মহাবিশ্বের কোথায় আমরা
আমাদের
বাসার ছাদে উঠে চারপাশে তাকালে শহরের প্রায় অনেকটুকু দেখা যায়। বাইশতলা বিল্ডিং-এর
ছাদ থেকে নিচের রাস্তাগুলোকে, রাস্তায় চলা গাড়িগুলোকে, মানুষগুলোকে এত ছোট দেখায়
যে ভালো করে বোঝাই যায় না কী হচ্ছে সেখানে। ছাদ থেকে নিচের রাস্তার দূরত্ব একশ'
মিটারও হবে না। এটুকু দূরত্বের জন্যই সবকিছু কেমন ছোট দেখায়। সেই হিসেবে সূর্যের
দিকে বা চাঁদের দিকে তাকালে আমরা যে আকারের সূর্য বা চাঁদ দেখতে পাই - তারা যে তার
চেয়ে কত কোটিগুণ বড় তা চিন্তা করলে এক ধরনের শিহরণ লাগে আমার। মনে হয় প্রকৃতির
চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছুই নেই।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার বেশ
ভালো লাগে। ভোরে উঠে দেখি পুবাকাশে সূর্য ওঠার আগেই আকাশটা কীরকম লাল হয়ে যায়।
তারপর সূর্য দেখা যায় - প্রথমে লাল তারপর কমলা তারপর আস্তে আস্তে উজ্জ্বল সাদা হতে
থাকে। আবার সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে উজ্জ্বলতা কমতে কমতে রঙ বদলাতে বদলাতে সূর্য ডুবে
যায়। তারপরেও অনেকক্ষণ আকাশে কী সুন্দর আলো থাকে। আস্তে আস্তে আকাশের রঙ বদলে যায়।
নীল থেকে ধুসর - তারপর কালো হয়ে যায়। আকাশের বুকে একটা দুটো করে তারা দেখা যেতে
শুরু করে। রাত যতই গভীর হয় - তারায় তারায় ভরে যায় আমাদের আকাশ। আকাশে যেদিন মেঘ
থাকে না - মনে হয় আকাশজুড়ে ফুটে আছে কোটি কোটি তারার ফুল। আমি ছাদে পাটি বিছিয়ে
চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবতে থাকি তারাদের কথা।
এই তারাগুলোর প্রত্যেকটাই একেকটা
সূর্য। আমাদের সূর্যের মতোই বা তার চেয়েও বেশি তাদের রূপ, তাদের তেজ। কিন্তু
পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব এত বেশি যে কয়েক হাজার বছর লেগে যায় ওদের আলো আমাদের
পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে। কোন বাধা না থাকলে আলো এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার
পর্যন্ত যেতে পারে। সে হিসেবে সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছাতে সময়
লাগে আট মিনিটের কিছু বেশি। তার মানে আমরা যে সূর্যকে দেখি সেটা সূর্যের আট মিনিট
আগের অবস্থা। অনেকটা ছবি দেখার মতো।
আমার ছোটবেলার একটি ছবি আছে - ছোটমামার
কাঁধের উপর বসে আছি আমি। তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। সেই ছবিটা আমার সাত বছর আগের
অবস্থা। তেমনিভাবে যে তারাগুলোকে দেখছি এখন আমাদের আকাশে - সেগুলো তাদের কয়েক
হাজার বছর আগের অবস্থা। আমরা আসলে কয়েক হাজার বছরের অতীত দেখতে পাচ্ছি। তারাগুলোর
জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে একসময় ধ্বংস হয়ে যায়। যেসব তারা আমরা আজকে দেখতে পাচ্ছি
হয়তো তাদের অনেকেই ধ্বংস হয়ে গেছে কয়েক হাজার বছর আগে। অথচ আমরা জানতেও পারিনি।
কেমন রহস্যময় লাগে না প্রকৃতির এসব কান্ডকারখানা দেখতে!
এরকম কোটি কোটি তারা নিয়ে একেকটা
গ্যালাক্সি। আবার কত হাজার কোটি গ্যালাক্সি যে আছে এই মহাবিশ্বে তার কোন সঠিক
হিসেব এখনো আমাদের জানা নেই। এই বিশাল মহাবিশ্বের আমরা যতটুকু জানি তা তার রহস্যের
তুলনায় অতি সামান্য। তাও আমরা সঠিকভাবে জানতে শুরু করেছি মাত্র কয়েকশ' বছর আগে
থেকে। যখন থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষ ধাপে ধাপে এগোতে শুরু করেছে তখন থেকেই
প্রকৃতির রহস্যের জট আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করেছে। আমাদের জানার পরিধি যতই বাড়ছে
ততই জানার আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে, ততই বড় হয়ে যাচ্ছে আমাদের জগৎ, বদলে যাচ্ছে আমাদের
ঠিকানা।
এই বিশাল মহাবিশ্বের ঠিক কোথায় আছি
আমরা? আমাদের বাসার ঠিকানা লেখার সময় বাসার নম্বর, রাস্তার নাম, মহল্লার নাম,
পোস্টকোড সব লিখতে হয়। দেশের বাইরে চিঠি লিখতে গেলে দেশের নাম লিখতে হয়। পৃথিবীর
বাইরে এখনো কোন দেশ নেই বলে গ্রহের নাম লিখতে হয় না। যদি এমন হতো যে মহাবিশ্বের সব
গ্যালাক্সি-নক্ষত্র-গ্রহ-উপগ্রহগুলোর মধ্যে যোগাযোগ আছে সেক্ষেত্রে আমাদের পুরো
মহাজাগতিক ঠিকানা জানতে হতো। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের সেই ঠিকানা কী? আমরা কি জানি
মহাবিশ্বের ঠিক কোথায় আছি আমরা? হ্যাঁ, আমরা জানি আমরা কোথায় আছি। এটা আমরা জেনেছি
মাত্র কয়েকশ' বছর আগে।
আমাদের এই পৃথিবীটা হলো
সূর্যের তৃতীয় গ্রহ। সূর্য ও তার গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে সৌরজগৎ। এরকম প্রায় এক হাজার
কোটি সৌরজগৎ নিয়ে একেকটা গ্যালাক্সি। আমরা যে গ্যালাক্সিতে আছি তার নাম মিল্কিওয়ে।
মহাবিশ্বে এরকম আরো কোটি কোটি গ্যালাক্সি আছে - যাদের বেশিরভাগই এখনো আমাদের
দৃষ্টির বাইরে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অসংখ্য নক্ষত্রের মধ্যে অতি সাধারণ একটি
নক্ষত্র - সূর্য। আর এই সাধারণ সূর্যের একটি অসাধারণ গ্রহ আমাদের পৃথিবী।
মহাবিশ্বের আর কোথাও আমাদের পৃথিবীর মতো এত প্রাণ নেই - বিচিত্র জীবন নেই। এই
চমৎকার পৃথিবীর উৎপত্তি হলো কীভাবে?
No comments:
Post a Comment