সমুদ্রের গভীরে
আমাদের
পৃথিবীর শতকরা ৭০ ভাগ ক্ষেত্রফল দখল করে আছে সমুদ্র। সমুদ্রের আনুমানিক গড় গভীরতা
চার কিলোমিটারের মত। সেখানে সূর্যালোক পৌঁছায় না। কিন্তু সমুদ্রের নিচের তল বা
ওখানের জগৎ কিন্তু আমাদের ধারণা দেয় আমাদের প্রাথমিক পৃথিবী কেমন ছিল, কীভাবে কাজ
করছিল। পৃথিবীর মোট প্রাণির মধ্যে আনুমানিক ৫০ থেকে ৮০% প্রাণির
সন্ধান পাওয়া যায় সমুদ্রের পানিতে যার দুই তৃতীয়াংশ এখনো অজানা।
১৯৬০ সাল থেকে সমুদ্রের
তলদেশ পরীক্ষা করা শুরু হয় - শব্দের প্রতিফলন, ম্যাগনেটমিটার, সাবমেরিন ইত্যাদির
সাহায্যে। আবিষ্কৃত হয় সমুদ্রের তলদেশে
প্রায় ৭০ হাজার কিলোমিটার লম্বা পর্বতমালার সারি। এগুলো পৃথিবীর ত্বকে জোড়া বা সেলাইয়ের
মুখের মত। এই সত্তর হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সেলাই বরাবর ফুলে উঠেছে পর্বতমালার
সারি।
পৃথিবীর সমুদ্রের গভীরতা
সবচেয়ে উঁচু পর্বতের উচ্চতার চেয়েও বেশি। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ৮.৯ কিলোমিটার। অথচ প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে গভীর
স্থান (চ্যালেঞ্জার ডিপ) ১১ কিলোমিটার। এভারেস্টও ডুবে যাবে সেখানে।
সাগরের নিচের স্তর (সমুদ্রের তলা) - নতুন হচ্ছে
বারে বারে। পুরনো স্তর ডুবে যাচ্ছে - ঢুকে যাচ্ছে পৃথিবীর গায়ের ভেতর। সেই জায়গায়
তৈরি হচ্ছে নতুন স্তর। সমুদ্রের তল যখন ঠান্ডা হয়ে যায় তখন তার ঘনত্ব বেড়ে যায় ফলে
একটু ভারি হয়ে যায়। তখন তারা নিচের দিকে চলে যায়। একটু গরম স্তর উপরে চলে আসে। তখন
সেখানে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠতে পারে, বা নতুন ডুবন্ত পাহাড়শ্রেণি জায়গা নেয়
তার।
মহাসাগরের নিচে যেখানে
টেকটোনিক প্লেট সরে যায় সেখানে প্রচন্ড গরম পাথর বেরিয়ে আসে এবং তা আস্তে আস্তে
পাহাড়-পর্বতে পরিণত হয়ে সমুদ্রের তলদেশে দাঁড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে এই পাহাড়গুলোর
উচ্চতা এত বেশি হয় যে সমুদ্রের উপর দেখা যায় এর উপরিভাগ। আমরা এদেরকে দ্বীপ বলি।
হাওয়াই দ্বীপ এরকমই একটি দ্বীপ।
সাগরের নিচের স্তরের গায়ে গভীর খাদের মতো যে অংশগুলো দেখা যায় সেগুলোকে
উল্টানো পর্বত বলা যেতে পারে - অবশ্য জলীয় পর্বত বা লিকুইড মাউন্টেন। আলাস্কার
নিচে যে খাদ পাওয়া গেছে তার গভীরতা হিমালয় পর্বতের চেয়ে বেশি। ফিলিপাইনের নিচে 'ভ্যালি
ইন কোর' আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে দ্বিগুণ গভীর।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড়
পর্বতমালা পানির নিচে আছে। মধ্য-আটলান্টিক পর্বতমালা আটলান্টিক মহাসাগরকে তলদেশে
দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে। এই পর্বতমালার দৈর্ঘ্য প্রায় ষোল হাজার কিলোমিটার।
মাঝ-সমুদ্রের নিচে সুপ্ত পাহাড়শ্রেণি
ভেদ করে মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির লাভা বেরিয়ে আছে। কিন্তু পানির কারণে তা কিছুটা
টুথপেস্টের মতো হয়ে যায়। এগুলোকে পিলো লাভা বা বালিশ লাভা বলা হয়। এরকম লাভা-নির্গমন সাধারণত খুব
একটা অশান্ত হয় না। তবে মাঝে মাঝে ছোটখাট ভূমিকম্প হয়ে যায় আশেপাশে।
প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় পুরোটাই একটা বড় টেকটোনিক প্লেটের ওপর বসে আছে।
প্লেটের চারপাশে আগ্নেয়গিরির চক্র আছে যাকে রিংস অব ফায়ার
বা আগুনের মালা বলা হয়। কিন্তু সব আগ্নেয়গিরিই প্লেটের চারধারে থাকে না। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি
আছে - হাওয়াই। পুরো দ্বীপটাই বসে আছে আগ্নেয়গিরির উপর। কোটি বছর ধরে আগ্নেয়গিরির
কেন্দ্র পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু প্যাসিফিক প্লেট সরে গেছে উত্তরপশ্চিম দিকে। ফলে
বেশ কিছু আগ্নেয়গিরির দ্বীপ তৈরি হয়েছে সেদিকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটা জ্যন্ত
ছিল দুই কোটি বছর আগে।
মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির ভেতর পানি ঢূকে যায়। তখন
সেই পানি মিশে যায় খনিজ পদার্থের সাথে। তখন ছিদ্র দিয়ে গরম বাতাস বেরিয়ে আসার সময়
পানি বেরিয়ে আসে। এর তাপমাত্রা ২০০ থেকে ৩০০ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। উচ্চ চাপের
কারণে এই পানি ফুটে না। এই
ছিদ্রগুলোর আশেপাশে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া দেখা যায়। ব্যাকটেরিয়াগুলো মাছের খাবার হয়।
সালফার ও অন্যান্য দ্রবীভূত খনিজ যেগুলো বের হয় এই ছিদ্রপথে - ওগুলো খেয়ে
প্রাণিগুলো বেঁচে থাকে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণের প্রতিনিধি।
No comments:
Post a Comment