১৯০৯ সালের শেষের দিকে ইতালির গুগ্লিয়েল্মো মার্কনি আর জার্মানির কার্ল ফার্ডিন্যান্ড ব্রোনকে যখন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো - সারাবিশ্ব জানলো যে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ বাঙালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বেতার তরঙ্গ নিয়ে মৌলিক গবেষণা শুরু করেন মার্কনিরও অনেক আগে এবং ১৮৯৫ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম কৃত্রিম মাইক্রোওয়েভ উৎপাদনে সাফল্য লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের পাশাপাশি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত করেন জগদীশচন্দ্র। উদ্ভিদও যে উদ্দীপনায় সাড়া দেয় - এ তথ্য জগদীশচন্দ্র বসুর আগে কেউ উপলব্ধি করেননি, প্রমাণ করতে পারেননি। বহুমুখী বিজ্ঞানের সাধক জগদীশচন্দ্র বিশ্ববিজ্ঞানীর আসরে যথোপযুক্ত আসন অর্জন করেছিলেন অনেক সাধনা, সংগ্রাম ও পরিশ্রমের বিনিময়ে। ১৯২৭ সালে লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস জগদীশচন্দ্রকে গ্যালিলিও এবং নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী হিসেবে উল্লেখ করেছে। আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে “জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য প্রদান করেছেন, তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।”
জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, ময়মনসিংহে। তাঁর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ও মা বামাসুন্দরী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে। জগদীশচন্দ্রের জন্মের সময় ভগবানচন্দ্র বসু ময়মনসিংহের একটি ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। পরে তিনি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট হয়ে ফরিদপুরে চলে আসেন।
সরকারি চাকরির দৌলতে ভগবানচন্দ্র অনেকটাই সাহেবী আদবকায়দায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের পাঁচ কন্যা ও দুই পুত্রের সবাইকেই উন্নতমানের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় করার ব্যাপারে তিনি খুব সচেষ্ট ছিলেন। তাঁদের কন্যাদের সকলেই উচ্চশিক্ষিত হয়েছিলেন। বড় মেয়ে স্বর্ণপ্রভা বসুর সাথে বিয়ে হয়েছিল অখন্ড ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসুর সাথে। দ্বিতীয় কন্যা লাবণ্যপ্রভা বসু বেথুন কলেজ থেকে পাশ করে বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্য ও শিশু সাহিত্যের প্রথম যুগের লেখিকা ছিলেন। তৃতীয় কন্যা হেমপ্রভা বসু ছিলেন বাঙালী মেয়েদের মধ্যে প্রথম চারজন এম-এ পাশের একজন। বেথুন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন হেমপ্রভা। নারীবাদী হেমপ্রভা সারা জীবন বিয়ে করেননি। ছোট কন্যা সুবর্ণপ্রভা বসুও বেথুন কলেজ থেকে পাশ করেন। আনন্দমোহন বসুর ছোটভাই ডাক্তার মোহিনীমোহন বসুর সাথে বিয়ে হয় সুবর্ণপ্রভার। মোহিনীমোহন ও সুবর্ণপ্রভার ছেলে দেবেন্দ্রমোহন বসু পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন।
ভগবানচন্দ্র ও বামাসুন্দরী দেবীর ছোট ছেলে অল্পবয়সে মারা যাওয়ায় বড় ছেলে জগদীশচন্দ্রের ওপর তাঁদের স্নেহ-ভালবাসা কেন্দ্রীভূত হয়। বামাসুন্দরী দেবী একমাত্র জীবিত পুত্রের সুরক্ষার খাতিরে জগদীশচন্দ্রকে কঠিন শাসন ও নিষেধের ঘেরাটোপের মধ্যে মানুষ করছিলেন। মাতৃস্নেহের বদলে মাতৃ-শাসনটাই বেশি পেয়েছেন জগদীশচন্দ্র। ফলে ছোটবেলা থেকে মায়ের চেয়ে বাবার কাছেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি।
ফরিদপুরে জগদীশচন্দ্রদের বাড়ির কাছাকাছি একটা ইংরেজি স্কুল ছিল। ইংরেজ সাহেব ও উচ্চ-পদের কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ার সুযোগ ছিল সেই স্কুলে। ভগবানচন্দ্র ইচ্ছে করলেই সেই স্কুলে ভর্তি করাতে পারতেন তাঁর ছেলে জগদীশচন্দ্রকে। কিন্তু তিনি চাননি যে তাঁর ছেলে ছোটবেলা থেকেই মানুষে মানুষে বিভেদের চেহারাটা দেখে ফেলুক। তাই তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে বড় হোক। তিনি তাঁর মায়ের নামে একটা বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। জগদীশচন্দ্রের পড়াশোনা শুরু হলো সেই স্কুলে।
জগদীশচন্দ্র তাঁর বাল্যকালের স্কুল সম্পর্কে লিখেছেন - “শৈশব কালে পিতৃদেব আমাকে বাংলা স্কুলে প্রেরণ করেন। তখন সন্তানদিগকে ইংরেজি স্কুলে প্রেরণ আভিজাত্যের লক্ষণ বলিয়া গণ্য হইত। স্কুলের দক্ষিণ দিকে আমার পিতার মুসলমান চাপরাশির পুত্র এবং বাম দিকে এক ধীবরপুত্র আমার সহচর ছিল। তাহাদের নিকট আমি পশুপক্ষী ও জীবজন্তুর বৃত্তান্ত স্তব্ধ হইয়া শুনিতাম। সম্ভবত প্রকৃতির কার্য অনুসন্ধানে আমার অনুরাগ এইসব ঘটনা হইতেই বদ্ধমূল হইয়াছিল।”[1]
১৮৬৯ সালে ভগবানচন্দ্র বদলি হয়ে যান বর্ধমানে। ফরিদপুর ছেড়ে বর্ধমানে চলে যেতে হলো জগদীশচন্দ্রদের সবাইকে। কিন্তু লেখাপড়ার জন্য জগদীশচন্দ্রকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হলো, ভর্তি করানো হলো হেয়ার স্কুলে। কিন্তু প্রথম দিন স্কুলে গিয়েই জগদীশচন্দ্র বুঝলো এখানের পরিবেশ ফরিদপুরের চেয়ে কত আলাদা। সহপাঠীরা জগদীশকে ‘গাঁইয়া’ বলে ক্ষেপাতে লাগলো। সহপাঠীদের সাথে মারপিট করতে হলো তাকে। কিন্তু মারপিট করে জিতেও বেশিদিন টিকে থাকতে পারলো না সেই স্কুলে। তিন মাসের মাথায় হেয়ার স্কুল ছেড়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হতে হলো জগদীশচন্দ্রকে।
১৮৭৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষাবৃত্তি লাভ করলো জগদীশচন্দ্র। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হলো জগদীশ বসুর। সে সময় ফাদার লাঁফো ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্সের নামকরা ফিজিক্স প্রফেসর। প্রবীণ এই অধ্যাপকের আকর্ষণীয় ক্লাস জগদীশ বসুকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করলো। জগদীশচন্দ্র ক্রমশঃ পদার্থবিদ্যার প্রতি গভীর আগ্রহ অনুভব করতে শুরু করলেন।
তবে শুধুমাত্র লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না জগদীশ। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে ঘোড়ায় চড়া, শিকারে যাওয়া, গভীর অরণ্যে অভিযান এসবও ছিল। একবার ছুটির সময় এক বন্ধুর আমন্ত্রণে আসামের জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন জগদীশ। রেলস্টেশন থেকে প্রায় একুশ মাইল পথ রাতের অন্ধকারে পালকিতে চড়ে আসামের জঙ্গলে পৌঁছেন জগদীশ ও তাঁর বন্ধুরা। তারপর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গভীর অরণ্যে শিকারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে বন্য মশার কামড় খেয়ে রাতের বেলায় প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হন জগদীশ। জ্বরের প্রকোপ বাড়ার কারণে কলকাতায় ফিরে আসতে হয় জগদীশকে। অনেকদিন কালাজ্বরে ভুগতে হয় তাঁকে। ফলে এফ-এ পরীক্ষায় খুব একটা ভালো ফলাফল করা সম্ভব হয়নি তাঁর।
১৮৭৭ সালে জগদীশচন্দ্র এফ-এ পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। এরপর ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে সাধারণ মানের বি এ। ইতোমধ্যে তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বর্ধমানে থাকতে বেশ ভালোই ছিলেন ভগবানচন্দ্র। কিন্তু ১৮৭৫ সালে সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে, বহু কর্মক্ষম মানুষ মারা যায়। তাদের পরিবারকে সাহায্য করার লক্ষ্যে ভগবানচন্দ্র নিজের বাড়িতে কামারশালা সহ আরো কিছু কুটিরশিল্পের ব্যবস্থা করে দেন। ছুটির সময় জগদীশচন্দ্রও কলকাতা থেকে বাড়িতে এসে এসব কাজে হাত লাগাতেন। এভাবে নিজের হাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করার নেশা তৈরি হয়ে গিয়েছিল জগদীশের।
১৮৭৫ সালে জগদীশের বাবা বর্ধমান থেকে কাটোয়ায় বদলি হয়ে গেলেন। ১৮৮০ সালে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ হয় সেখানে। নিজে খেয়ে না খেয়ে আর্তজনের সেবা করতে করতে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ভগবানচন্দ্র। ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে একটু সুস্থ হয়েই ছুটলেন আসামে। সেখানে তরাই অঞ্চলে প্রায় দু’হাজার একর জমি কিনে বন্ধু দুর্গামোহন দাস ও জামাতা আনন্দমোহন বসুর সহযোগিতায় ‘ন্যাশনাল টি কোম্পানি’ স্থাপন করে দেশের সর্বপ্রথম চা-শিল্পের সূত্রপাত করেন। নিজের বিষয়-সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে বোম্বে সহ আরো কয়েক জায়গায় তন্তুবায় শিল্প এবং ফরিদপুরে সমবায় ব্যাংক ও কুটির শিল্প স্থাপন করেন। কিন্তু তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি এতই কম ছিল যে এক বছরের মধ্যে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন।
জগদীশচন্দ্র তখন মাত্র বিএ পাশ করেছেন। বাবাকে ঋণমুক্ত করার উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। ঠিক করলেন ইংল্যান্ডে গিয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবেন। চাকরি পেলে আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাধ সাধলেন স্বয়ং ভগবানচন্দ্র। তিনি চান না যে তাঁর ছেলে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করুক। আই-সি-এস অফিসার হবার চেয়ে অনেক ভাল ডাক্তারি পড়া। তাতে স্বাধীনভাবে উপার্জনও করা যায় সাথে আর্তজনের সেবা করাও হয়। বাবা ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চাইলেও বাধ সাধলেন মা। ‘কালাপানি’ পার হয়ে ছেলে বিলেত যাবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বামাসুন্দরী দেবী। কিন্তু জগদীশচন্দ্র যাবেনই। মা-কে বোঝালেন। শেষপর্যন্ত বামাসুন্দরী দেবী রাজী হলেন। শুধু যে রাজী হলেন তা নয়, নিজের গয়না বিক্রি করে ছেলের বিদেশ যাবার টাকা জোগাড় করার ব্যবস্থা করলেন।
লন্ডনে গিয়ে ডাক্তারি পড়তে শুরু করলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু তাঁর শরীর তখন খুব খারাপ। আসামে গিয়ে যে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ সারেনি তখনো। ডাক্তারি পড়ার ধকল তাঁর সইলো না। একটা বছর নষ্ট হলো। পরের বছর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন জগদীশচন্দ্র। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছেন তাঁর জামাইবাবু আনন্দমোহন বসু। ১৮৭০ সালে আনন্দমোহন কেমব্রিজে ভর্তি হয়ে ১৮৭৪ সালে গণিতে ট্রাইপস করে ভারতবর্ষের প্রথম রেংলার হয়েছিলেন। আনন্দমোহন বসুর সুপারিশে ক্রাইস্ট কলেজে জগদীশচন্দ্রের জন্য একটা বৃত্তির ব্যবস্থাও হলো।
১৮৮৪ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে কেমব্রিজ থেকে ন্যাচারাল সায়েন্সে বিএ ডিগ্রি লাভ করলেন জগদীশচন্দ্র। একই বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি ডিগ্রি লাভ করলেন তিনি। লন্ডনে থাকার সময় আনন্দমোহন বসুর সুবাদে পোস্টমাস্টার জেনারেল ফসেটের সাথে সৌহার্দ্য হয় জগদীশচন্দ্রের। ফসেট তখনকার ভাইসরয় লর্ড রিপনের কাছে একটা চিঠি লিখে জগদীশচন্দ্রের হাতে দিলেন। দেশে ফিরে এসে লর্ড রিপনের সাথে দেখা করলেন জগদীশচন্দ্র।
অধ্যাপক ফসেট চিঠিতে লর্ড রিপনকে অনুরোধ করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের জন্য একটা অধ্যাপনার চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। লর্ড রিপন জগদীশচন্দ্রকে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরি দিতে সম্মত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে পাঠালেন শিক্ষাবিভাগের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফ্টের কাছে। লর্ড রিপনের সুপারিশ পেয়ে খুবই বিরক্ত হলেন স্যার ক্রফ্ট। ভারতীয়দের প্রতি তাঁর মনোভাব খুব একটা সম্মানজনক ছিল না। কিন্তু লর্ড রিপনের সুপারিশ তাঁর কাছে আদেশের সমতুল্য। স্যার ক্রফ্ট জগদীশচন্দ্রকে বললেন - “ইম্পেরিয়াল এডুকেশান সার্ভিসে কোন চাকরি খালি নেই, ইচ্ছে করলে প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে পারেন।”
প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসের বেতন ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ। জগদীশচন্দ্র জানতেন যে ইম্পেরিয়াল সার্ভিসে কোন ভারতীয়কে নিয়োগ দেয়া হয় না। ভারতীয়দের জন্য শুধুমাত্র প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসই বরাদ্ধ। স্যার ক্রফ্ট যে ইচ্ছে করেই তাঁকে অপমান করছেন তা বুঝতে পেরে জগদীশচন্দ্র প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে এলেন। কিছুদিন পরে লর্ড রিপন গেজেটে জগদীশচন্দ্রের নাম দেখতে না পেয়ে খবর নিয়ে সব জানলেন। তখন স্যার ক্রফ্ট বাধ্য হয়ে ১৮৮৫ সালে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের অধীনে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে জগদীশচন্দ্র বসুকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মজীবন শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের। কিন্তু প্রথম মাসের বেতন নিতে গিয়ে দেখলেন অস্থায়ী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবার কারণে তিনি বেতন পাচ্ছেন সমমানের পদের জন্য ব্রিটিশরা যত পাচ্ছেন তার এক তৃতীয়াংশ। এই বৈষম্য মেনে নেয়া সম্ভব হলো না জগদীশচন্দ্রের পক্ষে। তিনি বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। পর পর তিন বছর তিনি বিনা বেতনে কাজ করে গেলেন। সংসারে ঋণের বোঝা ক্রমশ ভারী হচ্ছিলো। কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপোষ করার কথা তিনি ভাবতেও পারেননি।
জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্রাবস্থাতেই ১৮৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দ্যা কালটিভেশান অব সায়েন্স।” ভারতীয় জনসমাজকে বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার এই অ্যাসোসিয়েশান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা জাগানোর পক্ষে এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই সময়ের বাঙালি-বিজ্ঞানী হিসেবে যারা স্বীকৃতি লাভ করেছেন তাঁদের অনেকেই এই অ্যাসোসিয়েশানের সঙ্গে কোন না কোন সময়ে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৫ সালে জগদীশ বসু এই অ্যাসোসিয়েশানে এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। কলেজে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তত্ত্ব পড়ান আর নিজের তৈরি যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন পরীক্ষা ছাত্রদের দেখান জগদীশচন্দ্র। অল্পদিনের মধ্যেই শিক্ষক হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি। বউবাজার স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে মা-বাবার সাথে থাকেন তিনি। চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেন না। সংসার চলছিলো মা-বাবার সঞ্চয়ের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেগুলো দিয়ে। কলেজের ছুটির সময় জগদীশচন্দ্র বেরিয়ে পড়তেন দীর্ঘ ভ্রমণে। সাথে থাকতো প্লেট ক্যামেরা। ভারতের সব দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করেছেন তিনি।
১৮৮৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জগদীশচন্দ্রের বিয়ে হয় তাঁর বাবার বন্ধু দুর্গামোহন দাসের দ্বিতীয় কন্যা অবলা দাসের সাথে। বিয়ের সময় অবলা মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তুখোড় ছাত্রী অবলা কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কলকাতায় তখনো মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার অনুমোদন ছিল না। তাই মেয়েকে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন দুর্গামোহন দাস। বিয়ের পর অবলা স্বামীর সহধর্মিনী হতে গিয়ে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরলেন।
অবলা জানেন তাঁর স্বামী কলেজ থেকে বেতন নিচ্ছেন না দু’বছর হয়ে গেলো। সংসার চালাতে হলে খরচ কমাতে হবে। কলকাতার বাসা ছেড়ে দিয়ে তাঁরা চন্দননগরে নদীর ধারে একটা বাড়ি ভাড়া নেন। একটা নৌকা ভাড়া নেয়া হলো। প্রতিদিন সকালে জগদীশচন্দ্র নৌকা বেয়ে নদী পার হয়ে নৈহাটি স্টেশনে আসেন। অবলাও যান তাঁর সাথে। জগদীশচন্দ্র নৈহাটি থেকে ট্রেনে চড়ে শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে কলেজে যান। অবলা নৌকা বেয়ে বাড়ি চলে আসেন। বিকেলে আবার নৌকা নিয়ে নৈহাটি থেকে স্বামীকে আনতে যান। ফেরার পথে নৌকা চালান জগদীশ। এভাবে চললো বছর খানেক। কলেজে সপ্তাহে ছাব্বিশ ঘন্টা ক্লাস নিতে হতো জগদীশচন্দ্রকে। তার ওপর যাওয়া আসার এত ধকল আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিলো না তাঁর পক্ষে। কলকাতায় ফিরে এলেন তাঁরা। উঠলেন মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে জগদীশচন্দ্রের ছোটবোন সুবর্ণপ্রভা’র বাড়িতে।
এদিকে অধ্যাপক হিসেবে জগদীশচন্দ্রের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ১৮৮৮ সালে তাঁকে স্থায়ী পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং আগের তিন বছরের পুরো বেতন এক সাথে দেয়া হয়। পরিবারের আর্থিক সমস্যা মিটে গেলো। এবার তাঁরা একটা বাসা ভাড়া করে অসুস্থ বাবা-মাকে চন্দননগর থেকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। ১৮৯২ সালে জগদীশচন্দ্রের বাবা মারা যান। এর দু’বছর পর তাঁর মা মারা যান।
১৮৯৪ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর ছত্রিশতম জন্মদিনে বিজ্ঞানের সেবায় আত্মনিবেদন করার ঘোষণা দিলেন জগদীশচন্দ্র। এর আগপর্যন্ত তাঁর গবেষণা ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত, কোন গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়নি। ১৮৯৫ সাল থেকে শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের নিরলস গবেষণা।
জগদীশ বসুর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। বিদ্যুৎচৌম্বক তরঙ্গ সম্পর্কিত পদার্থবিদ্যা, জড় ও জীবের সাড়ার ঐক্য, এবং উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কিত গবেষণায় পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ। ১৮৯৫ সালে উইলহেল্ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের পর পদার্থবিজ্ঞানে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পথ খুলে যায়। পরমাণু-বিজ্ঞান, বেতারে বার্তা পরিবহন, তেজষ্ক্রিয়তা, অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত যুগান্তকারী আবিষ্কার এসময় বৈজ্ঞানিক মহলে বিরাট প্রভাব ফেলে। এসময় জগদীশ বসু অদৃশ্য বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মাধ্যমে সংকেত বার্তা প্রেরণের গবেষণায় বেশ সাফল্য লাভ করেন। হেন্রিখ হার্ট্জ, ও গুগ্লিয়েল্মো মার্কনির সমসাময়িক জগদীশ বসুই হলেন বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি ১৮৯৫ সালে সর্বপ্রথম সাফল্যের সাথে মাইক্রোওয়েভ উৎপাদন করেন এবং তার ধর্মাবলীও নির্ধারণ করেন। রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের রিমোট সেন্সিং সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেন জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে। এর ক’দিন পরে জগদীশ বসু কলকাতার টাউন হলে ৭৫ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তুপে আগুন জ্বালাতে সমর্থ হন নিজের উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশানের সাহায্যে।
১৮৯৫ সালে জগদীশচন্দ্রের চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। প্রথম গবেষণাপত্র “On polarization of electric rays by double refracting crystals” প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এর জার্নালে। রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গবেষণাপত্র “On the determination of the index of refraction of sulphur for the electric rays”। ইংল্যান্ডের ‘The Electrician’ জার্নালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় ও চতুর্থ গবেষণাপত্র - “On a new electro-polariscope” ও “On double refraction of the electric ray by a strained dielectric”।
১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক সফরে যান ইউরোপে। সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ তরঙ্গ পরিমাপক যন্ত্রটি। সেপ্টেম্বর মাসে জগদীশচন্দ্র ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বক্তৃতা দিলেন। দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্যার জে জে থমসন, অলিভার লজ, লর্ড কেলভিন প্রমুখ পদার্থবিজ্ঞানী। প্রথম বক্তৃতাতেই জগদীশচন্দ্র পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেন। বক্তৃতা শেষে লর্ড কেলভিন মঞ্চে উঠে জগদীশচন্দ্রকে অভিনন্দন জানান। শুধু তাই নয়, তিনি জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুকে তাঁর গ্লাসগোর বাসভবনে নিমন্ত্রণ করেন। প্রফেসর অলিভার লজও বসু দম্পতির সম্মানে পার্টি দিলেন। জগদীশ বসুর আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা তাঁকে ইংল্যান্ডের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু মাতৃভূমি ত্যাগ করার কথা চিন্তাও করতে পারেন না জগদীশচন্দ্র। তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের প্রস্তাব।
জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতার সাফল্যে পরাধীন ভারতের বাদামী বর্ণের মানুষের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে ইংরেজদের তাচ্ছিল্যবোধ ও অবজ্ঞার ভাব কিছুটা হলেও বদলে গেলো। লন্ডন ইউনিভার্সিটি জগদীশ বসুকে ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান করলো। ১৮৯৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন জগদীশচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের প্রতি’ শিরোনামে কবিতা রচনা করলেন:
“বিজ্ঞান-লক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিমমন্দিরে
দূর সিন্ধুতীরে,
হে বন্ধু, গিয়েছ তুমি; জয়মাল্যখানি
সেথা হতে আনি
দীনহীনা জননীর লজ্জানত-শিরে,
পরায়েছ ধীরে।”
প্রথম ইউরোপ সফর শেষে কলেজে ফিরে এসে একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করা তো দূরে থাক - পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের কাজের জন্য একটা ল্যাবরেটরি দাঁড় করিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু অনুদানের জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখার পর যে উত্তর পেলেন তা এরকম: “ডক্টর বসু এখন মাসে পাঁচশ টাকা মাইনে পান। কোন নেটিভ সরকারি চাকুরের মাসে পাঁচশ টাকায় পোষাচ্ছে না বলাটা নেহায়েৎ বোকামি।”পদে পদে অপমানের উদাহরণ আরো অনেক আছে।
১৮৯৭ সালে কলকাতায় এলেন বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্যাভেন্ডিজ ল্যাবের এই বিখ্যাত অধ্যাপকের কাছে পড়াশোনা করেছেন জগদীশ বসু। কাজেই প্রিয় স্যারকে নিজের কলেজে পেয়ে নিজের গবেষণা, ল্যাব ঘুরিয়ে দেখালেন জগদীশ। এত সীমিত সুযোগের মধ্যেও জগদীশ যে এত কাজ করছেন - দেখে খুব খুশি হলেন লর্ড র্যালে। তিনি জগদীশের অনেক প্রশংসা করলেন কলেজের ইংরেজ প্রিন্সিপালের কাছে। হিতে বিপরীত হলো। লর্ড র্যালে চলে যাবার পর প্রিন্সিপালের কাছ থেকে ‘কারণ-দর্শাও’ নোটিশ পেলেন জগদীশ বসু। কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে “কলেজের অধ্যাপনায় ফাঁকি দিয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিজের ইচ্ছেমত গবেষণা করাটা কেন অপরাধের পর্যায়ে পড়বে না?” কলেজের ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি চুরির অপবাদও সইতে হয়েছে জগদীশ বসুকে। কারণ তিনি কিছু যন্ত্রপাতি ল্যাব থেকে তাঁর অফিস রুমে এনেছিলেন। অথচ ঐ যন্ত্রপাতিগুলো তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন।
কিন্তু কিছুতেই দমে গেলেন না জগদীশচন্দ্র। ইউরোপ সফরের সাফল্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিদ্যুৎ তরঙ্গ নিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে গবেষণা শুরু করলেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় লন্ডনের রয়েল সোসাইটি থেকে। পেপারগুলো হলো: (১) On the selective conductivity exhibited by certain polarizing substances, (২) Index refraction of glass for the electric ray, (৩) On the influence of thickness of air space on total reflection of electric radiation।
১৮৯৯ সালে গবেষণায় তিনি জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণস্পন্দনের অনুরূপ সাড়া প্রত্যক্ষ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন প্রাণীদের মত জড়বস্তুও বাইরের উত্তেজনায় সংবেদনশীল। জড় ও জীবের এই গোপন ঐক্য সম্পর্কে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের কাছে প্রকাশের একটা সুযোগ এসে পড়লো।
১৯০০ সালে প্যারিসে আয়োজিত পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হলেন জগদীশ। আমন্ত্রণ পেলেও জগদীশের যাওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তদানীন্তন শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে এতসব বাধার মুখেও জগদীশ বসুকে সহযোগিতা করেছিলেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্ন। উডবার্নের সহযোগিতায় ১৯০০ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জগদীশ বসু দ্বিতীয় বারের মত ইউরোপে গেলেন। বাংলা ও ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্যারিসে পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জড়বস্তুর সংবেদনশীলতা বিষয়ে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করেন।
প্যারিসে কংগ্রেস অব সায়েন্সে তিনি তাঁর “On the similarity of effect of electrical stimulus on inorganic and living substance” প্রবন্ধে ম্যাগনেটিক আয়রন অক্সাইডের ওপর বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ফেললে সময়ের সঙ্গে তার পরিবাহিতার পরিবর্তনের গ্রাফ দেখিয়ে জীবদেহের মাংসপেশীর সাড়া দেয়ার গ্রাফের সাথে তার সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করেন।
১৯০১ সালের মে মাসে রয়েল ইনস্টিটিউটের শুক্রবারের সান্ধ্য অধিবেশনে জগদীশচন্দ্র “The response of inorganic matter to mechanical and electrical stimulus” শীর্ষক প্রবন্ধে যান্ত্রিক ও তড়িৎ উদ্দীপনার প্রতি উদ্ভিদ ও প্রাণীর ‘সাড়া’ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষণের বর্ণনা দেন। এর আগেই সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং দেশীয় উপাদানে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে জগদীশ বসু একটা বৈদ্যুতিক সংবেনশীল যন্ত্রের মডেল তৈরি করেছিলেন। গ্যালেনা বা লেড সালফাইড ব্যবহার করে যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘গ্যালেনা ডিটেক্টর’। জগদীশচন্দ্র তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলে দেখালেন যে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনায় বস্তুর সাড়া দেওয়া ক্ষীণ হয়ে যায় - যাকে বস্তুর ‘অবসাদ’ বলা যায়। এ অবস্থায় আলো বা বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ প্রয়োগ করলে বস্তু পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে, কিন্তু পরিবাহিতা সহ আরো কিছু বৈশিষ্টের মান কিছুক্ষণ উঠানামা করে। তিনি প্রস্তাব করলেন যে কোন অত্যুজ্জ্বল বস্তু থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলে কিছুক্ষণ যাবৎ যে উজ্জ্বল বস্তুটি একবার দেখা যায় আবার অদৃশ্য হয়ে যায় বলে মনে হয় - তার কারণ চোখের রেটিনার পরিবাহিতা ধর্মের স্পন্দন। জগদীশবসুর আগে এরকম করে কেউ চিন্তা করেননি।
১৯০১ সালে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। সেগুলো যথাক্রমে: (১) On the continuity of effect of light and electric radiation in matter, (২) On the similarities between radiation and mechanical strains, (৩) On the strain theory of photographic action। প্রবন্ধগুলোতে আলোক ও অদৃশ্য বেতার তরঙ্গের সদৃশ ধর্ম নিয়ে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল আলোচিত হয়েছে।
১৯০২ সালে লিনিয়ান সোসাইটিতে বক্তৃতা দেন জগদীশচন্দ্র। জার্নাল অব লিনিয়ান সোসাইটিতে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাপত্র: “Electrical response in ordinary plants under mechanical stimulation”। ‘সাড়া’ মাপার যন্ত্র ‘রেসপন্স রেকর্ডার’ তৈরি করার পদ্ধতি বর্ণনা করলেন জগদীশ। যন্ত্রটা অনেকটা কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মত। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সংবেদনশীলতা মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এই যন্ত্র।
১৯০২ সালের মে মাসে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান সংক্রান্ত শেষ গবেষণাপত্র “On electromotive wave accompanying mechanical disturbance in metals in contact with electrolyte”। এর পর থেকে তাঁর গবেষণা পুরোপুরি উদ্ভিদ ও প্রাণির শারীরবৃত্তীয় ধর্মাবলী পরীক্ষার দিকে মোড় নেয়।
জগদীশ বসুকে আমরা পেলাম পৃথিবীর প্রথম বায়োফিজিসিস্ট হিসেবে। তিনি উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কে গবেষণা করেছেন পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়ে। এই পদ্ধতির বিস্তৃত প্রয়োগে উদ্ভিদের প্রাণচক্র ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা জগদীশ বসুকে চিনলাম উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে।
ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার প্রস্তাব আবারো পেলেন জগদীশবসু। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সুযোগ মানে গবেষণার ব্যাপক সূযোগ হাতে পাওয়া। কিন্তু স্বদেশের সাথে, প্রেসিডেন্সি কলেজের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকা জগদীশ বসুর পক্ষে সম্ভব হলো না। তিনি তাঁর দেশকে হয়তো তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার চেয়েও বেশি ভালবাসতেন।
লন্ডন প্রবাসকালে ১৯০০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯০২ সালের ২০ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লেখা অনেকগুলো চিঠিতে জগদীশ বসু তাঁর প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বার বার তাঁর স্বদেশপ্রেমের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমাদের হৃদয়ের মূল ভারতবর্ষে। যদি সেখানে থাকিয়া কিছু করিতে পারি, তাহা হইলেই জীবন ধন্য হইবে। দেশে ফিরিয়া আসিলে যেসব বাধা পড়িবে তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। যদি আমার অভীষ্ট অপূর্ণ থাকিয়া যায়, তাহাও সহ্য করিব”। রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রকে প্রেরণা জুগিয়েছেন, শুনিয়েছেন অভয়মন্ত্র।
জগদীশচন্দ্র ফিরে এসেছেন ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষেই অধ্যাপনার সাথে সাথে নিজের চেষ্টায় গবেষণা। বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় উদ্ভিদের সাড়া মাপার জন্য নিজের ওয়ার্কশপেই তৈরি করেছেন স্ফিগমোগ্রাফ, ফটোমিটার, ফটোসিন্থেটিক বাব্লার প্রভৃতি যন্ত্র। এ সব যন্ত্রপাতি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাধারণ বাঙালি মিস্ত্রিরাই। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের উপাদান হিসেবে তিনি শজারুর কাঁটা পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।
এতসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জনক জগদীশচন্দ্র বৈজ্ঞানিক-স্বত্ত্ব সংরক্ষণের প্রতি শুধু উদাসীনই ছিলেন না - বলা চলে ঘোর বিরোধী ছিলেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। ১৮৯৫-৯৬ সালে তাঁর মাইক্রোওয়েভ ও কোহেরের প্যাটেন্ট তিনি নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোন আগ্রহ দেখাননি। রয়েল ইনস্টিটিউটের বক্তৃতার পর লন্ডনের ‘দি ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার’ পত্রিকায় জগদীশচন্দ্রের প্রশংসার পাশাপাশি এই মন্তব্যও প্রকাশিত হয়: “Surprise that no secret was at anytime made as to its construction, so that it has been open to all the world to adopt it for practical and possibly money making purposes”।
শুধু তাই নয় লন্ডনের বিখ্যাত টেলিগ্রাফ কোম্পানির মালিক নিজে প্যাটেন্ট ফরম নিয়ে এসে জগদীশচন্দ্রের সাথে দেখা করে অনুরোধ করেছিলেন প্যাটেন্ট করানোর জন্য। তিনি এমনও বলেছিলেন, “There is money in it - let me take our patent for you. You do not know what money you are throwing away. I will only take half share in the profit - I will finance it”।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে জগদীশচন্দ্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন: “এই ক্রোড়পতি, আর কিছু লাভ করিবার জন্য আমার নিকট ভিক্ষুকের ন্যায় আসিয়াছে। বন্ধু, তুমি যদি এ দেশের টাকার উপর মায়া দেখিতে- টাকা, টাকা, কি ভয়ানক সর্বগ্রাসী লোভ। আমি যদি এই যাঁতাকলে একবার পড়ি তাহা হইলে উদ্ধার নাই। দেখ, আমি যে কাজ লইয়া আছি তাহা বাণিজ্যের লাভালাভের উপরে মনে করি। আমার জীবনের দিন কমিয়া আসিতেছে, আমার যাহা বলিবার তাহারও সময় পাই না, আমি অসম্মত হইলাম”।
স্বামী বিবেকানন্দ প্যারিসে জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা শুনেছিলেন। তাঁর শিষ্য নিবেদিতার সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল জগদীশচন্দ্রের। জগদীশচন্দ্রের অনেক গবেষণাপত্র ও বই লেখায় প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেছেন নিবেদিতা। বিবেকানন্দের আরেক আমেরিকান শিষ্য সারা বুলের সাথেও বেশ আন্তরিক সম্পর্ক ছিল জগদীশচন্দ্রের। নিবেদিতা জোর করে সারা বুলকে দিয়ে জগদীশচন্দ্রের গ্যালেনা ডিটেক্টরের প্যাটেন্ট করান। ১৯০৪ সালে আমেরিকার প্যাটেন্ট অফিস থেকে প্যাটেন্ট পেলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু মেয়াদ শেষে ওটা নবায়ন করার প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না জগদীশচন্দ্রের। তাই সেই প্যাটেন্টও রক্ষিত হয়নি।
১৯০২ সালে প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের প্রথম বই “Response in the living and non-living”। ১৯০৩-০৪ সালের মধ্যে উদ্ভিদ দেহে নানা উত্তেজনার সাড়া পরিমাপ করার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করার পাশাপাশি পাঁচটি গবেষণাপত্র রচনা করে প্রকাশের জন্য পাঠান রয়েল সোসাইটিতে। কিন্তু গবেষণাপত্রগুলোতে উল্লেখিত ‘response’ শব্দটি গ্রহণ করতে চাইলেন না রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দাবি করলেন উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ‘response’ এর বদলে ‘reaction’ই হবে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক শব্দ। কিন্তু জগদীশচন্দ্র একমত হলেন না। ফলে তাঁর পাঁচটি পেপারই রয়েল সোসাইটি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। জগদীশচন্দ্র সেগুলো একত্র করে বই আকারে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলেন।
১৯০৩ সালে জগদীশচন্দ্র বসু সি-আই-ই (Companionship of the Indian Empire) উপাধি লাভ করলেন। ১৯০৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় বই “Plan response: as a means of physiological investigations” প্রকাশিত হয় লংম্যান গ্রিন কোম্পানি থেকে। পরের বছর প্রকাশিত হলো তাঁর তৃতীয় গ্রন্থঃ “Comparative Electro-Physiology: A Physico-Physiological Study”।
১৯০৮-০৯ সালে জগদীশচন্দ্র তাঁর তৃতীয় বৈজ্ঞানিক সফরে যান ইউরোপ ও আমেরিকায়। ফিরে আসার পর ১৯১১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ময়মনসিংহ অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞান ও তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংক্রান্ত বক্তৃতা দেন। তিনি ছিলেন মাতৃভাষা ও স্বদেশী ভাবধারার বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ। ১৮৯১ সাল থেকে তিনি বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। ‘মুকুল’, ‘দাসী’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন। ১৯২১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘অব্যক্ত’ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
১৯১১ সালে দিল্লীর দরবারে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে জগদীশচন্দ্রকে সি-এস-আই (Companionship of the star of India) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-এস-সি ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আরো দু’বছর বাড়ানো হয় তাঁর চাকরির মেয়াদ। সে বছর প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ গ্রন্থঃ “Researches on irritability of plants”।
১৯১৪ সালে চতুর্থবার বৈজ্ঞানিক সফরে ইউরোপে যান জগদীশচন্দ্র। রয়েল ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেবার পর রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিনের সভায়ও বক্তৃতা দেন তিনি। সেই সভায় ডারউইনের সহযোগী স্যার লডার ব্রানটন মন্তব্য করেছিলেন যে “বিগত ৫০ বছরের মধ্যে শারীরবৃত্ত একটি নতুন বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে, কিন্তু এ প্রসঙ্গে যতসব পরীক্ষা নিরীক্ষা আমি এ পর্যন্ত দেখেছি তা আপনার আবিষ্কারের প্রদর্শনের সাথে তুলনা করলে অনেক পরিণত এবং স্থূল মনে হয়। আপনার এই প্রদর্শনে আপনি উদ্ভিদদেহের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে প্রাণিদেহের প্রতিক্রিয়ার বিস্ময়কর সাদৃশ্য উদ্ঘাটন করে দেখালেন।”
ইউরোপ থেকে তিনি আমেরিকায় যান। সেখানে তিনি তাঁর আবিষ্কৃত উদ্ভিদের বৃদ্ধিমান যন্ত্র (ক্রেস্কোগ্রাফ) প্রদর্শন করে বক্তৃতা দেন। এ যন্ত্র সম্পর্কে ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ লিখেছিলো - “ডক্টর বসুর ক্রেস্কোগ্রাফ বা বৃদ্ধিমান যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করলে আলাদীনের গল্প এবং তার আশ্চর্য প্রদীপও ম্লান হয়ে যায়। এক ঘন্টার এক চতুর্থাংশেরও কম সময়ের মধ্যে উদ্ভিদদেহে সার, খাদ্যাদি, বৈদ্যুতিক প্রবাহে বিভিন্ন উদ্দীপক বস্তুর ফলাফল সম্পূর্ণরূপে নিরুপণ করা যেতে পারে।”
আমেরিকা থেকে ফেরার পথে জাপান ও শ্রীলংকা সফর করে ১৯১৫ সালের জুন মাসে ভারতে ফিরলেন জগদীশচন্দ্র। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন তিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ইমেরিটাস প্রফেসর পদে নিয়োগ করেন। ১৯১৬ সালে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাদিবসে উদ্বোধনী বক্তৃতা দেন জগদীশচন্দ্র। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘নাইট’ উপাধি দেয় জগদীশচন্দ্রকে। তাঁর নামের আগে যোগ হলো ‘স্যার’।
১৯১৭ সালের তিরিশে নভেম্বর স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর ৫৯তম জন্মদিনে প্রতিষ্ঠিত হলো বসু বিজ্ঞান মন্দির। উদ্বোধনী বক্তৃতার শুরুতেই স্যার জগদীশচন্দ্র ঘোষণা করলেন “আমার স্ত্রী ও আমি এই গবেষণাগারের জন্য সর্বস্ব দান করছি”। জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু নিঃসন্তান ছিলেন।[2] আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের সবকিছু তাঁরা দান করেছিলেন বাঙলার বিজ্ঞান প্রসারের জন্য। জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেই প্রথমে একটি তত্ত্বাবধায়ক কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুধাংশুমোহন বসু, সতীশ রঞ্জন দাস এবং জগদীশচন্দ্র নিজে। কমিটিতে কোন ইংরেজকে রাখা হলো না এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে বিজ্ঞান মন্দিরের কোন ব্যাপারে সরকারের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না।
বিজ্ঞান মন্দির চালানোর জন্য প্রচুর অর্থের দরকার। জগদীশচন্দ্র ঘোষণা করেছেন বিজ্ঞান মন্দিরের কোন গবেষণা-কর্মের প্যাটেন্ট করানো হবে না। সুতরাং গবেষণা থেকে কোন অর্থ উপার্জনের পথ রইলো না। জগদীশচন্দ্র জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেন বিজ্ঞান মন্দিরের জন্য অর্থ সাহায্য করতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজা-মহারাজারা সাড়া দিলেন জগদীশচন্দ্রের আহ্বানে। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য ধারাবাহিক বিজ্ঞান বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন জগদীশচন্দ্র। বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শোনার জন্য টিকেটের দাম ধার্য হলো ২টাকা ও ১ টাকা। প্রদর্শনীর বিনিময়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা প্রদর্শনের ব্যবস্থাও হলো। টিকেটের দাম ধার্য করা হলো ২৪ টাকা, ১২ টাকা, ৮ টাকা ও ৪ টাকা। ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলো এসব কার্যক্রমে।
১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে জগদীশচন্দ্র তাঁর “Life movements in Plants” নামে বৃহৎ বইটি চার খন্ডে প্রকাশ করেন। ১৯১৯-২০ সালে পঞ্চম বৈজ্ঞানিক সফরে আবার ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। ইতোমধ্যে জগদীশচন্দ্র তাঁর আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে প্রাপ্ত ফলাফল প্রকাশ করার জন্য রয়েল সোসাইটিতে পাঠিয়েছিলেন। ১৯২০ সালের শুরুতে স্যার জগদীশচন্দ্রকে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কমিটির কয়েকজন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের ফলাফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ফলে একটি কমিটি গঠন করা হয় যাঁরা জগদীশচন্দ্রের যন্ত্র পরীক্ষা করে দেখলেন।
গাছের বৃদ্ধির হার শামুকের গতির চেয়েও দু’হাজার গুণ কম। একটি সাধারণ গাছ এক সেকেন্ডে এক ইঞ্চির এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ বাড়ে। অর্থাৎ এক লক্ষ সেকেন্ড বা প্রায় আটাশ ঘন্টায় এক ইঞ্চি বাড়ে। এই অতিধীর চলনের গতি লিপিবদ্ধ করার জন্য খুবই সংবেদী যন্ত্রের দরকার যা আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ‘ম্যাগনেটিক ক্রেস্কোগ্রাফ’ যন্ত্রের সাহায্যে গাছের বৃদ্ধিকে দশ লক্ষ গুণ বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে গাছের বৃদ্ধির সূক্ষ্ম তারতম্য হিসেব করা সহজ হয়। ১৯২০ সালের ৪ঠা মে রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা জগদীশচন্দ্রের ক্রেস্কোগ্রাফ পরীক্ষা করে দেখলেন যে জগদীশচন্দ্র তাঁর যন্ত্রের ব্যাপারে কিছুই বাড়িয়ে বলেন নি। এর কয়েকদিন পর ১৩ই মে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য জগদীশচন্দ্রের নাম চূড়ান্ত করা হলো। ১৯২০ সালের ২০শে মে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফেলোশিপ দেয়া হলো স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে।
১৯২২ সাল থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। সেগুলো যথাক্রমে: The ascent of Sap (১৯২২), Physiology of photosynthesis (১৯২৪), Nervous mechanism of plants (১৯২৬), Plan autographs and their revelation (১৯২৭), Motor mechanism of plants (১৯২৭), Collected physical papers (১৯২৭), Wrowth and troic movements of plants (১৯২৯)।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণার সবটাই নিজের হাতে করা। এত যুগান্তকারী আবিষ্কার তিনি করেছেন - তাতে তাঁকে ঘিরে একটা শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক দল গড়ে ওঠার কথা। কিন্তু তা হয়নি। তাঁর সরাসরি কোন গবেষক-ছাত্র ছিল না। দেবেন্দ্রমোহন বসু, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, শিশির মিত্র প্রমুখ জগদীশচন্দ্রকে শিক্ষক হিসেবে সম্মান করতেন। জগদীশচন্দ্র পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসে পড়িয়েছেন এঁদের সবাইকে। কিন্তু কাউকেই নিজের গবেষণার সহযোগী করে নেন নি। ফলে জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তাঁর গবেষণাপত্রগুলোর সবগুলোই ছিল পরীক্ষামূলক ফলাফলের প্রকাশ। পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ভিত্তি আলোচনাকে তিনি এড়িয়ে গেছেন সম্পূর্ণভাবে। ফলে তাঁর গবেষণার মূল বিস্তৃত হয়নি যতটা হওয়া উচিত ছিল।
১৯২৩ সালে ষষ্ঠবারের মত ইউরোপে যান জগদীশচন্দ্র। বক্তৃতা করেন লন্ডন, প্যারিস, প্রাগ, ও কোপেনহেগেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সালের জন্য জাতিসংঘের ‘কমিটি অন ইন্টেলেকচুয়াল কো-অপারেশান’ এর সদস্য মনোনীত হন তিনি। ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত প্রতিবছর তিনি জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভায় যেতেন। এই সময়ে তিনি আইনস্টাইনের সাথে পরিচিত হন। আইনস্টাইন জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন - “তাঁর প্রতিটি আবিষ্কারের জন্য একটা করে বিজয়স্তম্ভ স্থাপিত হওয়া উচিত”।
১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রফেসর অলিভার লজের আমন্ত্রণে লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউজে বক্তৃতা দিলেন জগদীশচন্দ্র। দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড, জর্জ বার্নাড শ, ভারতের প্রাক্তন গভর্নর জেনারেল হার্ডিঞ্জ প্রমুখ। সেই বক্তৃতায় জগদীশচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত ফটোসিন্থেটিক বাবলারের কার্যপদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন। উদ্ভিদ সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যালোক থেকে যে অক্সিজেন তৈরি করে বের করে দেয় তা কাজে লাগিয়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে গাছের জৈব প্রক্রিয়ার পরিমাপ করা হয় এ যন্ত্রের সাহায্যে। চোখের সামনে এ প্রক্রিয়া ঘটতে দেখে বক্তৃতা শেষে জর্জ বার্নাড শ প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন - “এই বিজ্ঞানী শীঘ্রই হয়তে এমন কোন যন্ত্র উদ্ভাবন করবেন যা দিয়ে রাজনীতিবিদদের কার্যক্ষমতা যন্ত্রলিপির সাহায্যে এঁকে দেখাবেন এবং বিভিন্ন কাজে তাঁদের দক্ষতাও নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করতে সক্ষম হবেন।”
১৯২৬ সালে ব্রাসেল্স-এ জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন বেলজিয়ামের রাজা। তিনি জগদীশচন্দ্রকে ‘কমান্ডার অব দি অর্ডার অব লিওপোল্ড’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯২৭ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন জগদীশচন্দ্র। ১৯২৮ সালের ৩০শে নভেম্বর সত্তর বছর পূর্ণ হয় জগদীশচন্দ্রের। সে উপলক্ষে ১লা ডিসেম্বর বসু বিজ্ঞান মন্দিরে সম্বর্ধনা দেয়া হয় জগদীশচন্দ্রকে। বাংলার বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। ভিয়েনার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন তিনি এ বছর। ১৯২৯ সালে ফিনল্যান্ডের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাঁকে সদস্যপদ দেয়। ১৯৩০ সালে জার্মান অ্যাকাডেমি ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ তাঁকে মেম্বারশিপ প্রদান করে। ১৯৩৩ সালে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে জগদীশচন্দ্রকে।
১৯৩৭ সালের ২রা নভেম্বর রায়বাহাদুর এ এন মিত্রের আমন্ত্রণে শীতকালীন অবকাশ যাপনের জন্য বিহারের গিরিডিতে আসেন জগদীশচন্দ্র। তখন তিনি উচ্চরক্তচাপে ভুগছিলেন এবং শরীর ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। পরিকল্পনা ছিল ২৮শে নভেম্বর কলকাতায় ফিরে এসে ৩০শে নভেম্বরের জন্মোৎসব ও বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। ২৩শে নভেম্বর সকাল আটটায় গিরিডিতে রায় বাহাদুর এ এন মিত্রের বাড়িতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান উপমহাদেশের বিজ্ঞান গবেষণার জনক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু।
তথ্যসূত্র
১। প্রদীপ দেব, জগদীশচন্দ্র বসু বিশ্বের প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী, ২০১৬, মীরা প্রকাশন, ঢাকা।
২। সুমন্ত রায়, বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, ২০০১, অনন্যা, ঢাকা।
৩। অনিল আচার্য সম্পাদিত, ব্যক্ত অব্যক্ত জগদীশচন্দ্র বসু, ২০১১, অনুষ্টুপ, কলকাতা।
৪। M. N. Saha, Sir Jagadis Chunder Bose, Biographical Memoirs of Fellows of the Royal Society, 1940, vol. 3, no. 8, pages 2-12.
৫। D. P. Sen Gupta, Jagadish Chandra Bose: The Man and His Time, in Remembering Sir J C Bose, 2009, World
Scientific,Singapore .
Scientific,
৬। Indian National Science Academy, Biographical memories of fellows of the Indian National Science Academy vol. 7,. 1983, Calcutta: INSC.
৭। শ্যামল চক্রবর্তী, বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. ১৯৯৯, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ।
৮। Indian Science Congress Association, The shaping of Indian Science: 1948-1981,. 2003, Calcutta: University Press. pages 702-703.
[2] জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুর একটি মৃত কন্যা-সন্তান হয়েছিল তাঁদের বিয়ের অনেক বছর পর। তারপর তাঁদের আর কোন সন্তান হয়নি।
No comments:
Post a Comment