বুধ গ্রহে জয়নুল আবেদিন
থার্ড পিরিয়ডে এলেন
অরুন্ধতী ম্যাডাম। সপ্তাহে
এই একটি পিরিয়ড হলো চারু ও কারুকলার ক্লাস। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমাদের ড্রয়িং টিচার ছিলেন রাজীব স্যার। তখন ড্রয়িং-এর ক্লাস ছিল আনন্দের। কিন্তু অরুন্ধতী ম্যাডামের হাতে পড়ে
ড্রয়িং ক্লাসের আনন্দ শেষ হয়ে গেছে আমাদের।
অরুন্ধতী ম্যাডাম এবছরই জয়েন করেছেন।
ম্যাডাম খুবই কড়া। ক্লাসে তিনি কোন ধরনের কথাবার্তা পছন্দ করেন না। কোন ধরনের
প্রশ্ন করাও পছন্দ করেন না। আফতাব স্যারের ক্লাসে যেমন আমরা স্বাধীনভাবে প্রশ্ন
করতে পারি, হা হা করে হাসতে পারি, আলোচনা করতে পারি, যুক্তি দেখাতে পারি - সেখানে
অরুন্ধতী ম্যাডামের ক্লাসে সেসব কিছুই খাটে না।
ম্যাডাম প্রথম দিন এসেই আমাদের বলে
দিয়েছেন, "দেখো, আমার ক্লাস হলো কাজের ক্লাস। সেখানে কোন ধরনের ট্যাঁ ফুঁ
চলবে না। যা কাজ দেবো তা করবে, যা লিখতে বলবো লিখবে, যা আঁকতে বলবো আঁকবে। কাজের
বাইরে একটা শব্দ করলে আমি সোজা ক্লাস থেকে বের করে দেবো।"
সবিতা ম্যাডামও এরকম কথাই বলেন, কিন্তু
বলার সময় ভীষণ চেঁচিয়ে ধমক দিয়ে বলেন। ফলে আমরা ভয় পাওয়ার বদলে বেশ মজাই পাই।
সবিতা ম্যাডাম আগে আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন, এখন বাংলা প্রথম পত্র পড়ান। তাঁর ক্লাসে
আমরা প্রচুর ধমক খাই - তবুও তাঁকে ভয় তেমন পাই না। কিন্তু অরুন্ধতী ম্যাডাম সবিতা
ম্যাডামের মতো নন। তিনি একটুও না চেঁচিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় যখন বললেন, "একটা
শব্দ করলে ক্লাস থেকে বের করে দেবো" - আমরা সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। সেদিন
ক্লাস চলাকালীন আবদুর রহিমের হাত লেগে ডেস্ক থেকে জ্যামিতিবক্স পড়ে গিয়েছিল ফ্লোরে।
অরুন্ধতী ম্যাডাম আবদুর রহিমকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে অরুন্ধতী
ম্যাডামের ক্লাসে আমরা কথা বলা তো দূরের কথা - জোরে নিঃশ্বাসও ফেলি না। যে নয়ন কথা
না বলে পাঁচ মিনিটও চুপ করে থাকতে পারে না সেও এই ক্লাসে চল্লিশ মিনিট মুখ বন্ধ
করে বসে থাকে।
অরুন্ধতী ম্যাডাম ক্লাসে ঢোকার সাথে
সাথেই আমরা চারু ও কারুকলা বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় খুলে বসলাম। পৃথিবীর বিখ্যাত
শিল্পীদের চিত্রকর্ম সম্পর্কে পড়াতে শুরু করলেন অরুন্ধতী ম্যাডাম।
"ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় ষাট
মাইল দূরে ভিলটি নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে ১৪৫২ খ্রীষ্টাব্দে আনচিআনো নামক গ্রামে
লিওনার্দোর জন্ম হয়। পিতা পাইরো দা ভিঞ্চি একজন বিশিষ্ট বিত্তশালী। তাঁর মাতার নাম
ক্যাটরিনা।"
আমার খুব প্রশ্ন করতে
ইচ্ছে করছিল ভিল্টি নামক ক্ষুদ্র শহরে তিনি জন্মেছিলেন নাকি আনচিআনো নামক গ্রামে?
কিন্তু প্রশ্ন করলেই ধমক খেতে হবে। তাই চুপ করে রইলাম।
ম্যাডাম বই থেকে লাইনের পর লাইন পড়ছেন
আর আমরা হা করে শুনছি। ফারজানা লাল-হলুদ হাইলাইটার দিয়ে
লিওনার্দোর জন্মসাল,
জন্মস্থান, পিতার নাম, মাতার নাম এগুলো দাগিয়ে রাখছে। পরীক্ষায় এসব তথ্য আমাদের
মুখস্ত লিখতে হয়। এগুলো গটগট করে মুখস্ত লিখতে পারলেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে আমি লিওনার্দো
দ্য ভিঞ্চি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি।
লিওনার্দো
দ্য ভিঞ্চি'র মোনালিসার ছবি আছে আমাদের বইতে। মোনালিসার চুল কেটে ছোট করে দিলে হুবহু
লুনার মতো দেখাবে বলে আমাদের ধারণা। কিন্তু এখন এসব নিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করলে
ক্লাস থেকে বের করে দেবেন অরুন্ধতী ম্যাডাম।
“ম্যাডাম আসি?”
দেখলাম পিয়ন সুরুজ মিয়া হাতে একটা কাগজ নিয়ে ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
“আসো। কী ব্যাপার?”
“আপনারে প্রিন্সিপাল স্যার ডাকছেন।"
“ঠিক
আছে তুমি যাও।"
সুরুজ মিয়া অরুন্ধতী ম্যাডামের হাতে
কাগজটা দিয়ে চলে গেলেন। ম্যাডাম
কাগজটা পড়ে হাতের বইটা টেবিলে রেখে বললেন, "আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। তোমরা চুপচাপ বসে থাকো।" বলেই ম্যাডাম দ্রুত বের
হয়ে গেলেন।
চুপচাপ থাকতে বললেই কি আর আমরা চুপ করে
থাকি? এতক্ষণের দমবন্ধ অবস্থা থেকে পাঁচ মিনিটের মুক্তি মিলেছে। সেটাকে উপভোগ করার
জন্য আমরা কথা বলতে শুরু করলাম। পাঁচ মিনিট কেটে যাবার পরেও ম্যাডাম এলেন না।
আমাদের মৃদুস্বর ক্রমশ কোলাহলে পরিণত হতে শুরু করলো। সুব্রত সামনে দাঁড়িয়ে স্কেল
উঁচিয়ে "অ্যাই চুপ্, কেউ কথা বলবে না" বলে ধমক
দেয়। কিন্তু সুব্রতের ধমকে ইদানীং খুব একটা কাজ হয় না। আমাদের কোলাহল ক্রমশ
চিৎকার-চেঁচামেচিতে পরিণত হলো।
“অ্যাই বদমায়েশের দল। মাছের বাজার
পেয়েছিস এখানে?” দেখলাম ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে হুংকার দিচ্ছেন হুজুর
স্যার। আমাদের চেঁচামেচিতে পাশের ক্লাস থেকে বের হয়ে এসেছেন। হুজুর স্যারের উচ্চতা
বা ওজন কোনটাই খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু গলার তেজ মারাত্মক। হুজুর স্যারের ধমক
আমাদের পিটি টিচার ভোলানাথ স্যারের ধমকের চেয়েও জোরালো। ফারজানা আর নয়নের কাছে
শুনেছি ইসলাম ধর্মের ক্লাসে পড়া না পারলে হুজুর স্যার গরুর মতো পেটান। শারীরিক
শাস্তি নিষিদ্ধ জাতীয় মধুর কথাবার্তার থোড়াই কেয়ার করেন তিনি। আমি অবশ্য কখনো
দেখিনি – কারণ সেই সময় আমাদের হিন্দুধর্মের ক্লাস করার জন্য
অন্য রুমে চলে যেতে হয়।
“হই জয়নাইল্যা, কান টানি ছিঁরি
ফ্যালব একটা শব্দ কইরলে।"
ঘাড় ঘুরিয়ে জয়নাল আবেদিনের দিকে দেখতে
ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ভয়ে তাকালাম না। কারণ হুজুর স্যার ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ধমক
দেন বেশি।
“ক্লাসে আর একটা যদি শব্দ হয় তোদের
সবার খবর আছে। বদমাইশের দল" -
বলতে বলতে হুজুর স্যার চলে গেলেন। সারা ক্লাস একেবারে চুপ করে আছি। একটা শব্দও নেই
কারো মুখে। সুব্রতের গন্ড তো আগে থেকেই গোল ছিল, দেখলাম ফারজানার গন্ডও গোল হয়ে
গেছে। মেধাভিত্তিক মনিটর হওয়ার নিয়মটা না থাকলে ফারজানা কিছুতেই মনিটর হতে চাইতো
না।
“এতক্ষণ পরে আসতেছেন ক্লাসে?”
“এটা আমার ক্লাস নয়। অরুন্ধতী
ম্যাডামের ক্লাস।"
হুজুর স্যার আর আফতাব স্যারের কথাবার্তা
শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আফতাব স্যার আমাদের ক্লাসের দিকেই আসছেন। আমরা খুশি হয়ে
উঠলাম। কিন্তু হুজুর স্যারের ভয়ে কোন শব্দ করলাম না। শুনতে পেলাম হুজুর স্যার আফতাব
স্যারকে বলছেন, “লাই দিয়া দিয়া তো পোলাপাইনগুলারে মাথায় তুলে ফ্যালছেন।"
“হা হা হা”
আফতাব স্যারকে দেখতে পাচ্ছি না এখনো।
কিন্তু তাঁর হাসির শব্দ শুনেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো পান খাওয়া বড় বড় অসংখ্য দাঁত।
নয়ন বলে আফতাব স্যারের নাকি চল্লিশটি দাঁত।
“আপনি হাসতেছেন? আফতাব সাব, আপনার
সাথে কি আমি মশ্করা করতেছি?”
হুজুর স্যারের গর্জন শুনতে পেলাম। আফতাব
স্যারকে আমরা ছাত্রছাত্রীরা সবাই পছন্দ করি। কিন্তু স্যার-ম্যাডামদের অনেকেই আফতাব
স্যারকে পছন্দ করেন না। হুজুর স্যার আফতাব স্যারকে একদম সহ্য করতে পারেন না।
কিন্তু আফতাব স্যার এসব খুব একটা
পাত্তা দেন না। তিনি হাসতে হাসতে আমাদের ক্লাসে এসে ঢুকলেন।
"অরুন্ধতী ম্যাডাম তোমাদের ম্যাগাজিন
কমিটির জরুরি মিটিং-এ ব্যস্ত আছেন। তাই আমাকে আসতে হলো। কী পড়ছিলে তোমরা?"
"লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
স্যার।"
পুরো ক্লাস যেন এক সাথে চিৎকার করে
উঠলো। আফতাব স্যারকে দেখলেই আমাদের সবার ভেতর এক ধরনের খুশির ভাব চলে আসে। হুজুর স্যারের ধমকের কথা ভুলতে আমাদের এক সেকেন্ডও লাগলো না।
"লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি?”
“জ্বি
স্যার। যাঁর জন্ম হয়েছিল ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় ষাট মাইল
দূরে ভিলটি নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে
আনচিআনো নামক গ্রামে" - নয়ন এক নিঃশ্বাসে বলে যায়।
এবার আমিও যোগ করি, “তাঁর পিতার নাম ছিল পাইরো দা ভিঞ্চি, মাতার নাম ক্যাটরিনা কাইফ্।"
পুরো ক্লাস আবার হেসে উঠলো হা
হা করে।
“বা
বা বা। তোমরা তো অনেক কিছু জানো দেখছি। তাঁর জন্ম কোথায় হয়েছিল আবার বল দেখি।"
"ইটালির
ফ্লোরেন্স থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে ভিলটি নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে ১৪৫২
খ্রীষ্টাব্দে আনচিআনো নামক গ্রামে লিওনার্দোর জন্ম হয়।"
একেবারে
দাঁড়িকমাসহ মুখস্ত বলে সুব্রত।
“ভিলটি
নামক শহর বলছো, আবার বলছো আনচিআনো গ্রামে। তিনি কি দুই জায়গায় জন্মেছিলেন নাকি?”
“বইতে
তো ওরকমই আছে স্যার।"
“দেখি
কী আছে?”
টেবিলের ওপর থেকে চারু ও
কারুকলা বইটি তুলে নিয়ে স্যার দেখলেন। তারপর কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললেন, “আশ্চর্য! তোমরা বইতে যা আছে হুবহু তাই মুখস্ত করে বসে আছো। বইতে তো ভুল আছে।
ভিল্টি শহর নয়। আসলে ফ্লোরেন্সের একটি ছোট শহরের নাম ভিঞ্চি। সেই ভিঞ্চি এলাকার
অন্তর্গত আনচিআনো গ্রামে লিওনার্দো জন্মেছিলেন। তাঁর পুরো নাম থেকেই কিন্তু তাঁর
বাবার নাম ও অঞ্চলের নাম জানা যায়। সেই সময় মানুষের পুরো নামের সাথে বাবার নাম ও
জন্মশহরের নাম জুড়ে দেয়া হতো। লিওনার্দোর পুরো নাম হলো –
লিওনার্দো ডি সের পিয়েরো দ্য ভিঞ্চি। লিওনার্দো হলো তাঁর নাম। পিয়েরো হচ্ছে তাঁর
বাবার নাম। পিয়েরোর আগে সের আছে – সের অনেকটা আমাদের দেশের স্যারের
মতো, অর্থাৎ বিশিষ্ট ব্যক্তি। এখান থেকে বোঝা যায় যে লিওনার্দোর বাবা পিয়েরো একজন
বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তারপর এসো নামের শেষের অংশে –
দ্য ভিঞ্চি। অর্থাৎ ভিঞ্চি অঞ্চলের মানুষ। সেই সময় সেই অঞ্চলের সব মানুষের নামের
শেষেই ‘দ্য ভিঞ্চি’ ছিল। দ্য ভিঞ্চি কিন্তু
লিওনার্দোর পদবী নয়।“
একটা নাম থেকেও যে কতকিছু
জানা যায়! অরুন্ধতী ম্যাডাম আমাদের এসব কিছুই বলেন না। এখন শহরের নাম ভিলটি লিখবো
না ভিঞ্চি লিখবো? অরুন্ধতী ম্যাডাম তো বইতে যা আছে তা-ই লিখতে বলেন।
“চিত্রলেখা
চক্রবর্তী, তুমি যে বললে লিওনার্দোর মায়ের নাম ক্যাটরিনা কাইফ্, এটা কোথায় পেলে?” - কিছুই ভোলেন না আফতাব স্যার।
“স্যার
বইতে ক্যাটরিনা আছে। ভুলে কাইফ্ বেরিয়ে গেছে।"
আমার কথায় হাসছে সবাই। স্যারও
হাসতে হাসতে বললেন, “ক্যাটরিনা কাইফ্কে তুমি ছয় শ’ বছরের বৃদ্ধা বানিয়ে দিলে!”
“সরি
স্যার।"
“তোমরা
কি জানো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যতটা শিল্পী ছিলেন তার চেয়েও বেশি বিজ্ঞানী ছিলেন? উড়োজাহাজ
উদ্ভাবিত হবার অনেক আগেই তিনি উড়োজাহাজের নকশা তৈরি করেছিলেন, হেলিকপ্টারের ছবি
এঁকেছিলেন। তোমরা কি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ছবিগুলো দেখেছো?"
"আমাদের বইতে স্যার মোনালিসার ছবি
আছে।"
স্যার বই খুলে ছবিটা দেখে বললেন,
"আরে এটা মোনালিসার ছবি না। এই ছবিটার নাম মোনালিসা।"
"আমিও তো তাই বললাম স্যার। বইয়ের
ছবিটা তো আসল মোনালিসা নয়, মোনালিসার ছবি।" - যুক্তি দেখাতে সময় লাগে না
নয়নের।
"ব্রিলিয়্যান্ট। চমৎকার যুক্তি।
আচ্ছা তোমরা কি শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে চেনো?"
আমাদের চারু ও কারুকলা বইয়ের প্রথম
অধ্যায়েই আছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নাম। বাংলাদেশে চারুকলা শিক্ষার
প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন তিনি। আমরা সবাই চিৎকার করে উঠলাম, "জ্বি
স্যার।"
"বলো তো তিনি কে?"
"তিনি আমাদের ক্লাসমেট স্যার। এই
তো আমার পাশেই বসে আছেন।"
রবিনের কথায় হো হো করে
হেসে উঠলো সারা ক্লাস। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম রবিনের ডান পাশে বসে আছে বিদ্যুৎ - যার
ভালো নাম জয়নাল আবেদিন।
শিল্পী জয়নাল আবেদিন!
হ্যাঁ, শিল্পীই বটে! তার গানের যন্ত্রণায় আমরা সবাই এত বিরক্ত যে কী আর বলবো।
ক্লাসে টিচার না থাকলেই সে হঠাৎ হঠাৎ কর্কশ গলায় গেয়ে ওঠে অদ্ভুত সব গান। আজ
ফার্স্ট পিরিয়ডের পর আফতাব স্যার ক্লাস থেকে বের হতে না হতেই গান ধরেছিল - "হলইদ্দা
চরই গাছর ডালত কিল্লা ডাকের বই..."। সুব্রত তখন তাকে থামিয়েছিল। তারপর
সেকেন্ড পিরিয়ডের পর আবার সে গান ধরেছিল। তখন সুব্রত আমাদের ক্লাস টেস্টের খাতা
নিয়ে অফিসে গিয়েছিল - তাই বিদ্যুৎ-কে থামানোর কেউ ছিল না।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এমনিতেই কঠিন,
তার ওপর বিদ্যুতের গলায় তা এতটাই কর্কশ লাগে যে কানে আঙুল দিতে হয়। বিদ্যুতের গানে
আমরা সবাই বিরক্ত হলেও লুনা মাঝে মাঝে মাথা দুলিয়ে বেঞ্চে তাল দেয় আর বলে
"ইন্টারেস্টিং মিউজিক।"
লুনার কাছে সব কিছুই ইন্টারেস্টিং লাগে।
অনেক বছর চীনে কাটিয়ে এসেছে বলেই হয়তো। ভোলানাথ স্যারের হুংকার, হালিমা ম্যাডামের
হালুম, সবিতা ম্যাডামের চিৎকার, হুজুর স্যারের ধমক - সবকিছুতেই লুনা বলে 'ইন্টারেস্টিং'।
বিদ্যুতের গানে লুনা ছাড়া আমরা সবাই বেশ বিরক্ত। আর রবিন
ইচ্ছে করেই দুষ্টুমি করছে আফতাব স্যারের সাথে।
আফতাব স্যার আমাদের এরকম দুষ্টুমীকে
প্রশ্রয় দেন। তিনি রাগ করার বদলে হাসিমুখে বললেন, "তোমরা যার কথা বলছ তার নাম
জয়নাল আবেদিন। আমি বলছি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথা। তোমরা নিশ্চয় তার নাম
শুনেছো। তোমরা কি জানো পৃথিবী ছাড়াও সৌরজগতের আরো একটি গ্রহে জয়নুল আবেদিনের নাম
আছে?"
আমার ধারণা আফতাব স্যার পৃথিবীর যে কোন
বিষয় নিয়ে কথা শুরু করুন না কেন সেটাকে এক সময় টেনে নিয়ে আসবেন বিজ্ঞানে। চারু ও
কারুকলার ক্লাসে এসেও সৌরজগতের গ্রহের প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন।
"পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহে তো
স্যার এখনো প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাহলে অন্য কোন গ্রহে মানুষের নাম
কীভাবে থাকবে?"
"সেটাই তো কথা। এই যে পৃথিবীতে এত
নাম ধাম আছে - সবকিছুই কি শুধু মানুষের নাম? জায়গার নাম আছে না? যেমন ধরো বঙ্গবন্ধু
অ্যাভিনিউ - বঙ্গবন্ধুর নামে একটি রাস্তার নাম। পৃথিবীর সব দেশ, সাগর, নদী, পর্বত,
রাস্তা ঘাট সবকিছুরই কোন না কোন নাম আছে। মানুষই এসব নাম রেখেছে। পৃথিবীর বাইরেও
যত গ্রহ নক্ষত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে - সেগুলোরও নাম দেয়া হচ্ছে। গ্রহ উপগ্রহের বিভিন্ন
জায়গার নামও রাখা হচ্ছে। চাঁদের বিভিন্ন জায়গার নাম তোমরা এর মধ্যেই জেনে ফেলেছো।
এমন একটা গ্রহ আছে যে গ্রহের সবগুলো জায়গার নাম রাখা হয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব
শিল্পীদের নামে। শিল্পী মানে লেখক, কবি, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী।"
"শুধুমাত্র শিল্পীদের
নামে স্যার? বিজ্ঞানীদের নামে কিছু নেই?" - অর্ক প্রশ্ন করে।
"বিজ্ঞানীদের নামে প্রায় সব
গ্রহ-উপগ্রহেই বিভিন্ন জায়গার নাম আছে। চাঁদের অনেকগুলো জায়গার নাম বিজ্ঞানীদের
নামে রাখা হয়েছে। কিন্তু যে গ্রহের কথা বলছি সেই গ্রহের যে সব জায়গা এখনপর্যন্ত
আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের সবগুলোর নাম রাখা হয়েছে শুধুমাত্র শিল্পীদের নামে। এবং
ভবিষ্যতে আরো যেসব জায়গা সেই গ্রহে আবিষ্কৃত হবে সেগুলোরও নাম রাখা হবে শুধুমাত্র
শিল্পীদের নামে। বিজ্ঞানীরা এই গ্রহকে শিল্পীদের গ্রহে পরিণত করেছেন। সেই গ্রহে
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নামেও একটা জায়গার নামকরণ করা হয়েছে। তোমরা কি জানো
সেই গ্রহের নাম কী?"
ভাবতে শুরু করলাম কবি সাহিত্যিকদের সাথে
কোন্ গ্রহের মিল আছে বেশি। মঙ্গল গ্রহ হতে পারে। কারণ মঙ্গল নিয়ে অনেক গান-কবিতা
আছে। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে... মঙ্গলদীপ জ্বেলে...।
বললাম, "মঙ্গল গ্রহ স্যার"
"চিত্রলেখা চক্রবর্তী বলছে মঙ্গল
গ্রহ। তোমরা কি সবাই এক মত?"
"বৃহস্পতি স্যার" - অর্ক
বললো।
"শনি স্যার" - সুব্রত বললো।
"ইউরেনাস"
"নেপচুন"
গ্রহগুলোর নাম একের পর এক বলে যাচ্ছে
অনেকেই। লুনা খুব মৃদুস্বরে বললো, "মার্কারি।"
মার্কারি? মার্কারি নামে সূর্যের কোন
গ্রহ আছে? লুনাকে জিজ্ঞেস করলাম, "কী বললি?"
"ইট্স প্ল্যানেট মার্কারি।"
আফতাব স্যার খুশি হয়ে দুই হাত শূন্যে
তুলে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। "দ্যাট্স ইট। ইউ আর রাইট ইলোরা ইসলাম। ইট্স
মার্কারি - প্ল্যানেট মার্কারি - বুধ গ্রহ। বুধ গ্রহ হলো শিল্পীদের গ্রহ। এই বুধ
গ্রহের একটা বড় গহ্বর বা ক্রেইটারের নাম আবেদিন ক্রেইটার। ২০০৯ সালের ৯ই জুলাই
থেকে এই বুধ গ্রহেই আছে আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নাম।"
"শুধু জয়নুল আবেদিনের নাম আছে
স্যার? আর কারো নাম নেই?"
"আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ থেকে আর
কারো নাম এখনো নেই। বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে একটা
গহ্বর আছে - ঠাকুর ক্রেইটার।"
"এই নামগুলি কীভাবে রাখা হয়
স্যার?"
"ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থা এই সিদ্ধান্ত নেয়। তারা
নিয়ম করেছে পৃথিবীর বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে যাঁরা গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিখ্যাত এবং
নামকরণের সময়ের কমপক্ষে তিন বছর আগে মারা গেছেন শুধুমাত্র তাঁদের নামই বিবেচনা করা
হবে।"
"আজ তো সময় শেষ। কাল এ ব্যাপারে
আরো আলোচনা করা যাবে।"
বেশ বুঝতে পারছি আমাদের নতুন প্রজেক্ট
হচ্ছে বুধ গ্রহ।
পরের দিন বৃহস্পতিবার। থার্ড ও ফোর্থ
পিরিয়ডে আফতাব স্যার বুধ গ্রহ সম্পর্কে অনেক কিছুই বললেন। প্রজেক্টরের সাহায্যে
দেখালেন প্ল্যানেট মার্কারি বা বুধ গ্রহের ওপর তথ্যচিত্র।
সূর্যের সবচেয়ে কাছের এই গ্রহটি
সম্পর্কে আমরা অন্যান্য গ্রহের চেয়ে অনেক কম জানি। অথচ বুধ হচ্ছে সূর্যের প্রথম গ্রহ, সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট গ্রহ। আগে
প্লুটোকে যখন গ্রহ বলে ধরা হতো তখন প্লুটোই ছিল সবচেয়ে ছোট গ্রহ। এখন প্লুটো আর
গ্রহ নয়। প্লুটো এখন বামন-গ্রহ। সূর্যের চারদিকে বুধ অন্য সব গ্রহের চেয়ে অনেক
বেশি দ্রুত গতিতে ঘুরছে। মাত্র ৮৮ দিনে বুধ সূর্যের চারপাশে এক বার ঘুরে আসে। তার
মানে বুধের এক বছর সমান পৃথিবীর ৮৮ দিন। কিন্তু বুধের এক দিন হলো পৃথিবীর ১৭৬
দিনের সমান যা বুধের দুই বছর। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার না? চলো দেখি বুধ গ্রহের
ব্যাপার-স্যাপার কী।
No comments:
Post a Comment