থাকে কত দূরে, কত বেগে ঘুরে
সৌরজগতের
গ্রহগুলোর মধ্যে বুধের গতি সবচেয়ে বেশি। সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে বলে সূর্যের
চারপাশে ঘুরে আসতে বুধের সময় লাগে অন্য সব গ্রহের চেয়ে অনেক কম। সূর্যের চারপাশে
একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর যেখানে ৩৬৫ দিন লাগে সেখানে বুধের লাগে মাত্র ৮৮ দিন।
অর্থাৎ বুধ গ্রহের এক বছর হলো পৃথিবীর ৮৮ দিনের সমান। বুধের দূরত্ব ও গতি দেখতে
হলে আমাদের শুরুতে দেখতে হবে বুধের কক্ষপথ কী রকম।
বুধের কক্ষপথ
বুধের কক্ষপথ বা অরবিট
অদ্ভুত। সূর্যের চারপাশে যে পথে বুধ ঘুরে সেটা উপবৃত্তাকার। একটু বেশি পরিমাণেই
উপবৃত্তাকার। দেখতে অনেকটা হাসের ডিমের মত। গ্রহগুলোর মধ্যে বুধের কক্ষপথই সবচেয়ে
বেশি চ্যাপ্টা। এর উপবৃত্তের উৎকেন্দ্রিকতা ০.২১। এটা পৃথিবীর প্রায় ১২ গুণ। অর্থাৎ বুধের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের
চেয়ে প্রায় বারো গুণ বেশি উপবৃত্তাকার। ফলে সূর্য থেকে বুধের
দূরত্ব সবসময় সমান থাকে না।
বুধ সূর্যের একেবারে কাছে যে বিন্দু
পর্যন্ত যেতে পারে সেখান থেকে সূর্যের দূরত্ব ৪৭ মিলিয়ন কিলোমিটার, অর্থাৎ চার
কোটি সত্তর লক্ষ কিলোমিটার। বুধ থেকে সূর্যের সবচেয়ে কাছের এই বিন্দুকে বলে
পেরিহিলিয়ন (perihelion) বা অনুসুর বিন্দু।
সূর্য থেকে বুধ অ্যাপহেলিয়ন বা অপসুর বিন্দু |
বুধ সূর্য থেকে সবচেয়ে
দূরে যে বিন্দু পর্যন্ত যেতে পারে তার দূরত্ব ৭০ মিলিয়ন কিলোমিটার অর্থাৎ সাত কোটি
কিলোমিটার। সূর্য থেকে বুধের সবচেয়ে দূরের এই বিন্দুকে বলে অ্যাপহিলিয়ন (aphelion) বা অপসুর
বিন্দু।
সূর্য থেকে বুধের গড় দূরত্ব ৫৮ মিলিয়ন কিলোমিটার - পাঁচ কোটি আশি লক্ষ কিলোমিটার। সূর্য থেকে বুধে আলো
আসতে সময় লাগে তিন মিনিট বিশ সেকেন্ড।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫
কোটি কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে সূর্যকে যত বড় দেখা যায়, বুধ থেকে দেখলে
সূর্যকে তার তিন গুণ বড় বলে মনে হবে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো যায় না। এখন
ভেবে দেখো সূর্যের আকার তিনগুণ বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় তাকাতে পারবে সূর্যের দিকে?
বুধ থেকে দেখলে এরকমই মনে হবে।
কক্ষপথে বুধের গতি
সূর্যের চারপাশে বুধই সবচেয়ে বেশি বেগে ঘুরছে। অনুসুর বা পেরিহিলিয়ন
বিন্দুতে বুধের গতিবেগ সবচেয়ে বেশি - সেকেন্ডে ৫৯ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ২,১২,৪০০
কিলোমিটার। অপসুর বা অ্যাপহিলিয়ন বিন্দুতে বুধের গতিবেগ সবচেয়ে কম - সেকেন্ডে
প্রায় ৩৯ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ১,৪০,৪০০ কিলোমিটার। কক্ষপথে বুধের গড় গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার, অর্থাৎ ঘন্টায়
এক লক্ষ ৭০ হাজার ৫০৩ কিলোমিটার। বুধ কক্ষপথে পৃথিবীর চেয়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি
বেগে ছুটছে।
বুধের বছর
সৌরজগতের গ্রহগুলোর বছর
হিসেব করা হয় সূর্যের চারপাশে এক বার ঘুরে আসতে যে সময় লাগে তার ভিত্তিতে। বুধের
এক বছর অর্থাৎ সূর্যের চার পাশে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর যেখানে লাগে ৩৬৫ দিন
সেখানে বুধের সময় লাগে মাত্র ৮৮ দিন। তার মানে বুধের এক বছর হলো পৃথিবীর ৮৮ দিনের
সমান।
নিজের অক্ষে বুধের গতি
বুধের অক্ষ একেবারে উলম্বিক। নিজের অক্ষে যখন ঘুরে তখন ভূমির সাথে একেবারে
লম্বভাবে ঘুরে। পৃথিবী নিজের অক্ষে ঘুরার সময় একটা কোণ করে ঘুরে। কিন্তু বুধ
সেরকমভাবে ঘুরে না। তাছাড়া বুধ নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে খুবই আস্তে আস্তে। নিজের
অক্ষে বুধের গতি ঘন্টায় মাত্র ১০.৯ কিলোমিটার।
একজন সাধারণ মানুষও এই বেগে দৌড়াতে পারবে। যে কোন গ্রহের তুলনায় বুধ এতটাই আস্তে
আস্তে ঘুরে যে নিজের অক্ষের উপর একবার সম্পূর্ণ ঘুরতে তার লেগে যায় পৃথিবীর ৫৯
দিনের সমান।
দিনে দু'বার সূর্যোদয়
বুধের
কক্ষপথ উপবৃত্তাকার; বলা যায় অনেকটা হাঁসের ডিমের মতো। তাই সূর্য থেকে বুধের দূরত্ব সব সময় সমান নয়। বুধ সূর্যের চারপাশে দ্রুত
গতিতে ঘুরে। ঘুরতে ঘুরতে যখন সূর্যের খুব কাছে চলে আসে তখন বুধের গতি বেড়ে যায়,
আবার যখন দূরে চলে যায় তখন গতি কিছুটা কমে যায়। আবার বুধের আকাশে সূর্যের চলাচল
বুধের নিজের অক্ষের ওপর মন্থর গতির জন্য কিছুটা প্রভাবান্বিত হয়। সূর্য নিজেও
কিছুটা আস্তে চলতে থাকে এবং কিছু সময়ের জন্য ডুবে যায়। যখন বুধের কক্ষপথের গতি কমে
যায়, অক্ষের ঘূর্ণন সূর্যকে আবার উপরে তুলে দেয়। অর্থাৎ বুধের আকাশে একই দিনে
দ্বিতীয়বার সূর্যোদয় হয়।
বুধের কক্ষপথে বুধ ও সূর্যের পারস্পরিক অবস্থান |
উপরের
ছবিতে বুধের নিজের অক্ষের উপর একবার ঘূর্ণনের সময়কে ষোলটি সমান ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
সূর্য থেকে দূরবর্তী দূরত্বে 1 অবস্থানে সূর্যোদয় হবার পর
নিজের অক্ষে আস্তে আস্তে আর কক্ষপথে অনেক দ্রুত চলে বুধ যখন 12 অবস্থানে তখন কিছু সময়ের জন্য সূর্যকে আর দেখা যায় না। কিন্তু সূর্য থেকে
বুধের দূরত্ব তখন খুব কাছে হওয়াতে বুধ তখন সূর্যের চারপাশে খুব দ্রুত ঘুরে 16 অবস্থানে আসার পর আবার সূর্য দেখা যায়। এজন্যই বলা যায় বুধের একদিনে
দুইবার সূর্যোদয় হয়, দু'বার সূর্যাস্ত হয়।
বুধের একদিন সমান দুই বছর
পৃথিবী নিজের অক্ষের
উপর চব্বিশ ঘন্টায় একবার ঘুরে আসে। চব্বিশ ঘন্টায় পৃথিবীর এক দিন। পৃথিবীর এক দিন
বলতে আমরা যে চব্বিশ ঘন্টা বুঝি সেই চব্বিশ ঘন্টার মোটামুটি দৈর্ঘ্য হলো পৃথিবীর
কোন একটা নির্দিষ্ট স্থানে এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত। বুধের এক
দিনের হিসেবও সেভাবে করা হলে সেটা হবে - বুধের কোন একটা নির্দিষ্ট স্থানে এক
সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত যে সময় লাগে সেটা।
বুধের এক সূর্যোদয় থেকে অন্য সূর্যোদয় |
বুধ
সূর্যের চারপাশে অনেক দ্রুত ঘুরে বলে এই ৫৯ দিনে তার কক্ষপথের প্রায় ২/৩ অংশ ঘুরে
আসে। তাই বুধের কোন জায়গায় একজন দর্শক যদি দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখে, সেই জায়গায়
দাঁড়িয়ে পরের সূর্যোদয় দেখতে হলে এই দর্শককে অপেক্ষা করতে হবে বুধ সূর্যের চারপাশে
দু'বার ঘুরে আসতে যে সময় লাগবে সেই সময়। অর্থাৎ বুধের দুই বছর। দেখা যাক কীভাবে তা
হয়।
উপরের চিত্রে মনে করি বুধের 1 অবস্থানে থেকে একজন দর্শক সূর্যোদয় দেখল। তারপর 2 অবস্থানে মধ্য-সকাল, 3 অবস্থানে
দুপুর, 4 অবস্থানে বিকেল, 5 অবস্থানে
যখন আসে তখন কিন্তু সূর্যের চারপাশে এক বার ঘোরা হয়ে গেছে। তার মানে বুধের এক বছর
সময় চলে গেছে। অথচ তখন মাত্র সূর্যাস্ত হয়েছে। তারপর 6 অবস্থানে সন্ধ্যা, 7 অবস্থানে মধ্যরাত্রি, 8 অবস্থানে ভোর এবং
তারপর আবার 1 অবস্থানে নতুন সূর্যোদয়।
ততক্ষণে বুধ সূর্যের চারপাশে আরো একবার অর্থাৎ অবস্থান 1 থেকে যাত্রা শুরু করে আবার 1 অবস্থানে আসতে ১৭৬
দিন বা বুধের দুই বছর কেটে গেছে। সূর্যের
চারপাশে দুই বার ঘুরে আসতে যে সময় নেয় সেই সময়ে বুধ নিজের অক্ষের উপর তিন বার
ঘুরে। এইভাবে বুধের এক দিন সমান দুই বছর।
বুধের অভিকর্ষজ ত্বরণ
বুধের
উপরের তলে অভিকর্ষজ ত্বরণের (acceleration
due to gravity) মান ৩.৭ মিটার/বর্গ সেকেন্ড (3.7 m/s2)।
এই মান পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের ৩৮%। তার মানে পৃথিবীতে তোমার ওজন[1] যদি ৪০০ নিউটন হয়, বুধে তোমার ওজন হবে ১৫২ নিউটন। আমাদের আবদুর রহিম
উচ্চলাফ দিয়ে পৃথিবীর ভূমি থেকে প্রায় দুই মিটার লাফাতে পারে। সে যদি বুধের ভূমি
থেকে উচ্চলাফ দেয় তাহলে পৃথিবীর ১/০.৩৮ = ২.৬ গুণ অর্থাৎ ৫.২ মিটার লাফাতে পারবে।
বুধের মুক্তিবেগ
পৃথিবী থেকে যখন মহাকাশে রকেট পাঠানো হয় তখন সেই রকেটের বেগ এমন হতে হয় যেন
সেটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের টানে পৃথিবীতে ফিরে না আসে। মাধ্যাকর্ষণ বল থেকে
মুক্তি পাবার জন্য সর্বনিম্ন যে বেগের দরকার হয় তাকে মুক্তিবেগ (escape
velocity) বলে। পৃথিবীর মুক্তিবেগ ঘন্টায় ২৫,০৩০
কিলোমিটার। বুধের মুক্তিবেগ ঘন্টায় ১৫,৩০০ কিলোমিটার।
সারণি: বুধ ও পৃথিবীর কক্ষপথের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের তুলনা
বৈশিষ্ট্য
|
বুধ
|
পৃথিবী
|
সূর্য
থেকে গড় দূরত্ব
|
57,900,000
km
|
149,600,000
km
|
সূর্য
থেকে সবচেয়ে কম দূরত্ব
|
46,000,000
km
|
147,100,00
km
|
সূর্য
থেকে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব
|
69,800,000
km
|
152,100,00
km
|
কক্ষপথে
গড় গতিবেগ
|
170,503 km/h
|
107,280
km/h
|
কক্ষপথে
সবচেয়ে কম গতিবেগ
|
140,400
km/h
|
105,480
km/h
|
কক্ষপথে
সবচেয়ে বেশি গতিবেগ
|
212,400
km/h
|
109,080
km/h
|
নিজের
অক্ষে গতি
|
10.9 km/h
|
1670
km/h
|
এক বছর
(কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে)
|
পৃথিবীর 88 দিন
|
365 দিন
|
নিজের
অক্ষে একবার ঘুরতে সময় লাগে
|
পৃথিবীর 58.6 দিন
|
24 ঘন্টা
|
এক দিন
(এক সূর্যোদয় থেকে পরের সূর্যোদয় পর্যন্ত)
|
পৃথিবীর 176 দিন।
(বুধের দুই বছর)
|
24 ঘন্টা
|
অভিকর্ষজ
ত্বরণ
|
3.7
m/s2
|
9.81
m/s2
|
মুক্তিবেগ
|
15,300
km/h
|
25,030
km/h
|
সূর্য
থেকে আলো আসতে সময় লাগে
|
3 min 20 sec
|
8
min 16 sec
|
[1] ভরের সাথে
অভিকর্ষজ ত্বরণ গুণ করলে ওজন পাওয়া যায়। পৃথিবীতে তোমার ওজন ৪০০ নিউটন হলে পৃথিবীতে
তোমার ভর কত? বুধে তোমার ওজন ১৫২ নিউটন হলে বুধে তোমার ভর কত? এক গ্রহ থেকে অন্য
গ্রহে তোমার ভরের কি কোন পরিবর্তন ঘটে?
No comments:
Post a Comment