মহাদেশ এবং
টেকটোনিক প্লেট
আমাদের বর্তমান পৃথিবীর
সাতটা মহাদেশ ভৌগোলিকভাবে আলাদা আলাদা। পৃথিবীর ক্রাস্টের নিচে যে লিথোস্ফিয়ার সেই
লিথোস্ফিয়ার গঠিত হয়েছে অনেকগুলো বিভিন্ন আকৃতির টেকটোনিক[1] প্লেট
দ্বারা। এই প্লেটগুলো একটার সাথে আরেকটা মিলে পুরো পৃথিবীর ভেতরটা ঢেকে রেখেছে। এই
প্লেটগুলোর উপরই আমাদের সবগুলো মহাদেশ, আমাদের সবগুলো মহাসাগর।
পৃথিবীর ক্রাস্ট বা
ভূ-ত্বকের প্রধান উপাদান যে বালি, মাটি ও পাথরের মিশ্রণ তা তৈরি হতে পৃথিবীর প্রায়
একশ' কোটি বছর সময় লেগেছে। টেকটোনিক প্লেটোগুলো স্থির নয়। খুব ধীরে ধীরে নড়ছে সেগুলো।
টেকটোনিক প্লেটের পারস্পরিক ধাক্কায় পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়, মাঝে মাঝে খুলে যায়
সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মুখ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে গলিত লাভা পাথর ইত্যাদি। মাঝে মাঝে
বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উপরের মাটির স্তর নিচে চলে যায়, সমুদ্র উঠে আসে ডাঙায়। পৃথিবীর ভেতরে যখন ক্রমাগত পাথরগুলো স্থান পরিবর্তন করছে ধীরে ধীরে -
সেখানে হালকা পাথরগুলো উপরের দিকে চলে আসে - ভেতরের দিকে চলে যায় ভারী পাথরগুলো। আগ্নেয়গিরি
থেকে উঠে আসা লাভা, পাথর ইত্যাদি শক্ত হয়ে মহাদেশের মাটিতে মিশেছে। পাথর ভেঙে মাটি
হয়েছে। পানির সাথে মিশে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন যৌগ। এভাবে নিরন্তর প্রাকৃতিক
ভাঙাগড়ার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে পৃথিবীর ভূমি - যা ক্রমাগত বিবর্তিত হতে হতে
মহাদেশগুলো গঠিত হয়েছে।
মহাদেশগুলো যে টেকটোনিক প্লেটের উপর বসে
আছে তাদের আয়তন বিশাল। মহাদেশগুলো ভূমির উপরে যতটা দেখা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি বড়
অংশ মাটির ভেতরে। একেকটা মহাদেশের প্লেট ত্রিশ চল্লিশ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু।
মহাসাগরের প্লেটগুলো মাত্র ছয় সাত কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু। মহাসাগরের প্লেটগুলির
বয়স খুব বেশি হলে চল্লিশ কোটি বছর। কিন্তু মহাদেশের প্লেটগুলির বয়স প্রায় চারশো
কোটি বছর। পৃথিবী যখন থেকে ঠান্ডা হয়ে কঠিন হতে শুরু করেছিল তখনকার বয়সের সমান।
অস্ট্রেলিয়ার কিছু কিছু অংশ তিনশ' কোটি বছরেরও পুরনো।
পৃথিবীর মোট ক্ষেত্রফলের শতকরা মাত্র
২৯ ভাগ স্থল। বর্তমানে পৃথিবীর স্থলভাগগুলোর অনেকটাই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের
মাঝখানে এখন বিশাল বিশাল মহাসমুদ্র। অথচ সবগুলো মহাদেশের স্থলভাগ একে অপরের সাথে
গায়ে গায়ে লাগানো ছিল একসময়। টেকনোটিক প্লেটগুলোর ক্রমাগত নড়াচড়ার কারণে
মহাদেশগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে গেছে। অতীতে অনেকবার সবগুলো মহাদেশ একসাথে যুক্ত
হয়েছে আবার আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে গেছে। পৃথিবীর মানচিত্র ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে
সেই পৃথিবীর শুরু থেকেই।
ভৌগোলিক তথ্য-প্রমাণ
বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে ৭৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীর পুরো স্থলভাগ
একসাথে লাগানো ছিল। বিজ্ঞানীরা সেই মহা-মহাদেশের নাম দিয়েছেন রোডিনিয়া (Rodinia)।
পরবর্তী ৫০ কোটি বছর ধরে মহাদেশগুলো
পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে সরতে সরতে আবার সবগুলো মহাদেশ এক সাথে মিশেছিল আজ থেকে
প্রায় বাইশ কোটি বছর আগে। বিজ্ঞানীরা এই মহা-মহাদেশের নাম দিয়েছেন প্যানজিয়া।
যেহেতু সবগুলো মহাদেশ একসাথে ছিল - তখন সবগুলো মহাসাগরও মিলে হয়েছিল একটা
মহা-মহাসাগর। যার নাম প্যানথালাসা (Panthalassa)।
উনিশ কোটি বছর আগে প্যানজিয়া মহা-মহাদেশের মহাদেশগুলো আবার আস্তে আস্তে
দূরে সরে যেতে শুরু করে। উনিশ কোটি বছরে আমাদের পৃথিবীর মহাদেশগুলো বর্তমান
অবস্থানে এসেছে। এগুলো এখনো ক্রমাগত সরে সরে যাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকা এক
সময় একসাথে লাগানো ছিল। উত্তর আমেরিকা লাগানো ছিল ইউরোপের সাথে।
কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট মা
মহাদেশগুলোর সরে যাওয়ার ধারণাটা ১৯২৩ সালে প্রথম দেন জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড
ভেগেনের (Alfred Wegener)। কিন্তু তখন তাঁর কথা কেউ মেনে নিতে চাননি। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা
যখন একই ধরনের উদ্ভিদের ফসিল বিভিন্ন মহাদেশে খুঁজে পেতে শুরু করেন - তাদের সময়
এবং অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে একটা সময়ে সব ভূখন্ড
একসাথে লাগানো ছিল।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা
মহাকাশে স্থাপিত জিপিএস স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর মহাদেশগুলোর প্রতি মিলিমিটার
চলাচল রেকর্ড করতে পারেন। তাঁরা নিয়মিত দেখছেন যে পৃথিবীর মহাদেশগুলো চলাচল করছে।
এই চলাচলের গতি খুবই ধীর - বছরে মাত্র বিশ সেন্টিমিটার। অনেকটা মানুষের নখের
বৃদ্ধির গতির সাথে তুলনা করা যায় মহাদেশের চলনের গতি।
বর্তমানে উত্তর আমেরিকা
ক্রমশ ইউরোপ থেকে দূরে সরে গিয়ে এশিয়া মহাদেশের দিকে চলে আসছে। এভাবে চলতে চলতে এক
সময় উত্তর আমেরিকা এশিয়ার সাথে লেগে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী পাঁচ থেকে বিশ
কোটি বছর পরে আমেরিকা এবং এশিয়া মহাদেশ মিলে একটা মহা-মহাদেশ হয়ে যাবে যার নাম হবে
অ্যামেশিয়া (Amesia)।
পৃথিবীতে সাতটি বড় (major), নয়টি ছোট
(minor) এবং অনেকগুলো ক্ষুদ্র (micro) টেকটোনিক প্লেট আছে। বড়
প্লেটগুলোর ক্ষেত্রফল এক কোটি বর্গকিলোমিটারের বেশি। ছোট প্লেটগুলোর ক্ষেত্রফল দশ
লক্ষ বর্গকিলোমিটার থেকে এক কোটি বর্গকিলোমিটারের মধ্যে। আর ক্ষুদ্র প্লেটগুলোর
ক্ষেত্রফল দশ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের কম। বড় প্লেটগুলোর বেশিরভাগের উপরেই মহাদেশ ও
মহাসাগরের অংশ আছে। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের প্লেটের ওপর কোন মহাদেশ নেই।
সাতটি বড় প্লেট পৃথিবীর
সবগুলো মহাদেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরের বেশিরভাগ অংশ ধারণ করে আছে। প্লেটগুলোর নাম ও
ক্ষেত্রফল নিচের সারণিতে দেয়া হলো:
বড় টেকটোনিক প্লেট
|
ক্ষেত্রফল (বর্গকিলোমিটার)
|
প্যাসিফিক (প্রশান্ত মহাসাগরীয়)
|
১০ কোটি ৩৩ লক্ষ
|
নর্থ আমেরিকান
|
৭ কোটি ৫৯ লক্ষ
|
ইউরেশিয়ান
|
৬ কোটি ৭৮ লক্ষ
|
আফ্রিকান
|
৬ কোটি ১৩ লক্ষ
|
অ্যান্টার্টিক
|
৬ কোটি ৯ লক্ষ
|
ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান
|
৫ কোটি ৮০ লক্ষ
|
সাউথ আমেরিকান
|
৪ কোটি ৩৬ লক্ষ
|
ছোট প্লেটগুলোর নাম ও ক্ষেত্রফল নিচের সারণিতে দেয়া হলো। পৃথিবীর মোট
ক্ষেত্রফলের তুলনায় এগুলো ছোট বলে অনেকসময় টেকটোনিক প্লেটের ম্যাপে এদের দেখা যায়
না।
ছোট টেকটোনিক প্লেট
|
ক্ষেত্রফল (বর্গকিলোমিটার)
|
ন্যাজকা (পেরুর উত্তরে)
|
৫৫ লক্ষ
|
ফিলিপাইন সী
|
৫৫ লক্ষ
|
অ্যারাবিয়ান
|
৫০ লক্ষ
|
ক্যারিবিয়ান (মেক্সিকোর দিকে)
|
৩৩ লক্ষ
|
কোকোস (মধ্য আমেরিকার পশ্চিমে)
|
২৯ লক্ষ
|
ক্যারোলাইন (নিউগিনির উত্তরে)
|
১৭ লক্ষ
|
স্কোশিয়া (দক্ষিণ আটলান্টিকের তীরে)
|
১৬ লক্ষ
|
বার্মা (আন্দামান, নিকোবার, সুমাত্রা)
|
১১ লক্ষ
|
নিউ হিব্রাইডিস (প্রশান্ত মহাসাগরে)
|
১১ লক্ষ
|
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে পৃথিবীর কেন্দ্রের বৈদ্যুতিক প্রবাহের কারণে
টেকটোনিক প্লেটগুলো চলাচল করছে। এই চলাচলের ফলে শুধুমাত্র যে মহাদেশগুলোর অবস্থান
বদলে যাচ্ছে তা নয়, পৃথিবীর আরো অনেক পরিবর্তনও ঘটছে এর প্রভাবে। আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ,
ভূমিকম্প, পাহাড়-পর্বত সৃষ্টির কারণও টেকটোনিক প্লেটের চলাচল।
No comments:
Post a Comment