Sunday, 15 December 2019

চাঁদের নাম লুনা - ১১


চন্দ্রগ্রহণ

প্রাচীন গ্রিকরা পৃথিবী যে গোলাকার তা বুঝতে পেরেছিলেন চাঁদের বুকে পৃথিবীর ছায়া দেখে। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে যে চন্দ্রগ্রহণ হয় তা ইওরোপিয়ানরা জেনে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশ তখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানে ততটা উন্নতি করতে শুরু করেনি। বিভিন্ন দেশে চন্দ্রগ্রহণকে অশুভ বলে মনে করা হতো। তেমনি একটা ঘটনার সুযোগ নিয়েছিলেন স্পেনিশ নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস - যাকে আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয়।
            ১৫০৪ সালে কলম্বাস জ্যামাইকায় গিয়েছিলেন সেখানে কোন ধনসম্পদ পাওয়া যায় কিনা দেখতে। জ্যামাইকানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনুন্নত। কলম্বাস ও তার লোকজন জ্যামাইকানদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছিলেন। অর্থাৎ শোষণ করছিলেন। ইওরোপিয়ানরা এক সময় বিশ্বজুড়ে তাই করেছে। একসময় জ্যামাইকানরা বিদ্রোহ করে। কলম্বাসের কাজ করে দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। কিন্তু ধূর্ত কলম্বাস জানতেন যে ২৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ হবে। তিনি সেদিন জ্যামাইকানদের ধমক দিয়ে বললেন তারা যদি স্প্যানিশদের নির্দেশমত কাজ না করে তাহলে স্প্যানিশ দেবতা তাদের শাস্তি দেবে। দেবতা তাদের কাছ থেকে আকাশের চাঁদ নিয়ে যাবে।
            যথাসময়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলো। জ্যামাইকানরা দেখলো সেই চাঁদ আস্তে আস্তে কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। কলম্বাস চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন যে এটা দেবতার অভিশাপ। জ্যামাইকানরা ভয়ে কলম্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। যথাসময়ে চন্দ্রগ্রহণও শেষ হলো। এই ঘটনা থেকে এটাই বোঝা যায় যে অজ্ঞতা থেকে মানুষের মনে কুসংস্কারের জন্ম নেয়। আর কুসংস্কারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ লাভবান হয়। যেমন এখনো অনেক মানুষ জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখিয়ে ভাগ্য গণনা করে, হাতে আংটি পরে হরেক পাথরের ভাগ্য ফেরানোর জন্য। জ্যোতিষীরা প্রায়ই বলে থাকেন অমাবস্যা-পূর্ণিমা, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণের সময় কী কী করতে হবে ইত্যাদি। আসলে চন্দ্রগ্রহণ খুবই সাধারণ স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।





পূর্ণিমার সময় সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদ একই লাইনে চলে আসে। সূর্যের আলো সরাসরি পৃথিবীর ওপর পড়ে। ফলে যেদিকে চাঁদ আছে সেদিকে পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক ছায়া পড়ে। যেহেতু সূর্য পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড় সেহেতু পৃথিবীর ছায়ার দু'পাশে অনেক বড় প্রচ্ছায়াও তৈরি হয়। পূর্ণিমার চাঁদ যখন পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে থাকে তখন উজ্জ্বল ধবধবে রূপালী চাঁদ লাল হয়ে যায়। চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে আলোর বিচ্ছুরণে এই লাল রঙ তৈরি হয়। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় পুরো চাঁদটিই পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে থাকে। তারপর চাঁদ আস্তে আস্তে সরে গিয়ে পৃথিবীর প্রচ্ছায়ায় যখন আসে তখন চাঁদ আস্তে আস্তে তার উজ্জ্বলতা ফিরে পেতে থাকে।
            মানুষের শরীরের ওপর এই চন্দ্রগ্রহণের কোন প্রভাব নেই। স্বাভাবিক পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে আমরা যেভাবে চাঁদ দেখি ঠিক একই ভাবে চন্দ্রগ্রহণের সময়ও চাঁদ দেখা যায়। চন্দ্রগ্রহণে শুধুমাত্র চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়াটা পড়ে। খালি চোখে চাঁদ দেখলে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু অনেক মানুষ অজ্ঞতা ও সংস্কারের বশবর্তী হয়ে চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ দেখা তো দূরের কথা, কোন কিছু খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দেয়। অনেক বাড়িতে সেই সময় আগের রান্না করা খাবার থাকলে তা পরে ফেলে দেয়। এরকম অযৌক্তিক সংস্কার ত্যাগ করতে হবে।
আগামী বারো বছরের পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের তারিখ নিচের তালিকায় দেয়া হলো।

২০২৯ সাল পর্যন্ত পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের তারিখ
তারিখ
কোথা থেকে দেখা যাবে
৩১/০১/২০১৮
উত্তর-পশ্চিম ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু
২৮/০৭/২০১৮
ইওরোপের বেশিরভাগ, এশিয়ার বেশিরভাগ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার দক্ষিণভাগ, দক্ষিণ আমেরিকা, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু
২০/০১/২০১৯
ইওরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর মেরু
২৬/০৫/২০২১
উত্তর-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ, দক্ষিণ আমেরিকা, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু
১৫/০৫/২০২২
দক্ষিণ-পশ্চিম ইওরোপে, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু
০৮/১১/২০২২
উত্তর-পূর্ব ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু
১৩/০৩/২০২৫
ইওরোপের বেশিরভাগ, এশিয়ার বেশিরভাগ, অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু
০৮/০৯/২০২৫
ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার পশ্চিম ভাগ, দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু
০৩/০৩/২০২৬
পূর্ব ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু
৩১/১২/২০২৮
ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর মেরু
২৫/০১/২০২৯
দক্ষিণ-পশ্চিম ইওরোপে, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Doesn't Rachi's death make us guilty?

  Afsana Karim Rachi began her university life with a heart full of dreams after passing a rigorous entrance exam. She was a student of the ...

Popular Posts