চিত্রার বুধবার
"চিত্রাপু,
দেখো কালবৈশাখী হচ্ছে।"
পূষণের কথায় বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে
চারদিক। বাসে ওঠার সময় আকাশ নীল ছিল, মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলো না সেখানে। কিন্তু
হঠাৎ সবকিছু বদলে গেছে। অন্যদিন এই সময় সকালের লালচে রোদ পড়ে চকচক করে কর্ণফুলির
পানি। এখন সেই পানি কালো মেঘের ছায়া পড়ে আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে।
স্কুলে যাবার পথে আমার সবচেয়ে ভালোলাগা
দৃশ্য হলো নদীর পানিতে আকাশের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ সেকেন্ড পিরিয়ডে ইংলিশ
সেকেন্ড পেপারের ক্লাস টেস্ট হবার সম্ভাবনা আছে বলে ইংরেজি প্যারাগ্রাফ মুখস্ত
করতে করতে খেয়ালই করিনি কখন নদী এসে গেছে।
হঠাৎ মেঘের বুক চিরে ছুটে এলো তীব্র
আলোর ঝলকানি। বজ্রপাত। এখনি প্রচন্ড শব্দ হবে। আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে বেশি
বলে বজ্রপাতের আলো আগে দেখা যায়, পরে শব্দ শোনা যায়।
"কান চেপে ধরো পূষণ।"
বলতে না বলতেই প্রচন্ড
শব্দে কানে তালা লাগার অবস্থা। পূষণ ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। এমনিতেই সে খুব
ভীতু। পড়ে ক্লাস ফোরে, কিন্তু সাইজে এবং সাহসে ক্লাস ওয়ানের সমান। আমাদের
বিল্ডিং-এর সব ছেলেমেয়ে তাকে ডাকে - ভীতুর ডিম।
পরপর অনেকগুলো বজ্রপাত হলো। অনেকেই
চিৎকার করে উঠলো বাসের মধ্যে। বাসভর্তি বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্রছাত্রী। কত্তো রকমের কোলাহল
চলে সারাটা পথ। যেদিন বাসে কোন টিচার থাকেন সেদিন কোলাহল একটু কম হয়। কিন্তু সব দিন
টিচার থাকেন না। টিচারদের জন্য আলাদা বাস আছে। সেই বাস মিস করলে স্টুডেন্টদের বাসে
ওঠেন টিচাররা। আজ কোন টিচার নেই - তাই সবাই জোরে জোরে কথা বলছে যার যার বন্ধুদের
সাথে।
বাস স্কুলগেটে এসে থামার আগেই ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। স্কুলের গেটে ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। প্রতিদিন সকালেই
এরকম হয়। স্কুলের বাসগুলি সব একসাথে চলে আসে এই সময়। তিন-চারজন সিকিউরিটি অফিসার খুব
ব্যস্তভাবে হুইসেল বাজাতে থাকেন। আর বাসের ড্রাইভাররাও তীব্র শব্দে হর্ন দিতে শুরু
করেন। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বরং আজ হঠাৎ বৃষ্টির কারণে ভীড় আর কোলাহল আরো
বেশি।
হেলপার ভাইয়া বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে বাসের
গায়ে জোরে জোরে থাপ্পড় দিতে দিতে চিৎকার করছেন - "আই অক্, আই অক্, আর-অ আই
অক্"। পূষণ মহা উৎসাহে অনুবাদ করতে থাকে, "আসুক, আসুক, আরো আসুক।"
একটু একটু করে সামনে পেছনে গিয়ে বাস
থামলো। কিন্তু নামবো কীভাবে? বৃষ্টি এখনো থামেনি। ছাতা আনিনি। কিন্তু বাসের ভেতর
বসে থাকারও উপায় নেই। সবাই ভিজতে ভিজতে নেমে যাচ্ছে। বাস থেকে নেমে ভিজতে ভিজতে
ঢুকলাম স্কুলের গেটের ভেতর।
গেট থেকে স্কুল বিল্ডিং-এর দূরত্ব এক শ
মিটারের মতো হবে। রাস্তার দু'পাশে বড় বড় গাছ। বৃষ্টির সাথে বড় বড় ফোঁটায় পানি পড়ছে
গাছের ডালপালা থেকে। এক শ মিটার দীর্ঘ এই পথ আমি এক মিনিটে হেঁটে যেতে পারি। মানুষ
স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলে ঘন্টায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। একটু দ্রুত হাঁটলে
ঘন্টায় ছয় কিলোমিটার যেতে পারে। তার মানে দশ মিনিটে এক কিলোমিটার অর্থাৎ এক মিনিটে
এক শ মিটার। কিন্তু আজ পূষণের জন্য জোরে হাঁটতে পারছি না। সে হাঁটছে শামুকের গতিতে।
শুধু তাই নয়, বৃষ্টির পানি মাথায় পড়তে না পড়তেই হাঁচতে শুরু করেছে। এক পা হাঁটে, একটা
হাঁচি দেয়। মহা যন্ত্রণায় পড়া গেলো। ইচ্ছে করছে তাকে ফেলে চলে যাই। কিন্তু তাকে ফেলে এক পা আগে গেলেও সে বাসায় গিয়ে
মাকে নালিশ জানাবে। আমার মা তার প্রতিবেশী বান্ধবীর মেয়ের কথায় যতটা গুরুত্ব দেয়,
নিজের মেয়ের কথায় ততটা দেয় না।
"চিত্রলেখা চক্রবর্তী, ছাতা নিয়ে
আসোনি কেন?"
হঠাৎ আফতাব স্যারের গলা
শুনে চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। বিশাল বড় একটা ছাতা আফতাব স্যারের মাথায়। টিচারদের
বাস এসে গেছে। অন্যান্য স্যার-ম্যাডামরাও আসছেন আফতাব স্যারের পেছনে। আফতাব স্যার
এমনিতেই জোরে হাঁটেন, আজ বৃষ্টি হচ্ছে বলে আরো জোরে হাঁটছেন।
"গুড মর্নিং স্যার" বলে এক
পাশে সরে দাঁড়ানোর আগেই একটার পর একটা বেশ কয়েকটা হাঁচি দিলো পূষণ।
"ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছো। বৃষ্টিতে
ভিজবে না। এই নাও, এর মাথায় ছাতা ধরো"
- বলতে বলতে আফতাব স্যার বিশাল ছাতাটা পূষণের মাথার ওপর দিয়ে দিলেন। এত বড় ছাতার
নিচে পূষণ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি ছাতাটা হাতে নিয়ে দেখলাম আফতাব স্যার
অনেক দূরে চলে গেছেন।
ছাতা হাতে নিয়ে বেশ লজ্জা লাগছে। এরকম
তাবুর সাইজের ছাতা আজকাল কেউ ব্যবহার করে না। এগুলো এখন আর দোকানেও কিনতে পাওয়া
যায় না। আফতাব স্যার কোত্থেকে জোগাড় করেছেন কে জানে। নয়ন বলে - আফতাব স্যারের জামাকাপড়গুলো সব মিউজিয়াম থেকে
সংগ্রহ করা। এই ছাতাটাও নিশ্চয় মিউজিয়াম থেকে এসেছে।
মেইন বিল্ডিং-এর বারান্দায় উঠে ছাতা
বন্ধ করতে করতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম আমাদের ক্লাসের কেউ আমাকে দেখেছে কি না।
যা ভয় পেয়েছিলাম তাই। অর্ক, আবদুর রহিম আর বিদ্যুৎ একই সাথে ছুটতে ছুটতে হাসতে
হাসতে বারান্দায় উঠে এলো। বিদ্যুৎ বেশ জোরে জোরে গান গাইছে – “ঝর পরের লে বাজ পরের, আঁর পরানে ক্যান্ গরের ..."
বিদ্যুতের গানের সাথে
হে হে করে হাসছে অর্ক আর আবদুর রহিম। বিদ্যুৎ যখন-তখন এমন বিদ্ঘুটে সব গান গায় যে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আজ মেজাজ আরো খারাপ
হলো। কিন্তু এখন তাদের সাথে লাগতে গেলে তারা আরো পেয়ে বসবে। এমনও হতে পারে যে তারা হাসছে নিজেদের কোন কথায়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তারা আমার হাতের ছাতার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সব
হয়েছে এই পূষণ শয়তানটার জন্য। সে সাথে না থাকলে আফতাব স্যারের ছাতা আমার হাতে আসতো
না। ইচ্ছে হচ্ছে পূষণের কানটা টেনে দিই। কিন্তু ততক্ষণে সে চলে গেছে তার ক্লাসে।
তাদের ক্লাস নিচের তলায়।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে টিচারস্ রুমের
দিকে চললাম। ছাতাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরৎ দেয়া দরকার। ম্যাডামদের অফিস রুমের
পাশের রুমটা স্যারদের অফিস রুম।
অফিসে ঢুকতে হলো না। দেখলাম আফতাব স্যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছেন আসমানি ম্যাডাম আর
অরুন্ধতী ম্যাডামের সাথে। আফতাব স্যারের বাসায় মনে হয়
কোন আয়না নেই। আয়না থাকলে আফতাব স্যার বুঝতে পারতেন বড় বড় লাল লাল দাঁত বের করে হা
হা করে হাসলে তাঁকে কীরকম ভয়ংকর দেখায়।
আমাকে দেখতে পেয়ে আফতাব
স্যার বললেন, "চিত্রলেখা চক্রবর্তী, আমার ছাতা নিয়ে এসেছো? ভেরি গুড। থ্যাংক
ইউ। দাও এদিকে।"
আমি ছাতাটা এগিয়ে দিলাম। ছাতাটা হাতে নিয়ে
স্যার বললেন, "এরকম বৃষ্টিতে তোমরা ছাতা ছাড়া কীভাবে বের হও?"
"বের হবার সময় রোদ ছিল
স্যার।"
"আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখবে না?
আজকাল তিন-চার দিন
আগে থেকেই জানা যায় কখন ঝড়বৃষ্টি হবে। এই স্যাটেলাইট কম্পিউটার ইন্টারনেটের যুগেও
প্রাচীন কালের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে?"
অরুন্ধতী ম্যাডাম আফতাব স্যারের কথার
মাঝখানে বলে উঠলেন, "কেন চলবে না? তুই যদি এই স্যাটেলাইট কম্পিউটার
ইন্টারনেটের যুগে প্রাচীন কালের ছাতা নিয়ে বের হতে পারিস, তারা কেন আকাশের দিকে
তাকিয়ে বের হতে পারবে না? তোর এই ছাতার ছাতা মাথায় দেয়ার চেয়ে বৃষ্টিতে ভেজা অনেক
ভালো।"
আফতাব স্যার আর আসমানি ম্যাডাম দুজনই হা
হা করে হেসে উঠলেন অরুন্ধতী ম্যাডামের কথায়। আমারও খুব হাসি পাচ্ছিলো। কিন্তু
স্যার-ম্যাডামদের আলোচনা শুনে হেসে ফেলাটা বেয়াদবি হতে পারে ভেবে অনেক কষ্টে হাসি
চেপে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যার-ম্যাডামরা একজন আরেকজনকে 'তুই' করে বলছেন - শুনতে কী যে ভালো লাগছিলো তা তোমাদের বোঝাতে পারবো না।
"তোদের ওই মরডান
মাইক্রুস্কুপিক ছাতা দিয়ে রোদ থেকে বাঁচা যায়, ঝড়-বৃষ্টি
থেকে নয়।"
আসমানি ম্যাডাম
ইংরেজি উচ্চারণের ভুল কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। আফতাব স্যারকে প্রায় ধমক দিয়েই
বললেন, “মরডান নয় – মডার্ন, মাইক্রুস্কুপিক নয় – মাইক্রোস্কোপিক।”
আফতাব স্যার বললেন, “উচ্চারণে কিছু যায় আসে না। বুঝতে পারলেই হলো। আমার কথা তুই বুঝতে পারিসনি?”
আফতাব স্যার যখন “উচ্চারণ” বলেন তখন বোঝা যায় তাঁর ‘চ’
উচ্চারণের যে কী ভয়ংকর অবস্থা। স্যারের বাংলা উচ্চারণেই যেখানে চট্টগ্রামের
আঞ্চলিক টান সেখানে ইংরেজি উচ্চারণ ঠিক করাতে পারবেন আসমানি ম্যাডাম?
আমি চোখ বড় বড় করে স্যার-ম্যাডামদের কথা
গিলছি দেখে আসমানি ম্যাডাম বললেন, "ছিট্রা - গো টু ইওর
ক্লাস।"
“ইয়েস
ম্যাডাম, থ্যাংক ইউ ম্যাডাম” -
বলে দ্রুত ক্লাসের দিকে রওনা দিলাম। আসমানি ম্যাডাম
আমাদের ইংরেজি প্রথম পত্র পড়ান। কথাবার্তার শতকরা আশি ভাগ ইংরেজিতে বলেন। নয়ন বলে – “আসমানি ম্যাডাম চলেন দীপিকা পাড়ুকোনের মতো, আর বলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো।" সত্যিই
তাই। হলিউডের অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ম্যাডামও নিশ্চয় চিত্রাকে 'ছিট্রা' উচ্চারণ করবেন।
সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতে তিন তলায় উঠে
এলাম। আফতাব স্যারকে বলা অরুন্ধতী ম্যাডামের কথাগুলো এখনই গিয়ে নয়ন, ফারজানা আর
স্বাতীকে বলতে হবে।
ভেবেছিলাম তাদেরকে
ক্লাসের বাইরে বারান্দাতেই পেয়ে যাবো। ক্লাস শুরুর আগে
দলবেঁধে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করা আমাদের স্বভাব। ঘন্টা বাজার পরেও ক্লাসে ঢুকতে
চায় না অনেকে। আমাদের ফার্স্টবয় এবং ক্লাস মনিটর সুব্রত তখন স্কেল উঁচিয়ে জোর করে ধাক্কা দিয়ে তাদের ক্লাসে ঢোকায়। কিন্তু
আজ বারান্দায় অন্য ক্লাসের সামনে অনেককে দেখলেও আমাদের ক্লাসের কাউকে দেখলাম না। ক্লাস শুরু হতে এখনো পাঁচ-ছয় মিনিট বাকি। সবাই গেলো কোথায়
আজ? নিশ্চয়ই ক্লাসের ভেতরে কিছু হচ্ছে।
সত্যিই তাই। ক্লাস
রুমের দরজায় এসে দেখি হোয়াইট বোর্ডের সামনে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। আমি
ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথেই নয়ন ফারজানা আর স্বাতী এক সাথে চিৎকার করে উঠলো, "জাওশাং হাও চিত্রা।"
“কী হচ্ছে এখানে?”
“ভাষা শিক্ষা হচ্ছে। আমরা চায়নিজ
শিখছি।"
একটু পরেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম।
দেখলাম লুনা বোর্ডে লিখে লিখে বিভিন্ন শব্দের চায়নিজ রূপ কী হবে তা শেখাচ্ছে।
লুনা আমাদের ক্লাসে এসেছে
এখনো এক মাসও হয়নি। এর মধ্যেই আমাদের খুব কাছের বন্ধু হয়ে গেছে। আগে নয়ন, ফারজানা,
স্বাতী আর আমি এই চারজনের একটা দল ছিল। এখন সেই দলে লুনাও ঢুকে পড়েছে। লুনা বেশ
কয়েক বছর চীনে ছিল। সেখানে থেকে চীনা ভাষা শিখেছে। দেখলাম বোর্ডে কিছু ইংরেজি ও
চায়নিজ শব্দ পাশাপাশি লেখা হয়েছে।
গুড
মর্নিং – জাওশাং হাও
গুড
ইভনিং – ওয়াইনশাং হাও
গুড
বাই – ঝাইজিয়েন
ইয়েস
– শি
নো
– মেইয়াউ
ধন্যবাদ
– শেই শেই
হ্যালো
– নি হাউ
বাংলাদেশ
– মইনজালা
ভেরি
গুড – খেইন খাও
“তার মানে আমাকে তোরা গুড মর্নিং
বলেছিস?”
“শি”
নতুন ঝামেলা শুরু হলো
দেখছি। এরা সবাই হঠাৎ চায়নিজ ভাষা চর্চা করতে শুরু করেছে। ক্লাস ওয়ান থেকে ইংরেজি
পড়ছি – অথচ এখনো ইংরেজিটাই ঠিকমতো বুঝতে পারি না, তার ওপর
চায়নিজ!
ঘন্টা বাজলো। লুনা আর ফারজানা বোর্ডটা
দ্রুত মুছে ফেলে বেঞ্চে এসে বসতেই আমি শুরু করলাম – “জানিস আজ কী হয়েছে? আমি আজ আফতাব স্যারের ছাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে এসেছি।"
“অ্যাই, কীভাবে কীভাবে? শুরু থেকে
বল্” – কৌতূহলে অস্থির হয়ে উঠলো নয়ন আর স্বাতী। ফারজানা
ক্লাসের সেকেন্ড মনিটর। তাই সে এখন গল্প করতে পারছে না। সে সুব্রত’র সহকারী হয়ে ক্লাসে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। আর লুনা সবকিছুতেই খুব ঠান্ডা
মাথার মানুষ। তাকে আমাদের মতো হৈ চৈ করতে দেখিনি কখনো। কোন কিছুতে তার উৎসাহ আছে
কি নেই তা বোঝা যায় না। সে চোখ পিট পিট করে মুখে একটা রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে রেখে
তাকিয়ে রইলো। আমি ফিস ফিস করে আফতাব স্যার আর অরুন্ধতী ম্যাডামের কথার ধারাবিবরণী কিছুটা দিতে না দিতেই স্যার এসে গেলেন।
আফতাব স্যার আমাদের ক্লাসটিচার।
সপ্তাহের প্রথম চার দিন ফার্স্ট পিরিয়ডে বিজ্ঞান পড়ান। আর বৃহস্পতিবার থার্ড ও
ফোর্থ পিরিয়ডে আমাদের সাথে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করতে করতে অনেক রকমের
সায়েন্স প্রজেক্ট করান। আমরা গত তিন মাসে তিনটি বড় বড় প্রজেক্ট শেষ করেছি। আমরা
সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। এখন এপ্রিল মাসের প্রথম
সপ্তাহ চলছে। আজ তো বুধবার – মনে
হচ্ছে আগামী কালই আমরা নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করবো।
আফতাব স্যার আসার সাথে সাথে গুড মর্নিং
স্যার বলার বদলে আজ আমরা সবাই এক সাথে বলে উঠলাম, “জাওশাং
হাও স্যার।"
আমরা সবাই ভেবেছিলাম
আফতাব স্যারকে চমকে দেবো। কিন্তু স্যার খুব স্বাভাবিকভাবেই হাসিমুখে বললেন, “জাওশাং
হাও”।
আমরা খুব অবাক হয়ে গেলাম। আফতাব স্যার
কি চায়নিজ ভাষাও জানেন? নয়ন সরাসরি প্রশ্ন করলো স্যারকে, “স্যার আপনি কি চীনা ভাষা
বুঝতে পারেন?”
“চেন নিং ইয়াং সুং ডাও লি লিও শিয়াবো মো
ইয়ান টু ইউইউ শি জিনপিং।”
আমাদের সবার মুখ হা হয়ে গেলো। আফতাব স্যার এত
সুন্দর চায়নিজ বলতে পারেন! একেবারে চীনাদের মতো। লুনাও তো মনে হয় এত দ্রুত বলতে
পারবে না।
“বুঝতে পেরেছো আমি কী বললাম? খুব তো চায়নিজ বলছিলে আমার সাথে। কী বলেছিলে
তোমরা? জাওশাং হাও? জাওশাং হাও এর অর্থ কী?”
নয়ন
প্রায় চিৎকার করে উঠলো, “এর অর্থ স্যার গুড মর্নিং মানে শুভ সকাল অর্থাৎ সুপ্রভাত।"
প্রশ্নের
উত্তর জানা থাকলে নয়নকে থামায় কার সাধ্য! কিন্তু সে ভুলে গেছে যে আজ বুধবার – আমার
দিন। তাকে কনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিলাম। সে উঃ করে উঠল। তারপর চোখ কটমট করে আমার
দিকে তাকাতেই ফিসফিস করে বললাম, “আজ বুধবার। আজ আমার দিন।"
“ওহ,
সরি সরি।"
নয়ন
এখন সরি বললেও একটু পরেই ভুলে যাবে। আমাদের চার জনের গ্রুপে সব সময় সর্দারি করে
নয়ন। তার একনায়িকাতন্ত্রকে গণতন্ত্রে রূপ দেয়ার জন্য আমরা সপ্তাহের দিনগুলিকে ভাগ
করে নিয়েছি। রবিবার ফারজানার, সোমবার নয়নের, মঙ্গলবার স্বাতীর আর বুধবার আমার।
বৃহস্পতিবার সবার। আমরা সবাই এই নিয়ম মেনে চলি, কিন্তু নয়নের তা মনে থাকে না।
“কী
কথা হচ্ছে নুসরাত নীলিমা এবং চিত্রা চক্রবর্তী?”
“স্যার
আপনি চীনা ভাষায় কী বলেছেন তা আমরা বুঝতে পারিনি।"
“কেউ
বুঝতে পারোনি? ইলোরা ইসলাম?”
আফতাব
স্যার ক্লাসের কাউকেই ডাকনাম ধরে ডাকেন না। ইলোরা ইসলাম ওরফে লুনার দিকে তাকিয়ে
প্রশ্ন করেছেন স্যার। আমরাও তাকিয়ে আছি লুনার দিকে।
লুনা
আস্তে আস্তে বললো, “নো স্যার, আমি আন্ডারস্ট্যান্ড করতে পারিনি।"
লুনা এখনো বাংলার সাথে প্রচুর ইংরেজি শব্দ
মিশিয়ে কথা বলে। আমরা আশা করেছিলাম লুনা অন্তত বুঝতে পারবে। কিন্তু এখন দেখা
যাচ্ছে স্যারের চেয়ে ভালো চায়নিজ লুনাও জানে না।
“তোমরা
কেউই বুঝতে পারোনি? আবার শোন, আস্তে আস্তে বলছি - চেন
নিং ইয়াং - সুং ডাও লি - লিও শিয়াবো - মো ইয়ান - টু ইউইউ - শি জিনপিং।”
আমরা
এবারো কিছু বুঝতে পারলাম না। কেবল শি শব্দের অর্থ বুঝতে পারলাম – ইয়েস। লুনার দিকে
তাকিয়ে মনে হলো সেও কিছু বুঝতে পারেনি। দেখলাম সুব্রত হাত তুললো। টিচারদের সাথে
কথা বলার সময় হাত তুলে অনুমতি নেয়ার নিয়ম আছে। টিচার যাকে অনুমতি দেবেন সে দাঁড়িয়ে
কথা বলবে। কিন্তু আফতাব স্যার এরকম অনেক ফর্মালিটি থেকে আমাদের রেহাই দিয়েছেন।
আমরা যে কোন প্রশ্ন সরাসরি করতে পারি আফতাব স্যারকে। সেজন্য আমাদের উঠে দাঁড়াতেও
হয় না। আফতাব স্যার বলে দিয়েছেন, "এরকম উঠ বস করতে করতেই তো সময় চলে
যাবে।"
কিন্তু সুব্রত আমাদের ক্লাসের
ব্যতিক্রম। সে সবসময় প্রশ্ন করার আগে স্যারের অনুমতি নেয়।
"হ্যাঁ, সুব্রত চৌধুরি, বলো।"
সুব্রত গম্ভীরভাবে উঠে দাঁড়ালো। সে
সারাক্ষণ এমন গোমড়ামুখো হয়ে থাকে - দেখলে মনে হয় পেটের পীড়ায় ভুগছে। আমার মামার
একটা তত্ত্ব আছে - সেটা হলো যে মানুষের পেট যত পরিষ্কার সে তত হাসিখুশি। আর যে
মানুষ যত বদমেজাজী - তার পেটে তত সমস্যা। সুব্রত সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকে দেখে
নয়ন তার নাম দিয়েছে - গন্ডগোলকারী - অর্থাৎ যে গন্ড গোল করে রাখে।
সুব্রত গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলো, “স্যার, আপনি কি চীনা ভাষা শিক্ষা
কোর্স করেছেন?”
“না।
আমি চীনা ভাষার কিছুই জানি না। আমি শুধুমাত্র কয়েকটি চায়নিজ নাম মুখস্ত করেছি।
সেগুলোই তোমাদের বললাম একটার পর একটা।"
অর্ক
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললো, “শি জিনপিং স্যার চীনের প্রেসিডেন্টের নাম।"
“বাকি
নামগুলি কাদের?”
“জানি
না স্যার।"
“বাকি
পাঁচটি নাম হলো চীনের পাঁচ জন নোবেল পুরষ্কার বিজয়ীর নাম। চেন নিং ইয়াং এবং সুং ডাও লি
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে। লিও শিয়াবো শান্তিতে নোবেল
পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১০ সালে। মো ইয়ান সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১২ সালে।
আর টু ইউইউ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১৫ সালে।"
“টু
ইউ ইউ – নামটা খুব মজার স্যার" - অর্ক মন্তব্য করলো।
“মানুষটার
কাজও কিন্তু খুব দরকারি। তিনি ম্যালেরিয়া রোগের আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করে
নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। তোমরা কি জানো তিনি পুরুষ না মহিলা?”
“শি
ইজ আ লেডি লরিয়েট স্যার" - লুনা উত্তর দিলো।
“ঠিক
বলেছো ইলোরা ইসলাম। টু ইউইউ হলেন চীনের প্রথম নারী নোবেল বিজয়ী। নোবেল পুরষ্কার
বিজয়ীদের মধ্যে নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় এখনো খুবই কম। তবে ভবিষ্যতে
আস্তে আস্তে এই সংখ্যা বাড়বে।"
আফতাব
স্যার প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে কীভাবে যেন বিজ্ঞানের কথায় চলে
আসেন। আজও তাই হলো। স্যার শুরু করলেন ভাষার প্রসঙ্গে।
“তোমরা
চীনা ভাষা শিখছো দেখে খুব ভালো লাগছে। নতুন নতুন ভাষা শেখার উপকারিতা আছে অনেক।
ভাষা হলো তথ্য আদানপ্রদানের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। পৃথিবীতে কত রকমের ভাষা যে
আছে তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। কত ধরনের আঞ্চলিক ভাষা আছে, আছে সাংকেতিক ভাষা।
এই যে কম্পিউটারের ভাষা – তা কিন্তু সব ডিজিটাল – মানে শূন্য এবং এক এর খেলা। আর
বিজ্ঞানের ভাষা? তোমরা নিশ্চয় জানো যে বিজ্ঞানের মূল ভাষা হলো গণিত।"
“গণিত?
স্যার গণিত কি বিজ্ঞান, নাকি ভাষা?” পেছনের বেঞ্চ থেকে অর্ক প্রশ্ন করলো। আফতাব
স্যারের ক্লাসে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করে অর্ক। অর্ক অনেক বই পড়ে। মনে হয় আমাদের
ক্লাসের সবার চেয়ে বেশি বই পড়ে অর্ক। ক্লাসের পড়ার চেয়ে অন্য বই বেশি পড়ে বলেই
হয়তো সে পরীক্ষায় তেমন ভালো করতে পারে না। সেটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা আছে বলেও
মনে হয় না।
আফতাব
স্যার অর্কের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “গণিত হলো বিজ্ঞানের ভাষা। সকল বিজ্ঞানের মূল
হলো পদার্থবিজ্ঞান। আর পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভাষা হলো গণিত। হাজার হাজার শব্দ খরচ
করে তুমি যা বোঝাতে পারবে – গণিতের কয়েকটি মাত্র সমীকরণ দিয়েই তুমি তা বুঝিয়ে দিতে
পারো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে – যদি কেউ গণিত না জানে তবে সে সেই সমীকরণগুলি বুঝতে
পারবে না।"
আফতাব
স্যারের ক্লাসে আমরা বিজ্ঞানের বইতে যা আছে তার বাইরেও অনেক কিছু শিখে ফেলি। স্যার
প্রতিটি ক্লাসেই বলেন, “বিজ্ঞানে মুখস্ত করার কিছুই নেই। মূল ব্যাপারটা বুঝতে
পারলে তুমি তা নিজের ভাষায় বুঝিয়ে লিখতে বা বলতে পারবে।"
স্যারের
কথা শুনে লেখাপড়া কত সহজ বলে মনে হয়। কিন্তু এখনো বিজ্ঞান ছাড়া আর সব কিছুই আমাদের
মুখস্ত করতে হয়। হালিমা ম্যাডাম আমাদের জ্যামিতিও মুখস্ত করতে বাধ্য করেছেন। ক্লাস
টেস্টে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ প্রমাণ করতে দিয়েছিলেন। আমি নিজের
মতো ছবি এঁকে এ-বি-সি’র জায়গায় ত্রিভুজ এক্স-ওয়াই-জেড লিখেছিলাম বলে পুরোটাই
কেটে দিয়েছেন। আমার অবস্থা দেখে ফারজানা বলেছে, “উচ্চ নম্বর পেতে হলে উচ্চ রকমের
বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। হয় হালিমা ম্যাডামের কাছে প্রাইভেট পড়, নয় দাঁড়ি কমা সেমিকোলনসহ
সবকিছু মুখস্ত করে ফেল।"
ফারজানা মূল্যবান কথা বলেছে। আমাদের চারজনের
মধ্যে ফারজানার রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো। মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য সে ফার্স্ট হতে
পারেনি। এবছর সে আর সুব্রতর মধ্যে কঠিন প্রতিযোগিতা হবে। দু’জনই হালিমা ম্যাডামের
কাছে গণিত প্রাইভেট পড়তে শুরু করেছে।
আফতাব
স্যার ক্লাস থেকে যাবার পর দেখলাম সবাই বই-খাতা খুলে ইংরেজি প্যারাগ্রাফ পড়তে শুরু
করেছে। তার মানে আজ মোতালেব স্যার ক্লাস টেস্ট নেবেন। শুধুমাত্র বিদ্যুৎকে দেখলাম
উঠে দাঁড়িয়ে বেসুরো গলায় গান ধরলো, “হলইদ্দা চড়ই গাছর ডালত কিইল্লা ডাকের বই...”। সুব্রত স্কেল
হাতে তার দিকে তেড়ে যেতেই সে থেমে গেল।
ক্লাস টেস্ট কখন
হবে তা আমাদের আগে থেকে জানার কথা নয়। যে কোন দিনই ক্লাসে টেস্ট নিতে পারেন
টিচাররা। কিন্তু অনেকগুলি ক্লাস টেস্টের কথা আমরা আগে থেকেই জেনে ফেলি। আমাদের
নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ আছে খবর সংগ্রহ করার জন্য। শুধুমাত্র আফতাব স্যার কখন ক্লাস টেস্ট নেবেন তা জানার কোন উপায় নেই। কারণ আফতাব
স্যার প্রাইভেট পড়ান না। তিনি কোথায় থাকেন সেটাও আমরা কেউ জানি না।
আজকের ক্লাস টেস্টের অগ্রিম খবরটা পেয়েই
কাল সন্ধ্যায় ফারজানা ফোন করেছিল আমার মায়ের ফোনে। ফারজানার মোবাইল ফোন নেই, আমারও
নেই। মা বলেছে ক্লাস নাইনে উঠার আগে ফোন কিনে দেবে না। ফারজানা ফারহানা আপুর
মোবাইল থেকে ফোন করে। আর আমি ব্যবহার করি আমার মায়েরটা।
আজ যে মোতালেব স্যার ইংরেজি সেকেন্ড
পেপারের ক্লাস টেস্ট নেবেন সে ব্যাপারে হানড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়েছে
ফারজানা। ফারজানাকে বলেছে শিখা। শিখা মোতালেব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে। সুতরাং
খবর পাক্কা।
ক্লাসের অবস্থা দেখে
মনে হচ্ছে সবাই জেনে গেছে যে আজ ক্লাস টেস্ট হবে। আমাদের ক্লাসের ৬৫ জনের মধ্যে
মনে হয় ৪০ জন প্রাইভেট পড়ে মোতালেব স্যারের
কাছে।
মোতালেব স্যার ক্লাসে আসতে প্রতিদিনই
দেরি করেন। আজ এলেন আরো দেরিতে। ক্লাসে এসে চেয়ার টেনে বসে একটা কাগজ বের করে সুব্রতকে
ডেকে বললেন, “এইটা বড় বড় করে বোর্ডে লিখে দে।"
আমরা ক্লাসটেস্টের
খাতা খুলে বসেই ছিলাম। সুব্রত বোর্ডে প্রশ্ন লিখছে – Write a paragraph on
Bengali new year celebration. Word Limit 200.
তার মানে পহেলা
বৈশাখ সম্পর্কে লিখতে হবে। মনে হচ্ছে বিপদে পড়ে গেলাম। কারণ
ফারজানা যে তিনটি সম্ভাব্য প্যারাগ্রাফের কথা বলেছিল তার মধ্যে পহেলা বৈশাখ ছিল
না। আমাদের নিশ্চিত ধারণা ছিল যে মোতালেব স্যার কখনোই পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে লিখতে
দেবেন না। কারণ সুযোগ পেলেই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলেন
তিনি। আমাদের ক্লাসেই তিনি অনেকবার বলেছেন, “এই সব পহেলা বৈশাখ, বর্ষবরণ – এগুলা
হইল হিন্দুয়ানি অনুষ্ঠান। ইন্ডিয়ানরা গায়ের জোরে আমাদের উপ্রে ওগুলা চাপাই দিছে।"
স্যার যখন আমার দিকে তাকিয়ে এসব কথা বলেন তখন আমার মনে হতে থাকে যেন তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করেই এসব
বলছেন। আমাদের স্কুলেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়। আমরা সেই অনুষ্ঠানে গান করি, নাচি -
এসব মোতালেব স্যার একেবারেই পছন্দ করেন না। এখন সেই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে লিখলে
স্যার কি নম্বর দেবেন? বানিয়ে বানিয়ে লিখতে হবে। বানিয়ে বানিয়ে দুইশ’টি ইংরেজি
শব্দ লেখা আমার জন্য দুইশ’টি ইট কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতোই কঠিন।
কোন রকমে দুই লাইন লেখার পর মোতালেব
স্যারের দিকে চোখ গেলো। দেখলাম স্যার চেয়ারে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ক্লাসে
চল্লিশ মিনিটের মধ্যে বিশ মিনিটও জেগে থাকতে পারেন না, অথচ বাসায় ঘন্টার পর ঘন্টা
ব্যাচের পর ব্যাচ প্রাইভেট পড়ান কীভাবে জানি না।
ঘন্টা বাজার সাথে সাথে স্যার জেগে
উঠলেন। জেগেই হুংকার দিলেন, “স্টপ রাইটিং। সুব্রত আর ফারজানা – খাতাগুলি তুলে আমার
টেবিলে রেখে আসবি।"
মোতালেব স্যার ক্লাস থেকে বের হবার সাথে
সাথেই হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। আমরা মেয়েরা সব খাতা জড়ো করে ফারজানার কাছে দিয়ে দিলাম।
কিন্তু ছেলেদের সব খাতা নিতে সুব্রতকে অনেক কষ্ট করতে হলো। টিপু আর ফয়সল বই দেখে
দেখে লিখছিলো। লেখা শেষ হবার আগে কিছুতেই খাতা দিচ্ছিলো না। সুব্রত সাইজে কিছুটা
ছোটখাট হলেও গায়ে শক্তি আছে অনেক। টিপু আর ফয়সলকে কিল-ঘুষি মেরে খাতা কেড়ে নিলো।
সুব্রত যদি কখনো টিচার হয় – স্টুডেন্টদের খবর আছে। পিটিয়ে সোজা করে ফেলবে।
সবার ক্লাস টেস্টের খাতা নিয়ে সুব্রত ও
ফারজানা বেরিয়ে যেতেই আবার গান ধরলো বিদ্যুৎ,
"হলইদ্দা চড়ই গাছর ডালত্ ..."। এমনই গান আর এমনই তার
গলা যে কানে আঙুল দিতে হলো।