বরফঢাকা পৃথিবী
পৃথিবীর বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ সর্বোচ্চ
পর্যায়ে পৌঁছার পর প্রায় আড়াইশো কোটি বছর আগে পৃথিবী হঠাৎ যেন থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়ায়
মানে তার গতি বন্ধ হয়ে যায় তা নয়, তবে তার প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলানোর ক্ষেত্রে এক
ধরনের ঢিলেমি চলে আসে। পরের একশ' কোটি বছরে ধরতে গেলে কোন বড় পরিবর্তনই ঘটেনি
পৃথিবীতে। বিজ্ঞানীরা এই সময়কালের নাম দিয়েছেন 'বোরিং বিলিয়ন'। হিসেব করে দেখা
গেছে সেই একশ' কোটি বছর ধরে পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলো সব ট্রাফিক জ্যামে পড়েছিল।
একটা আরেকটার গায়ে লেগে তাদের চলাচলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই
একশ' কোটি বছর ধরে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটছিলো নিরবে। সালোকসংশ্লেষণ
প্রক্রিয়া শুরু হবার পর পৃথিবী জটিল জীবন-প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। টেকটোনিক
প্লেটের আনাচে-কানাচে প্রস্তুতি চলছিলো বিভিন্ন প্রজাতির জীবন-উদ্ভবের।
তারপর
হঠাৎ একদিন পৃথিবী যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। গায়ে গায়ে লেগে জ্যাম হয়ে থাকা টেকটোনিক
প্লেটগুলোর নিচে এক শ' কোটি বছরের জমা চাপ হঠাৎ পৃথিবীর চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসে।
আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাস লাভায় আটকে পড়ে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড। ফলে
পৃথিবী-পৃষ্ঠে হঠাৎ তাপমাত্রার এত পার্থক্য দেখা দেয় যে পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশ বরফে
ঢাকা পড়ে। পুরো পৃথিবী একটা বরফের পিন্ডে পরিণত হয়। ভূ-বিজ্ঞানীরা সেই সময়ের বরফের
আস্তরণের প্রমাণ পেয়েছেন পৃথিবীর প্রায় সব অংশেই। এমনকি সেই সময়ের বেশ কিছু বরফ
এখনো উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে রয়ে গেছে। অ্যান্টার্টিকা মহাদেশ পুরোটাই বরফে ঢাকা।
এমনিতে
স্বাভাবিক পৃথিবীর খুব বেশি অংশ বরফে ঢাকা থাকে না। তবে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত
অনেকবার বরফ যুগ এসেছে। বরফ একমাত্র কঠিন পদার্থ যেটার
ঘনত্ব তরলের চেয়ে কম। অন্য যে কোন পদার্থের ঘনত্ব তরলের চেয়ে বেশি। মানে
তাপমাত্রার সাথে ঘনত্বের সম্পর্ক। তাপমাত্রা কমে গেলে তরল পদার্থের ঘনত্ব বাড়তে
থাকে। কিন্তু পানির তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে যতই কমতে থাকে - তার
ঘনত্বও তত কমতে থাকে এবং আয়তন বাড়তে থাকে। ফলে বরফ পানিতে ভাসে। একেবারে পুরো অংশই
পানির উপরে ভেসে উঠে না। মোট আয়তনের শতকরা ৯২ ভাগ পানির নিচে থাকে বাকি ৮ ভাগ
পানির উপরে থাকে। নিচের ছবিতে যে বিশাল বরফের চাঁই দেখতে পাচ্ছো পানিতে ভাসছে - তা
ঐ টুকরাটির মাত্র আট শতাংশ। যেটুকু দেখছো তার প্রায় বারোগুণ আছে পানির নিচে।
পানি
জমে বরফ হলে সেটা ভেসে উঠে। তখন পুরো নদী বা সাগর কিন্তু বরফ হয়ে যায় না। শুধু উপরের
অংশ হয়। নিচের অংশে কিন্তু তখনো পানি তরল থাকে। উপরের বরফের আস্তরণের কারণে নিচের
পানির তাপমাত্রা আর কমতে পারে না। ফলে জলজ প্রাণি বেঁচে থাকে। নইলে তো পুরো সাগর
নদী নালা সব পুরোপুরি জমে ফুলে উঠতো।
তাপমাত্রা
যখন বাড়তে থাকে জমাট বরফ আস্তে আস্তে গলতে থাকে। তখন মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল আকৃতির
বরফের চাঁই ধ্বসে পড়ে আলাদা হয়ে আস্তে আস্তে ভেসে যেতে
পারে। এরা এত বড় হতে পারে যে কোন কোনটা একেকটা দেশের সমান বড় হতে পারে। বাংলাদেশের
সমান। যেতে যেতে হয়তো কোথাও আটকে গেলো। সেখানে জমাট অবস্থায় রয়ে গেল কয়েক লক্ষ
বছর। ততদিনে চারপাশ থেকে হয়তো নদী চলে গেছে অনেক দূরে। তারপর একদিন তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলো। বরফ গলে
গিয়ে হলো পানির পুকুর। বিরাট হ্রদ ইত্যাদি। এই বড় বড় বরফ খন্ড পুরো মহাদেশের ওপর
চাপ দিতে পারে। অনেক বড় বড় হ্রদ সৃষ্টি
হয়েছে এরকম বরফের চাঁই থেকে। বরফ আয়তনে বাড়ে ফলে বিরাট বিরাট পাথরের পাহাড়ও ভেঙে
পড়তে পারে বরফের সম্প্রসারণে।
পৃথিবীতে অনেক বার বরফযুগ এসেছিল।
শেষবার এসেছিল প্রায় ৭০ কোটি বছর আগে। এখনো যে আমাদের দুই মেরুতে বরফ আছে তা শেষবারের
বরফ যুগের অবশেষ। সাড়ে বত্রিশ লক্ষ বছর আগে (৩ দশমিক ২৫ মিলিয়ন) এর সূচনা হয়েছিল।
তখন থেকে বার চারেক চেষ্টা হয়েছে উত্তর আমেরিকার বড় অংশ বরফ হয়ে যেতে। এই পোলার
আইস পুরনো দিনের ইতিহাসের সাক্ষী। জমানো বরফ বিশ্লেষণ করে আগের দিনের আবহাওয়ায় বাতাসের
উপাদান কী কী ছিল জানা যাচ্ছে।
এই বরফ যুগের ফলে পৃথিবীতে এসেছিলো বিশাল
আকৃতির ম্যামথ - যাদের গায়ে বিরাট বিরাট লোম - শীতের আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য।
কিন্তু তারা একসময় বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু রেখে গেছে তাদের পরবর্তী প্রজাতি হাতি।
পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেক বিরাট আকৃতির প্রাণী বিলীন হয়ে গেছে প্রাকৃতিক পরিবর্তনে।
কেন এমন হয় - তার কিছু যুক্তি আজ আমাদের আছে।
No comments:
Post a Comment