চাঁদের জন্ম
পৃথিবীর
বয়স যখন দশ কোটি বছর তখনো পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রাকৃতিক সংঘর্ষ চলছিলো। বিশাল আকৃতির
গ্রহাণু আছড়ে পড়ছিলো পৃথিবীর উপর। এসময় পৃথিবীর দিকে প্রচন্ড গতিতে ধেয়ে এলো বিশাল
আকৃতির একটা পাথর। পরে বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন থেইয়া (Theia)। থেইয়ার আকার ও আয়তন মঙ্গল গ্রহের সমান। থেইয়ার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে
পৃথিবীর একপাশ থেকে বিরাট একটা অংশ ভেঙে গেলো, থেইয়া গেলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে।
সংঘর্ষের ফলে যে তাপ উৎপন্ন হলো তাতে এতদিন ধরে পৃথিবীর যে বায়বীয় আবরণ তৈরি
হচ্ছিলো তা একেবারে বাষ্প হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো।
তারপরেও পৃথিবীর ঘূর্ণন কিন্তু থামেনি
একটুও। থেইয়ার ধ্বংসাবশেষ আর পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়া অংশগুলো মহাকর্ষ বলের প্রভাবে
মিশে গিয়ে একটা পিন্ডে পরিণত হয়ে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে শুরু করলো। এই গোলাকার
পিন্ডটিই হলো পৃথিবীর চাঁদ।
অ্যাপোলো
মিশন চাঁদের যে পাথরের নমুনা নিয়ে এসেছে তা রেডিও-ডেটিং[1] করে দেখা গেছে যে সেগুলোর বয়স ৩১০ থেকে ৩৯০ কোটি বছরের ভেতর। দক্ষিণ মেরুতে
২০০৭ সালে পাওয়া একটি পাথরে চাঁদের উপাদান পাওয়া গেছে যার বয়স ৪৩৫ কোটি বছর।
চাঁদের জন্মের সময় হয়তো এই পাথর ছিটকে পড়েছিল উত্তপ্ত পৃথিবীর গায়ে। সমস্ত
বৈজ্ঞানিক তথ্য ও প্রমাণ থেকে হিসেব করে দেখা যায় চাঁদের বয়স প্রায় চার শ' চল্লিশ
কোটি বছর। জন্ম থেকে এত বছরে চাঁদ অনেক বিবর্তিত হয়েছে। দেখা যাক কীভাবে বর্তমান
অবস্থায় এসে পৌঁছালো সে।
চাঁদের বিবর্তন
চারশ' চল্লিশ কোটি বছর ধরে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে চলেছে চাঁদ। পৃথিবীর
অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে চাঁদেরও অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু চাঁদের
পরিবর্তনে পৃথিবীর মতো এত বৈচিত্র্য দেখা যায়নি কখনো। চাঁদে প্রাণের উদ্ভবের
পরিবেশ তৈরি হয়নি কখনো। তাই চাঁদে জন্মেনি কোন প্রাণ।
প্রথম দশ কোটি বছর ধরে
উত্তপ্ত গ্যাস ও বস্তুপিন্ড পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে ঘুরতে ঘুরতে গোলাকার
হয়েছে। পৃথিবীও তখন প্রচন্ড উত্তপ্ত চাঁদের চেয়ে চারগুণ বড় একটি গোলাকার পিন্ড।
আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। ম্যাগনেসিয়াম ও লোহার পরমাণু ঠান্ডা হয়ে কঠিন
পাথরের আকার নিতে শুরু করেছে। তারপর বিশ কোটি বছর ধরে আরো ঠান্ডা হতে হতে কিছু
পটাশিয়াম ও ফসফরাসের পরমাণু তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরের দশ কোটি বছরে চাঁদের ভেতরের
গ্যাসের বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ ঘটেছে। আশি কোটি বছর পর্যন্ত চলেছে চাঁদের
বুকে আগ্নেয়গিরির লাভার উদ্গীরণ। তার সাথে যোগ হয়েছে মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা
গ্রহাণুর অজস্র আঘাত। গ্রহাণুগুলোর আঘাতে চাঁদের গায়ে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল
গর্ত। লাভার স্রোতে তৈরি হয়েছে সমতল লাভার
সাগর। তৈরি হয়েছে উঁচু পাহাড়, উপত্যকা।
এর পরের ২৬০ কোটি বছর
ধরে বিভিন্ন সময়ে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ হয়েছে চাঁদে। চাঁদের ৩৮০ কোটি বছর বয়সে
সৃষ্টি হয়েছে চাঁদের সবচেয়ে বড় গর্ত - যার নাম দেয়া হয়েছে কপারনিকাস। চাঁদের
সবচেয়ে কমবয়সী গর্ত টাইকোর সৃষ্টি হয়েছে মাত্র দশ কোটি বছর আগে। চাঁদের বয়সের
তুলনায় দশ কোটি বছর কিছুই না। কিন্তু মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র কয়েক লক্ষ বছর
আগে।
পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব
হওয়ার অনেক আগে থেকেই চাঁদ আস্তে আস্তে তার বর্তমান আকার ধারণ করে ফেলেছে।
বর্তমানে চাঁদের যে ভৌগোলিক পরিবেশ আমরা দেখি তা কোটি বছর থেকেই আছে সেভাবে।
[1] রেডিয়েশান
বা তেজষ্ক্রিয়তা পদার্থের একটি মৌলিক ধর্ম। তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাপ করে পদার্থের
অর্ধ-জীবন বা হাফ লাইফের সাথে হিসেব করে পদার্থের বয়স হিসেব করা যায়।
No comments:
Post a Comment