চলো যাই চাঁদের দেশে
"আচ্ছা লুনা, চাঁদের এত কিছু জানার পর এখনো কি তোর চাঁদের ভয়
যায়নি?"
স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে
আমরা চাঁদের প্রেজেন্টেশান রেডি করছিলাম। লাইব্রেরি এখন ছুটির পর বিকেল পাঁচটা
পর্যন্ত খোলা থাকে। লুনা তার ল্যাপটপ কম্পিউটারে প্রেজেন্টেশান স্লাইডে অ্যাপোলো
মিশনের ছবি আপলোড করতে করতে আমার দিকে তাকালো। তারপর হাসিমুখে বললো, "ডোন্ট
নো ইয়েট। চাঁদ দেখলে বুঝতে পারবো।"
"তুই চাঁদ দেখবি?
"তোরা সবাই দেখবি,
আর আমি বসে থাকবো?"
"তোর সেলিনোফোবিয়ার
কী হবে?"
"ভয়কে জয় করতে হলে
ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় মাই ফ্রেন্ড।"
"ইয়েস, ইফ ইউ
ওয়ান্ট জয়, স্ট্যান্ড ইন ফ্রন্ট ভয়।"
এরা দেখছি আফতাব স্যারের
ডায়লগ ঝাড়ছে। লুনা এখন ইংরেজির চেয়ে বাংলা বেশি বলে। আর স্বাতীর হয়েছে উল্টো। সে ভয়ংকর
রকমের ইংরেজি বলতে শুরু করেছে। চিত্রা তাড়া দিলো, "হেই তোরা কথা বন্ধ করে কাজ
শেষ কর। বাসায় যেতে হবে।"
"তার আগে চল চাঁদ
থেকে ঘুরে আসি।"
তার মানে আমাদের
প্রেজেন্টেশান রেডি। এবার পুরোটা একবার দেখার পালা। চলো যাই চাঁদের দেশে।
মনে করো চাঁদে যাবার জন্য দীর্ঘদিনের কঠোর
প্রশিক্ষণের পর সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কমান্ড মডিউলে উঠে বসলে। প্রচন্ড
বিস্ফোরণের সাথে সাথে প্রচন্ড গতিতে রকেট উড়লো। তোমার মনে হবে শরীরের ওজন বেড়ে
যাচ্ছে। পৃথিবী অভিকর্ষ বলে টেনে রাখতে চাইছে তোমাকে। রকেটের গতি যত বাড়ছে এই টানও
তত বাড়ছে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই তুমি পৃথিবীর টান ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। পৃথিবীর
বায়ুমন্ডলের বাইরে মহাকাশে পৌঁছে যাবে।
এবার
তুমি দেখবে হঠাৎ সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তোমার মনে হবে তুমি শোলার মতো হালকা
হয়ে গেছো। কমান্ড মডিউলে সবকিছু নিদির্ষ্ট জায়গায় আটকে না রাখলে শূন্যে ভাসতে
থাকবে। ইচ্ছে করলে তুমি শূন্যে উড়তেও পারবে। কারণ সেখানে কোন মাধ্যাকর্ষণ নেই।
পৃথিবী
থেকে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছাতে তিন দিন লাগবে। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর
চন্দ্রযানের কমান্ড ও সার্ভিস মডিউল এবং লুনার মডিউল ছাড়া রকেটের বাকি অংশ আলাদা
হয়ে যাবে। কমান্ড মডিউল থেকে চাঁদের দিকে তাকালে পরিষ্কার দেখতে পাবে গোলাকার
চাঁদ। চাঁদের যতই কাছে যাবে দেখবে চাঁদের আসল চেহারা। চাঁদের যে দিকটা আমরা পৃথিবী
থেকে দেখতে পাই, সেটা তো দেখবেই, চাঁদের অন্যপিঠও দেখবে।
চাঁদের
কক্ষপথে বেশ কয়েকবার প্রদক্ষিণ করার পর কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউল আলাদা করে
ফেলবে। কমান্ড মডিউলের পাইলট কমান্ড মডিউল চাঁদের কক্ষপথে চালাতে থাকবে। তুমি ও
লুনার মডিউলের পাইলট লুনার মডিউলে উঠে চাঁদের দিকে যাবে। লুনার মডিউলের ইঞ্জিন ও
স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশান সিস্টেম চাঁদে নামার উপযুক্ত স্থানে ল্যান্ড করাবে লুনার
মডিউল। চাঁদে যেহেতু কোন বাতাস নেই নামার সময় কোন ঝাঁকুনি বা দুলুনি এসব কিছুই
পাবে না। চাঁদের উপরিতল ধুলোময়। লুনার মডিউল ধুলোর উপর ল্যান্ড করবে।
লুনার
মডিউল থেকে বাইরে বের হবার সময় সাথে সব দরকারি যন্ত্রপাতি নিয়ে বের হবে। চাঁদের
মাটিতে পা দিয়ে দেখবে নিজের ওজন ছয় ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। বাতাস নেই বলে ধুলোবালি
একটুও নড়বে না। তুমি যদি কোন দাগ দাও সেখানে সেটা সেরকমই রয়ে যাবে কোটি বছর।
তুমি
দেখবে চাঁদের বুকে পৃথিবী থেকে পাঠানো অনেক যন্ত্রপাতি, অ্যাপোলো অভিযাত্রীদের ফেলে
আসা যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসপত্র পড়ে রয়েছে।
আগের অ্যাপোলো মিশনের ছয়টি লুনার মডিউলের ল্যান্ডিং পার্টসও দেখতে পাবে
সেখানে। তোমার বুটের নিচে চাঁদের মাটি রেগোলিথ দেখবে অনেকটা নরম পলির মতো। চারপাশে
দেখবে অনেকটা ধূসর উঁচুনিচু নদীর চরের মতো। মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট গর্ত। তারপর
কিছু উঁচু পাহাড় আর উপত্যকা।
চাঁদের
পাহাড়ের উপর উঠে দেখলে মনে হবে দিগন্ত যেন খুব কাছে চলে এসেছে। পৃথিবীর চারভাগের
এক ভাগ সাইজের একটা গোলকের ওপর তুমি দাঁড়িয়েছো, তাই তাঁর সীমান্তের বাঁকগুলো চোখে
পড়বে - কারণ তোমার দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করার মতো কিছুই নেই সেখানে।
আকাশের
দিকে তাকিয়ে দেখবে সূর্য। কিন্তু সূর্যকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেই দেখবে ঘন অন্ধকার।
পৃথিবীতে যেমন সূর্য পূর্বদিকের আকাশে থাকলেও পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ে সেই আলো, চাঁদে
কিন্তু সেরকম নয়। চাঁদের আকাশ কুচকুচে কালো। বায়ুমন্ডল নেই বলে সূর্যের আলোর কোন
বিচ্ছুরণ নেই। চাঁদ থেকে পৃথিবীর উদয় ও অস্তও দেখতে পাবে। চাঁদ থেকে পৃথিবীকে একটি
নীল গোল মার্বেলের মতো লাগবে।
চাঁদের
ল্যান্ডস্কেপ দেখতে হলে লুনার মডিউলে ঢুকে যাও। তারপর মডিউল নিয়ে চাঁদের উপর ভূমি
থেকে ১০০ মিটারের মত উঁচু দিয়ে ঊড়তে উড়তে তুমি চাঁদের পিঠের বড় বড় গর্ত, পাহাড় আর
শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো সমতল ভূমি দেখতে পাবে - যেগুলোর নাম মারিয়া বা সমুদ্র। চাঁদের পৃষ্ঠের প্রায় ১৭% জুড়ে আছে এই মারিয়া। এগুলো সব তৈরি হয়েছিল চাঁদের বুকে আগ্নেয়গিরির লাভার
স্রোতের প্রবাহে।
আগ্নেয়গিরির লাভার উপস্থিতিও পাওয়া গেছে চাঁদের পিঠে। কিন্তু ঠিক কোথায় আগ্নেয়গিরির ফাটলগুলো আছে তা বের করা সহজ নয়। তবে ভেতরের গ্যাস ও
লাভা উদ্গীরণ ঘটে প্রায় কয়েক শ' কিলোমিটার পর্যন্ত চলে যায়। সেগুলো আবার শুকিয়েও
যায়।
তুমি দেখবে সি অব নেকটার বা অমৃত-সাগর
যেটা সৃষ্টি হয়েছিল ৩৫০ কোটি থেকে ৩৮০ কোটি বছর আগে। প্রায় একই সময়ে সৃষ্টি হওয়া
সি অব ট্রাংকুইলিটি - যেখানে নেমেছিল অ্যাপোলো-১১ এর লুনার মডিউল ঈগল।
কয়েকটি
প্রধান মারিয়ার অবস্থান উপরের চিত্রে দেখানো হয়েছে। এই মারিয়াগুলোকেই আমরা পৃথিবী
থেকে দেখতে পাই চাঁদের গায়ে কালো কালো দাগের মতো।
৬০০ কিলোমিটার লম্বা মারে ইমব্রিয়ামের কিনারা ঘেঁষে দেখবে অ্যাপেনিয়াস
পর্বত যার সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা তিন কিলোমিটারের বেশি।
ছোটবড় অসংখ্য ক্রেটার (Crater) বা গর্ত আছে চাঁদের গায়ে।
বেশিরভাগই সৃষ্টি হয় চাঁদের পিঠে গ্রহাণুর আঘাতে তিন শ কোটি বছর আগে, যখন সৌরজগতের
মধ্যে হাজার হাজার গ্রহাণু ঘুরে বেড়াতো আর চাঁদের পিঠও ছিল নরম। গ্রহাণুগুলো চাঁদের পিঠে এত জোরে পড়েছে যে গর্তগুলোর
আকার হয়েছে বস্তুগুলোর আকারের চেয়ে ১৫ গুণ বড়।
অনেকগুলো বড় বড় গর্তের নাম রাখা হয়েছে
বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের নামে। দেখবে কম্পটন নামের ১৬০ কিলোমিটার ব্যাসের
একটি বড় গর্ত। কপারনিকাসের ব্যাস ৯১ কিলোমিটার, প্ল্যাটোর ব্যাস ১০৯ কিলোমিটার,
টাইকো ব্রাহের ব্যাস ৮৫ কিলোমিটার, আর্কিমেডিসের ব্যাস ৮২ কিলোমিটার।
এবার তোমার লুনার মডিউলকে উড়িয়ে নিয়ে
যাও চাঁদের অন্যপিঠে। এই পিঠটা পৃথিবী থেকে কখনোই দেখা যায় না। এদিকে তুমি কোন
'মারে' দেখতে পাবে না। কিন্তু অসংখ্য গর্ত দেখতে পাবে। চাঁদের এই অবস্থা থেকে এরপর
থেকে তোমাকে কেউ 'চাঁদের মতো মুখ' বললে তোমার মেজাজ খারাপ হতে পারে। চাঁদের এই
দিকের পিঠের সর্বনিম্ন ভূমি থেকে সর্বোচ্চ ভূমির উচ্চতার পার্থক্য প্রায় ষোল
কিলোমিটার।
এবার চলো চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে।
সেখানে দেখতে পাবে চাঁদের সবচেয়ে বড় ক্রেটার - 'সাউথ পোল অ্যাইটকেন' (South Pole-Aitken)।
৪৩০ কোটি বছর আগে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি চওড়া এই গর্তের সৃষ্টি
হয়েছিল। আগ্নেয়গিরির লাভার স্রোত এখানে এসে পৌঁছায়নি, তাই এটা ক্রেটারই রয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment