far যা
ফারজানা
গাড়ি
থেকে নেমে এক দৌড়ে ক্লাসে এসে দেখি সেকেন্ড বেঞ্চের এক কোণায় বসে মাথা নিচু করে কিছু
লিখছে নয়ন। চোখ তুলে একবার আমার দিকে তাকিয়েই নিজের লেখার দিকে মন দিলো সে। একটু
খটকা লাগলো আমার। কী হলো আজ নয়নের?
ব্যাগটা পিঠ থেকে নামিয়ে হাঁপাতে
হাঁপাতে নয়নের পাশে বসতেই সে গম্ভীরভাবে বললো, "ফারজা"।
ফারজানার বদলে ফারজা বলে ডাকছে ভেবে
আমি বেশ খুশি হয়ে গেলাম। হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, "তুই কি ফেসবুকে
আমাদের কালচারাল ফাংশানের ছবিগুলো দেখেছিস?"
"ফারজা বললাম না?"
"বুঝেছি তো ভাই। তুই আমাকে
সংক্ষিপ্ত নামে ডাকছিস।"
"জ্বি না, আমি তোকে সংক্ষিপ্ত
নামে ডাকছি না। এতো আহ্লাদ দেখাবার মতো কিছু হয়নি। আমি তোকে বলছি ফার যা - এফ এ আর
- ফার মানে তফাৎ যা - দূর হট্।"
"কেন? আমি আবার কী করলাম?"
"তুই কিছু করিসনি। কে করেছে একটু
পরে টের পাবি। এখন - চুপ থাক্ আর ফার যা - মিনিমাম টু ফিট।"
দুই ফুট সরে গেলে আর দেখতে হবে ন।
স্বাতী বা চিত্রা এসেই সেখানে বসে যাবে। যদিও আমরা চারজন সবসময় এক বেঞ্চেই বসি,
তবু নয়নের পাশে বসতেই আমার বেশি ভালো লাগে। আমি কয়েক ইঞ্চি সরে বসলাম। এখন নয়নের
সাথে কথা বলার চেষ্টা করা মানে আরো কিছু ধমক খাওয়া। হয়তো ফার-ফার-ফার যা বলে অন্য
বেঞ্চে সরিয়ে দেবে।
ফার যা - ইন্টারেস্টিং। শব্দের এরকম
উদ্ভট বিভাজন নয়নের পক্ষেই সম্ভব। তবে আমার ডাকনাম ফারজা হলেও ক্ষতি ছিলো না। আমার
একটা ডাকনাম নেই - এই দুঃখ আমার কোনদিনই যাবে না। নয়ন, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা -
সবার কী সুন্দর সুন্দর নাম। কেমন গ্রহ-নক্ষত্রের নামে নাম। এমনকি সবিতা ম্যাডামের
নামটাও কী সুন্দর, কবিতার সাথে মিলে যায়। কেবল আমার নামটাই ছন্দহীন - ফারজানা।
এই সেদিনও আমার ডাকনাম না থাকার শোকে সান্ত্বনা
দেবার চেষ্টা করেছিল আমার বন্ধুরা। স্বাতী বলেছিল, "ডাকনাম নেই বলে এত মন
খারাপ করিস কেন? অনেকেরই তো ডাকনাম থাকে না। যেমন ধর - আবদুর রহমান, বা সুরুজ আলি
বা হালিমা ম্যাডাম।"
সেটা ঠিক। অনেকেরই ডাকনাম থাকে না।
যেমন আমাদের আফতাব স্যারেরও মনে হয় কোন ডাক নাম নেই। তাঁকে নিশ্চয়ই কেউ "হেই
আফু কেমন আছিস?" বা "হেই আফতা, এদিকে আয়" বলে না। কী জানি হয়তো
বলতেও পারে। কিন্তু অর্ক আর আবদুর রহিম তো তাঁকে 'সূর্যমামা' বলে ডাকতে শুরু
করেছে। তাদের দেখাদেখি আরো অনেকেই 'সূর্যমামা' শব্দটি ব্যবহার করে। অবশ্য সরাসরি
না। আফতাব স্যার হয়তো জানেনই না যে তাঁকে কেউ কেউ সুর্যমামা বলে ডাকে। সে যাই হোক,
কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাচ্ছি। ডাকনাম প্রসঙ্গে যা বলছিলাম। সেদিন চিত্রা যোগ
করেছিল, "আমাদের সুব্রতেরও কিন্তু কোন ডাকনাম নেই।"
"বুদ্ধিজীবীদের ডাকনাম না থাকলেও
চলে।" - নয়নের কথায় আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিলাম।
নয়ন আমার একটা ডাকনাম দেয়ার চেষ্টা
করেছিল।
"চল্ তোর একটা ডাকনামের
ব্যবস্থা করা যাক। ফারজানা থেকে ফারা হতে পারে।"
"কিন্তু ফারাহ তো আছে একজন। সে
তো বলবে আমি তাকে নকল করেছি।"
"ফারাহ না হলে তোকে ফারু বলেও
ডাকা যায়।"
"ওটা তো ফারুক আর ফারুকী স্যারের
ডাকনাম হয়ে গেলো।"
"ফাজা বা ফানা চলবে? কিংবা ফাজু
বা ফাজি?"
"খারাপ না, কিন্তু কেমন যেন
ফাজিল ফাজিল লাগে না?"
"তাহলে তোর নাম হোক জানা।
ফারজানা থেকে জানা।"
"ধুর! জানা কোন নাম হলো? ফারজানা
থেকে জানা হলে আমার আপুর নাম তাহলে ফারহানা থেকে হানা?"
"ঠিক আছে। তোর ডাকনাম লাগবে না। তোর
নামের একটা সম্মানজনক অর্থ আছে। তা বদলানোর দরকার নেই।"
সম্মানজনক অর্থ আমার নামের? আমার
নামের কোন অর্থ আছে বলেই তো মনে হয় না। আমার নাম রাখা হয়েছে আপুর নামের সাথে
মিলিয়ে - ফারহানার বোন ফারজানা। "আমার নামের অর্থ কী?"- জিজ্ঞেস
করেছিলাম মাকে। মা বলেছিল - "সব নামের অর্থ লাগে না। নাম হলো নাম। আমেরিকায়
এমন সব নাম দেখা যায় - যেগুলোর অর্থ বড়ই হাস্যকর। যেমন - রবার্ট ড্রিংকওয়াটার।
খাবার পানি। এই যে তোদের আইনস্টাইন - তার নামের অর্থ কী? নামের আসলে কোন অর্থ হয়
না। মানুষটা বড় হলে তার নাম এমনিতেই অর্থবহ হয়ে যায়।"
সুযোগ পেলেই আমার মা লম্বা লেকচার
দিয়ে দেয়। কলেজের লেকচারার বলেই হয়তো এমন। আর যে কোন লেকচারেই কোন না কোনভাবে
আমেরিকার প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। কারণ তার ছোটভাই যে আমেরিকায় থাকে তা মানুষকে শোনাতে
না পারলে তার ভাত হজম হয় না।
যাই হোক, নয়ন আমার নামের
কী সম্মানজনক অর্থ বের করেছে জানার উৎসাহ দেখাতেই সে বলেছিলো, "ফার মানে দূর,
আর জানা মানে জানা। ফারজানা মানে হলো দূর জানা - অর্থাৎ তুই অনেকদূর পর্যন্ত
জানিস।"
চিত্রা বললো, "অর্থাৎ তুই হলি
আমাদের সবার চেয়ে জ্ঞানী, সবজান্তা না হলেও দূরজান্তা।"
কথাটা সে বিদ্রুপ করে বলেছে কি না
জানি না। তবে আমার খুব একটা খারাপ লাগেনি। একটু জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে থাকতে
খারাপ লাগে না। সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষায় আমি সেকেন্ড হয়েছি। সুব্রত আমার চেয়ে
পাঁচ নম্বর বেশি পেয়ে আবারো ফার্স্ট হয়ে গেছে। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী সুব্রত ক্লাস
মনিটর, আর আমি সেকেন্ড মনিটর। নয়ন অবশ্য বলে সেকেন্ড-ক্লাস মনিটর। আমি রাগ করি না।
আমার যে রাগ একেবারেই নেই - তা নয়, কিন্তু নয়নের ওপর রাগ করতে পারি না। শুধু আমি
নই - কেউই নয়নের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ। সে এত কথা বলে যে তার সাথে
কেউ রাগ করে কথা না বলে থাকবে সে উপায়ও থাকে না। কিন্তু আজ সে গম্ভীর হয়ে এত কী
লিখছে? একটু দেখার চেষ্টা করতেই ধমক দিলো নয়ন, "ফার যা ফারজানা। কথা শুনতে
পাস না?"
ক্লাসে অনেকেই এসে গেছে
ইতোমধ্যে। সবাই ব্যাগ রেখে মাঠে অথবা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। পেছনে তাকিয়ে
দেখলাম লাস্ট বেঞ্চে বসে অর্ক আর আবদুর রহিম কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। অর্কের
সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। শয়তানটা নিশ্চয়ই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। আমাদের
চার-বন্ধুর গ্রুপের নাম দিয়েছে সে চতুরঙ্গ গ্রুপ। নামটা সে কখন দিয়েছে জানি না।
আমরা প্রথম শুনি গত বছর - মানে ক্লাস সিক্সের শেষের দিকে। শোনার পর বেশ রাগ হলো
আমাদের। চতুরঙ্গ মানে কী? গ্রুপের জন্য অপমানজনক কিছু হতে পারে। অর্ক দিন-রাত বই
নিয়ে থাকে, জানেও অনেক। কিন্তু আমাদের গ্রুপেরও একটা মানসম্মান আছে। গতবছর গ্রুপের
লিডার ছিলাম আমি। আমাদের গ্রুপের লিডারশিপ একেক বছর একেক জনের হাতে থাকে। নামের ইংরেজি
আদ্যাক্ষর অনুসারে চিত্রার নাম সবার আগে আসে। ক্লাস ফাইভে আমরা গ্রুপটা তৈরি
করেছি। চিত্রা ছিল সে বছর গ্রুপ-লিডার। তারপর আমি হয়েছি। গ্রুপের সম্মান রক্ষার
দায়িত্ব ছিল আমার। অর্ককে শিক্ষা দেয়া দরকার। কিন্তু আমি একটু নরম আর ভীতু টাইপের।
তাই কঠিন কাজগুলো সব আমার হয়ে নয়নই করে দেয়। নয়ন সোজা গিয়ে ধরেছিল অর্ককে,
"শুনলাম তুই নাকি আমাদের গ্রুপের নাম দিয়েছিস চতুরঙ্গ?"
"তোকে কে বললো?"
"আমাকে কে বললো সেটা বড় কথা নয়।
তুই নাম দিয়েছিস কি না?"
"হ্যাঁ, দিয়েছি।"
"কেন দিয়েছিস? তুই কি ভেবেছিস
আমরা এখানে চার জনে মিলে রঙ্গ তামাশা করি?"
"তোরা যে রঙ্গ-তামাশা করিস সেটা
সত্য। কিন্তু তার সাথে চতুরঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই।"
"মানে?"
"চতুরঙ্গ শব্দের অর্থ হলো - হাতি-ঘোড়া-রথ
ও পদাতিক এই চার শাখা বিশিষ্ট সৈন্যদল। তোদের গ্রুপকে একটা সেনাবাহিনীর সাথে তুলনা
করে আমি তোদের সম্মানিত করেছি। অথচ তোরা তার অর্থই জানিস না। শুধু হাতির স্যুপ
খেলে তো হয় না নয়ন, একটু পড়াশোনাও করতে হয়।"
সেদিন খুব অপমান লেগেছিল আমাদের সবার।
নয়নের গলার জোর একটু বেশি বলে একদিন অর্ক জিজ্ঞেস করেছিল, "তোকে দেখলে তো মনে
হয় বাতাসে উড়ে যাবি। এত জোরে কথা বলার শক্তি পাস কোত্থেকে?"
নয়ন সাথে সাথেই বলেছিল, "আমি যে
হাতির স্যুপ খাই তা জানিস না?"
সেদিনের সেই কথাটা যে অর্ক এভাবে
ফিরিয়ে দেবে আমরা ভাবতেও পারিনি। অর্ককে তাই আমরা খুব একটা ঘাটাই না। সেও অবশ্য
গায়ে পড়ে কিছু বলতে আসে না। তার সব বন্ধুত্ব আবদুর রহিমের সাথে। এখনো তাদের দু'জনের
হা-হা-হি-হি শোনা যাচ্ছে। তারা কি ফেসবুকে আমাদের ফাংশানের ছবিগুলো দেখেছে?
নিশ্চয়ই দেখেছে। অনু আপু যখন দেখেছে অর্কও নিশ্চয় দেখেছে। অনু আপু অর্কের বড় বোন -
আমার আপুর বেস্টফ্রেন্ড। আপুর ফেসবুক পেজ থেকেই আমি দেখেছি আমাদের কালচারাল
ফাংশানের ছবিগুলো। আমাদের চারবন্ধুর তিনটা গ্রুপ ছবি পোস্ট করা হয়েছে আমাদের
স্কুলের পেজে। অনেকগুলো লাইক পড়েছে ছবিগুলোতে।
আমাদের কালচারাল ফাংশান হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার
সন্ধ্যায়। তার আগপর্যন্ত গত তিন সপ্তাহ ধরে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। যদিও কোন
ক্লাস হয়নি, প্রতিদিন ক্লাসে আসতে হয়েছে। ফার্স্ট পিরিয়ডে রোল কল করার পর আমাদের
ক্লাস টিচার আফতাব স্যার হাসিমুখে বলতেন - "আজকেও পড়া হবে না - লম্ফঝম্প হবে।
যাও রেডি হও।"
রেডি হওয়া মানে ক্লাসের বাইরে
বারান্দায় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পিটি স্যারের হুইসেলের অপেক্ষা করা। আমাদের পিটি
স্যারের নাম ভোলানাথ মন্ডল। নাম ভোলানাথ হলেও তিনি কোনদিনই কিছু ভুলে যান বলে মনে
হয় না। অ্যাসেম্বলি চলাকালিন স্যার হয়তো সোমবারে কাউকে দেখেছেন গন্ডগোল করতে।
কয়েকদিন পর হয়তো সে নিজেই ভুলে গেছে কী করেছে। কিন্তু ভোলানাথ স্যার হঠাৎ
বৃহস্পতিবারের অ্যাসেম্বলিতে তাকে ধরে বলবেন, "মাঠের চারদিকে চার পাক দৌড়ে আয়।"
সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে হয়তো বলবে,
"কেন স্যার?"
"সোমবার সকালে জাতীয় সঙ্গীতের
সময় হেসেছিলি।"
আমাদের খেলার মাঠের চারদিকে একবার
দৌড়ে আসতেই প্রাণ বেরিয়ে যাবার অবস্থা হয় - সেখানে চারবার দৌড়ে আসা যে কত বড়
শাস্তি তা তো আর বলতে হচ্ছে না। কিন্তু ভোলানাথ স্যারের দয়ামায়া নেই। চারবার দৌড়ে
ফিরে আসার পর তাকে আবার বলবেন, "যা, আরেক রাউন্ড দৌড়ে আয়।"
"কেন স্যার?"
"প্রশ্ন করেছিস - সেজন্য।"
ক্লাসের ছেলেমেয়েরা গন্ডগোল করলে অনেক
সময় ক্লাস মনিটরদেরও ধমক দেন ভোলানাথ স্যার। তাই সুব্রত ক্লাসে শৃঙ্খলা বজায় রাখার
জন্য হাতে স্কেল নিয়ে শাসায় সবাইকে। কিন্তু কোনদিন সুব্রত স্কুলে না এলে আমার
অবস্থা বারোটা বেজে যায়। মনিটর হিসেবে কেউ আমাকে মানতেই চায় না। কাউকে ধমক দেয়া তো
দূরের কথা - জোরে কথাও বলতে পারি না আমি।
যাই হোক। গত তিন সপ্তাহ ফার্স্ট
পিরিয়ডে রোল কলের পর বারান্দায় আমরা ছেলেরা ও মেয়েরা আলাদা আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে
যাই। সুব্রত স্কেল হাতে ছেলেদের লাইনের শৃঙ্খলা রক্ষা করে, আর আমি মেয়েদের লাইনের
সামনে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দেখি সবাই প্রচুর হাসাহাসি করছে, জোরে জোরে কথা বলছে।
ক্লাস টিচার হিসেবে সেই সময় আফতাব স্যারের উচিত সবাইকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া।
সবিতা ম্যাডাম হলে ধমক দিয়ে কান ফাটিয়ে ফেলতেন। কিন্তু আফতাব স্যার ধমক দেয়া তো
দূরের কথা নিজেই হা হা করে হাসতে থাকেন সবার সাথে। পান খাওয়া লাল দাঁতগুলি দেখাতে
তাঁর একটুও লজ্জা লাগে না। আদর্শ শিক্ষক হবার মতো কোন গাম্ভীর্য নেই আফতাব স্যারের।
নয়ন বলে, "স্যারের মনে হয় চল্লিশটা দাঁত, যার মধ্যে তিরিশটা সর্বদা
দৃশ্যমান।"
এক সপ্তাহ মাঠে অনুশীলন, বিভিন্ন
স্পোর্টস ইভেন্টের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি হলো। পরের দুই সপ্তাহে চললো সাংস্কৃতিক
প্রতিযোগিতা ও বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। তখনো একই ভাবে ফার্স্ট
পিরিয়ডের পরে আমরা মাঠের বদলে অডিটোরিয়ামে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে আমরা চারজন সবুজ
শাড়ি পরে সলিল চৌধুরির একটা গান গেয়েছি। সবাই বলছে খুব ভালো হয়েছে গানটা।
"কী রে ক্লাসে এসে ঘুমাচ্ছিস
কেন? রাতে ঘুমাসনি?"
স্বাতী আর চিত্রা এসে গেছে।
"আরে ঘুমাচ্ছি না। নয়ন আমাকে চুপ
করে থাকতে বলেছে - তাই চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম।"
"আর ভাবতে হবে না। কী বলছিলি
বল।" নয়ন একটা লাল খাতা বন্ধ করে তার ব্যাগে রাখতে রাখতে বললো।
"ওটা কীসের খাতা? নতুন বলে মনে
হচ্ছে।"
"ওটা হলো মেজাজ খারাপের খাতা।
মেজাজ খারাপ হওয়া ঘটনাগুলি লিখে রাখছি।"
"আজ কি তোর মেজাজ খারাপ?"
"খুব"
"কী কারণে?"
"তোদের সূর্যমামার কারণে।"
"কী করেছেন তিনি?"
"আসুক আজকে ক্লাসে। দেখতে
পাবি।"
আমাদের কৌতূহল বাড়তে শুরু করলো।
কিন্তু অ্যাসেম্বলির ঘন্টা বেজে যাওয়াতে আর কথা বলা গেলো না।
অ্যাসেম্বলিতে দেখলাম আজ অনেক স্যার-ম্যাডামই
আসেননি। তার মানে আজ আমাদের ক্লাস রুটিন এলোমেলো হয়ে যাবে। ক্লাসে ফেরার জন্য লাইন
ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় চিত্রা বললো, "আজ মনে হয় সূর্যমামা আসেননি।"
"অবশ্যই এসেছেন। আমাদের বাসেই
এসেছেন।" নয়ন কিছুতেই নিচুস্বরে কথা বলতে পারে না।
"তাহলে দেখলাম না যে
অ্যাসেম্বলিতে?"
"কোথাও লুকিয়ে আছেন মনে হয়। হা
হা হা।"
খেলার মাঠ থেকে ক্লাসরুম
পর্যন্ত আসতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায়। স্কুলটা চারতলা। আমাদের ক্লাস তিন তলায়
একেবারে শেষ প্রান্তে। স্যার-ম্যাডামরা ক্লাসে আসার আগের সময়টাতে সুব্রত স্কেল
হাতে নিয়ে তার কর্তৃত্ব দেখায়। সুব্রতের ভাষায় "গন্ডগোলকারীদের দেখিবামাত্র
নাম লেখার নির্দেশ আছে" এবং সে সেই নির্দেশ পালন করতে করতে মনে হয় গত এক
মাসের মধ্যেই একটা খাতা শেষ করে ফেলেছে। সবিতা ম্যাডাম যখন ক্লাসটিচার ছিলেন তখন
সুব্রতের খাতাটাকে আমরা কিছুটা হলেও ভয় করতাম। কারণ সবিতা ম্যাডাম সুব্রতের দেয়া
লিস্ট ধরে ধরে শাস্তি দিতেন। ক্লাসে শারীরিক শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ না হলে মনে হয়
সবিতা ম্যাডাম আমাদের চামড়া ছাড়িয়ে নিতেন। কিন্তু তা করতে না পেরে এমন জোরে ধমক
দিতেন যে তাতে মারের চেয়ে কোন অংশে কম ব্যথা লাগতো না। কিন্তু আফতাব স্যার ক্লাসটিচার
হবার পর শাস্তি বা ধমকের ব্যাপারটা কেমন যেন ভুলে যেতে বসেছি আমরা। প্রথম যেদিন
সুব্রত খাতাটা স্যারকে দিয়েছিল সেদিনের কথা মনে হলে আমার এখনো হাসি পায়।
সেদিন ছিল আফতাব স্যারের দ্বিতীয় দিন
আমাদের ক্লাসে। রোল কল শেষ হতে না হতেই সুব্রত তার খাতা খুলে স্যারের সামনে রাখলো।
"স্যার"
"এটা কী?"
"এটা স্যার গন্ডগোলকারীদের
লিস্ট।"
"গন্ডগোলকারীদের লিস্ট?"
স্যার মনে হলো খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
"নুসরাত নীলিমা, আবদুর রহিম,
সুলতানা ইয়াসমিন, শাকিল আহমেদ, শুভ্র দাস ... এ তো দেখছি অনেক নাম। এরা সবাই
গন্ডগোলকারী?"
"হ্যাঁ স্যার।"
"এরা কী করেছে?"
"গন্ডগোল করেছে।"
"কী জাতীয় গন্ডগোল?"
"কথা বলেছে স্যার। হৈ চৈ
করেছে।"
"আমাকে কী করতে হবে?"
"শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে
স্যার।"
"কথা বলা হৈ চৈ করা এগুলো কি
অপরাধের পর্যায়ে পড়ে? কথা বলার অপরাধে শাস্তি দিতে হলে তো স্বৈরাচারী হয়ে যেতে হয়।
খাতার প্রত্যেক পৃষ্ঠাতেই তো নুসরাত নীলিমার নাম। এ তো দেখি নিত্য-গন্ডগোলকারী।
নুসরাত নীলিমা -"
নয়ন উঠে দাঁড়ালো। স্যার
হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি এত কী গন্ডগোল করেছো যে তোমার নাম এতবার করে
লেখা হয়েছে?"
নয়ন হাসিমুখে বললো,
"স্যার, আমি কথা বলেছি, মানে ক্লাসে
আমার বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করেছি।"
আফতাব স্যার নয়নের কথা শুনে হা হা করে
হেসে উঠলেন। সুব্রতের মুখ কালো হয়ে গেলো। ক্লাসের অনেকেই স্যারের হাসির সাথে যোগ
দিলো। সুব্রত বললো, "ও স্যার আমাকে মনিটর হিসেবে একটুও মানতে চায় না। বলে
আমিই নাকি সবচেয়ে বড় গন্ডগোলকারী।"
"সেটা কীভাবে? নুসরাত নীলিমা,
তুমি বলেছো এই কথা?"
"হ্যাঁ স্যার, বলেছি।"
"তুমি কীভাবে তোমার সিদ্ধান্তে
উপনিত হলে যে সুব্রত হলো সবচেয়ে বড় গন্ডগোলকারী? তোমার কথার যুক্তি কী?"
"স্যার যুক্তি আছে। গন্ড মানে তো
গাল। সে হিসেবে গন্ডগোল করা মানে গাল গোল করে রাখা। অর্থাৎ গাল ফুলিয়ে রাখা।
আমাদের ক্লাসে তার মতো সবসময় গাল ফুলিয়ে রাখা গোমড়ামুখো আর একজনও নেই। আপনিই দেখেন
স্যার। তাহলে সেই তো সবচেয়ে বড় গন্ডগোলকারী।"
নয়নের কথা শুনে আফতাব
স্যারসহ সারা ক্লাস এত জোরে হেসে উঠেছিলাম যে পাশের ক্লাস থেকে হালিমা ম্যাডাম বের
হয়ে এসে উঁকি দিয়ে দেখে গিয়েছিলেন কী হচ্ছে ক্লাসে। সুব্রতের গন্ড সেদিন আরো গোল
হয়ে গিয়েছিল।
আমরা ভেবেছিলাম সেদিনের পর সুব্রত আর
কারো নাম লিখবে না। কিন্তু সে কঠিন কর্তব্যপরায়ণ। দিনের পর দিন নিষ্ঠার সাথে
গন্ডগোলকারীদের নাম লিখেই চলেছে তার খাতায়। আজও লিখছে।
ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজার প্রায় পাঁচ
মিনিট পরেও স্যার আসছেন না দেখে আমরা অধৈর্য হয়ে উঠছি। আফতাব স্যার কোনদিন এত দেরি
করেন না। স্যার-ম্যাডামদের অফিস দোতলায়। দোতলা থেকে তিন তলায় উঠে ক্লাসে আসতে দুই
মিনিটের বেশি লাগে না। চিত্রা বললো, "স্যার মনে হয় আজ কলেজেই আসেননি।"
"বললাম না আমাদের বাসে এসেছেন
তিনি" - রেগে গেলো নয়ন। "আমার মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছেন তিনি আজ।"
"কেন? কী করেছেন তিনি?"
"স্যার তোকে কিছু বলেছেন? বকা
দিয়েছেন নাকি?"
আমাদের কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেলো আফতাব
স্যার ঢুকছেন ক্লাসে। স্যারের গায়ে একটা সাদা অ্যাপ্রন। কালো লিকলিকে শরীরে ঢোলা সাদা
অ্যাপ্রন - স্যারকে একটা কাকতাড়ুয়ার মতো লাগছে।
আমাদের স্কুলের সব
স্যার-ম্যাডামরা সাদা অ্যাপ্রন পরে পড়াতে আসেন। আফতাব স্যার নতুন এসেছেন বলে এতদিন
অ্যাপ্রন ছিল না। আজকেই মনে হয় নতুন অ্যাপ্রনটা পেয়েছেন। শুধু তাই নয়। স্যার চুল
কাটিয়েছেন - কিন্তু এমন ছোট করে কাটিয়েছেন যে স্যারকে দেখতে নতুন রিক্রুট করা
এয়ারম্যানদের মতো লাগছে। সারা ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো স্যারকে দেখে।
"কী খবর তোমাদের? কেমন আছো তোমরা
সবাই?" বলতে বলতে সবার দিকে তাকালেন তিনি।
পেছনের বেঞ্চ থেকে অর্ক বললো,
"আজ আপনাকে অন্যরকম লাগছে স্যার।"
"কী রকম?"
"ভূতের মতো লাগছে স্যার। হা হা
হা।" থার্ড বেঞ্চ থেকে ভাস্করের উত্তর। বেফাঁস মন্তব্য করার ব্যাপারে
ভাস্করের রেকর্ড খুব খারাপ।
"ভূত বলে যে কিছু নেই তা তো
তোমার জানার কথা ভাস্কর। সুতরাং ভূতের মতো লাগতেই পারে না। হা হা হা।"
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়
স্যার আমাদের একটু বেশি লাই দিয়ে ফেলছেন। আমরা স্যারের সাথে যে এরকম করি এটা শুনে
তো আমার আপু বেশ অবাক হয়ে গেছে। কলেজের ক্লাসে নাকি তারা স্যারের সাথে এরকম কিছু
করার কথা চিন্তাও করতে পারে না।
নাম ডাকার খাতা খুললেন আফতাব স্যার। বললেন,
"এবার দেখা যাক তোমরা কে কে এসেছো ক্লাসে। সুব্রত শুরু করো।"
সুব্রতকে শুরু করতে বলা মানে ভেবো না
যে সুব্রতই আমাদের ক্লাসে রোলকল করে। ক্লাসে স্যারের নাম ডাকার পদ্ধতিটা একটু
ভিন্ন। স্যার এটা চালু করেছেন আমাদের ক্লাসটিচার হবার কয়েকদিন পর থেকে। শুরুতে কয়েকদিন
রোল কল করেছিলেন স্বাভাবিক ভাবে - মানে যেরকম সবাই করেন। যেমন, স্যার ডাকলেন,
"রোল নাম্বার ওয়ান", সুব্রত বললো, "ইয়েস স্যার"। স্যার তখন
খাতায় সুব্রতের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিলেন। তারপর ডাকলেন, "টু", আমি
বললাম, "ইয়েস স্যার"। স্যার টিক চিহ্ন দিলেন ইত্যাদি।
সেদিন স্যার রোল কল শেষে ঘড়ি দেখে
বললেন, "তোমাদের পঁয়ষট্টি জনের রোল কল করতে আট মিনিট চলে গেলো। চল্লিশ
মিনিটের ক্লাস থেকে আট মিনিট চলে যাওয়া মানে শতকরা কত ভাগ সময় চলে যাওয়া?"
আমরা শুরুতে বুঝতেই পারিনি যে এটা
একটা অংক এবং স্যার আমাদের কাছ থেকে উত্তর আশা করছেন। আমরা কোন উত্তর না দিয়ে বসে
রইলাম। স্যার বললেন, "বলো। হিসেব করে বলো। শতকরা হিসেবের অংক তোমরা
করোনি?"
"করেছি স্যার।"
"তাহলে?"
আমরা দ্রুত খাতা খুলে
লিখতে শুরু করলাম। কার আগে কে করতে পারে - ক্লাসে অলিখিত একটা প্রতিযোগিতা সবসময়
থাকে। আমি 'আট মিনিট চল্লিশ মিনিটের চল্লিশ ভাগের আট সমান পাঁচ ভাগের এক ভাগ'
পর্যন্ত লিখতে না লিখতেই পেছনের বেঞ্চ থেকে অর্ক আর সামনের বেঞ্চ থেকে সুব্রত
প্রায় একই সময়ে চিৎকার করে উঠলো - "স্যার শতকরা বিশ ভাগ।"
স্যার বললেন, "শতকরা বিশ ভাগ সময়
কিন্তু অনেক সময়। আমাদের চেষ্টা করতে হবে কোনভাবে রোলকলের সময়টাকে কমানো যায় কি
না।"
পরের দিন রোলকলের আগে স্যার বুঝিয়ে
দিলেন নতুন পদ্ধতি। "তোমরা নিজেরা ধারাবাহিকভাবে নিজেদের রোল নং নিজেরা বলে
যাবে একের পর এক, আর আমি নিঃশব্দে খাতায় মার্ক করতে থাকবো। তাহলে ৬৫ জনের ৬৫ বার
"ইয়েস স্যার" বলার জন্য যে সময়টা লাগে সেই সময়টা বেচে যাবে। আট মিনিটের
জায়গায় আমরা পুরো কাজটা চার মিনিটে সেরে ফেলতে পারবো। আর তোমাদের যদি অভ্যাস হয়ে
যায়, তাহলে দেখবে দুই মিনিটেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।"
শুরুতে ব্যাপারটা পুরোপুরি আয়ত্বে
আসতে একটু সময় লাগলো। পরে আমরা ধরে ফেললাম পদ্ধতিটা। এখন আমরা বেশ দ্রুতই আমাদের
রোল-কল পর্বটা সেরে ফেলতে পারি। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর ... এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ
থেমে গেলে বুঝতে হবে সেই রোল নম্বর অনুপস্থিত। তখন স্যার সেই নম্বরটা একবার ডাকেন।
কোন সাড়া না পেলে পরের নম্বর থেকে আবার চলতে থাকে। ব্যাপারটাতে আমাদের সবার
অংশগ্রহণ থাকে বলে আমরা খুব মজা পাই তাতে। আজ তাই সুব্রতকে শুরু করতে বলার পর
সুব্রত "ওয়ান", আমি "টু", ইয়াসমিন "থ্রি", চিত্রা
"ফোর", এভাবে বেশ দ্রুতই আগাচ্ছিল। কিন্তু "সিক্স" এর পর নয়ন
"সেভেন" বলার জন্য দাঁড়ানোর আগেই ক্লাসের দরজায় এসে দাঁড়ালেন পিওন সুরুজ
মিয়া। বললেন, "স্যার আসি?"
"আসেন আসেন। কী ব্যাপার?"
"অ্যাডজাস্টমেন্ট স্যার"
ক্লাসে ঢুকে একটা মোটা খাতা স্যারের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন সুরুজ মিয়া।
স্যার খাতার কয়েক জায়গায় সাইন করে
খাতাটা ফিরিয়ে দেবার পর সুরুজ মিয়া চলে গেলেন। স্যার বললেন, "আজ মনে হচ্ছে
তোমাদের সাথেই আমার কাটবে পর পর চার ঘন্টা।"
শুনে ক্লাসের সবাই
খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমাদের স্কুলে কোন স্যার/ম্যাডাম না এলে অন্য
স্যার/ম্যাডাম এসে সেই ক্লাসটা নেন। ওটাকে অ্যাডজাস্টমেন্ট ক্লাস বলে। তাতে অবশ্য
আমাদের খুব একটা লাভ হয় না। বেশিরভাগ সময়েই স্যার/ম্যাডামরা অ্যাডজাস্টমেন্ট
ক্লাসে এসে কিছু পড়ান না। আমাদের পড়তে বলে বা কিছু লিখতে বলে স্যার/ম্যাডাম হয়তো
নিজের কাজ করেন, অথবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালাতে থাকেন। কিন্তু আফতাব
স্যারের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন। স্যার সময় পেলেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে
আলোচনা করেন। আমরা ইতোমধ্যেই 'প্রজেক্ট সূর্যমামা' শেষ করে ফেলেছি। এতদিনে নতুন
প্রজেক্ট শুরু হয়ে যেতো - কিন্তু গত তিন সপ্তাহ খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজের জন্য
তা করা যায়নি।
"ঠিক আছে। এখন চুপ করো। রোল কল
পর্ব শেষ হোক আগে।"
মিনিট দুয়েকের মধ্যে রোলকল শেষ হতে না
হতেই সুব্রত তার বিখ্যাত খাতা মেলে ধরলো স্যারের সামনে। আর স্যার যথারীতি হাসিমুখে
খাতায় লেখা নামগুলির দিকে একটু তাকিয়ে খাতাটা বন্ধ করে ফেললেন। সুব্রত নিজের সিটে
ফিরে যাবার আগেই নয়ন তার লাল খাতাটা বের করে স্যারের টেবিলে রেখে এলো।
"এটা আবার কী?"
"অভিযোগ খাতা।"
"গন্ডগোল খাতার পর আবার অভিযোগ
খাতা? কীসের অভিযোগ? কার বিরুদ্ধে অভিযোগ?" বলতে বলতে খাতাটা খুললেন স্যার।
নয়ন আজ সকালে ক্লাস শুরুর আগে এই
খাতাটাতেই লিখছিলো যা আমাদের কাউকে দেখতে দেয়নি। খুব কৌতুহ্ল হচ্ছে আমার খাতায় কী
লেখা আছে জানতে।
"আপনার বিরুদ্ধে এক নম্বর
অভিযোগ" - স্যার নয়নের 'অভিযোগ খাতা' পড়তে শুরু করেছেন - "আপনি বাংলার
বিশিষ্ট শিল্পীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। আপনার বিরুদ্ধে দুই নম্বর অভিযোগ
- আপনি সঙ্গীত সম্পর্কে কিছু না জেনেই রুঢ় মন্তব্য করেছেন। আপনার বিরুদ্ধে তিন নম্বর
অভিযোগ - ...। আরে এ যে দেখছি অনেক অভিযোগ - দশ বারো পৃষ্ঠা লম্বা অভিযোগপত্র।
পড়তে গেলে তো অনেক সময় লাগবে। এগুলো কে লিখেছ?"
"আমি লিখেছি স্যার।" নয়নের
সরাসরি উত্তর।
"কী হয়েছে একটু বুঝিয়ে বল দেখি
নুসরাত নীলিমা।"
স্যার মনে হয় আমাদের ডাকনাম জানেন না।
আসল নামেই ডাকেন সবাইকে। তাতে আমার বেশ ভালোই লাগে। আমার ডাকনাম না থাকার কষ্টটা
তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূর হয়ে যায়।
"এগুলো সব আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ
স্যার।"
"আমার বিরুদ্ধে? আমি বাংলার
বিশিষ্ট শিল্পীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছি?"
"হ্যাঁ স্যার, করেছেন।"
"কখন করলাম? কীভাবে করলাম কিছুই
তো বুঝতে পারছি না।" স্যারকে কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে।
"একবার নয়, আপনি
দুইবার করেছেন। প্রথমবার করেছেন গত বৃহস্পতিবার রাত আটটা বিশ মিনিটে, দ্বিতীয়বার
করেছেন আজ সকাল সাতটায়।"
"গত বৃহস্পতিবার
সন্ধ্যায় তো তোমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। একটু বিস্তারিত বলতো কী হয়েছে।
যেভাবে কঠিন সব অভিযোগ করছো আমার বিরুদ্ধে।"
আমার হঠাৎ খুব টেনশান হচ্ছে। নয়ন কী
বলছে এসব? স্যার কেন বাংলার শিল্পীকে অশ্রদ্ধা করতে যাবেন?
"স্যার, বৃহস্পতিবার আমাদের
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আপনি দেখেছেন। আমরা চারজন মিলে একটা গান গেয়েছি আপনি সেটাও
দেখেছেন।"
"হ্যাঁ, তোমরা চারজন লাল শাড়ি
পরে একটা গান গেয়েছো। আমি দেখেছি।"
স্বাতী বলে উঠলো, "লাল শাড়ি না
স্যার, আমরা সবুজ শাড়ি পরেছিলাম।"
"সবুজ শাড়ি? লাল ছিল না?"
"লাল পাড়, সবুজ শাড়ি ছিল। কথা
সেটা নয়। আমি যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের গানটা কেমন হয়েছে - আপনি বললেন,
গানটা ভুল হয়েছে। আজ সকালে বাসে আসার সময় আপনি নিজে থেকে আবার বলেছেন, "তোমরা
যে গানটা গেয়েছো সেটা একটা ভুল গান।""
নয়নের কথা শুনে স্যারের মুখের হাসি
ফিরে এলো। হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, "গানটা আসলেই ভুল। গানের সুর তাল ইত্যাদি
আমি জানি না। কিন্তু কথাগুলো অর্থহীন এবং যুক্তিহীন। তাই বলেছি ভুল গান।"
এবার আমারও রাগ হচ্ছে। বলতে চেষ্টা
করলাম, "ওটা স্যার সলিল চৌধুরির গান।"
"সলিল চৌধুরি কে?"
"আপনি সলিল চৌধুরিকে চেনেন না
স্যার? বাংলার এত বড় সুরকার গীতিকার শিল্পীকে আপনি না চিনেই বলে দিলেন যে তাঁর গান
ভুল?"
"দেখো, কোন ব্যক্তির - সে যেই
হোন - ভুল ধরিয়ে দিলে ব্যক্তিকে অসম্মান করা হয় না। তোমরা অ্যারিসটটলের নাম
শুনেছো?"
"শুনেছি স্যার। তিনি গ্রিসের
বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন।"
"তিনি বলতেন পৃথিবী নড়াচড়া করে
না, এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। আর সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। তিনি কি ঠিক কথা
বলেছিলেন?"
"না স্যার।"
"গ্রহ নক্ষত্রের ব্যাপারে তার
তত্ত্ব তাহলে কী ছিল?"
"ভুল ছিল।"
"টলেমির কথা তোমরা
জানো। সূর্য সম্পর্কে পড়াশোনা করার সময় তোমরা জেনেছো যে টলেমি তত্ত্ব দিয়েছিলেন -
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরে। হাজার বছরেরও বেশি সময়
ধরে পৃথিবীর মানুষ তা বিশ্বাস করেছে। এখন কি তোমরা তা টলেমির তত্ত্বে বিশ্বাস
করো?"
"না স্যার, টলেমির তত্ত্ব ভুল
ছিল।"
"অ্যারিসটটল বা টলেমি খুবই
সম্মানিত এবং বিখ্যাত মানুষ। তাদের ভুল তত্ত্বকে ভুল বললে কি তাদের অপমান করা
হয়?"
"না, হয় না স্যার।"
"আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্স
সম্পর্কে যা বলেছেন তার সবকিছুই কিন্তু ঠিক না। সেখানে আইনস্টাইনের ভুল যারা ধরিয়ে
দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিন্তু অভিযোগ করেনি যে তারা আইনস্টাইনকে অপমান করেছেন।"
স্যারের যুক্তি আমরা বুঝতে পারছি।
কিন্তু সলিল চৌধুরির গানের সাথে আইনস্টাইনের তত্ত্বের কী সম্পর্ক তা এখনো বুঝতে
পারছি না।
"অথচ দেখো গ্যালিলিও যখন
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রমাণ সহ বললেন যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে - তখন
চার্চের পাদ্রিরা ক্ষেপে গেলেন এই বলে যে তাতে নাকি তাদের এতদিনের বিশ্বাসকে অপমান
করা হয়েছে। ক্ষেপে গিয়ে গায়ের জোরে তারা গ্যালিলিওকে শাস্তি দিয়েছে। কোন বৈজ্ঞানিক
তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হলে কোন বিজ্ঞানীই কখনো সেটাকে ব্যক্তিগত অপমান বলে মনে করেন
না। অথচ শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী-ধর্মগুরু সবাই তাদের কাজের সামান্যতম
সমালোচনাকেও ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে দেখেন। তাদের অনুসারীরা প্রতিক্রিয়া দেখায় আরো
সাংঘাতিকভাবে।"
স্যারের কথাগুলো কেমন যেন জটিল হয়ে
যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে আমার। স্যার যদিও হাসিমুখে আস্তে আস্তে বলছেন, কিন্তু সারা
ক্লাসে কেমন যেন একটা সিরিয়াস ভাব চলে এসেছে।
"আমি তোমাদের সবসময় উৎসাহ দিচ্ছি
যেন সবকিছু নিয়েই তোমরা নিজের মতো করে ভাবতে পারো। কেউ কিছু বললেই তা যেন তোমরা
যাচাই না করে মেনে না নাও। ভুল কিন্তু যে কেউ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা
সত্যজিৎ রায় বা আইজাক নিউটন বা প্রধানমন্ত্রী বা প্রিন্সিপাল বা আমি বা তুমি -
আমরা কেউই সমালোচনার উর্ধ্বে নই। আমার কথার বিরুদ্ধে যে তোমরা অভিযোগ করছো আজ তাতে
আমি খুব খুশি হয়েছি।"
তাই তো। আফতাব স্যারের সাথে আমরা
যেভাবে তর্ক করছি হুজুর স্যারের সাথে করলে এতক্ষণে বেয়াদবির অভিযোগে প্রিন্সিপালের
অফিসে ডাক পড়তো আমাদের সবার।
"আমাদের হাতে আজ চার পিরিয়ড সময়
আছে। পড়াশোনার আগে তোমাদের অভিযোগগুলি খন্ডানো যাক। সলিল চৌধুরির যে গানটা তোমরা
গেয়েছো তার শুরুর কথাগুলি বলো দেখি।"
চিত্রা আমাদের গানের
মূল-শিল্পী, আমরা বাকি তিনজন তার সহশিল্পী। সে বললো, "এই রোখো, পৃথিবীর
গাড়িটা থামাও, আমি নেমে যাবো। আমার টিকেট কাটা অনেক দূরের, এ গাড়ি যাবে না, আমি
অন্য গাড়ি নেবো।।"
"থ্যাংক ইউ। কেউ
বলতে পারবে এই কথাগুলির মধ্যে কী কী ভুল আছে?"
আমরা সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবতে
লাগলাম। এখানে কী ভুল আছে? পৃথিবীর গাড়ি? থামতে বলা? নেমে যাওয়া? অন্য গাড়িতে ওঠা?
কোন্টা ভুল?
নয়ন মুখ খুললো সবার আগে। "কোন
ভুল নেই স্যার। ভুল পথে গেলে গাড়ি থামানোই যায়। অন্য গাড়িতে ওঠাও যায়।"
হঠাৎ আমার মনে হলো পৃথিবীর গাড়ি বলতে
কি পৃথিবীকে বোঝানো হয়েছে? প্রশ্ন করলাম, "স্যার, এখানে পৃথিবীর গাড়ি বলতে কি
পৃথিবীকে বোঝানো হয়েছে?"
স্যার কিছু বলার আগেই সুব্রত খুব
উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, "পুরো ব্যাপারটাই ভুল স্যার। প্রথমত পৃথিবীকে থামানো
যায় না, দ্বিতীয়ত পৃথিবী থেকে নামা যায় না, তৃতীয়ত অন্য গাড়ি নেয়া মানে এক গ্রহ থেকে
নেমে গিয়ে অন্য গ্রহে উঠে যাওয়ার ব্যবস্থা মানুষের জন্য এখনো হয়নি।"
"ঠিক বলেছো। পৃথিবী কত বেগে
সূর্যের চারদিকে ঘুরছে জানো? সেকেন্ডে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার বেগে। মিনিটে আঠারো
শ' কিলোমিটার, আর ঘন্টায় এক লক্ষ আট হাজার কিলোমিটার বেগে। দ্রুতগামী রকেটের
গতিবেগ ঘন্টায় সবচেয়ে বেশি হলে ত্রিশ হাজার কিলোমিটার। ভেবে দেখো - আমরা এমন একটা
ছুটন্ত গ্রহের উপর আছি যার গতি ঘন্টায় এক লাখ কিলোমিটারের বেশি। একটা চলন্ত রিক্সা
থেকেও যদি নামতে যাও - পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হবে।"
"কিন্তু স্যার - এখানে তো রোখ -
মানে থামাতে বলা হচ্ছে।"
"থামাতে বলা হচ্ছে ঠিক আছে।
কিন্তু মহাবিশ্বের কোন গ্রহকেই কি থামানো সম্ভব? গ্রহ ঘুরছে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে।
এই মহাকর্ষ বলকে থামানোর কোন উপায় তো নেই। পৃথিবীর তো নিজের কোন ইঞ্জিন নেই যে তা
বন্ধ করে দিলেই পৃথিবী থেমে যাবে। পৃথিবীকে থামাতে হলে সূর্যের সাথে তার
সম্পর্কচ্ছেদ করে ফেলতে হবে।"
নয়ন এতক্ষণ যেরকম শক্ত হয়ে ছিল,
দেখলাম আস্তে আস্তে কিছুটা নমনীয় হয়ে উঠছে। বললো, "সব কিছু আক্ষরিক অর্থে
নিলে তো হবে না স্যার। শৈল্পিক ব্যাপারটা দেখতে হবে না? সেভাবে ধরলে তো আমাদের জাতীয়
সঙ্গীতও ভুল। আকাশ বাতাস বাঁশি বাজাতে পারে না কি? কিন্তু প্রাণে বাজায় বাঁশি মানে
তো ঠিক বাঁশি বাজানো না, তাই না?"
"ঠিক বলেছো। কিন্তু
তুমি যে আমার 'ভুল গান' কথাটা একেবারে আক্ষরিকভাবে নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ করে ফেললে
আমার বিরুদ্ধে?"
স্যারের কথায় নয়ন চুপ
করে রইলো। তার মানে নয়ন বুঝতে পারছে যে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
স্যার বললেন, "যাই
হোক। ওই গানটার মাঝখানে এরকম কথাও আছে যেখানে বলা হচ্ছে ''নিজের বৃত্তে ঘুরে মরে
না যে গ্রহ সেই গ্রহটাতে তুলে দিয়ে যাও'। সব গ্রহই কিন্তু নিজের বৃত্তে ঘুরে
মরে।"
আমার এখন মনে হচ্ছে গান
সিলেক্ট করতে ভুল করেছি আমরা। আবার এভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে তো
সব গান থেকেই কোন না কোন ভুল বের হবে।
"তারপরও দেখো - আমি
কিন্তু কোন মানুষকেই কখনো অশ্রদ্ধা করি না। কারণ প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই কোন না
কোন মহৎ গুণ আছে, বড় কিছু করার ক্ষমতা আছে। এই যে আবদুর রহমান - সে গত পরীক্ষায় তত
ভালো করতে পারেনি বলে ক্লাসের লাস্ট বয়। কিন্তু সে যে এবার খেলাধুলায় উচ্চলাফে
ফার্স্ট হয়েছে - এটা কি আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়েছে? অনেকসময় পরিশ্রম করলে পড়াশোনা সবাই
আয়ত্ব করতে পারে। কিন্তু সঙ্গীত বা চিত্রকলা বা সাহিত্য? এগুলোতো শুধুমাত্র বই পড়ে
অর্জন করা যায় না। তোমরা যে চমৎকার গান করেছো, কবিতা আবৃত্তি করেছো, নেচেছো - তাতে
আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। তোমাদের ক্ষমতাকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। সলিল চৌধুরিকেও আমি
ভীষণ শ্রদ্ধা করি - তিনি পৃথিবীকে থামিয়ে নেমে যাবার কথা বললেও। হা হা হা।"
আমরাও স্যারের কথায় হেসে
উঠলাম। নয়নের মুখেও দেখলাম হাসি ফুটে উঠেছে।
"তাহলে নুসরাত
নীলিমা, আমার বিরুদ্ধে তোমার অভিযোগগুলো কি এখনো প্রযোজ্য?"
"না স্যার। আমার
অভিযোগ আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।"
"ঠিক আছে। এই
নাও।" স্যার নয়নের অভিযোগ খাতা ফেরৎ দিলেন।
"আমরা কি স্যার তাহলে আজ পৃথিবী
সম্পর্কে কথা বলবো?" অর্কের প্রশ্ন। অর্ক সিলেবাসের বাইরে কিছু করতে পারলে কেন
যে এত খুশি হয় কে জানে।
"আগে দেখি এখন তোমাদের বই থেকে
কী পড়ার কথা। বিজ্ঞান ক্লাসে আমরা কোথায় আছি?"
এ জাতীয় প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর
সুব্রতের আগে আর কেউ দিতে পারে না। সে বললো, "স্যার আমরা তৃতীয় অধ্যায় শুরু
করবো আজ।"
স্যার বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়ে
উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, "চলো এক কাজ করা যাক। সৌরজগৎ ও তার গ্রহগুলি'র
অধ্যায়টা আগে শেষ করে ফেলি। সূর্য সম্পর্কে এর মধ্যে তোমরা নিজেরাই অনেক কিছু জেনে
ফেলেছো। এবার সূর্যের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবী সম্পর্কে জানতে শুরু করো।
আমি বললাম, "প্রজেক্ট পৃথিবী
স্যার?"
স্যার বললেন, "ঠিক
তাই। আমাদের পৃথিবীর মতো গ্রহ মহাবিশ্বে আর একটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। কেন
বলতে পারবে?"
"এই গ্রহে মানুষ আছে।"
"শুধু মানুষ নয়, একমাত্র এই
গ্রহেই প্রাণের বিকাশ ঘটেছে এবং একমাত্র পৃথিবীর আবহাওয়াই প্রাণ-ধারণের
সহায়ক।"
আমাদের প্রজেক্ট পৃথিবী শুরু হলো।
স্যার লাইব্রেরি থেকে পৃথিবী সম্পর্কিত যত বই আছে নিয়ে এলেন ক্লাসে। দুটো গ্লোব
নিয়ে এলেন। কম্পিউটার আর প্রজেক্টরের মাধ্যমে নাসার ওয়েবসাইট থেকে (www.nasa.gov) প্রচুর ছবি দেখালেন। পৃথিবী থেকে আমরা যেমন সূর্যোদয় দেখি - সেরকম চাঁদ
থেকে আমাদের পৃথিবীর উদয় হতে দেখেছিলেন চাঁদের নভোচারীরা। পৃথিবী-উদয়ের ছবি দেখে
আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
পরের দুই সপ্তাহের মধ্যেই আমরা আমাদের
প্রজেক্ট-পৃথিবী শেষ করে ফেললাম আমাদের মতো করে। আমরা জানলাম পৃথিবী কীভাবে গঠিত
হলো, পৃথিবীর বয়স কত, পৃথিবীর বায়ুমন্ডল-পানি-সাগর-পাহাড় ইত্যাদি কীভাবে হলো, প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হলো, পৃথিবীর ভেতরে কী
আছে, পৃথিবী কেন একটা বড় আকারের চুম্বক, পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ - চাঁদ
কীভাবে এলো, পৃথিবী আর কত বছর বেঁচে থাকবে - ইত্যাদি অনেক কিছু। একে একে সব বলছি
তোমাদের।
No comments:
Post a Comment