সূর্যের জন্ম
সূর্যের জন্ম হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৪৭০ কোটি (4.7 বিলিয়ন) বছর আগে। কিন্তু জন্ম হতে সময় লেগেছে প্রায় একশ' কোটি বছর। খুবই
সাদামাটাভাবে সূর্যের জন্মপ্রক্রিয়ার শুরু মহাকাশের নেবুলা থেকে।
গ্যাসের বিশাল মেঘকে
নেবুলা (nebula) বলা হয়। গ্যাস ও
ধূলিকণার মেঘ থেকে নেবুলা সৃষ্টি হয়। দুরকম ভাবে নেবুলার সৃষ্টি হতে পারে।
প্রাথমিকভাবে বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় ধূলিকণা ও গ্যাস থেকে নেবুলা
সৃষ্টি হয়েছিল। আরেক ধরনের নেবুলার সৃষ্টি হয় নক্ষত্রগুলোর বিস্ফোরণের ফলে। প্রাথমিক
উপাদান ও নক্ষত্রগুলোর অবশেষের মিশ্রণেও নেবুলার সৃষ্টি হতে পারে।
গ্যাসের কণার মেঘে ভরা শান্ত নেবুলার পাশ দিয়ে হয়তো একটা গ্যালাক্সি
যাচ্ছিলো। গ্যালাক্সি নেবুলার শান্ত মেঘে আলোড়ন সৃষ্টি করলো, প্রচন্ড ঘূর্ণির
সৃষ্টি হলো। ফলে নেবুলার ভেতরের গ্যাস একটার সাথে আরেকটা মিলেমিশে যেতে শুরু করলো
তাদের মধ্যকার মাধ্যকর্ষণের টানে।
মাধ্যাকর্ষণ বল কী তা
আমরা জানি। স্যার আইজাক নিউটন এই বলের সূত্র দেন। মহাশূন্যে সব গ্যালাক্সি,
নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ - সবকিছু একে অন্যকে একটা আকর্ষণ বলে পরস্পরের দিকে টানছে।
এই আকর্ষণ বলের কারণেই সবকিছু মহাশূন্যে ভেসে থাকতে পারছে। যে কোন দুটো বস্তুর
মধ্যে এই আকর্ষণ বল বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক। অর্থাৎ বস্তুর ভর যত
বেশি হবে এই আকর্ষণ বল তত বাড়বে। আবার এই মহাকর্ষ বল বস্তু দুটোর মধ্যবর্তী
দূরত্বের বর্গফলের বিপরীত অনুপাতিক। অর্থাৎ বস্তু দুটো যদি কাছে আসতে থাকে -
আকর্ষণ বলের পরিমাণ বেড়ে যাবে, আর যদি দূরে সরে যেতে থাকে, আকর্ষণ বলের পরিমাণ
দ্রুত কমতে থাকবে।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সব জায়গায় আছে। নেবুলাতেও আছে। এর ফলে আরো গ্যাস আর
নেবুলা ধূলিকণা আকর্ষণ করতে লাগলো নিজের দিকে। ফলে একটা ছোট ভরের গোল্লা সৃষ্টি
হলো। সেই ভর কাছে টানলো আরো ভর। গোল্লাটা আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করলো। নক্ষত্রের
এই পর্যায়কে প্রোটো-স্টার বা প্রাক-নক্ষত্র বলা চলে।
মাধ্যাকর্ষণের টানে জমাট পদার্থগুলো
পরস্পরের আরো কাছে আসতে শুরু করার পর একদিকে ভর যেমন বাড়তে শুরু করলো আবার
অন্যদিকে ঘনত্বও বাড়তে শুরু করলো। ঘনত্ব বাড়ার ফলে মাধ্যাকর্ষণ আরো বেড়ে গেলো। ফলে
বস্তুগুলো আরো বস্তুকে কাছে টানতে শুরু করলো। পরস্পরের আরো কাছে আসার ফলে
বস্তুগুলো ক্রমাগত ঘন হবার ফলে চাপ বেড়ে গেলো। চাপ বাড়ার ফলে কেন্দ্রে তাপ বাড়তে
শুরু করলো। গ্যাসপিন্ডের কেন্দ্রের তাপ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে এক সময় প্রায় এক কোটি
ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গেল। এক কোটি ডিগ্রিতে পৌঁছার পর গ্যাসপিন্ডে নিউক্লিয়ার
ফিউশান শুরু হলো।
নিউক্লিয়ার ফিউশান হলো এক ধরনের
নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। একটু পরে আমরা নিউক্লিয়ার ফিউশান সম্পর্কে আবার আলোচনা করবো।
নিউক্লিয়ার ফিউশানের ফলে অসীম শক্তির
উৎপত্তি ঘটতে শুরু করলো এবং এভাবেই আমাদের সূর্যের জন্ম হলো। জন্ম হবার পরও নেবুলার যেসব গ্যাস তখনো অবশিষ্ট থাকে সৌরঝড় তাদের উড়িয়ে
নিয়ে যায়।
যখন প্রোটোস্টার সৃষ্টি হবার পর আর বড়
হতে পারে না বা কেন্দ্রের তাপমাত্রা নিউক্লিয়ার ফিউশান ঘটানোর মত অবস্থায় যেতে
ব্যর্থ হয়, তখন প্রোটোস্টারগুলো স্টারে পরিণত হতে পারে না। এগুলোকে তখন ব্রাউন
ডোয়ার্ফ বা বাদামি বামন বলা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে ডোয়ার্ফ বা বামন শব্দটি ব্যবহার
করা হয় আকারে ছোট বোঝানোর জন্য। বাদামি বামনগুলো সাধারণত সূর্যের ভরের এক শতাংশ
থেকে এক দশমাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এই অবস্থাতেও তারা কিছুটা তাপ উৎপন্ন করতে পারে,
কিন্তু উজ্জ্বলতা পায় না। বাদামি বামনগুলোর গড় তাপমাত্রা ১৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস
পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রায় এক ট্রিলিয়ন (এক লক্ষ কোটি) বাদামি
বামন আছে।
একটা প্রোটোস্টার থেকে স্টার মানে নক্ষত্রের উদ্ভব ঘটতে এক কোটি বছর থেকে
একশো কোটি বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আমাদের সূর্যের জন্ম হয়েছে ঠিক এইভাবে -
খুবই ধীর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। নিচের চিত্রে তার বিভিন্ন ধাপগুলো দেয়া হলো।
চিত্র: সূর্যের জন্মের বিভিন্ন ধাপ
সূর্যের জন্ম-প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে অপেক্ষাকৃত ছোট-পিন্ডও তৈরি হয়েছে
অনেকগুলো - যা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। যাদেরকে আমরা সূর্যের গ্রহ হিসেবে জানি।
আমাদের পৃথিবীও সূর্যের আটটি গ্রহের একটি। গ্রহগুলোর মধ্যে অনেকেরই আবার উপগ্রহ
আছে। চাঁদ আমাদের পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ।
বুধ, শুক্র, পৃথিবী,
মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন এই আটটি গ্রহ এবং তাদের উপগ্রহ নিয়ে
সৌরজগৎ। প্লুটো নামে এক সময় একটা গ্রহ ছিল বলে ধরা হতো। কিন্তু প্লুটো এখন আর গ্রহ
নয়। কেন নয় সেটা আরেকদিন বলবো।
সূর্যকে কেন্দ্র করে
ঘুরছে গ্রহ ও উপগ্রহগুলো। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সূর্য গ্রহগুলোকে নিজের দিকে
টানছে। গ্রহগুলোও সূর্যকে টানছে তাদের নিজেদের দিকে। এই পারস্পরিক আকর্ষণ বলের
প্রভাবে মহাশূন্যে এরা ভেসে আছে এবং অবিরাম ঘুরছে। এদের আয়তন মানুষের তুলনায় এত
বেশি যে ঘূর্ণনের ব্যাপারটা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না বা সরাসরি বুঝতে পারি না।
এই গ্রহগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র পৃথিবীতে প্রাণ ও প্রাণিদের বিচরণ। গ্রহগুলো
সম্পর্কে আমরা অন্য কোনদিন বিস্তারিত আলোচনা করবো। সূর্যের সাথে তার অন্যান্য
গ্রহগুলোর পারস্পরিক দূরত্বের একটা চিত্র নিচে দেয়া হলো।
চিত্র: সূর্যের সাথে অন্যান্য গ্রহগুলোর দূরত্ব
সূর্যের আকার, আয়তন, ভর
রাতের আকাশের কোটি কোটি তারাকে আমরা ছোট ছোট বিন্দুর মতো দেখি। আমাদের কাছ
থেকে লক্ষ কোটি কিলোমিটার দূরে আছে বলেই এত ছোট মনে হয় তাদের। সূর্য আমাদের সবচেয়ে
কাছের তারা। তাই এটাকে আমরা তুলনামূলকভাবে অনেক বড় আকারে দেখতে পাই। অনেক বেশি
উজ্জ্বলও মনে হয় সেই কারণে। বিজ্ঞানীরা অনেক হিসেব কষে বের করেছেন সূর্যের আকার,
আয়তন ও ভরের পরিমাপ।
সূর্যের ব্যাস তের লক্ষ
নব্বই হাজার কিলোমিটার। পৃথিবীর ব্যাসের চেয়ে ১০৮ গুণ বেশি। তার মানে ১০৮টি
পৃথিবীকে পাশাপাশি বসালে সূর্যের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ছুঁতে পারবে।
সূর্যের যে আয়তন তাতে ৯১৫টা বৃহস্পতি গ্রহ আর বারো লক্ষটা
পৃথিবীকে ভরে ফেলা যায় সেখানে। সূর্যকে বাদ
দিয়ে সৌরজগতের যা কিছু আছে সবকিছু একত্র করলে যে আয়তন হবে সূর্য নিজে তার চেয়ে ৭৫০
গুণ বড়।
সূর্য পৃথিবীর চেয়ে তিন লাখ তেত্রিশ হাজার গুণ
ভারী। সৌরজগতের শতকরা ৯৮ ভাগ ভর
এই সূর্যই ধারণ করে। সূর্যের সাথে অন্যান্য গ্রহগুলোর আয়তনের একটা তুলনামূলক চিত্র
নিচে দেয়া হলো।
চিত্র: সূর্যের সাথে তার গ্রহগুলোর পারস্পরিক আয়তনের তুলনা
___________
No comments:
Post a Comment