সূর্যের প্রথম গ্রহ
বুধ
সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ। কিন্তু ১৯৭০ সালের আগপর্যন্ত আমরা তেমন কিছুই জানতাম না এই গ্রহটি সম্পর্কে। সৌরজগতের
অন্য গ্রহগুলো সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি বুধ সম্পর্কে জানি তার চেয়ে অনেক কম।
টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়েছে সেই গ্যালিলিওর যুগে। টেলিস্কোপ দিয়ে পৃথিবী থেকে কত কত
দূরের গ্যালাক্সি আবিষ্কার করে ফেলেছে মানুষ, কত দূরের গ্রহ সম্পর্কে কত কিছু জেনে
গেছে, অথচ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ সম্পর্কেই বেশি কিছু জানতে পারেনি।
জানতে না পারার কারণও আছে। পৃথিবী
থেকে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে সূর্য দেখতে গেলে সূর্যের তীব্র আলোর তেজে চোখ তো
নষ্ট হয়ে যেতে পারেই – টেলিস্কোপের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম
ইলেকট্রনিক সার্কিটও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বুধ সূর্যের এত কাছে বলে পৃথিবী থেকে
সূর্যকে এড়িয়ে বুধকে দেখার কোন সুযোগ নেই। তাই হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপ (Hubble Space Telescope) দিয়েও
বুধ দেখা যায় না। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে কিছু কিছু বিশেষ টেলিস্কোপ দিয়ে বুধ
দেখা যায় – কিন্তু তাতে যে ছবি পাওয়া যায় তা এতটাই অস্পষ্ট যে
তেমন কিছুই বোঝা যায় না। তাই বুধের কাছাকাছি নভোযান পাঠানোর আগপর্যন্ত বিজ্ঞানীরা
বুধ সম্পর্কে অনেককিছুই জানতে পারেননি।
কিন্তু বুধ গ্রহের কিছু মৌলিক
বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে বসেই হিসেব করে বের করে ফেলতে পেরেছিলেন। বিজ্ঞানীরা
অনেকদিন আগেই জেনেছেন যে বুধ সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে আয়তনে সবার ছোট, সূর্যের
সবচেয়ে কাছে থাকে। বুধের ব্যাস, ভর, কক্ষপথ, আয়তন, ঘনত্ব সব হিসেব করে বের করেছেন
বিজ্ঞানীরা।
বুধ যেহেতু সূর্যের এত কাছে থেকে
সূর্যের চারপাশে কক্ষপথে ঘুরছে – সূর্য ও বুধের মধ্যে আকর্ষণ বলের
তীব্রতার কারণে কক্ষপথে বুধের গতিবেগ অন্যান্য গ্রহগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
সূর্যের চারপাশে এক বার ঘুরে আসতে পৃথিবীর যেখানে গড়ে ৩৬৫ দিন সময় লাগে সেখানে
বুধের লাগে মাত্র ৮৮ দিন।
বুধের কক্ষপথ অন্যান্য গ্রহগুলোর
কক্ষপথের তুলনায় অনেকটাই অন্যরকম। বুধের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে প্রায় সাত
ডিগ্রি কোণ করে আছে। অর্থাৎ পৃথিবী যে তলে সূর্যের চারপাশে ঘুরে বুধ ঘুরে তার সাথে
সাত ডিগ্রি কোণ করে। বুধের কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা (eccentricity) ০.২০৫ (0.205) যা অন্যান্য
গ্রহের চেয়ে অনেক বেশি। বুধের কক্ষপথ এতটাই উপবৃত্তাকার যে
সূর্য থেকে এর কাছের ও দূরের বিন্দুর দূরত্বের পার্থক্য প্রায় ৩৪%।
সূর্যের খুব কাছে থাকার কারণে বুধ
সূর্যের আলো ও তাপ পায় অনেক বেশি। ফলে বুধের যে পাশ সূর্যের দিকে থাকে সেই পাশটা
ভীষণ উত্তপ্ত। আর সূর্যের এত কাছে হওয়ার কারণে বুধে কোন বায়ুমন্ডল নেই। ফলে তাপ
ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই যেদিকে সূর্যের আলো ও তাপ পৌঁছায় না সেদিকে
প্রচন্ড ঠান্ডা। এক পিঠ থেকে অন্য পিঠের যে তাপমাত্রার পার্থক্য সেটাও বুধেরই
সবচেয়ে বেশি। বুধের যে পিঠে সূর্যের আলো পড়ে সেই পিঠের তাপমাত্রা +৪৫০ ডিগ্রি
সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে, আর যে পিঠে সূর্যালোক পড়ে না সেই পিঠের তাপমাত্রা
শূন্য ডিগ্রির নিচে আরো ১৮৫ ডিগ্রি অর্থাৎ -১৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।
তাহলে তাপমাত্রার পার্থক্য দাঁড়ায় প্রায় ৬৩৫ ডিগ্রি।
১৯৭০ সালে বুধ গ্রহে পৃথিবী থেকে
প্রথম নভোযান ম্যারিনার-১০ (Mariner-10) পাঠানো হয়।
ম্যারিনার-১০ বুধের অনেক ছবি তুলে পাঠায়। সেখান থেকে বিজ্ঞানীরা বুধ সম্পর্কে বেশ
কিছু নতুন ধারণা পান। কিন্তু ম্যারিনার-১০ তিন বার বুধের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়েও বুধের
মোট ক্ষেত্রফলের শতকরা ৪৫ ভাগ জায়গার ছবি তুলতে পেরেছিল। বাকি ৫৫% জায়গায় কী আছে
তা বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি ২০০৪ সাল পর্যন্ত।
২০০৪ সালে বুধের দ্বিতীয় মিশন মেসেঞ্জার
(MESSENGER) বুধের সম্পূর্ণ ক্ষেত্র পরিক্রমা করে ছবি তুলে আনে।
তোমরা আবার এটাকে ফেসবুক মেসেঞ্জার মনে করো না। মেসেঞ্জার নামটি এসেছে MErcury, Surface,
Space ENvironment, GEochemistry, Ranging থেকে। মেসেঞ্জার
মিশনের মাধ্যমে পাওয়া বুধের ছবিগুলো বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে
বিজ্ঞানীরা বুধের অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছেন। বুধ গ্রহের একটি সামগ্রিক ম্যাপ
আমাদের আছে এখন।
২০১৮
সালে বুধ গ্রহে আরেকটি মিশন বেপিকলম্বো (BepiColombo) পরিচালনা করা হবে।
বুধ
সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এপর্যন্ত যা কিছু জেনেছেন তার মধ্য থেকে সবচেয়ে দরকারি
বিষয়গুলো একে একে বলছি তোমাদের।
শুরুতেই দেখা যাক সৌরজগৎ ও তার
গ্রহগুলোর উৎপত্তি কীভাবে হলো।
No comments:
Post a Comment