Sunday, 15 December 2019

চাঁদের নাম লুনা - ৩৩



চাঁদের পরিবেশ

চাঁদের নভোচারীদের পোশাক তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করেছো। চাঁদে নামার সময় ওরকমই আটঘাট বেঁধে নামতে হয় কারণ আমরা পৃথিবীর যে পরিবেশে অভ্যস্ত সেই পরিবেশের কিছুই নেই সেখানে। বাতাস ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না।
            চাঁদের বায়ুমন্ডল বলতে কিছুই নেই। খুব সামান্য পরিমাণে হিলিয়াম, নিয়ন, হাইড্রোজেন আর আর্গনের অস্তিত্ব আছে চাঁদে। কিন্তু হাইড্রোজেন ছাড়া বাকিরা সবাই নিষ্ক্রিয় গ্যাস - ফলে চাঁদে কোন বায়ুমন্ডল গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া এই গ্যাসগুলো খুবই হালকা। সেগুলোকে চাঁদের পিঠে ধরে রাখার জন্য জোরালো অভিকর্ষ দরকার। কিন্তু চাঁদের অভিকর্ষের মান খুবই কম।
            চাঁদের অভিকর্ষ পৃথিবীর অভিকর্ষের ছয় ভাগের এক ভাগ। পৃথিবীতে তোমার ভর যদি ৪০ কেজি হয়, চাঁদে তোমার ভর কত হবে বলতে পারবে? কী বললে? ছয় ভাগের এক ভাগ? না, ভর ঠিক ৪০ কেজিই থাকবে। ভরের কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু ওজনের পরিবর্তন হবে।[1] পৃথিবীতে তোমার ওজন যত, চাঁদে ওজন হবে তার ছয় ভাগের এক ভাগ। তার মানে সবকিছুই হালকা বলে মনে হবে। চাঁদের অভিকর্ষ ত্বরণ ১.৬৩৫ মিটার/বর্গ-সেকেন্ড। চাঁদের সব জায়গায় অভিকর্ষের মান সমান নয়। কিছু কিছু স্থানে ভূমির ঘনত্ব খুবই বেশি। সেই জায়গাগুলোকে বলে ম্যাসকন। ম্যাসকনের কারণে চাঁদের অভিকর্ষ খুবই রহস্যময়।
            অভিকর্ষ কম হওয়াতে চাঁদের মুক্তিবেগ পৃথিবীর মুক্তিবেগের তুলনায় অনেক কম। পৃথিবীর মুক্তিবেগ ঘন্টায় ৪০,৩২০ কিলোমিটার। চাঁদের মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ২.৩৮ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ৮,৫৬৮ কিলোমিটার। তার মানে পৃথিবী থেকে বেরিয়ে যেতে যত বেগে বের হতে হয়, চাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে তার মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ বেগ হলেই চলে।
            চাঁদের তাপমাত্রা খুব চরম ভাবাপন্ন। বায়ুমন্ডল না থাকাতে চাঁদের যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে সেই অংশে তাপমাত্রা প্রায় ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়। আবার যে অংশে সূর্যের আলো ও তাপ থাকে না সেই অংশের তাপমাত্রা খুবই কমে গিয়ে মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। চাঁদের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই হিসেবে বলা চলে চাঁদ একটি বিশাল আকৃতির ডিপ ফ্রিজ।
            চাঁদে শব্দ শোনা যায় না। কারণ শব্দতরঙ্গ কোন মাধ্যম ছাড়া চলাচল করতে পারে না। চাঁদে বাতাস নেই। তাই চাঁদ সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। চাঁদে নভোচারীরা পাশাপাশি দাঁড়িয়েও কথাবার্তা বলেছেন যান্ত্রিক মাইক্রোফোন ও রিসিভারের সাহায্যে।
            চাঁদে পানি নেই। চাঁদের মাটির শতকরা ৯৯ ভাগ জরিপ করেও কোন পানির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু চাঁদের স্পেস প্রোব লুনার প্রসপেক্টর চাঁদের মেরুতে খুব সামান্য কিছু জমাট বরফের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে। এগুলো চাঁদের মেরুর গভীর গর্তের ভেতর যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। বহুকোটি বছর আগে হয়তো কোন ধূমকেতু থেকে এই বরফ এসেছিল।
            চাঁদে মহাজাগতিক তেজষ্ক্রিয়তা অনেক বেশি। বায়ুমন্ডল না থাকার কারণে তেজষ্ক্রিয়তা শোষণ করার কোন উপায় নেই।
            চাঁদের চৌম্বকক্ষেত্র নেই বললেই চলে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে  পৃথিবীর কেন্দ্রে তরল লোহার ঘূর্ণনের ফলে। কিন্তু চাঁদের ঘনত্ব পৃথিবীর ঘনত্বের চেয়ে অনেক কম। চাঁদের কেন্দ্রে লোহা বা অন্য কোন ধাতুর গোলক থাকলেও তা হয়তো কঠিন। চাঁদের ঘূর্ণনের বেগ পৃথিবীর ঘূর্ণনের বেগের তুলনায় এত কম যে চাঁদের ঘূর্ণনের দ্বারা কোন বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই চৌম্বকক্ষেত্রও নেই।
            চাঁদের দিন-রাত্রি পৃথিবীর দিন-রাত্রির তুলনায় খুবই দীর্ঘ। চাঁদ নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে ২৮ দিন সময় নেয়। তাই চাঁদের একদিকে ১৪ দিন ধরে একটানা দিনের আলো থাকে, আর অন্যদিকে চৌদ্দ দিন ধরে একটানা রাতের অন্ধকার থাকে।
            চাঁদের আকাশ কালো। কারণ সেখানে কোন বায়ুমন্ডল নেই। তাই সূর্যের আলোর কোন বিচ্ছূরণ ঘটে না। চাঁদের যেখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে সেখানেই শুধু আলো থাকে। বাকি অংশে সেই আলো যায় না। পৃথিবীর আকাশের এক জায়গায় সূর্য থাকলেও বায়ুমন্ডলের কারণে সেই আলো সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চাঁদে সেটা ঘটে না। চাঁদের কালো আকাশে তারা দেখা যায়। কিন্তু সেই তারার আলো স্থির, পৃথিবীর আকাশের মতো ঝিকমিক করে না।
            চাঁদের মাটির রাসায়নিক উপাদান পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেখানে অক্সিজেন, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, ও সোডিয়ামের অস্তিত্ব আছে। খুব সামান্য পরিমাণে টাইটানিয়ামও আছে। মোট রাসায়নিক উপাদানের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ অক্সিজেন। কিন্তু এই অক্সিজেনগুলো সব অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত আছে যে আলাদা অক্সিজেন গ্যাস নেই বললেই চলে। সিলিকনের পরিমাণ শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ, আর অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণ শতকরা প্রায় দশ ভাগ। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ তার চেয়ে কম।


চাঁদের আলো

পূর্ণিমার চাঁদে যখন আলোর বন্যায় ভেসে যায় চারদিক, তখন মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বনে চলে যেতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ইচ্ছের কথা জেনেই মনে হয় লিখেছিলেন "আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে ... ...।" কিন্তু বনে যাওয়ার সুযোগ কোথায়? তাই বনের বদলে ছাদে চলে যাই চাঁদ দেখতে। কী যে ভালো লাগে। চাঁদের নিজের আলো নেই, সূর্যের আলো চাঁদের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে যেটুকু আসে তাতেই এত আলো! সূর্য হলো রাগী বড়মামার মতো, সরাসরি তাকানো যায় না। আর চাঁদ হলো হাসিখুশি ছোটখালার মতো, যতক্ষণ খুশি তাকিয়ে থাকা যায়।
            সুর্যের আলোর কতটুকু প্রতিফলিত হয় চাঁদের পিঠ থেকে? চাঁদ খুব একটা ভালো প্রতিফলক নয়। যতটুকু আলো তার গায়ে পড়ে তার মাত্র শতকরা সাত ভাগ আলো ফিরিয়ে দেয়। বাকি তিরানব্বই ভাগ আলো চাঁদের পিঠে শোষিত হয়ে যায়। সে তুলনায় আমাদের পৃথিবী অনেক বেশি ভালো প্রতিফলক। পৃথিবী শতকরা ৩৯ ভাগ আলোর প্রতিফলন ঘটায়। চাঁদ থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে চাঁদের চেয়েও উজ্জ্বল দেখায় আমাদের পৃথিবী।
            চাঁদের আলোর প্রখরতা (intensity of light) মাত্র ০.২ লাক্স।[2] একটি মোমবাতির আলোর প্রখরতাও চাঁদের আলোর প্রখরতার দশ গুণ। চাঁদের আলোয় তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গের সবগুলো কম্পাঙ্কই আছে। তবে সূর্যের আলোর দৃশ্যমান কম্পাঙ্কের সমস্ত বর্ণ চাঁদের আলোয় দেখা যায় না। তাই একেবারে ঝকঝকে পূর্ণিমার আলোতেও আমরা স্বাভাবিক আকৃতির অক্ষরে ছাপানো বই পড়তে পারি না। চাঁদের আলোয় রঙ চেনা যায় না।
            সন্ধ্যাবেলা যখন পূর্বদিকে পূর্ণিমার চাঁদ ঊঠে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখার সময় চাঁদকে স্বাভাবিকের চেয়েও বড় বলে মনে হয়। মনে হয় কত কাছে চলে এসেছে এই চাঁদ। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে চাঁদ যখন আকাশের উপরে উঠে যায়, মনে হয় চলে গেছে অনেক দূরে, আর আকারেও অনেক ছোট হয়ে গেছে।
            কেন এমন হয়? এটা হয় মূলত পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে চাঁদের আলোর প্রতিসরণ ও বিচ্ছুরণের কারণে, এবং কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক কারণে। গাছপালা ইত্যাদির দূরত্ব আমরা জানি। তাই সেগুলোর ফাঁক দিয়ে চাঁদ ওঠার সময় আপেক্ষিকভাবে মনে হয় চাঁদ অনেক কাছে। সেকারণে চাঁদের আকারও অনেক বড় মনে হয়। আবার চাঁদ যখন আকাশের অনেক উপরে উঠে যায় সেখানে দূরত্ব তুলনা করার মতো আর কোন কিছু থাকে না। তাই মনে হয় চাঁদ দূরে চলে গেছে। আর মনের স্বাভাবিক হিসেব - দূরের জিনিস ছোট দেখা যাবে। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো চন্দ্রোদয়ের সময় চাঁদের দূরত্ব মাঝ আকাশের চাঁদের দূরত্বের চেয়ে কয়েক হাজার কিলোমিটার বেশি।

           





[1] ওজন হলো ভর ও অভিকর্ষজ ত্বরণের গুণফলের সমান। চাঁদের অভিকর্ষজ ত্বরণের মান পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের ছয় ভাগের একভাগ।
[2] লাক্স (Lux) হলো আলোর প্রখরতার একক। একটা ছোট্ট মোমবাতি জ্বালালে সেটা থেকে এক মিটার দূরে আলোর যে প্রখরতা হবে সেটার পরিমাণ এক লাক্স।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts