পৃথিবীর ওপর সূর্যের প্রভাব
মানুষ সূর্যকে দেখছে অনেক অনেক বছর থেকে; উদ্ভব হওয়ার পর থেকেই। তবে
টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর মানুষ সূর্যের বাইরের স্তরের কিছুটা ভালোভাবে দেখতে
পাচ্ছে। ১৬১৩ সালে সর্বপ্রথম টেলিস্কোপ ব্যবহার করে সূর্য পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে
সরাসরি সূর্যের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে তাকানো বিপজ্জনক। আধুনিক টেলিস্কোপগুলোতে
প্রয়োজনীয় ফিল্টার লাগানো থাকে যার মধ্য দিয়ে সূর্যকে নিরাপদে দেখা সম্ভব।
আমাদের সূর্য সঠিক সূর্য
আমাদের সূর্য পৃথিবীর জন্য সঠিক সূর্য। খুব বড়ও নয়, খুব ছোটও নয়। নক্ষত্র
যত বড় হয় তার আয়ুও তত কম হয়। বড় নক্ষত্রে হাইড্রোজেন বেশি থাকে, বেশি হাইড্রোজেন
বেশি ফিউশান ঘটায়। ফলে বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু বড় দ্রুত সেই শক্তি উৎপন্ন
করতে হয়। কারণ বড় নক্ষত্রের বেশি শক্তির দরকার হয় নিজের মাধ্যাকর্ষণ বলকে ঠেকিয়ে
রাখতে। নইলে নিজে নিজে সংকুচিত হয়ে যাবে। অত্যন্ত বড় আকারের সূর্য খুব বেশি হল দশ
কোটি বছর বাঁচতে পারে। তারপর সব শক্তি শেষ হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তত কম সময়ে
জীবনের উদ্ভব হতে পারে না। অন্যদিকে খুব ছোট আকারের নক্ষত্র প্রায় বিশ হাজার কোটি
বছর বাঁচতে পারে। কিন্তু তাদের শক্তি উৎপন্ন হয় খুবই কম। কম শক্তি উৎপন্ন হবার
কারণে জীবনের উদ্ভবের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দিতে পারে না ছোট আকারের
নক্ষত্রগুলো। তাই আমাদের সূর্যই পৃথিবীর জন্য যথোপযুক্ত।
সূর্যের আলোর রঙ বদলায়
পৃথিবী থেকে সূর্যকে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রঙের দেখায়। সকালে
সূর্যোদয় ও সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সময় টকটকে লাল বা কমলা রঙের দেখায়। তার একটু পরে
কমলা থেকে হলুদ তারপর দুপুর আসতে আসতে তপ্ত সাদা। আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে
সূর্যের আলোর মিথষ্ক্রিয়ার ফলে এরকম হয়।
চিত্র: সূর্যের আলোর রঙ বদল
দিনের আকাশ নীল, রাতের
আকাশ কালো
দিনের বেলা আমাদের আকাশ নীল দেখায়। কারণ সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ
করে আসার সময় ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলো বাতাসের ধূলিকণার গায়ে লেগে বিক্ষিপ্ত
হয়। তাই আকাশ নীল দেখায়। রাতের বেলায় আকাশে সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে আকাশ কালো
দেখায়। কারণ কোন আলো বিক্ষিপ্ত হবার সুযোগ পায় না।
চিত্র: দিনের আকাশ নীল
চিত্র: রাতের আকাশ কালো
পৃথিবীর দিন রাত, পৃথিবীর জলবায়ু
পৃথিবীর শক্তির যোগানদাতা সুর্য। সূর্যের আকর্ষণেই পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে
ছিটকে পড়ছে না। সূর্যের মহাকর্ষ বল পৃথিবীকে কক্ষপথে ধরে রাখে। পৃথিবীর দিন রাত
মাস বছর সবই সূর্যকেন্দ্রিক। সূর্য না থাকলে কী হতো? পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে
মহাশূন্যে মিলিয়ে যেতো। দিনরাত নিয়মিত হতো না। কারণ কার চারপাশে ঘুরবে সে? তাছাড়া
অন্য গ্রহের সাথে তার সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনাও ছিল প্রচুর।
চিত্র: পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর গড়ে ২৪ ঘন্টায় একবার ঘুরে, তাই দিন-রাত্রি হয়।
পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য উপযোগী আবহাওয়া তৈরি করে দিয়েছে সূর্য। সূর্য
পৃথিবীকে আলো ও তাপ দেয়। এই তাপ-শক্তির পরিমাণ পৃথিবীর সব জায়গায় সমান নয়। কোন
জায়গায় গরম বেশি হলে সেই জায়গার বাতাস গরম হয়ে হালকা হয়ে যায় এবং উপরের দিকে উঠে
যায়। সেই বাতাসের জায়গা দখল করতে আসে ঠান্ডা জায়গার ঠান্ডা বাতাস। ফলে
বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। এই বায়ুপ্রবাহ পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখে।
পৃথিবীর পানি সূর্যের তাপে গরম হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়। ফলে মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়।
পৃথিবীর আবহাওয়া যে প্রাণধারণ ও প্রাণের বিবর্তনের উপযুক্ত ক্ষেত্র তা সূর্যের
দান।
চিত্র: পৃথিবীর জলবায়ু
পৃথিবীর ঋতু পরিবর্তন হয় সূর্যের প্রভাবে। সূর্যের
সাথে পৃথিবীর অবস্থান ও সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে ঋতুপরিবর্তন ঘটে। যে
সব দেশ পৃথিবীর পেট বরাবর অবস্থিত তাদের ওপর সূর্যের আলো ও তাপ পড়ার কোন পরিবর্তন
হয় না। ফলে সেই সব দেশের আবহাওয়া সারা বছরই প্রায় একই রকম থাকে। মালয়েশিয়া
সিংগাপুর ইত্যাদি দেশে সারা বছরই গ্রীষ্মকাল।
চিত্র: সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণন ও পৃথিবীর ওপর সূর্যের তাপ ও আলোর প্রভাবে
পৃথিবীর ঋতু পরিবর্তন।
সূর্যগ্রহণ
পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ। এই চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে।
পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। কেউ কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। এভাবে
ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ পৃথিবী এবং সুর্যের মাঝখানে এসে পড়ে। তখন চাঁদের ছায়া পৃথিবীর
উপর পড়ে। ফলে পৃথিবীর যেদিকে এই ঘটনা ঘটে সেই অঞ্চল থেকে সূর্যকে দেখা যায় না। যখন
পুরো চাঁদের ছায়ার কারণে সূর্যকে একেবারেই দেখা যায় না তখন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ
হয়েছে বলা হয়। প্রায় ছয় সাত মিনিট থাকতে পারে এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।
চিত্র: সূর্যগ্রহণ
পৃথিবীর শক্তিদাতা সূর্য
সূর্য পৃথিবীকে শক্তি দেয়। সূর্যের আলো ও তাপ থেকে গাছপালা খাদ্য তৈরি করে।
উদ্ভিদ মাটি থেকে মূলের সাহায্যে যে খাদ্য-উপাদান শোষণ করে তা উদ্ভিদের পাতার
ক্লোরোফিল ও সূর্যের আলোর মিথষ্ক্রিয়ায় উদ্ভিদের খাদ্যে পরিণত হয়। এভাবে উদ্ভিদ
বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। অপরদিকে মানুষ
এবং অন্যান্য প্রাণী বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে।
সূর্যের আলো না থাকলে প্রাণ ধারণের এই জরুরি ব্যাপারটাই ঘটতে পারতো না।
চিত্র: সূর্যালোক থেকে উদ্ভিদের খাদ্যগ্রহণ
সৌরশক্তি বা সোলার এনার্জি
পৃথিবীতে এখন জ্বালানি ছাড়া এক মুহূর্তও চলা সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ না থাকলে
আমাদের বেশিরভাগ কাজকর্মই বাধাগ্রস্ত হয়। জ্বালানি হিসেবে সৌরশক্তিকে কাজে লাগানো
শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে থেকেই। মহাশূন্যে এখন অসংখ্য কৃত্রিম উপগ্রহ ভাসছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মহাশূন্য অভিযান চালানোর জন্য মহাকাশে ভাসমান স্টেশন তৈরি
করেছে। আমাদের মোবাইল ফোন, ক্যাবল টেলিভিশন সবকিছুর জন্যই আমাদের স্যাটেলাইটের
সাহায্য নিতে হয়। এই স্যাটেলাইটগুলোর জ্বলানি আমরা সৌরশক্তি কাজে লাগিয়েই পাচ্ছি।
নিচের ছবিতে দেখো - বিখ্যাত হাবল টেলিস্কোপ চালানোর জন্য শক্তি তৈরি হচ্ছে সোলার
প্যানেল থেকে। সোলার প্যানেল সূর্যের আলোকে ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তিতে
রূপান্তরিত করে।
চিত্র: হাবল টেলিস্কোপ
চিত্র: বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকান্ড সোলার প্যানেল
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন সোলার প্যানেলের সাহায্যে সৌরশক্তি
ব্যবহার করা হচ্ছে। সৌরশক্তি ব্যবহার করে গাড়ি চালানো যাচ্ছে। অনেক দেশে বাড়ির
ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করে নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেরাই তৈরি করে ব্যবহার করছে।
উপকারি বন্ধু সূর্য
সূর্য যে আমাদের উপকারি বন্ধু তা তো দেখতেই পাচ্ছো। শীতকালে সূর্যের দেখা
না পেলে আমাদের যে কত কষ্ট হয় তা তো তোমরা জানো। শৈত্যপ্রবাহে মানুষ কষ্ট পায় সূর্য
কুয়াশায় ঢেকে গেলে। নিচের ছবিতে সূর্যের কিছু উপকারের কথা, যা একটু আগেও আলোচনা
করেছি, আবার দেয়া হলো। কারণ উপকারির উপকারের কথা বার বার বলতে হয়।
No comments:
Post a Comment