতিযোগিতায় আবদুস সালাম অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু বৃত্তির শর্ত যে পূরণ হচ্ছে না।
দরিদ্র কৃষকের ছেলেকে বৃত্তি দেয়া হবে। আবদুস সালামের বাবা তো শিক্ষা অফিসার, কৃষক
নন। কী করা যায়! এগিয়ে এলেন আবদুস সালামের জ্যেঠা চৌধুরি গোলাম হোসেইন। নিজের কিছু
জমি ছোট ভাইকে দিলেন। আবদুস সালামের বাবা কয়েকটা গরু ছাগল কিনে এবং ঐ জমিতে দ্রুত
চাষ করে আইনত কৃষক হয়ে গেলেন। বৃত্তি পেতে আর সমস্যা হবার কথা নয়।
ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির
প্রক্রিয়া শুরু করলেন আবদুস সালাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে।
ব্রিটেনে নতুন লেবার সরকার এসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে ইন্ডিয়া থেকে তারা প্রশাসন
গুটিয়ে নিয়ে ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে দেবে। এ অবস্থায় হাই-কমিশনে সাংঘাতিক কাজের
ভীড়। আবদুস সালামের কেমব্রিজে ভর্তির দরখাস্তে সুপারিশ করেছেন প্রফেসর চাওলা ও
ডক্টর আবদুল হামিদ। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির কলেজগুলোতে কতজন ভারতীয় ছাত্র নেয়া হবে
তার কোটা আছে- যা ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। ভর্তির জন্য আরো এক বছর অপেক্ষা করতে
হবে।
কিন্তু হঠাৎ জানা গেলো সেন্ট জন্স
কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট করার জন্য নির্বাচিত একজন ভারতীয় ছাত্র অনিবার্য্য
কারণে যেতে পারছেন না। এই খালি সিটে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলেন আবদুস সালাম। কিন্তু
সেন্ট জন্স কলেজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটের বদলে তারা
আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ছাত্র নেবে। আবদুস সালাম ইতোমধ্যেই বি-এ অনার্স ও এম-এ পাস করে
ফেলেছেন। কেমব্রিজে গিয়ে আবার বি-এ ক্লাসে ভর্তি হবেন?
আবদুস সালামের বাবা এখনো আশা ছাড়েন নি
যে ছেলে আই-সি-এস অফিসার হবে। অনেকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত দিলেন যে
আবদুস সালাম কেমব্রিজে গিয়ে আবার বি-এ পড়ুক। আই-সি-এস পরীক্ষার ঘোষণা দিলে ওখান
থেকেই পরীক্ষায় বসতে সুবিধে হবে। আই-সি-এস এর বয়স সীমা ২৫, আবদুস সালামের বয়স এখনো
২০। বিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি তখনো কোন আগ্রহ জন্মায়নি আবদুস সালামের। ১৯৪৬ সালের
০৩ সেপ্টেম্বর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির কনফার্মেশান টেলিগ্রাম এসে পৌঁছালো
আবদুস সালামের হাতে। এবার বৃত্তি কনফার্ম করতে হবে।
সেই রাতের ট্রেনেই মুলতান থেকে লাহোরে
চলে গেলেন তিনি। পরের দিন সকালে স্টেশন থেকে ছুটতে ছুটতে পাঞ্জাব শিক্ষা অধিদপ্তরে
গিয়ে শোনেন যে অত্যধিক গরমের কারণে শিক্ষা অফিস সরিয়ে নেয়া হয়েছে আড়াইশ’ কিলোমিটার
দূরে সিমলায়। আবার ছুটে গিয়ে সিমলাগামী ট্রেন ধরলেন। সিমলায় পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর
দুটো। গিয়ে দেখলেন তাঁর জন্য একটা সুখবর অপেক্ষা করছে। আরো চারজন পাঞ্জাবী ছেলের
সাথে তাঁকেও উচ্চশিক্ষা বৃত্তি দেয়া হয়েছে। বছরে ৩৬৫ ব্রিটিশ পাউন্ড হিসেবে তিন
বছর। বৃত্তির শর্ত এই যে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। আবদুস
সালামের ভর্তির টেলিগ্রাম পকেটেই ছিল। এটাকেই আবদুস সালাম পরবর্তীতে ‘দৈবঘটন’ হিসেবে উল্লেখ
করেছেন। কারণ বৃত্তিপ্রাপ্ত বাকি চারজনকে পরের বছরে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করতে
হয়েছে। কিন্তু পরের বছর ১৯৪৭ ভারত স্বাধীন আর পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলো। বৃত্তির
টাকা অন্যান্য খাতে অবলুপ্ত হয়ে গেল। বাকি চারজনের আর বিদেশ যাওয়া হলো না।
বৃত্তি হলো, কেমব্রিজে ভর্তি নিশ্চিত
হলো। পরের মাস থেকেই ক্লাস শুরু। জাহাজে চেপে ব্রিটেনে পৌঁছাতে লেগে যাবে কয়েক
সপ্তাহ। হাতে একদম সময় নেই। ভারত থেকে সব ব্রিটিশ সৈন্য আর কর্মকর্তারা দেশে ফিরতে
শুরু করেছেন। লাহোর থেকে জানা গেছে জাহাজের কোন টিকেট নেই, ডিসেম্বরের আগে টিকেট
পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আবদুস সালাম চলে গেলেন দিল্লি। শনিবারের বিকেলে গিয়ে
পৌঁছলেন শিপিং কোম্পানির অফিসে। অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। অফিসের পিয়ন কাম কেরানিকে
কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে একটা অপেক্ষ-মান টিকেট সংগ্রহ করলেন আবদুস সালাম। রাতের
ট্রেনেই ফিরে গেলেন মুলতান।
তখন ভারত জুড়ে অস্থিরতা।
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। আবদুস সালাম যখন মুলতানে পৌঁছলেন তাঁর বাবা
অপেক্ষা করছিলেন ট্রেন স্টেশনে। দাঙ্গার কারণে সান্ধ্যকালীন কারফিউ জারি করা
হয়েছে। মোহাম্মদ হোসেইন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে স্টেশনে
এসেছেন। এই উত্তাল সময়ে তিনি মনে-প্রাণে কামনা করছেন তাঁর ছেলে যেন ভালোয় ভালোয়
কেমব্রিজে গিয়ে পৌঁছতে পারে। একদিকে ইংরেজ তাড়ানোর যুদ্ধ, আবার অন্যদিকে ইংরেজদের
দেশে যাবার প্রাণপন চেষ্টা। পরের কয়েকদিন জিনিস-পত্র গোছানো চললো। স্থানীয় বড়লোক
মালিক উমর আলির ছেলেদের কিছুদিন প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন আবদুস সালাম। তিনি আবদুস সালামের
বিদেশ যাবার ভ্রমণ-খরচ দিলেন কিছু।
১৯৪৬ এর সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ সকালে
চল্লিশ কেজি ওজনের ট্রাংক সাথে নিয়ে বোম্বে-গামী ট্রেনে উঠে বসলেন আবদুস সালাম।
মুলতান থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে বোম্বাই। সেখান থেকে লিভারপুল-গামী জাহাজে
উঠবেন যেদিন সিট পাওয়া যায়। দু’দিন পর যখন
বোম্বে পৌঁছলেন তখন শহরজুড়ে কারফিউ চলছে। স্টেশনের কাছে একটি সস্তা হোটেলে গিয়ে
উঠলেন আবদুস সালাম। পরের দিন সকালে বোম্বে ডকে গিয়ে দেখলেন ব্রিটিশ সৈন্যে গিজগিজ
করছে ডক। সবাই বসতি গুটিয়ে ফিরে যাচ্ছে ব্রিটেনে। একেক জনের দশ-বারোটা করে সুটকেস,
সাথে অন্যান্য জিনিস তো আছেই। এসব ডিঙিয়ে জাহাজে ওঠা সহজ কাজ নয়।
ভারী সুটকেস সামলাতে সামলাতে প্রায়
বিধ্বস্ত হয়ে জাহাজে উঠলেন আবদুস সালাম। আরেকজন ভারতীয়ের সাথে শেয়ারে একটা বার্থ
পাওয়া গেল। ছয়শ’ ব্রিটিশ সৈনিক পরিবার, ছয়শ’ ইতালিয়ান যারা
বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন- এখন বন্দী-বিনিময়ের আওতায়
মুক্ত, আর সাথে আবদুস সালামের মত কিছু সাধারণ নাগরিককে নিয়ে বোম্বে ডক থেকে
ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ব্রিটিশ জাহাজ ফ্রাংকোনিয়া।
বিশ বছরের তরুণ আবদুস সালাম একুশ
দিনের জাহাজ-যাত্রার পুরোটাই বেশ উপভোগ করলেন। এডেন বন্দরে জাহাজ ভিড়লে একটা
হাতঘড়ি কিনলেন- তাঁর জীবনের প্রথম হাত ঘড়ি। সুয়েজ খাল অতিক্রম করে জাহাজ ভিড়লো
ইতালির নেপল্স-এ। আবদুস সালাম পা রাখলেন ইতালির মাটিতে। সেদিন কারও ধারণা ছিল না
যে একদিন এই ইতালিতেই তিনি গড়ে তুলবেন আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা
কেন্দ্র।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে লিভারপুলে
পৌঁছলো ফ্রাংকোনিয়া। এরকম শীত আগে কখনো দেখেননি আবদুস সালাম। জাহাজ থেকে নেমে কী
করবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি। ভারত তখনো ব্রিটিশের অধীন। ভারতীয়রা সামর্থ্য থাকলে
ব্রিটেনের যে কোন জায়গায় যেতে পারেন। লিভারপুল ডকেও কিছু কিছু ভারতীয় দেখা যাচ্ছে।
আবদুস সালামের সাথে দেখা হয়ে গেলো একজন বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তির সাথে। স্যার
মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান- আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বড় নেতা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক।
আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পথে ব্রিটেনে কিছুদিনের
যাত্রাবিরতি করছিলেন জাফরুল্লাহ খান। সেদিন লিভারপুল ডকে এসেছিলেন তাঁর এক
ভাইপোকে নিতে। তিনি দেখলেন বিশাল এক ট্রাংক সাথে নিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডায় হু হু করে
কাঁপছে একজন ভারতীয় তরুণ। তিনি এগিয়ে গিয়ে নিজের ভারী ওভারকোটটা খুলে জড়িয়ে দিলেন
তরুণটির গায়ে।
আবদুস সালামের পরিচয় পেয়ে আর কেমব্রিজে
পড়তে এসেছেন শুনে তাঁকে সাথে করে লন্ডনে নিয়ে এলেন জাফরুল্লাহ খান। রাতে থাকার
ব্যবস্থা করে দিলেন সাউথফিল্ডের আহমদিয়া মসজিদে। পরদিন সকালে ট্রেন ধরে কেমব্রিজ।
স্টেশন থেকে ট্রেক্সিতে সোজা সেন্ট জন্স কলেজ। ভারী ট্রাংকটি নামিয়ে দিয়ে
টেক্সিড্রাইভার চলে গেলো। আবদুস সালাম এদিক ওদিক তাকালেন যদি কোন কুলি পান। কলেজের
একজন গার্ডকে দেখে সাহায্য করার জন্য বললে গার্ড আঙুল তুলে একটা ট্রলি দেখিয়ে
দিলেন। সাংস্কৃতিক ধাক্কা শুরু হলো আবদুস সালামের। ভারতে পয়সা দিলেই কুলি পাওয়া
যায়। আর ব্রিটেনে কোন কুলি নেই- নিজের বোঝা নিজেই সামলাও। মিশ্র অনুভূতি নিয়ে
সেন্ট জন্স কলেজের হোস্টেলে ঢুকলেন আবদুস সালাম।
এই সেই পৃথিবী বিখ্যাত কেমব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে রয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম স্থপতি পল ডিরাক,
তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হার্মান বন্ডি। এখানকার বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে কাজ করেছেন
প্রথম বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী জগদীশ বসু। আবদুস সালামের মন ভরে গেলো এখানে এসে।
সেন্ট জন্স কলেজের ফুলের বাগানের সৌন্দর্য আবদুস সালামকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। বলা
হয়ে থাকে এই ফুলের বাগানের জন্যই আবদুস সালাম পরবর্তীতে ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ
প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যদিও ট্রিনিটিকেই ব্রিটেনের সবচেয়ে ভালো কলেজ বলা হয়।
কেমব্রিজে আবদুস সালাম গণিত ট্রাইপ্সের
দ্বিতীয় অংশ এবং পদার্থবিজ্ঞানের দ্বিতীয় অংশ নিয়েছিলেন। পরীক্ষায় দুই বিষয়েই তিনি
প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। গণিতে প্রথম শ্রেণী অর্জন করার জন্য তিনি
হলেন রেংলার। পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণী পাওয়ার ফলে কেমব্রিজের রীতি অনুযায়ী
তিনি পরীক্ষণ পদার্থবিদ্যায় গবেষণার উপযুক্ততা অর্জন করেন।
সেন্ট জন্স কলেজে আবদুস সালামের টিউটর
ছিলেন বিশিষ্ট জ্যোতির্পদার্থবিদ ফ্রেড হয়েল। তিনি বলতেন পদার্থবিজ্ঞানে তত্ত্বীয়
জ্ঞানের পাশাপাশি পরীক্ষণের জ্ঞান থাকাও দরকার। আবদুস সালাম ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে
কিছুদিন কাজও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাষায় “পরীক্ষণের কাজে
যে সব গুণ থাকা প্রয়োজন তা আমার মোটেও ছিল না। ধৈর্য ধরে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করা-
আমি বুঝেছিলাম যে আমার দ্বারা হবে না”। তত্ত্বীয়
পদার্থবিজ্ঞানই হয়ে উঠলো আবদুস সালামের প্রধান ভালবাসা।
নিকোলাস কেমার তখন সবল ও দুর্বল
পারমাণবিক বলের পারস্পরিক ক্রিয়ায় পায়নের ভূমিকা আবিষ্কার করে খ্যাতি লাভ করেছেন।
কেমারের প্রিয় ছাত্র পল ম্যাথিউজ। আবদুস সালাম পারমাণবিক বলের তত্ত্বের ব্যাপারে
আগ্রহী হয়ে গেলেন নিকোলাস কেমারের কাছে। কেমার তাঁকে পাঠালেন পল ম্যাথিউজের কাছে।
ম্যাথিউজ বললেন বড় ধীরে ধীরে এগোচ্ছে এ-সংক্রান্ত গবেষণা। বললেন- ফ্রিম্যান
ডাইসনের গবেষণা-পত্রগুলো পড়া থাকলে সুবিধে হবে। পড়তে শুরু করলেন আবদুস সালাম। পড়তে
পড়তে অনেক জায়গায় খটকা লাগতে শুরু করলো। ভাবলেন এ ব্যাপারে সরাসরি ফ্রিম্যান
ডাইসনের সাথে কথা বলা যাক। একদিন চলে গেলেন বার্মিং-হামে প্রফেসর ডাইসনের কাছে।
ডাইসন বললেন- হাতে হাতে প্রমাণ চাইলে তো দেখাতে পারবো না। সব তত্ত্বের তো
পরীক্ষামূলক প্রমাণ সম্ভব হয় না।
১৯৪৭ সালে যখন আবদুস সালাম কেমব্রিজের
বিজ্ঞানীদের মাঝে নিজের জায়গা করে নিচ্ছিলেন তখন ব্রিটিশরা তাদের ভারত সাম্রাজ্যের
অবসান ঘটায়। স্বাধীন ভারতের সাথে সাথে নতুন মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়।
পাঞ্জাব দু’ভাগ হয়ে যায়। আবদুস সালামরা এখন পাকিস্তানী। ১৯৪৯ সালে
প্রথম বারের মত স্বাধীন পাকিস্তানে নিজেদের বাড়িতে ফিরলেন আবদুস সালাম। সেখানে
একটা আনন্দের আয়োজন অপেক্ষা করছিল আবদুস সালামের জন্য। তাঁর জ্যেঠা চৌধুরি গোলাম
হোসেইনের দ্বিতীয় কন্যা আমতুল হাফিজ বেগমের সাথে আবদুস সালামের বিয়ে ঠিক করে
ফেলেছেন তাদের বাবা-মা। ১৯৪৯ সালের ১৯শে আগস্ট বেশ ধুম ধাম করে বিয়ে হলো আবদুস
সালাম ও আমতুল হাফিজ বেগমের।
সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথম
শ্রেণীর কেমব্রিজ ডিগ্রি নিয়ে ফেরা আবদুস সালাম চাইলেই যে কোন সরকারি চাকরিতে
ঢুকতে পারেন। কিন্তু তাঁর মাথায় ঢুকে গেছে কেমব্রিজে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা
চালিয়ে যাবার স্বপ্ন। তিনি চেষ্টা করলেন যদি তাঁর শিক্ষাবৃত্তিটার মেয়াদ আরো কয়েক
বছর বাড়ানো যায়। বৃত্তি আর সেন্ট জন্সের স্টুডেন্টশিপ নিয়ে বেশ আরামেই চলে যাবে
তাঁর। বৃত্তির মেয়াদ বাড়লো আরো দু’বছর, কিন্তু
হিসেব করে দেখা গেলো বৃত্তির টাকায় স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কেমব্রিজে থাকা সম্ভব নয়।
ছয় সপ্তাহ পর আবদুস সালাম ফিরে এলেন কেমব্রিজে একা। তাঁর স্ত্রী রয়ে গেলেন
মা-বাবার সাথে মুলতানে।
পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদানের
জন্য পাঠ্যাবস্থায় ১৯৫০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আবদুস সালামকে স্মিথ
পুরষ্কারে ভূষিত করে। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে এই বিরল সম্মান পাওয়া সহজ নয়। পরের
বছর ১৯৫১ সালে তিনি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি লাভ করেন। তাঁর দুটো
গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ফিজিক্স জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ-তে। এসময় তিনি
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিমন্ত্রণ পেলেন। আইনস্টাইন তখন প্রিন্সটনে কর্মরত।
প্রচন্ড খুশি আবদুস সালাম। কিন্তু যাওয়া হলো না তাঁর। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা আটকে
দিলো। স্কলারশিপের মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে এলেন আবদুস সালাম।
দেশে ফিরে যোগ দিলেন লাহোর সরকারি
কলেজে। পরে ১৯৫২ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। কিন্তু নামেই অধ্যাপক।
কেমব্রিজের পড়াশোনা, গবেষণা কোন কাজেই লাগলো না লাহোরে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান তাঁকে
পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে এতদিন যা গবেষণা করেছেন তা তিনি ভুলে যেতে পারেন, কেননা
এখানে গবেষণার কোন প্রয়োজন নেই। এ সময় বছরে সাতশ’ পাউন্ড বেতনে
তাঁর কাজ হিসেবে ‘ছাত্রদের বৃত্তি পরিচালক’, ‘ছাত্রাবাসের
ওয়ার্ডেন’ বা ফুটবল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট- এই তিনটি থেকে যে কোন
একটিকে বেছে নিতে বলা হলো। আবদুস সালাম ফুটবল ক্লাবকেই বেছে নিলেন। যদিও তিনি
নিজেকে একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় মনে করতেন না।
১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি
বুদ্ধিবৃত্তির জগতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। লাহোরের কর্মজীবনের পরিবেশে চরম
হতাশাবোধ তাঁকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে বাধ্য করে। তাঁর ভাষায় তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও
‘মগজ পাচারের’ শিকার হলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “অন্যান্য
পদার্থবিজ্ঞানীরা কী চিন্তা করছেন তা আপনাকে জানতে হবে এবং তাদের সঙ্গে আপনাকে কথা
বলতে হবে। আমার ভয় হয়েছিল যে আমি যদি লাহোরে থাকি, তবে আমার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তারপর আমার দেশের কোন্ কাজে লাগবো আমি? কেমব্রিজে প্রভাষক হওয়া লাহোরে অধ্যাপক
হওয়ার চেয়ে অনেক ভালো”।
তাছাড়া পাকিস্তানের নতুন সরকার মৌলিক
দেশের মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে না পেরে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে জনগণের মনযোগ
অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে পাকিস্তান সৃষ্টি
হয়েছে। এবার পাকিস্তানের মধ্যেই আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে
পড়ছে। আহমদিয়াদের উৎসস্থল কাদিয়ান এখন ভারতীয় ভূ-খন্ডের অন্তর্ভুক্ত। আহমদিয়াদের
নতুন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে রাবওয়াতে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর যখন তখন
শারীরিক আক্রমণ হচ্ছে। বলা হচ্ছে আহমদিয়ারা মুসলমান নন। আবদুস সালাম নিজে এ জাতীয়
বিতর্ক থেকে সব সময় দূরে থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু নিজে দূরে থাকলেই কি নিরাপদে থাকা যায়?
আবদুস সালামের ওপর শারীরিক আক্রমণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিলো। নিজেকে ভীষণ অপমানিত
মনে করলেন আবদুস সালাম। নিজের দেশে নিজের প্রতিবেশীর কাছ থেকে এরকম ব্যবহার তিনি
আশা করেন নি। ১৯৫৪ সালে স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে চলে এলেন কেমব্রিজে।
প্রফেসর কেমারের প্রিয় ছাত্র আবদুস
সালাম। কেমার এডিনবরায় চলে যাচ্ছেন ম্যাক্স বর্ন অধ্যাপক পদে। কেমব্রিজে কেমারের
জায়গায় ‘স্টোক্স প্রফেসর’ পদে যোগ দিলেন
ডক্টর আবদুস সালাম। এর তিন বছর পর ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে
ফুল প্রফেসর পদে যোগ দিলেন প্রফেসর আবদুস সালাম।
১৬৮০ সালে স্যার আইজাক নিউটন যখন
মহাকর্ষ বলের সূত্র দিলেন- বলা যায় তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। প্রকৃতিতে
বিদ্যমান বলগুলোর পারস্পরিক ঐক্যের সন্ধানে অবিরত কাজ করতে থাকেন অনেক বিজ্ঞানী।
১৮৩০ সালে অ্যাম্পিয়ার ও মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তিকে একত্রিত করে ‘তড়িৎচৌম্বক’ এর ধারণা দেন।
এরপর ১৮৭৮ সালে ম্যাক্সওয়েল প্রতিষ্ঠা করলেন ‘তড়িৎ-চৌম্বক বল’ এর সূত্রাবলী।
মাইকেল ফ্যারাডেই প্রথম চেষ্টা করেছিলেন মহাকর্ষ বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের মধ্যে
সমন্বয় সাধনের। কিন্তু তিনি সফল হননি। ১৯১৭ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন চেষ্টা
করেছিলেন মহাকর্ষ বলের সাথে অন্যান্য বলগুলোর ঐক্য খুঁজতে। তিনিও সফল হননি। ১৯৩০
সালে এনরিকো ফার্মি যখন চেষ্টা করেন দুর্বল পারমাণবিক বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের ঐক্য
প্রতিষ্ঠা করতে- তখন আবদুস সালামের বয়স মাত্র চার বছর। এখন আবদুস সালাম কেমব্রিজে
এসে মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করার একটি দুরূহ ধাপ অতিক্রম করতে সচেষ্ট হলেন।
লন্ডনে ফিরে এসে কাজ শুরু করার সাথে
সাথে সাফল্যের মুখ দেখলেন আবদুস সালাম। ১৯৫৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আহূত শান্তির
জন্য পরমাণু সম্মেলনের তিনি বৈজ্ঞানিক সচিব নিযুক্ত হলেন। ভারতের বিজ্ঞানী ডক্টর
হোমি ভাবা হলেন সভাপতি। ঐ বিখ্যাত সম্মেলনে আবদুস সালাম অভিভূত হয়ে অনুভব করলেন
বিশ্বমানবতায় বিশ্ব-বিজ্ঞানের অবদানের ক্ষমতা অসীম। পদার্থবিজ্ঞানের জন্য একটি
আন্তর্জাতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা এখান থেকেই তাঁর মনে আসে। তিনি বুঝতে
পারেন- ‘তৃতীয় বিশ্বে সুযোগ এত কম আসে যে সবচেয়ে ভালো
ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষেও কোন সুযোগ পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে’।
তৃতীয় বিশ্বের ভালোদের সুযোগ করে
দেয়ার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র
গড়ার ব্যাপারে। কারণ তিনি জানতেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান অল্প কয়েকটি বিষয়ের একটি
যে বিজ্ঞানে খুব অল্প ঐতিহ্য সম্বল করেও বেশ ভালো বিজ্ঞানী তৈরি করা যায়। তৎকালীন
পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থায় তিনি এ ধরনের কেন্দ্র
স্থাপন করার প্রস্তাব করেন।
১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের বিশিষ্ট
রাজনীতিবিদ মিঞা ইফতেখার উদ্দিন লন্ডনে এসে পাকিস্তানের সন্তান প্রফেসর আবদুস
সালামের নাম-ডাক শুনে দেশে ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের বললেন আবদুস সালাম সম্পর্কে। ‘পাকিস্তান
টাইমস’-এ প্রতিবেদন বেরোল আবদুস সালামের কৃতিত্বের বিষয়ে। সে
বছরই পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় আবদুস সালামকে সম্মান-সূচক ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান
করলো।
১৯৫৯ সালে আবদুস সালামকে ‘সিতারা-ই-পাকিস্তান’ খেতাব দেয়া
হয়। আইয়ুব খান তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তিনি প্রফেসর আবদুস সালামকে
পাকিস্তানের জাতীয় বিজ্ঞান কমিশনের সদস্য ও শিক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা নিয়োগ করলেন।
প্রফেসর আবদুস সালাম মহা উৎসাহে নিজের দেশের কাজে লেগে গেলেন।
আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান
গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাজ অনেক দূর এগিয়ে রেখেছেন আবদুস সালাম।
পাকিস্তানের মাটিতে যদি এই গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা যায় বিজ্ঞান গবেষণায় অনেক দূর
এগিয়ে যেতে পারবে তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটি। বিজ্ঞান কমিশনের সভায় তিনি এই প্রস্তাব
পাঠালেন। বিজ্ঞান কমিশনে পাশ হয়ে প্রস্তাবের ফাইল গেলো অর্থমন্ত্রীর টেবিলে।
পাকিস্তানের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবনার ফাইলে নোট লিখলেন- ‘পাকিস্তানের
মাটিতে আন্তর্জাতিক কেন্দ্র করার উদ্দেশ্য হচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ধরণের
আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এদেশে এরকম কোন কেন্দ্রের দরকার নেই। তারচেয়ে ওই টাকায় একটা
পাঁচ-তারা হোটেল হোক। বড় বড় বিজ্ঞানীদের ডেকে এনে আমরা যত্ন করে রাখবো ওই হোটেলে’। পরে ১৯৬৪
সালে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ইতালিতে।
১৯৬১ সালে প্রফেসর আবদুস সালামের
নেতৃত্বে পাকিস্তানের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৯৬৫ সালে
পাকিস্তানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রও স্থাপিত হয় প্রফেসর আবদুস সালামের
নেতৃত্বে। ১৯৭২ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টোর উদ্যোগে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প
গ্রহণ করে। মূল উদ্দেশ্য ভারতের পারমাণবিক প্রকল্পের জবাব দেয়া। ভুট্টোর উদ্যোগে
প্রফেসর আবদুস সালামকে এই প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়।
পাকিস্তানের আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান মুনির আহমদ খান ও প্রফেসর আবদুস সালাম
মিলে গঠন করলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গ্রুপ- যাদের কাজ হলো পারমাণবিক অস্ত্রের
তত্ত্বীয় অংশ ডিজাইন করা। ১৯৭৭ সালে এ ডিজাইন সম্পন্ন হয়।
কেমব্রিজে আবদুস সালামের প্রথম
গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একটা অসঙ্গতি দূর করা। এ
পর্যন্ত তত্ত্বে এমন কিছু ছিল না যা দিয়ে ইলেকট্রনের গণনাকৃত অসীম ভর এবং অসীম
বৈদ্যুতিক আধানকে সসীম করা যায়। পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়ান সুইঙ্গার, রিচার্ড
ফাইনম্যান ও সিনিট্রো টেমোনাগা তড়িৎচুম্বক তত্ত্বকে কীভাবে পরিমার্জিত করা যায় তা
দেখিয়েছিলেন এবং নিউক্লিয়ার বলের মেসন তত্ত্বের ব্যাপারে একই কাজ করেছিলেন আবদুস
সালাম। মেসন ফিল্ড থিওরিতে যে অসীম রাশির উদ্ভব হয় তা দূর করার পদ্ধতি আবিষ্কার
করেছিলেন আবদুস সালাম। এই পদ্ধতিকে বলা হয় সালামের পুনঃসাধারণীকরণ। পদার্থবিজ্ঞানে
এই উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আবদুস সালামকে হপ্কিন্স পুরষ্কার
দেয় ১৯৫৮ সালে।
আবদুস সালামের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য
অবদান হলো মৌলিক কণাগুলোর শ্রেণীকরণের জন্য গণিতের গ্রুপ থিওরির ব্যবহার। ১৯৬০
সালে জাপানের কয়েকজন বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেছিলেন যে পরিচিত মৌলিক
কণাগুলো (ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন) আরো তিনটি মৌলিকতর কণা দিয়ে তৈরি, পরে যাদের
নাম দেয়া হয়েছে কোয়ার্ক। আবদুস সালামই প্রথম অ-জাপানী বিজ্ঞানী যিনি এই ধারণা
গ্রহণ করেছিলেন। বস্তুকণার কোয়ার্ক-তত্ত্ব এখন প্রতিষ্ঠিত। আবদুস সালামের সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য অবদান অবশ্যই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ও দুর্বল নিউক্লিয়ার ফোর্সের
একত্রীকরণ তত্ত্ব। যার জন্য ১৯৭৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
আবদুস সালাম হলেন প্রথম মুসলমান নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী।
কণা পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন অংশে
আবদুস সালাম তাঁর প্রতিভার কালজয়ী স্বাক্ষর রেখেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছরের নিরলস
গবেষণার মাধ্যমে। তাঁর গবেষণার স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। ফিজিক্যাল সোসাইটি অব
লন্ডনের ম্যাক্সওয়েল পুরষ্কার (১৯৬১)। ১৯৬৪ সালে পেয়েছেন রয়েল সোসাইটি অব লন্ডনের
হিউজ পুরষ্কার। ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন এটম্স ফর পিস মেডেল। ১৯৭১ সালে রবার্ট
ওপেনহেইমার মেমোরিয়্যাল মেডেল, ১৯৭৭ সালে লন্ডন ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্সের গাথিরি
মেডেল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক, ১৯৭৮ সালে
রোমের মেট্রেউটিক মেডেল ও রয়েল সোসাইটি অব লন্ডনের রয়েল মেডেল। ১৯৭৯ সালের নোবেল
পুরষ্কার, ইউনেস্কোর আইনস্টাইন পদক। নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির পর স্বাভাবিক ভাবেই
পুরষ্কার ও পদকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। অসংখ্য পুরষ্কারের পাশাপাশি বিশ্বের
পয়ঁত্রিশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি
প্রদান করে।
তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানীরা প্রফেসর
আবদুস সালামের কাছে অবশ্যই কৃতজ্ঞ তাঁর ট্রিয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল থিওরেটিক্যাল
ফিজিক্স সেন্টার (আই-সি-টি-পি)’র জন্য। ১৯৬২
সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত অক্লান্তভাবে
লবি করেছেন এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রথমদিকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স,
এমনকি ভারতও এই কেন্দ্রের ব্যাপারে উৎসাহী ছিল না। কোন কোন দেশ সক্রিয়ভাবে এর
বিরোধিতাও করেছে। যদিও পরবর্তীকালে এসব দেশই এই কেন্দ্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে
সবচেয়ে বেশি। ১৯৬৪ সালে আই-সি-টি-পি
স্থাপন করেন ইতালির ট্রিয়েস্টে এড্রিয়াটিক সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের উপর। যার পেছনে
সক্রিয় ছিল তার ইটালিয়ান বন্ধু পাউলো বুডিনির কর্মপ্রেরণা এবং ইটালিয়ান সরকারের
মহানুভবতা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রফেসর আবদুস সালাম এই
প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন।
তাঁর আই-সি-টি-পি’র অফিসের দেয়ালে একটি ষোড়শ শতাব্দীর পারসিক
প্রার্থনার লিপি ঝোলানো আছেঃ “তিনি চিৎকার
করে বললেন, ঈশ্বর, একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা সংঘটিত করুন”। আবদুস
সালামের শক্তি এই যে তিনি বিশ্বাস করতেন আশ্চর্যজনক ঘটনা সম্ভব যদি আমরা এগিয়ে
গিয়ে ঘটতে সাহায্য করি। তিনি তা বিশ্বাস করতেন বলেই সারাজীবন বিজ্ঞানের মাধ্যমে
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন “আজ থেকে বিশ
বছর পরেও স্বল্পোন্নত দেশগুলো আজকের মতোই ক্ষুধার্ত, আপেক্ষিকভাবে অনুন্নত এবং
হতাশাজনকভাবে দরিদ্র থাকবে”। তাই তিনি
সারাজীবন কাজ করে গেছেন তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য। তিনি প্রতিষ্ঠা
করেছেন ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স’। এই একাডেমির
স্কলারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় পৃথিবীর অনেক দরিদ্র দেশের অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা করার
সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই প্রফেসর আবদুস সালামের
সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রফেসর আবদুস সালাম বেশ কয়েক বার বাংলাদেশের ঢাকা ও
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন।
প্রফেসর আবদুস সালাম বিজ্ঞানকে পেশা
হিসেবে কখনই দেখতে চাননি। সারাদেশের জীবনযাত্রার মান দ্রুত উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাই তিনি সারাজীবন বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘আমাদের মানবিক
ও বস্তুগত যে সম্পদ রয়েছে তারই সবচেয়ে ভাল প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবহারের চিন্তাশীল
হিসাব নিকাশই হল বিজ্ঞান’। পৃথিবীর
অনুন্নত অংশ যে ভীতিপ্রদ সংকটের সম্মুখীন তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে যেসব অগণিত মানুষ
চিন্তাভাবনা করেন তাঁর মধ্যে অল্প কয়েকজন আছেন যাঁরা শুধু কথা বলেন না, কাজও করেন।
প্রফেসর আবদুস সালাম শেষের দলে। কাজ করতে করতে ছুটে গেছেন পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে
ও-প্রান্তে।
ব্যক্তিগত জীবনে এই কাজ-পাগল বিজ্ঞানী
ছিলেন অনেকটাই একা। খুব কাছের বন্ধু- যাদের কাছে মন খোলা যায়- তেমন একটা ছিল না।
তাই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো খুব একটা জানাও যায় না। ১৯৪৯ সালে আমতুল হাফিজ
বেগমের সাথে বিয়ের পর ১৯৬০ সালের মধ্যে তাঁদের চারটি কন্যা ও একটি পুত্র সন্তানের
জন্ম হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আবদুস সালাম থাকতেন লন্ডনের পুটনিতে। সুখের
সংসারই বলা চলে। কিন্তু মনে হয় লেখাপড়া না জানা আমতুল হাফিজ বেগম স্বামীর
বৈজ্ঞানিক মননের সঙ্গী হতে পারেন নি। তাই আমরা দেখি স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও
আরেকটা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন প্রফেসর আবদুস সালাম।
১৯৬২ সালে আবদুস সালামের সাথে পরিচয়
হয় অক্সফোর্ডের ছাত্রী লুইস জন্সনের। আবদুস সালাম তখন ইম্পেরিয়াল কলেজের বিখ্যাত
প্রফেসর। লুইস জীববিজ্ঞানের ছাত্রী। আবদুস সালাম আর লুইসের ঘন ঘন দেখা হতে লাগলো।
জটিল গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানীর মুখে ইংরেজি সাহিত্য আর কবিতা নিয়ে আলোচনা শুনে
মুগ্ধ লুইস। ছয় বছর ধরে চললো তাঁদের গোপন প্রেম। ১৯৬৮ সালে আবদুস সালাম লুইস
জনসনকে বিয়ে করেন। লুইস তখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার বায়োলজির প্রফেসর।
লাইসোজমের রাসায়নিক গঠন আবিষ্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন লুইস জনসন। এক
স্ত্রী বর্তমান থাকতে আরেকজনকে বিয়ে করা ব্রিটিশ আইনে অপরাধ। কিন্তু আবদুস সালাম
পাকিস্তানী নাগরিক। তাছাড়া রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করার সময় সম্ভবত প্রথম স্ত্রীর কথা
তিনি গোপন করেছিলেন। একই শহরে মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে পাশাপাশি দুটো সংসার
আলাদা আলাদা ভাবে চালিয়ে নিয়ে গেছেন আবদুস সালাম। ১৯৭৪ সালে আবদুস সালাম ও লুইস
দম্পতির একটা পুত্র-সন্তান হয়। তারপর সব জানাজানি হয়ে যায়। নীরবে সব কিছু মেনে নেন
আমতুল হাফিজ।
১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করার
জন্য স্টকহোমে যাবার সময় প্রফেসর আবদুস সালাম তাঁর দু’জন স্ত্রীকেই
সাথে নিয়ে যান। এরকম পরিস্থিতি আগে কখনো দেখেননি নোবেল ফাউন্ডেশানের কর্মকর্তারা। নোবেলবিজয়ীর
স্ত্রীকে যথাযোগ্য প্রটোকল দিতে হয়। ভোজের টেবিলে রাজার পাশে আসন দেয়া হয় নোবেলবিজয়ীর
স্ত্রীকে, আর রাণীর পাশে বসেন নোবেলবিজয়ী। এখন নোবেলবিজয়ীর দু’জন স্ত্রী
উপস্থিত। কাকে কোথায় বসাবেন- সমস্যায় পড়ে গেলেন কর্মকর্তারা। কিন্তু লুইস জনসন
ইংরেজ মহিলা। আবদুস সালামের যোগ্য স্ত্রীর সম্মান তাঁকেই দেয়া হলো।
নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর আবদুস
সালামের নিজের দেশ পাকিস্তানে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হলো। যখন বলা হলো আবদুস সালাম
প্রথম মুসলিম নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী, অস্বস্তিতে পড়লেন জেনারেল জিয়াউল হকের সরকার।
কোনরকমে একটা সংবর্ধনার আয়োজন করলেন আবদুস সালামের জন্য। রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ দেয়া হয় আবদুস
সালামকে। অনেক সংবাদপত্রে লেখা হলো আবদুস সালামের মত একজন আহমদিয়াকে নোবেল
পুরষ্কার দেয়াটা পশ্চিমাদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র। সরকার অবশ্য বাধ্য হয়ে তাঁর
নামে একটা ডাক-টিকেট ইস্যু করে।
অনেকেই মনে করেন আবদুস সালাম - তৃতীয়
বিশ্বের সাথে প্রথম বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সুযোগের বৈষম্যের প্রতি রেগে ওঠা মানুষ।
সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কারণেও তিনি মাঝে মাঝে রেগে যেতেন। তাঁকে ফর্মালি ‘প্রফেসর সালাম’ বলে ডাকবেন,
নাকি ইনফর্মালি ‘আবদুস’ বলে ডাকবেন তা
নিয়ে সমস্যায় পড়তেন তাঁর পশ্চিমা সহকর্মীরা। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করাতে তিনি
কিছুটা রেগে গিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন “আমার নাম আবদুস
সালাম। মানে আল্লাহ্র চাকর। এখন তুমিই ঠিক করো আমাকে ‘সালাম’ মানে ‘আল্লাহ’ বলে ডাকবে,
নাকি ‘আবদুস’ মানে ‘চাকর’ বলে ডাকবে”।
জীবনের শেষের দিকে পার্কিনসন্স রোগে
আক্রান্ত হন আবদুস সালাম। ১৯৯৬ সালের ২১শে নভেম্বর অক্সফোর্ডের বাড়ীতে মারা যান
আবদুস সালাম। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিজের দেশের মাটিতে দাফন করার
জন্য পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। কারণ তিনি নিজেই তা চেয়েছিলেন। তিনি অন্য দেশের
নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন নি। করলে পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হতো। তাঁকে দাফন
করা হয় রাবওয়াতে।
আহমদিয়াদের নিজেদের শহর- রাবওয়া।
কিন্তু রাব-ওয়া নামটাও গ্রহণযোগ্য নয় সেখানে। রাবওয়া নাম বদলে রাষ্ট্রীয় হুকুমে
নাম রাখা হয়েছে- চেনাব নগর। ঝাং - নিজের গ্রাম- সেখানে কবর দেয়া যায়নি তাঁকে।
কাছেই রাব-ওয়া। তেমন কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানো হয়নি পাকিস্তানের একমাত্র নোবেলবিজয়ী
বিজ্ঞানীকে। তাঁর নিজের গ্রামের মানুষ, যাদের স্কুল ও কলেজের জন্য আবদুস সালাম
তাঁর নোবেল পুরষ্কারের পুরো টাকাই দিয়ে দিয়েছেন- সেই আইন মেনে চলা মানুষ, ধর্ম
মেনে চলা মানুষ দেখতে যান দাফনের সবকিছু আইনমত হয়েছে কিনা ধর্ম-মত হয়েছে কি না।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা
রাষ্ট্রীয় আইন আছে পাকিস্তানে। কী আইন? পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে-
আহমদিয়ারা মুসলমান নন। তাঁরা কোন অবস্থাতেই নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করতে পারবেন
না, কলমা পড়তে পারবেন না। ইসলামের কোন চিহ্নই তারা ব্যবহার করতে পারবেন না। মসজিদে
নামাজ পড়তে পারবেন না। সংবিধানের এই সংশোধনী পাস করেছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো-
যিনি লিবারেল সোশাল ডেমোক্রেট বলে খ্যাত, যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডেকে এনেছিলেন
প্রফেসর আবদুস সালামকে ভারতের সাথে পাল্লা দিয়ে পারমাণবিক প্রকল্প তৈরির কাজে।
ভুট্টোর পরে জেনারেল জিয়াউল হক আরো সব কঠিন আইন পাস করেন আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে।
চেনাব নগরে আবদুস
সালামের সমাধি-ফলকে লেখা ছিল: “Abdus Salam the First Muslim Nobel Laureate”। সমাধি-ফলক
স্থাপনের পর পুলিস সাথে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসে মুসলিম শব্দটা মুছে দেন। তাতে
লাইনটি দাঁড়ালো “Abdus Salam the
First Nobel Laureate”। এর যে কোন অর্থ হয় না তাতে কিছু আসে যায় না আইনের ও
ধর্মের অনুসারীদের।
১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাসে আবদুস
সালামের স্মরণ সভা হয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স-
ট্রিয়েস্টে। সেই সভায় এই কেন্দ্রের নামের সাথে আবদুস সালামের নাম যোগ করা হয়।
১৯৮১ সালের ২
জুলাই ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডিএসসি প্রদান
অনুষ্ঠানে রয়েল সোসাইটির ফেলো প্রফেসর জন হাইম্যান বলেছিলেন ‘আবদুস সালাম
একজন একব্যক্তির বহুজাতিক কর্পোরেশন যিনি মেধাভিত্তিক প্রকৌশল পৃথিবীর অনুন্নত
দেশগুলোতে ব্যস্ততার সাথে সরবরাহ করছেন’। এই ‘এক-ব্যক্তির
বহুজাতিক কর্পোরেশনের’ কাছে তৃতীয় বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞান চিরঋণী থাকবে।
তথ্যসূত্র
১। প্রদীপ
দেব, আবদুস সালাম: নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী, মীরা প্রকাশন, ঢাকা,
২০১৫।
২। Gordon
Fraser, Cosmic Anger Abdus Salam- the first Muslim Nobel
Scientist, Oxford University Press, New York , 2008.
৩। Jagjit
Singh, Abdus Salam A biography, Penguin
Books, Calcutta , 1992.
৪। Abdus
Salam, Ideals and Realities, World Scientific, Edited by
Z Hassan & C. H. Lai , Singapore , 1984.