সূর্যের আলো
আমাদের পৃথিবীতে যে
আলো সূর্য থেকে এসে পৌঁছায় তা কিন্তু তৈরি হয়েছে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে। সুর্যের
কেন্দ্রে যে আলো উৎপন্ন হয় তা সেখান থেকে বেরোতে এত সময় নেয়। তার কারণ কী? মনে করো
তুমি কোন একটা কনসার্টে গিয়ে একেবারে স্টেজের কাছে বসেছো যেখানে প্রচন্ড ভিড়। এই
ভিড় ঠেলে তুমি যদি স্টেডিয়ামের বাইরে যেতে চাও অনেক বেশি সময় তোমার লাগবে। তুমি তো
ভীড়ের মধ্যে দৌড়ে আসতে পারবে না। কারণ দৌড়োতে চাইলেও দেখবে ভিড়ের ঠেলায় আবার সামনে
থেকে পেছন দিকে ফিরে যাচ্ছো। আলোর কণা ফোটনগুলোও সেই একই রকম সমস্যায় পড়ে সূর্যের
কেন্দ্র থেকে বের হতে গিয়ে। প্রচুর পারমাণবিক মিথষ্ক্রিয়া করতে করতে কেন্দ্র থেকে
আলোকমণ্ডল পার হতে লেগে যায় লক্ষ বছর।
তবে আলো একবার সূর্যের আলোকমন্ডলে পৌঁছাতে
পারলে বাধাহীনভাবে আলোর বেগে চলে যায় যা সেকেন্ডে তিরিশ কোটি মিটার বা তিন লক্ষ
কিলোমিটার। সূর্যের বাইরের স্তর থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় প্রায় আট মিনিট ২৬
সেকেন্ড। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকে আলোর বেগ দিয়ে ভাগ করে তোমরা এই সময় হিসেব
করে নিতে পারো।
সূর্যের আলোর অনেক রঙ। আমরা সূর্যের আলোর যে
অংশটা খালি চোখে দেখতে পাই তাকে আলোর বর্ণালী বলা হয়। ১৬৬৬ সালে স্যার আইজাক নিউটন
প্রিজমের সাহায্যে সূর্যের আলো থেকে সাতটি রঙ আলাদা করেছিলেন সর্বপ্রথম। বেগুনি,
নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল; এই সাতটি রঙ নিয়ে সূর্যের দৃশ্যমান আলোর
বর্ণালী।
দৃশ্যমান
আলোর মধ্যে বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম এবং তার শক্তি সবচেয়ে বেশি। আবার
লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি এবং শক্তি সবচেয়ে কম। তোমরা জানো তরঙ্গের শক্তি
ও তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক পরস্পর বিপরীতানুপাতিক। অর্থাৎ একটির মান বাড়লে অন্যটির
মান কমে যায়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর কম্পাঙ্কও একে অপরের বিপ্রতীপ। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য
বেশি হলে কম্পাঙ্ক কম হয় এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলে কম্পাঙ্ক বেশি হয়। যে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক
বেশি তাদের শক্তিও বেশি। পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে এর কারণ
ব্যাখ্যা করা যায়।
সূর্য
থেকে যে শক্তি বেরিয়ে আসে তা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ আকারে আসে। এই তরঙ্গের বর্ণালীর খুব
ছোট একটা অংশ আমরা দেখতে পাই। দৃশ্যমান আলোর বাইরে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের বিশাল
বিস্তৃতির কোন অংশই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।
বেগুনি আলোর চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর শক্তি অনেক
বেশি। এই রশ্মিগুলোকে আমরা অতিবেগুনি রশ্মি বলে জানি। আমাদের শরীরে অতিবেগুনি
রশ্মি প্রবেশ করলে খুবই ক্ষতি হয়। এগুলো এক ধরনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। অতিরিক্ত অতিবেহুনি
রশ্মি শরীরের ত্বকে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
দৃশ্যমান
আলোর কম্পাঙ্কের চেয়ে বেশি কম্পাঙ্কের তরঙ্গ এত বেশি শক্তিশালী যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে
এদের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। এক্স-রে, গামা-রে ইত্যাদি খুবই উচ্চ কম্পাঙ্কের
তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। চিকিৎসায় যে এক্স-রে ও গামা-রে ব্যবহার করা হয় তা যন্ত্র থেকে
উৎপন্ন করা হয়। সূর্য থেকে যে এক্স-রে ও গামা-রে বের হয়ে পৃথিবীর দিকে আসে তাদের
বেশিরভাগই পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডল শোষণ করে নেয়। নইলে পৃথিবীতে আমাদের বাস করা
বিপজ্জনক হয়ে উঠতো।
বেতার
তরঙ্গ দৃশ্যমান আলোর চেয়ে অনেক কম শক্তিশালী এবং এদের কম্পাঙ্কও অনেক কম। তাই এদের
তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বড়। বেতার তরঙ্গ জ্যোতির্বিদ্যায় খুব কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়।
কারণ দৃশ্যমান আলো যেখানে মেঘ বা ধূলিকণা ভেদ করে যেতে পারে না সেখানে বেতার তরঙ্গ সহজেই সবকিছু ভেদ করে চলে যেতে পারে। রেডিও
টেলিভিশন ইত্যাদি মাধ্যমে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়।
উপরের ছবিতে
তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বিভিন্ন অংশের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক দেয়া হলো।
______________
No comments:
Post a Comment