চাঁদের ম্যাপ
সপ্তদশ
শতাব্দীর শুরুতে অর্থাৎ ১৬০০ সালের শুরুর দিকে চাঁদের প্রথম ম্যাপ তৈরি করেন উইলিয়াম
গিলবার্ট। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ডাক্তার, পদার্থবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। ইলেকট্রিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং এর অন্যতম স্থপতি বলে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। তিনি খালি চোখে চাঁদ
দেখে চাঁদের তেরোটি জায়গা চিহ্নিত করে প্রথম চাঁদের ম্যাপ এঁকেছিলেন। ঊনবিংশ
শতাব্দীর শেষে অর্থাৎ ১৮৯৯ সালের মধ্যে চাঁদের ম্যাপে প্রায় তেত্রিশ হাজারেরও বেশি
অঞ্চল চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। ততোদিনে অবশ্য শক্তিশালী টেলিস্কোপ মানুষের হাতে এসে
গেছে।
এ পর্যন্ত চাঁদের অসংখ্য ম্যাপ
প্রকাশিত হয়েছে। শুরুতে চাঁদের জায়গাগুলোর যার যেরকম খুশি সেরকম নাম দিয়েছে।
গ্যালিলিও চাঁদের বুকে যে কালো কালো সমতল দাগ দেখেছেন সেগুলোকে ভেবেছেন সাগর। তাই
তিনি সেগুলোর নাম দিলেন 'মারে', বহুবচনে 'মারিয়া'। ল্যাটিন শব্দ 'মারে' অর্থ
সমুদ্র। গ্যালিলিও ছাড়াও আরো অনেকেই চাঁদের বিভিন্ন জায়গার ল্যাটিন নাম দিয়েছেন।
চাঁদের প্রথম বিস্তারিত ম্যাপ
প্রকাশিত হয় ১৬৪৫ সালে। প্রকাশ করেন জার্মান-ডাচ বিজ্ঞানী মিশিল ভ্যান ল্যাংরিন।
তিনি উজ্জ্বল ভূমির অংশের ল্যাটিন নাম দেন 'টেরা' যার অর্থ ভূমি। আর সমতল অংশের
নাম মারিয়া। চাঁদের গর্তগুলোর নাম দেয়ার সময় তিনি পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষদের নাম
ব্যবহার করেন। ১৬৪৭ সালে আরেকটি ম্যাপ প্রকাশ করেন পোলান্ডের জোহান্স হেভিলিয়াস। তিনি
প্রচলিত ল্যাটিন ও ইংরেজি নামের সংমিশ্রণ ঘটান।
১৬৫১ সালে দুজন ক্যাথলিক পাদ্রি
জিওভানি রিকিওলি এবং ফ্রান্সিস্কো গ্রিমাল্ডি চাঁদের অনেক বিস্তারিত ম্যাপ প্রকাশ
করেন। তাঁদের নামকরণের পদ্ধতি অনেকটাই সর্বজনগ্রাহ্য হয়। চাঁদের পাহাড়, সাগর,
গর্ত, উপত্যকা, সমতলভূমি সবকিছু চিহ্নিত করে আলাদা আলাদা নাম দেয়া হয়। তখনো কিন্তু
ছবি তোলার কোন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। সব ম্যাপ হাতেই আঁকতে হতো।
চাঁদের পর্বতমালার নাম দেয়া হলো
পৃথিবীর পর্বতমালার নামে: আল্পস, জুরা, অ্যাপেনাইন্স,
আলতাই, ককেশাস ইত্যাদি। চাঁদের সমুদ্রের নাম দেয়া হলো খুব কাব্যিক: মারে সেরিনিতাতিস বা সি অব সেরেনিটি - শান্তির সাগর, সি অব
ট্রাংকুইলিটি - প্রশান্তির সাগর, ওশেন অব স্টর্ম - ঝড়ের মহাসাগর, বে অব রেইনবো -
রঙধনুর উপসাগর ইত্যাদি। চাঁদের গর্তগুলোর নাম দেয়া হলো বিখ্যাত
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নামে: প্ল্যাটো, হিপারকাস,
আর্কিমিডিস, টলেমি, কপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও।
পরবর্তী দেড়শো বছর ধরে রিকিওলির
চাঁদের ম্যাপকেই সবাই আদর্শ ম্যাপ হিসেবে বিবেচনা করেছে। সেই ম্যাপে আরো নতুন নতুন
জায়গা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ততদিনে শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে চাঁদের পিঠের
বেশিরভাগ জায়গাই দেখা হয়ে গেছে বিজ্ঞানীদের।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে
যখন ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু হলো - তখন চাঁদের ম্যাপে সমস্যা দেখা দিলো। পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রকমের ম্যাপ তৈরি করতে লাগলেন। একই জায়গা অথচ
অনেকগুলো নাম। সমস্যা তৈরি হয়ে গেলো বৈজ্ঞানিক আলোচনায়।
১৯১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (IAU) গঠিত হলো।
চেষ্টা করা হলো একটা সমন্বিত নিয়ম তৈরি করার। কিন্তু সহজে সমাধান করা গেলো না।
প্রধান সমস্যা দেখা দিলো চাঁদের ম্যাপের কোন্টা উপরের দিক হবে কোন্টা নিচের দিক
হবে তা নিয়ে। পৃথিবীতে যে কোন ম্যাপ আঁকার ক্ষেত্রে আমরা উপরের দিককে উত্তর দিক আর
নিচের দিককে দক্ষিণ দিক ধরে ম্যাপ আঁকি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যেহেতু টেলিস্কোপে
চাঁদের উপরের অংশ নিচে দেখেন - সেহেতু তাঁদের অনেকেই চাঁদের ম্যাপ আঁকার ক্ষেত্রে
দক্ষিণ দিক উপরের দিকে দিয়ে আর উত্তর দিক নিচের দিকে আঁকেন। বিজ্ঞানীদের মধ্যে
মতবিভেদ সৃষ্টি হলো। সমস্যার সমাধানের জন্য ভোট নেয়া হলো। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে
পৃথিবীর মতোই চাঁদের ম্যাপেও উত্তর দিক উপরে থাকবে। কিন্তু তারপরেও অনেক
জ্যোতির্বিজ্ঞানী উল্টো করে চাঁদের ম্যাপ আঁকা বন্ধ করলেন না।
পৃথিবী থেকে চাঁদের শুধু
একটা পিঠই দেখা যায়। ফলে সেই পিঠের ম্যাপই শুধু তৈরি হয়েছে। কিন্তু ১৯৬০ সালে নতুন
সমস্যা দেখা দিলো ম্যাপ নিয়ে। ততোদিনে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সবকিছু
নিয়েই ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মহাকাশ
গবেষণা নিয়েও চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত চন্দ্রযান লুনা-৩ চাঁদের
চারপাশে ঘুরে যে পিঠটা এতদিন কেউ দেখেনি চাঁদের সেই পিঠের ছবি তুলে আনলো। ১৯৬০
সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই পিঠের ম্যাপ প্রকাশ করলো - Atlas
of the Far Side of the Moon। আমেরিকার মাথা খারাপ হয়ে গেলো
যখন তারা দেখলো যে চাঁদের অন্যপিঠের সব জায়গার নাম সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকজনের নামে
রাখা হয়ে গেছে।
এ যেন চাঁদের দখল নেবার প্রতিযোগিতা
শুরু হলো। সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘে আইন পাশ করা হলো যে মহাকাশের
সমস্ত গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র এবং অন্যান্য সব প্রাকৃতিক বস্তুর মালিকানা কোন দেশ
বা ব্যক্তির নয়। গবেষণা করার জন্য আন্তর্জাতিক সমঝোতা আইন মেনে চলতে হবে সবাইকে।
সে হিসেবে চাঁদের বা অন্য কোন গ্রহের মালিকানা কেউ দাবি করতে পারে না। সে যাই হোক,
নামকরণের ব্যাপারেও একটা আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি হলো ১৯৬১ সালে।
তারপরও সহজে বিতর্ক থামেনি। শেষ
পর্যন্ত ১৯৮২ সালে নাসা চাঁদের সব জায়গার নামের তালিকা প্রকাশ করে - Catalog
of Lunar Nomenclature। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়
গ্রহগুলোর সমস্ত আবিষ্কৃত জায়গার নামের তালিকা - Gazetteer of Planetary
Nomenclature 1994। ২০০৭ সালে নাসা ও গুগল মিলে
সিদ্ধান্ত নেয় যে চাঁদের উৎকৃষ্ট মানের ম্যাপ ও ছবি তৈরি করবে।
মানুষ যখন চাঁদে যাবার প্রস্তুতি শুরু
করে তার আগেই চাঁদের বিস্তারিত ম্যাপ তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু পৃথিবী থেকে চাঁদের
দূরত্ব কম হলেও এমন কোন সরাসরি রাস্তা নেই যে চাইলেই চলে যাওয়া যাবে। আজকাল তো
গাড়ি চালাতে ম্যাপও দেখতে হয় না। কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীর রাস্তা
খুঁজে বের করে ফেলে। কিন্তু চাঁদে যাওয়া অত সহজ নয়। কারণ ভেবে দেখো - পৃথিবী একটি
প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলা গ্রহ। এর গতিবেগ ঘন্টায় এক লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি। এই
প্রচন্ড গতিশীল গ্রহ থেকে প্রচন্ড গতির রকেট নিয়ে যেতে হবে চাঁদের কক্ষপথে। চাঁদ
কোন্ পথ দিয়ে যায় সেই পথে না গেলে মহাশূন্যে চাঁদকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। চাঁদও
গতিশীল। সাধারণ একটা চলন্ত রিক্সাতে ওঠাও যে কত মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চিন্তা
করো। সেখানে এতগুলো গতিশীল বস্তুর মধ্যে সমন্বয় করা। তুমি চাঁদকে হয়তো বলতে পারো
থামতে। কিন্তু সে থামবে না। পৃথিবীও তাই। কিন্তু মানুষ বড়ই বুদ্ধিমান প্রাণী।
চাঁদে যাবার ব্যবস্থা করেই ফেললো। দেখা যাক এবার কীভাবে চাঁদে গেলো মানুষ।
No comments:
Post a Comment