অ্যাপোলো প্রোগ্রাম
চাঁদে
অভিযানের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল চাঁদের মাটিতে পা রাখা। সেই লক্ষ্যে ১৯৬১ সাল থেকে
নিরলস পরিশ্রম করেছেন কয়েক হাজার বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী সহ আরো অনেক পেশার
বিশেষজ্ঞরা। বিশাল বাজেটের একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ আমেরিকার চন্দ্রাভিযান। অ্যাপোলো
মিশন হলো চাঁদে অভিযানের চূড়ান্ত মিশন। অ্যাপোলো নামটা দেয়া হয়েছে প্রাচীন গ্রিক
দেবতা অ্যাপোলোর নাম অনুসারে।
অ্যাপোলো মিশনের লক্ষ্য ছিল চাঁদে
মানুষ নিয়ে যাওয়া, চাঁদের পিঠে যন্ত্রপাতি স্থাপন করা, চাঁদের ভূতত্ত্ব ও চাঁদের
উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস জানার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, চাঁদের উপাদান -
ধুলো, মাটি, পাথর ইত্যাদি সংগ্রহ করে সেগুলো সাথে নিয়ে পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে আসা।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ পেরিয়ে মহাশূন্যে
যেতে হলে পৃথিবী থেকে মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি বেগে ছুটে যেতে হবে। পৃথিবীর
মুক্তিবেগ বা স্কেইপ ভেলোসিটি হলো সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ৪০ হাজার ৩২০ কিলোমিটার। এরকম বেগ অর্জন করার
জন্য শক্তিশালী রকেটের দরকার। চন্দ্রযান
যত উন্নত হয়েছে সাথে সাথে রকেটও তত উন্নত হয়েছে। চাঁদের সবগুলো মিশনে চন্দ্রযান
উৎক্ষেপণ করা হয়েছে রকেটের মাধ্যমে। অ্যাপোলো মিশনের জন্য শক্তিশালী
স্যাটার্ন-ফাইভ (Saturn V)
রকেট ব্যবহার করা হয়েছে।
অ্যাপোলো
প্রোগ্রামে প্রতিটি মিশনে চাঁদে যাওয়ার জন্য তিনজন করে অভিজ্ঞ নভোচারী বাছাই করা
হয়। তারপর কয়েক বছর ধরে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চাঁদের কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি
করে সেখানে প্রশিক্ষণ চলে। চাঁদে যাওয়া এবং আসার পথে তাঁদের যা যা করতে হবে
সবকিছুরই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চাঁদে গিয়ে কী কী করতে হবে তার প্রশিক্ষণও তাঁরা পায়।
মহাকাশে তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাণ অনেক বেশি এবং কোন বাতাস নেই। তাই নভোচারীদের বিশেষ
পোশাক পরতে হয়। সেই পোশাকে অভ্যস্ত হবার প্রশিক্ষণ চলে মাসের পর মাস। মহাকাশে অভিকর্ষ
বল শূন্য। চাঁদের অভিকর্ষ পৃথিবীর অভিকর্ষের ছয় ভাগের এক ভাগ। সেই পরিবেশে
চারপাশের সবকিছুই বদলে যায়। দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নভোচারীরা
মহাশূন্যের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যান মহাশূন্যে যাবার আগেই। আমেরিকার হিউস্টনে এই
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। কিন্তু সবগুলো অ্যাপোলো মিশনের রকেট উৎক্ষেপণ করা
হয়েছে ফ্লোরিডা থেকে।
স্যাটার্ন-ফাইভ এর একেবারে সামনের
অংশে থাকে অ্যাপোলো চন্দ্রযান। অ্যাপোলো মিশনের সবগুলো চন্দ্রযানের তিনটি অংশ: কমান্ড মডিউল (Command Module), সার্ভিস মডিউল (Service Module),
এবং লুনার মডিউল (Lunar Module)।
কমান্ড
মডিউল একটি কোণাকৃতি অংশ যার উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন
মিটার। এর ভেতরের কন্ট্রোল প্যানেলে আছে চব্বিশ রকমের যন্ত্রপাতির ডিসপ্লে
স্ক্রিন, ৭১টি লাইট, এবং ৫৬০টি সুইচ। নভোচারী তিনজন পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়া আসার
পুরো সময়টা থাকেন কমান্ড মডিউলে।
সার্ভিস
মডিউল হলো সাড়ে সাত মিটার লম্বা ও চার মিটার ব্যাসের
একটি বড় সিলিন্ডার। এটাতে একটি মূল ইঞ্জিন আছে এবং ছোট ছোট কয়েকটি মোটর আছে।
সার্ভিস মডিউলে থাকে কমান্ড মডিউলের জ্বালানি, এবং অক্সিজেন, পানি ও
বিদ্যুৎ সরবরাহের যন্ত্রপাতি। কমান্ড মডিউল ও সার্ভিস মডিউল পরস্পরের সাথে লেগে
থাকে।
লুনার মডিউল প্রায় সাত মিটার উঁচু। লুনার
মডিউলের দুটো অংশ। চাঁদের কক্ষপথ থেকে চাঁদের মাটিতে নামার জন্য একটি অংশ ব্যবহৃত
হয়, আবার চাঁদ থেকে চাঁদের কক্ষপথে কমান্ড মডিউলে ফিরে আসার জন্য অন্য অংশ ব্যবহৃত
হয়। লুনার মডিউল চাঁদে যাবার সময় কমান্ড মডিউল ও সার্ভিস মডিউলের সাথে থাকে। লুনার
মডিউল বায়ুশূন্য স্থানেই শুধু উড়ে। সে কারণে তার ডিজাইন করার সময় যে কোন আকৃতির
করা যায়। অ্যাপোলো-১১ এর লুনার মডিউলের নাম ছিল ঈগল।
রকেট
স্যাটার্ন-ফাইভ অ্যাপোলো চন্দ্রযানকে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে দিয়ে চন্দ্রযান থেকে
আলাদা হয়ে যায়। রকেটটি তখন মহাশূন্যে ভাসতে থাকে।
অ্যাপোলো চন্দ্রযান চাঁদের কক্ষপথে
ঘুরতে থাকে। চাঁদের নির্দিষ্ট সুবিধাজনক স্থানে আসার পর দুইজন নভোচারী লুনার মডিউল
নিয়ে চাঁদে নামে। অন্য নভোচারী কমান্ড মডিউলে থেকে চাঁদের কক্ষপথে ঘুরতে থাকে।
দুজন নভোচারী লুনার মডিউলে করে চাঁদে নেমে সেখানে নির্দিষ্ট কাজ শেষ করে লুনার
মডিউলে করে আবার চাঁদের কক্ষপথে কমান্ড মডিউলে ফিরে আসে।
কমান্ড মডিউলে আসার পর লুনার মডিউলকে
মহাশূন্যেই ছেড়ে দেয়া হয় কারণ সেটার আর দরকার নেই। এবার কমান্ড মডিউল ও সার্ভিস
মডিউল পৃথিবীর দিকে রওনা দেয়।
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢোকার ঠিক আগে
কমান্ড মডিউল থেকে সার্ভিস মডিউল আলাদা হয়ে যায়। সার্ভিস মডিউলেরও আর কোন দরকার
থাকে না। তিনজন নভোচারীকে নিয়ে শুধুমাত্র কমান্ড মডিউলই পৃথিবীতে ফিরে আসে।
কমান্ড মডিউল পৃথিবীতে এসে সাগরে পড়ে।
সেখান থেকে আমেরিকান নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার নিয়ে নভোচারীদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে
যাওয়া হয়। কিছুদিন তাঁদেরকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয় যেন কোন ধরনের
তেজষ্ক্রিয়তা বা মহাকাশের কোন অজানা রোগজীবাণুর সংক্রমণ পৃথিবীতে ঘটতে না পারে।
সবগুলো
অ্যাপোলো মিশনেই এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। সতেরোটি অ্যাপোলো মিশনের মধ্যে ছয়টি মিশন
চাঁদে যায়। অ্যাপোলো-১ উৎক্ষেপণের সময়ে আগুন লেগে কমান্ড মডিউলের ভেতর পুড়ে মারা
যান তিনজন নভোচারী। অ্যাপোলো-১৩ মহাশূন্যে ওঠার পর অক্সিজেন ট্যাংকে আগুন লেগে
যায়। অনেক কষ্টে তিনজন নভোচারীকেই সুস্থ অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।
অ্যাপোলো মিশনের ছয়টি মিশনে মোট বারোজন নভোচারী চাঁদের বুকে হেঁটে বেড়িয়েছে ১৯৬৭
থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে।
No comments:
Post a Comment