Monday, 4 November 2019

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ৪


সূর্যের তৃতীয় গ্রহ

মহাকাশ থেকে সৌরজগতের দিকে তাকালে দেখা যায় সূর্যের আটটি গ্রহের মাঝে শুধুমাত্র একটি গ্রহ অন্ধকারে নীল হীরার মতো জ্বলজ্বল করছে। সেই নীল গ্রহটি আমাদের পৃথিবী - সূর্য থেকে দূরত্বের ভিত্তিতে তৃতীয় - কিন্তু অন্যান্য সব বৈশিষ্ট্যে অনন্য। পৃথিবীর বাইরের আবরণের শতকরা সত্তর ভাগ দখল করে আছে সমুদ্রের পানি। আর পুরো পৃথিবীকে ঘিরে আছে একটা বায়বীয় আবরণ - পৃথিবীর বায়ুমন্ডল। দিনের বেলা সূর্যের আলো এই বায়ুমন্ডলে বিচ্ছুরিত হয়ে পৃথিবীর আকাশকে নীল রঙে রাঙিয়ে দেয় বলেই পৃথিবী একটি নীল গ্রহ। যে পৃথিবীকে আমরা আজ দেখছি - সাড়ে চার শ' কোটি বছর আগে যখন গঠিত হয়েছে - পৃথিবী মোটেও এরকম সুন্দর ছিল না। শত কোটি বছরের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হতে হতে পৃথিবী আমাদের বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে।
            পৃথিবীর জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত ঠিক কী কী হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রথম দিকের পৃথিবীর কোন উপাদান আর অপরিবর্তিত অবস্থায় পৃথিবীতে পাওয়া যায়নি। কিন্তু পৃথিবী গঠিত হবার মাত্র পাঁচ কোটি বছরের মধ্যেই জন্ম হয়েছে চাঁদের। তারপর পৃথিবী যেভাবে বদলে গেছে চাঁদের পরিবর্তন কিন্তু সেভাবে হয়নি। মানুষ চাঁদে গিয়ে নিয়ে এসেছে চাঁদের পাথর, মাটি। সেগুলো পরীক্ষা করে আদি-পৃথিবীর অনেককিছুই আজ জানতে পেরেছে বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব যখন থেকে হয়েছে প্রায় তখন থেকেই মানুষ পৃথিবী সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যতই উন্নত হচ্ছি আমরা - আমাদের আবিষ্কারের গতি বেড়ে যাচ্ছে খুবই দ্রুত। পৃথিবী সম্পর্কে গত দশ হাজার বছরে আমরা যতটুকু জেনেছি তার বেশিরভাগই আমরা জেনেছি গত দু'শ বছরে।
            পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ও জ্ঞানের বিবর্তনের একটা সময়চিত্র নিচে দেয়া হলো।

সময়কাল
তত্ত্ব এবং অনুসিদ্ধান্ত
১০,০০০
বছর আগে
মানুষ তাদের চারপাশের এলাকার মানচিত্র তৈরি করে তা পাথরে খোদাই করে রাখতে শুরু করে। ভৌগোলিক অবস্থান জানার শুরু।
৩০০০ বছর আগে
প্রাচীন গ্রিক-পন্ডিতরা মত দেন যে পৃথিবী সমতল।
২৫০০ বছর আগে
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে করতে গ্রিক দার্শনিকরা মত দেন যে পৃথিবী গোলাকার। তবে এটা থালার মতো গোল নাকি বলের মতো গোল সে ব্যাপারে দ্বিমত দেখা দেয়।
২৪০০ বছর আগে
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্‌টটল মত দেন যে পৃথিবী বলের মতো গোল এবং স্থির। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহগুলো নির্দিষ্ট পথে ঘুরছে। অ্যারিস্‌টটলের পর আরেকজন গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিডিস তত্ত্ব দেন যে পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর দিনে একবার ঘুরে। আর সূর্য বছরে একবার পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে। অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘুরে।
২৩০০ বছর আগে
গ্রিক গণিতজ্ঞ ইরাটোস্থেনিস প্রমাণ করেন যে পৃথিবী গোলাকার। তিনি পৃথিবীর পরিধির মাপও হিসেব করেন এবং সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের একটা ধারণা দেন। একই শতাব্দীতে গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যারিস্টারকাস সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্ট যুক্তি দেন যে পৃথিবী নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরছে। পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর দিনে একবার এবং সূর্যের চারপাশে বছরে একবার ঘুরে আসে।
১৮০০ বছর আগে
রোমান-মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি আবার অ্যারিস্‌টটলের মতবাদকে সামনে নিয়ে আসেন। পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে তিনি সূর্য ও অন্যান্য গ্রহগুলোর ঘূর্ণনের একটা বিস্তারিত মডেল দাঁড় করান তিনি। পরবর্তী এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে টলেমির পৃথিবী-কেন্দ্রিক মডেল টিকেছিল।
১৪০০ বছর আগে
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রহ্মগুপ্ত সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে একটা আকর্ষণ বলের অস্তিত্ব অনুমান করেন। মহাকর্ষ বলের ধারণার উৎপত্তি হলো।
১০০০ বছর আগে
পারস্যের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল বেরুনি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের বর্ণনা দেন। পৃথিবী সব পদার্থকে তার কেন্দ্রের দিকে টানছে। তিনি যুক্তি দেন যে সূর্য নয়, পৃথিবীই বছরে একবার সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। একই শতাব্দীতে পারস্যের ওমর খৈয়ামও প্রমাণ করেন যে সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরছে। তিনি সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর একবার ঘুরে আসতে কত সময় লাগে তার একটা নিঁখুত হিসেব দেন। তাঁর হিসেব করা ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন বর্তমানের হিসেবের সাথে দশমিকের পরে ছয় সংখ্যা পর্যন্ত মিলে যায়।
৪৭০ বছর আগে
১৫৪৩ সালে পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কপার্নিকাস পৃথিবী-কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো ঘুরছে।
৪৩০ বছর আগে
১৫৮৪ সালে ইটালিয়ান দার্শনিক জিওরদানো ব্রুনো কপার্নিকাসের তত্ত্বকে আরো একধাপ সামনে নিয়ে যান। তিনি তত্ত্ব দেন যে সূর্য শুধু সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে। সৌরজগৎ মহাবিশ্বের খুব ছোট একটা অংশমাত্র। মহাবিশ্বে সূর্যের মতো আরো অসংখ্য নক্ষত্র আছে।
৪০০ বছর আগে
·          ১৬০৫ সালে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার গ্রহের গতি সম্পর্কিত তিনটি সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন - যেগুলো কেপলারের সূত্র নামে পরিচিত। এতদিন মনে করা হতো যে সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো বৃত্তাকারে ঘুরে। কেপলার দেখালেন যে গ্রহগুলোর গতিপথ উপবৃত্তাকার। কেপলারের সূত্রের ভিত্তিতেই পরবর্তীতে নিউটন বস্তুর গতিসূত্র এবং মহাকর্ষ সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
·          ১৬১০ সালে ইটালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবন করেন যার মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণার নতুন যুগের সূচনা হয়।
৩০০ বছর আগে
১৬৮৭ সালে স্যার আইজাক নিউটন মহাবিশ্বের মহাকর্ষ সূত্র এবং বস্তুর গতিসূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে গ্রহ-নক্ষত্র এবং তাদের ভেতর অন্যান্য বস্তুগুলোর পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণের রহস্য উন্মোচিত হয়।
২৩০ বছর আগে
১৭৮৫ সালে স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস হুটন তত্ত্ব দেন যে বহুকোটি বছর ধরে অনবরত প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এর পেছনে ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লোন-ভূমিকম্প-আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ সবকিছুরই অবদান আছে। আধুনিক ভূ-তত্ত্ববিদ্যার জনক বলা হয় তাঁকে।
বিংশ শতাব্দীতে
·          ১৯১২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ভেগেনের তত্ত্ব দেন যে পৃথিবীর মহাদেশীয় টেকটোনিক প্লেটগুলো আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ফলে মহাদেশগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান বদলে যাচ্ছে।
·          ১৯২২ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার ওপারিন ধারণা দেন যে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে যে জৈবযৌগ আছে তার মধ্যে জটিল রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে সাড়ে তিনশ' কোটি বছর আগে।
·          ১৯২৯ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডঊইন হাবল দেখান যে মহাবিশ্বের সব গ্যালাক্সি পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তার মানে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে।
·          ১৯৫৩ সালে আমেরিকান প্রাণ-রসায়নবিদ স্ট্যানলি মিলার ও হ্যারোল্ড উরেই প্রথম যুগের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের গ্যাসীয় উপাদান - হাইড্রোজেন, মিথেন, অ্যামোনিয়া ও জলীয় বাষ্পে  বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ ঘটিয়ে প্রাণের প্রধান উপাদান অ্যামিনো এসিড তৈরি করে প্রমাণ করেন যে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হবার রাসায়নিক উপাদান যখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তৈরি হয়েছে তখনই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে।
·          ১৯৫৬ সালে আমেরিকান ভূ-রসায়নবিদ ক্লেয়ার প্যাটারসন প্রাচীন শিলার তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করে পৃথিবীর বয়স হিসেব করেন। তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের হিসেবে পৃথিবীর বর্তমান বয়স সাড়ে চারশ' কোটি বছরের বেশি।
·          ১৯৬০ সালে ভূ-বিজ্ঞানীরা ভেগেনেরের তত্ত্ব মেনে নিয়ে মহাদেশগুলোর সঞ্চরণের আধুনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীর সব মহাদেশ এক সময় একটার সাথে আরেকটা লাগানো ছিল। মহাদেশীয় টেকটোনিক প্লেটগুলো পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে মহাদেশগুলো আলাদা হয়ে গেছে।
·          ১৯৯০ সালে মানুষ মহাকাশে ২৪টি ন্যাভস্টার স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ স্থাপন করে। এদের সাহায্যে পৃথিবীর গ্লোবাল পজিশানিং সিস্টেম বা জিপিএস প্রযুক্তি শুরু হয়েছে।


প্রায় দশ হাজার বছরের সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রচেষ্টায় আমরা বর্তমান পৃথিবী সম্পর্কে যেসব মৌলিক তথ্য জানতে পেরেছি তা সংক্ষেপে বলছি তোমাদের।
·         পৃথিবীর বয়স = সাড়ে চার শ' কোটি বছর।
·         বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবীর ব্যাস = ১২,৭৫৬ কিলোমিটার
·         উপরিতলের ক্ষেত্রফল = ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটার
·         স্থলভাগের ক্ষেত্রফল = ১৪.৮ কোটি বর্গ কিলোমিটার
·         ভর = ৫.৯৭৪x১০২১ টন (প্রায় ছয় কোটি কোটি কোটি টন)
·         আয়তন = ১০৮৩০০ কোটি ঘন কিলোমিটার
·         সামগ্রিক ঘনত্ব = ৫.৫১৭ গ্রাম/সেমি
·         অভিকর্ষজ ত্বরণ = ৯.৭৮ মিটার/সেমি
  • চাঁদের সংখ্যা = ১



  • অক্ষ থেকে নতি = ২৩.৪ ডিগ্রি
  • ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা = ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
  • ভূপৃষ্ঠের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা = মাইনাস ৮৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস
  • ভূপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা = ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস
  • সূর্য থেকে গড় দূরত্ব = ১৪ কোটি ৯৬ লক্ষ কিলোমিটার
  • সূর্য থেকে সর্বনিম্ন দূরত্ব = ১৪ কোটি ৭১ লক্ষ কিলোমিটার
  • সূর্য থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব = ১৫ কোটি ২১ লক্ষ কিলোমিটার
  • কক্ষপথে গড় গতি = ঘন্টায় ১,০৭,২৮০ কিলোমিটার
  • কক্ষপথে সর্বোচ্চ গতি = ঘন্টায় ১,০৯,০৮০ কিলোমিটার
  • কক্ষপথে সর্বনিম্ন গতি = ঘন্টায় ১,০৫,৪৮০ কিলোমিটার
  • সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরতে সময় নেয় = ৩৬৫.২৫৬ দিন (১ বছর)
  • নিজের অক্ষে একবার ঘুরতে সময় নেয় = ২৩.৯৩ ঘন্টা (১ দিন)
  • নিজের অক্ষে গতি = ঘন্টায় ১৬৭০ কিলোমিটার
  • আকারের দিক থেকে সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে পৃথিবী পঞ্চম, অবস্থানের দিক থেকে তৃতীয়। চারটি কঠিন গ্রহের মধ্যে পৃথিবীর ব্যাস সবচেয়ে বেশি। পৃথিবী শুক্রের চেয়ে ৫% বড়, মঙ্গলের প্রায় দুই গুণ, বুধের আড়াই গুণ।
  • কঠিন গ্রহগুলোর মধ্যে পৃথিবী সবচেয়ে ভারী। পৃথিবী শুক্রের চেয়ে ২৩% ভারী, মঙ্গলের চেয়ে সাড়ে নয় গুণ, আর বুধের চেয়ে আঠারো গুণ ভারী।
  • কিন্তু মহাশূন্যের তুলনায় আমাদের পৃথিবীকে একটা বিন্দুর মতো লাগে। সূর্যের চেয়ে পৃথিবী আয়তনে ১০৮ গুণ ছোট। ভরের হিসেবে পৃথিবী সূর্যের চেয়ে ৩৩৩০০০ গুণ হালকা। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts