চাঁদের ভবিষ্যৎ
চাঁদ তুলনামূলকভাবে খুব স্থির একটি উপগ্রহ। সেখানে কোন ধরনের প্রাকৃতিক
পরিবর্তন ঘটছে না। ভূমিকম্প নেই, আগ্নেয়গিরি নেই, মহাজাগতিক ঝড় নেই। পৃথিবী থেকে
রকেটে করে মাত্র তিন দিনের পথ। মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহের উদ্দেশ্যে মহাকাশযান
পাঠানোর জন্য চাঁদ হয়ে উঠতে পারে একটি মহাকাশ জংশন। একদিন হয়তো মানুষ চাঁদে কলোনি তৈরি করে বসবাস করবে।
সৌরজগতের বিজ্ঞান জানার জন্যে চাঁদ
একটা বড় উৎস। সৌরজগতের উৎপত্তির পর থেকে চাঁদের পরিবর্তন হয়েছে খুবই কম। তার মানে
সৌরজগতের প্রথম একশ কোটি বছরে কী হয়েছে তা জানা যাবে চাঁদের বিজ্ঞান থেকে। পৃথিবীর
শৈশব থেকেই চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবীর বিবর্তনের সাক্ষী চাঁদ। পৃথিবীর
ভবিষ্যতের উপর অনেকখানি নির্ভর করছে চাঁদের ভবিষ্যৎ।
পৃথিবীর মতোই চাঁদেও অনেক খনিজ সম্পদ
থাকতে পারে। সেটা খুড়ে বের করবে মানুষ। হয়তো কোন একদিন চাঁদের বুকে খনি আবিষ্কারের
জন্য খোড়াখুড়ি শুরু হবে।
চাঁদ
ও পৃথিবী পরস্পর টানাটানি করছে। এতে শক্তির ক্ষয় হচ্ছে অনবরত। ঘূর্ণনের বেগ কমে
যাচ্ছে। চাঁদ আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। প্রতিবছর প্রায় তিন
সেন্টিমিটার করে দূরে সরে যাচ্ছে। আজ থেকে কোটি বছর পরে চাঁদ আরো ছোট দেখাবে
পৃথিবী থেকে। ৫ কোটি বছর পর পৃথিবীর চার পাশে ঘুরে আসতে চাঁদের লাগবে ৫০ দিন।
চন্দ্রবীক্ষণ
আমাদের
স্কুলের ছাদটি যে এত বড় তা আগে কখনো বুঝতেই পারিনি। বিকেল থেকেই স্কুলে উৎসব শুরু
হয়ে গেছে। চন্দ্রোৎসব। আজ সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়
পরে সবাই বেশ সেজেগুঁজে এসেছে। আমরা বন্ধুরা সবাই সাদারঙের শাড়ি পরেছি, ছেলেরা
পরেছে লম্বা পাঞ্জাবি। উঁচু ক্লাসের আপুরাও অনেকে শাড়ি পরেছে। স্যার-ম্যাডামদেরও
অন্যরকম লাগছে। আসমানি ম্যাডাম মনে হয় পার্লার থেকে সেজে এসেছেন।
ছাদের একপাশে স্টেজের কাছে দেখা গেলো
আফতাব স্যার বিভিন্ন ক্লাসের ক্লাস-মনিটরদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। ফারজানাকে খুঁজে
পাচ্ছিলাম না এতক্ষণ। দেখলাম সেও আছে এখানে সুব্রতর সাথে। আমাকে দেখতে পেয়েই আফতাব
স্যার জিজ্ঞেস করলেন, "নুসরাত নীলিমা, তোমরা রেডি?"
"জ্বি স্যার, আমরা রেডি।"
আফতাব স্যারকে দেখে হঠাৎ খুব হাসি
পেয়ে গেলো। স্যার একটা কুঁচকানো পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। পাঞ্জাবিটা হয়তো কোন একসময়
সাদা ছিল।
ছাদের উত্তরকোণায় ছোট্ট মঞ্চ। সেখানে
আমরা বিভিন্ন ক্লাসের বিভিন্ন গ্রুপ গান গাইবো। অন্যদিকে ছাদের পূর্বদিকের
রেলিং-এর কাছে আরেকটা মঞ্চ। সবার কৌতূহল সেই মঞ্চের উপর ট্রাইপডে স্থাপিত
টেলিস্কোপের উপর। টেলিস্কোপের পাশে একটি টেবিলে রাখা আছে ল্যাপটপ কম্পিউটার ও
প্রজেক্টর। জীবনে প্রথমবারের মতো টেলিস্কোপের সাহায্যে আমরা চাঁদ দেখবো। এই
টেলিস্কোপও আমরা আগে কখনো দেখিনি।
চারতলার ছাদ থেকে
পূর্বদিকের আকাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খুব কাছেই গাড়ির রাস্তা। আর রাস্তার পাশেই নদী।
সেদিকে বড় কোন বিল্ডিং মাথা তুলে আকাশ আড়াল করেনি এখনো। চাঁদ উঠলেই আমরা দেখতে
পাবো।
আজ চৌদ্দই নভেম্বর ২০১৬।
আজকের এই সন্ধ্যার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি সেই মার্চ মাস থেকে। আজ দেখা দেবে
সুপারসুপারমুন। ৬৮ বছর পর পৃথিবীর এত কাছে এসেছে চাঁদ।
প্রোগ্রামের শুরুতে টেলিস্কোপের পাশে
একটা বড় স্ক্রিনে আমাদের প্রজেক্ট-লুনার প্রেজেন্টেশান দেখানো হলো। প্রিন্সিপাল
স্যার তাঁর বক্তৃতায় আমাদের বিজ্ঞান প্রজেক্টের খুব প্রশংসা করলেন। চাঁদের
প্রজেক্ট আমরা শেষ করে ফেলেছিলাম সেই মার্চ মাসে। আফতাব স্যার আমাদের
প্রেজেন্টেশানসহ বিভিন্ন ক্লাসের অনেকগুলো প্রজেক্ট-প্রেজেন্টেশান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন। তারপর ছয় মাস ধরে চেষ্টা করার পর স্কুলের জন্য এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি
পাওয়া গেছে সরকার থেকে। প্রিন্সিপাল স্যার বললেন এটা আমাদের উৎসাহ ও পরিশ্রমের
পুরষ্কার।
কলেজের ভাইয়া ও আপুদের গানের পর ক্লাস
টেন, তারপর নাইন। এভাবে আমাদের পালা যখন এলো ততক্ষণে পশ্চিমাকাশ লাল হয়ে উঠেছে।
নভেম্বর মাসেও শীত পড়ছে না বলে আমরা কী যে খুশি। কারণ শীতের কুয়াশায় চাঁদ যদি ভালো
করে দেখা না যায়! আজ কোন কুয়াশা নেই।
আমি, ফারজানা, চিত্রা আর স্বাতী মঞ্চে
উঠলাম। লুনাকেও দলে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লুনা কিছুতেই সবার সামনে মঞ্চে উঠে গান
গাইতে রাজি নয়। তাছাড়া তার চন্দ্রভীতি নিয়ে সে এখনো চিন্তায় আছে - যদি চাঁদ দেখে
সব গন্ডগোল হয়ে যায়।
ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে
ধরা দিয়েছ যে আমার পাতায় পাতায় ডালে ডালে।।
যে গান তোমার সুরের ধারায়
বন্যা জাগায় তারায় তারায়
মোর আঙিনায় বাজল গো, বাজল সে-সুর আমার প্রাণের
তালে-তালে।।
আমাদের গান শেষ হতে না হতেই দেখলাম সবার চোখ
পূর্বদিকের আকাশে। সেদিকে পাতায় পাতায় ডালে ডালে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু
করেছে।
আফতাব
স্যার দূরবীণে চোখ রেখে চাঁদের দিকে তাক করলেন। প্রজেক্টরের পর্দায় স্পষ্ট হয়ে
উঠলো উদীয়মান চাঁদ।
আমাদের
ক্লাসের মতো অন্যান্য ক্লাসেও চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদের প্রতিনিধিরা আছে। তারা খুব
সক্রিয় এখন। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে দূরবীণে চোখ রাখছে। কয়েক সেকেন্ডের
বেশি সময় দেয়া যাচ্ছে না কাউকেই। আফতাব স্যার বলেছেন সবার দেখা হয়ে গেলে পরে সময়
থাকলে আবার দেখার সুযোগ দেয়া হবে।
দূরবীণে
যা দেখা যাচ্ছে তার সবকিছুই প্রজেক্টরের সাহায্যে বড়পর্দায় দেখানোর ব্যবস্থা
করেছেন আফতাব স্যার। এজন্য যে টেকনিক্যাল টিম আছে সেই টিমে আমাদের ক্লাস থেকে অর্ক
ও লুনাও আছে। লুনা খুব উৎসাহ নিয়ে
প্রজেক্টরের কাছে বসে আছে।
অনেকগুলো
ঘটনা এক সাথে ঘটছে এখন। সামনের আকাশে বিশাল আকৃতির পূর্ণিমার চাঁদ আমরা খালি চোখে
দেখতে পাচ্ছি। পূর্ণিমার আলোয় সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। যে সবিতা
ম্যাডাম ধমক না দিয়ে কথা বলতে পারেন না, তিনিও কত মিষ্টি করে হেসে হেসে কথা বলছেন
আজ। ভোলানাথ স্যার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন আফতাব স্যারের পাশে। গলায় হুইসেল থাকা
সত্ত্বেও আজ একবারও হুইসেল বাজাননি তিনি।
আকাশের
চাঁদকে টেলিস্কোপ দিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে আরো কাছে - একেবারে প্রজেক্টরের পর্দায়।
আমাদের ক্লাসের সবার দেখা হয়ে যাবার পর চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদের প্রতিনিধিদের দেখার
সুযোগ এলো। এই নিয়ম আফতাব স্যার চালু করেছেন। তিনি বলেন, "একজন সত্যিকারের
ক্যাপ্টেন দায়িত্ব নেবে সবার আগে, কিন্তু সুযোগ নেবে সবার শেষে।"
টেলিস্কোপের
আইপিসে (eyepiece) চোখ রেখে মনে হলো সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা। আফতাব
স্যার বললেন, "নিচু সমতল যে জায়গাটা দেখতে পাচ্ছো সেটাই হলো ..."
"আমি
কিছু দেখতে পাচ্ছি না স্যার।"
আফতাব
স্যার বড় পর্দার দিকে তাকালেন। সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চাঁদের বুকে লাভাস্রোতের
থমকে থাকা চিহ্ন। আমি বড়পর্দার ছবি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু টেলিস্কোপে কিছু দেখতে
পাচ্ছি না। আবার চোখ রাখলাম টেলিস্কোপে। এবারো সবকিছু ঝাপসা। আফতাব স্যার
টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে একবার দেখলেন, তারপর হাত বাড়িয়ে আমার চশমাটা খুলে কুচকানো
পাঞ্জাবির এক কোণায় মুছে আবার পরিয়ে দিলেন।
"এবার
দেখো।"
মুহূর্তেই
চোখের সামনে ভেসে উঠলো চাঁদের সি অব ট্রাংকুইলিটি - প্রশান্তির সাগর, যেখানে প্রথম
পা রেখেছিল পৃথিবীর মানুষ।
"টাইম'স
আপ নয়ন, ইট্স মাই টার্ন।" লুনা ধাক্কা দিচ্ছে।
পরের
কয়েক সেকেন্ড ভয়ে ভয়ে লুনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লুনা টেলিস্কোপে চোখ রেখে চাঁদ
দেখলো খুবই স্বাভাবিকভাবে। তারপর বললো, "ওয়ান্ডারফুল, অ্যামেজিং!"
"তোর
সেলিনোফোবিয়ার কী হলো?"
"চলে
গেছে।"
"ইউ
শিওর?"
"নট
শিওর। বাট আমি থিংক করি। হাহাহা।"
লুনাকে
এত জোরে হাসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। সেলিনোফোবিয়া সেরে গিয়ে লুনা কি লুনাটিক হয়ে
গেলো?
_________
তথ্যসূত্র
1. Ian
Graham, My best book of the Moon, Kingfisher, London, 2005.
2. Isaac
Asimov, The Earth's Moon, Collins publishers Australia, Sydney, 1988.
3. David
A Rothery, Planets a very short introduction, Oxford University Press, Great
Britain, 2010.
4. Robin Birch, The new solar
system The Moon, Macmillan Library, Auatrlia 2008.
5. Carmel
Reilly, Sky watching The Moon, Macmillan Library, Australia 2011.
6. Chris Cooper, Pam Spence,
Carole Stott, Stars + Planets an illustrated guide, Star Fire, London, 2007.
7. Gerard
Cheshire, The Solar System and Beyond, Evans, London, 2006.
8. Giles
Sparrow, Planets and Moons, Hinkler Books, Australia, 2006.
9. Steve
Parker, Solar System, Ticktock Media Ltd, Great Britain, 2006.
10. Colin
Ronan, The Universe Explained, Ken Fin Books, Australia, 1997.
11. Heather
Couper and Nigel Henbest, Encyclopedia of Space, DK Publishing, UK,
2003.
12. John
Christopher, Apollo Story, The History Press, UK, 2009.
13. Steve Massey,
Exploring the Moon, New Holland, Australia, 2004.
14. Michael
Carlowicz, the Moon, Abrams, New York, 2007.
15. Rick Stroud,
The Book of the Moon, Doubleday, London, 2009.
১৬। প্রদীপ
দেব, অর্ক ও সূর্যমামা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫।
১৭। প্রদীপ
দেব, পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬।
No comments:
Post a Comment