প্রাচীন চাঁদ প্রাচীন বিশ্বাস
আমার
দাদুর কাছে ছোটবেলায় চাঁদের যে গল্প শুনেছি তোমরাও হয়তো শুনেছো। অনেক অনেক বছর আগে
এক বুড়ি ছিল। বুড়ির একটি বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির একটা উঠোন ছিল। বুড়ি প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে উঠোন পরিষ্কার করতেন। চাঁদ তখন
পৃথিবীর খুব কাছে ছিল। এত কাছে ছিল যে উঠোনে দাঁড়ালে চাঁদের গায়ে মাথা ঠেকে যেতো।
আর চাঁদের গায়ের সব ধুলোবালি উঠোনে এসে পড়তো। একদিন বুড়ি উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে
ক্লান্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সাথে সাথে চাঁদের গায়ে ঠেকে গেলো বুড়ির মাথা। চাঁদের
ধুলো ঝরে পড়লো বুড়ির গায়ে মাথায় আর উঠোনে। বুড়ি রেগে গিয়ে চাঁদকে করলো ঝাড়ুপেটা।
চাঁদ ক্ষোভে দুঃখে একেবারে দূরে চলে গেলো। যাবার সময় করলো কী - বুড়িকেও ধরে নিয়ে
গেলো। সেই থেকে বুড়ি চাঁদে থাকে। কাজকর্ম কিছু নেই, তাই বসে বসে চরকায় সুতো কাটে।
গল্পটা শুনে হয়তো তোমাদের হাসি
পাচ্ছে। কিন্তু কল্পকাহিনি তো এরকমই। পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হয়েছে যখন থেকে তার
অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডল তৈরি হয়েছে, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ,
গাছপালা সব পৃথিবীতে এসেছে মানুষের অনেক অনেক বছর আগে। ডায়নোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে
পৃথিবীতে মানুষ আসার প্রায় ছয় কোটি বছর আগে। মানুষ পৃথিবীতে চোখ মেলেই দিনে সূর্য
ও রাতে চাঁদের দেখা পেয়েছে। যখন প্রযুক্তি বলতে কিছুই ছিল না, মানুষ আগুন জ্বালাতে
শিখেনি, তখন আলোর একমাত্র উৎস ছিল সূর্য ও চাঁদ। এগুলো আসলে কী সে সম্পর্কে কোন
ধারণাই তখন ছিল না কারো। অন্ধকারকে মানুষ ভয় পায়। সেই অন্ধকার যখন সূর্যের আলোয়
দূর হয়ে যায় তখন সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু হয়। গতিবিধি লক্ষ্য করা হয়। সূর্যের
দিকে খালিচোখে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। সে তুলনায় চাঁদ অন্যরকম। যতক্ষণ খুশি
চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। কিন্তু মানুষ দেখলো চাঁদ বড় রহস্যময়। প্রত্যেকদিন
বদলে যায় তার চেহারা। আকাশে থাকার সময়ও বদলে যায়। কিন্তু মানুষ প্রতিদিন দেখতে
দেখতে বুঝে ফেলে চাঁদের গতিপ্রকৃতি। ভয় ও কৃতজ্ঞতা থেকে মানুষের মনে প্রকৃতির
প্রতি ভক্তি জন্মে। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্নরূপে হতে থাকে প্রকৃতিপূজা। তাই
দেখা যায় প্রাচীন মানুষের সমস্ত প্রাকৃতিক কাজের জন্যই দেবতা আছে। যেমন বৃষ্টির
দেবতা, সূর্যের দেবতা, চন্দ্রের দেবতা, বজ্রপাতের দেবতা, রোদের দেবতা, আগুনের
দেবতা, মাটির দেবতা ইত্যাদি।
প্রাচীন মিশরীয়দের চাঁদের দেবতার নাম
ছিল থোৎ (Thoth)। কুকুরের মাথাবিশিষ্ট থোৎ হলো
চাঁদের রক্ষক। বিভিন্ন তিথিতে চাঁদের আকারের যে পরিবর্তন দেখা যায় সে সম্পর্কে
মিশরীয়দের প্রচলিত বিশ্বাস এরকম: আকাশে নৌকা
করে বেড়াতে বের হয় চাঁদ। কিন্তু পথে এক দৈত্য চাঁদকে গিলে ফেলতে থাকে। তখন চাঁদ আস্তে
আস্তে ছোট হয়ে যেতে থাকে। যখন একেবারে দৈত্যের পেটের মধ্যে চলে যায় তখন চাঁদকে
একেবারে দেখা যায় না। এদিকে বডিগার্ড থোৎ বসে থাকে না। সে দৈত্যের সাথে যুদ্ধ করে
দৈত্যকে বাধ্য করে চাঁদকে বের করে দিতে। তখন চাঁদ আস্তে আস্তে দৈত্যের পেটের ভেতর
থেকে বের হয়ে আসে। আমরা দেখি চাঁদ আস্তে আস্তে বড় হতে হতে পূর্ণচন্দ্র অর্থাৎ
পূর্ণিমা হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে গিলে ফেলা আর উগরে দেয়া।
রোমানদের চাঁদের দেবী লুনার কথা আমরা
আগেই বলেছি। এই লুনা থেকে অনেক শব্দ আমাদের জীবনে এসেছে যা আমরা এখনো ব্যবহার করি।
যেমন চাঁদ সম্পর্কিত ব্যাপার বোঝাতে আমরা 'লুনার' (lunar) শব্দটা ব্যবহার করি। যেমন লুনার মান্থ বা চাঁদের মাস, লুনার ক্যালেন্ডার,
লুনার ফেস্টিভ্যাল বা চাঁদের উৎসব।
লুনাটিক (lunatic) শব্দটি এসেছে চাঁদ থেকে। মানসিক রোগীর আটপৌরে নাম। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবশ্য
এই শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। বাংলায় 'পাগল' শব্দটি আমরা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার
করি। কিন্তু লুনাটিক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো চন্দ্রগ্রস্ত। এটা এসেছে একটা
প্রাচীন বিশ্বাস থেকে। সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনো অনেকে বিশ্বাস করে যে চাঁদ কোন
কোন মানুষকে পাগল করে দিতে পারে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অনেকে পাগল হয়ে যায় - এমন
বিশ্বাসও অনেকে করে। অনেকে মনে করে যে পূর্ণিমার সময় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়,
মানসিক রোগের তীব্রতা বাড়ে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বেড়ে যায় ইত্যাদি। কিন্তু
এগুলোর কোনটারই কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। কিন্তু মানুষ যখন বিশ্বাসের দাস হয় তখন
বিজ্ঞানকেও অস্বীকার করতে চায়।
প্রাচীন
গ্রিকদের চাঁদের দেবী সেলিনির কথা বলেছি একটু আগে। সেলিনি হলো পূর্ণিমার চাঁদের
দেবী। তাদের কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের দেবী হলো হেকেটি (Hecate)। উপরের ছবিতে তোমরা দেখতে পাচ্ছো মশাল হাতে অন্ধকার দূর করতে বেরিয়েছে
হেকেটি। গ্রিকদের শুক্লপক্ষের চাঁদের দেবী হলো আর্টিমিস (Artemis)। রোমানরা আর্টিমিসকে বলে ডায়ানা (Diana)।
আর্টিমিস বা ডায়ানাকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার শিকারের দেবী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়
ডায়ানাকে। রোমানরা মনে করে ডায়ানা হলো ভয়ংকর সুন্দর। শুক্লপক্ষের চাঁদের মতোই
সুন্দর। আবার মানুষকে ভয়ংকর পাগলও করে দিতে পারে।
মেক্সিকান
অ্যাজটেক (Aztec) জাতির বিশ্বাসে বিভৎসতার প্রাধান্য বেশি। তাদের চাঁদের দেবীর নাম
কয়োলসাউকি (Coyolxauhqui)। তারা বিশ্বাস
করে কয়োলসাউকিকে কেটে টুকরো টুকরো করে আকাশে ছুড়ে দেয় তার নিজের ভাই। কয়োলসাউকির
শরীরের অংশগুলো আকাশে গিয়ে গোল হয়ে চাঁদের আকার নিয়েছে। সেই থেকে কয়োলসাউকি
মেক্সিকানদের চাঁদের দেবী।
চাঁদ
সম্পর্কে চায়নিজদের অনেকরকম বিশ্বাস আছে। চায়নিজ নিউ ইয়ার বা চীনা নববর্ষ একটা
বিরাট উৎসব। চাঁদের হিসেব অনুযায়ী তাদের চায়নিজ ক্যালেন্ডার। লুনা অনেক গল্প জানে
চায়নিজদের চাঁদ সম্পর্কে।
চায়নিজরা বিশ্বাস করে চাঁদে একটা
খরগোস আছে। এই খরগোসটা চাঁদে কীভাবে গিয়েছে? একবার তিনজন চাঁদের পরী পৃথিবীতে
বেড়াতে এসে ক্ষুধার্ত হয়ে গেলো। তখন তারা ভিক্ষুকের বেশ ধারণ করে খাবার ভিক্ষা
করতে বের হলো। একটা শিয়াল, একটা কাক ও একটা খরগোশ দেখতে পেয়ে তাদের কাছে খাবার
চাইলো। শিয়াল ও কাকের কাছে খাবার ছিল। তারা ভিক্ষা দিলো। কিন্তু খরগোশের কাছে
দেবার মতো কোন খাবার ছিল না। তাই সে বললো, 'আমি আগুনে ঝাঁপ দেবো। তখন তোমরা আমার
পোড়া মাংস খেয়ো।' বলেই খরগোশ আগুনে ঝাঁপ দিলো। এতে খরগোশের এরকম আত্মত্যাগ দেখে
পরীরা খরগোশকে প্রাণ ফিরিয়ে দিলো এবং সাথে করে চাঁদে নিয়ে গেলো। সেই থেকে খরগোশ
চাঁদে থাকে। "পরীদের যদি এমন ক্ষমতা থাকে, তাদের ভিক্ষা করে খেতে হলো
কেন?" এরকম প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এগুলো
সব রূপকথা। রূপকথায় যুক্তি খোঁজা নিরর্থক।
চায়নিজদের
চাঁদের দেবতা কিন্ত খরগোশ নয়। তাদের চাঁদের দেবীর নাম চাঙ্গি (Chang'e)। চাঙ্গি সম্পর্কে অনেকগুলো গল্প প্রচলিত আছে। একটা গল্প হলো এরকম:
চাঙ্গি ও তার স্বামী হাউই
(Houyi) বাস করতো আকাশে। তারা দুজনই
ছিল অমর। হাউই ছিল খুব ভালো তীরন্দাজ। জেইড সম্রাটের আকাশে সুখেই ছিল তারা। জেইড
সম্রাটের দশটি ছেলে। একদিন তারা সবাই সূর্য হয়ে গেলো। দশটি সূর্যের উত্তাপে আকাশে
টেকা দায় হয়ে পড়লো। জেইড সম্রাট হাউকে বললেন কিছু করা যায় কিনা দেখতে। হাউই
তীরন্দাজ। তীর ছুঁড়ে মেরে ফেললো দশ সূর্যের নয় সূর্যকে। ছেলেদের হারিয়ে সম্রাট
শোকে রাগে হাউই আর চাঙ্গিকে আকাশ থেকে তাড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন পৃথিবীতে। পৃথিবীতে
নেমে চাঙ্গি আর হাউই অমরত্ব হারিয়ে ফেললো।
মরে
যেতে হবে ভেবে চাঙ্গির খুব মন খারাপ। হাউই অমরত্ব কীভাবে ফিরে পাওয়া যায় চেষ্টা
করতে লাগলো। চেষ্টা করতে করতে একদিন অমরত্বের ট্যাবলেট পেয়ে গেলো। একটা কৌটার
মধ্যে ট্যাবলেটটা রেখে চাঙ্গিকে বললো কৌটার মুখ না খুলতে। কিন্তু চাঙ্গির কৌতূহল
হলো। সে কৌটা হাতে নিয়ে দেখলো কৌটার ভেতর থেকে কী সুন্দর গন্ধ আসছে। কৌতূহল বেড়ে
গেলো। কৌটার মুখ খুলে দেখে সেখানে একটা সুন্দর ট্যাবলেট। কী সুন্দর গন্ধ। জিভে
পানি এসে যায় চাঙ্গির। ট্যাবলেটটা তুলে মুখে দিলো। আর সাথে সাথে চাঙ্গি আকাশে উঠতে
শুরু করলো। হাউই দেখলো তার বৌ ঊড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার।
চাঙ্গি উড়ে চলে গেলো চাঁদে। সেই থেকে চাঁদের দেবী হয়ে গেলো চাঙ্গি। খরগোশ তো আগে
থেকেই ছিল সেখানে। চাঙ্গির সঙ্গী হলো খরগোশ।
এই চাঙ্গির নাম তোমরা আবার শুনবে
চাঁদে অভিযানের কথা যখন বলবো। আমেরিকা ও রাশিয়া ছাড়া তৃতীয় যে দেশের চন্দ্রযান
চাঁদে নেমেছে - সেটা হলো চীন। চীনের চন্দ্রযানের নাম চাঙ্গি। আর রাশিয়ার
চন্দ্রযানের নাম লুনা। আমেরিকার চন্দ্রযানের নাম অ্যাপোলো।
আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিতেও চাঁদ
সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। আমাদের বেশিরভাগ ধর্মীয় উৎসবই চাঁদের বিভিন্ন
তিথি এবং চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর এবং
ঈদুল আজহা চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। বৌদ্ধধর্মের প্রধান উৎসবগুলো হয় পূর্ণিমায়।
খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব ইস্টার চাঁদের তিথির ওপর নির্ভরশীল। হিন্দুধর্মের
বেশিরভাগ উৎসবও চাঁদের তিথি মেনে পালিত হয়।
No comments:
Post a Comment