Thursday, 13 February 2020

বুধ - পর্ব ১৭


মেসেঞ্জার উৎক্ষেপণ

২০০৪ সালের ৩ আগস্ট মেসেঞ্জার নভোযান উৎক্ষেপণ করা হয়। ফ্লোরিডার কেইপ ক্যানাভেরাল এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে ডেল্টা টু রকেটের মাধ্যমে মেসেঞ্জারকে মহাকাশে পাঠানো হয়। নাসার ডিসকভারি প্রোগ্রামের লো-কস্ট স্পেস সায়েন্স মিশনের ডেল্টা টু রকেট হলো সবচেয়ে বড় রকেট।



মেসেঞ্জারের গতিপথ
           
মেসেঞ্জার ছিল বুধের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া শুধু নয়, বুধের চারপাশে ঘুরে আসার মিশন। কিন্তু পৃথিবী থেকে তো আর এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো সোজা বুধে চলে যাওয়া যায় না। ২০০৪ সালের ৩ আগস্ট পৃথিবী থেকে রওনা দিয়ে মেসেঞ্জার নভোযান পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকে পৃথিবীর সমান বেগে সূর্যের চারপাশে এক বার ঘুরে এসে ২০০৫ সালের ২ আগস্ট পৃথিবীর ২,৩৪৮ কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে যায়। পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাবার সময় নভোযানের কিছু যন্ত্রপাতি সমন্বয় করার জন্য নভোযানের গতি বেশ কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়। তারপর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল কাজে লাগিয়ে মেসেঞ্জার চলে যায় শুক্র গ্রহের কক্ষপথের দিকে।
            এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ২০০৬ সালের ২৪ অক্টোবর শুক্র গ্রহের  ২,৯৮৭ কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে যায় মেসেঞ্জার। শুক্র গ্রহের পাশ দিয়ে প্রথমবার উড়ে যাওয়ার সময় তেমন কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করেনি মেসেঞ্জার। কিন্তু ছয় মাস ঘুরার পর ২০০৭ সালের ৫ জুন মেসেঞ্জার শুক্র গ্রহের ৩৩৮ কিলোমিটার দূর দিয়ে আবার উড়ে যায়।
            শুক্রের পাশ দিয়ে দ্বিতীয়বার উড়ে যাবার সময় মেসেঞ্জার শুক্র গ্রহের অনেক তথ্য সংগ্রহ করে। শুক্র গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ কাজে লাগিয়ে মেসেঞ্জার তার কক্ষপথের সমন্বয় ঘটায় এবং বুধের কক্ষপথের দিকে রওয়ানা দেয়।
            ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি বুধ গ্রহের মাত্র দুই শ কিলোমিটার পাশ দিয়ে উড়ে যায় মেসেঞ্জার। তারপর আরো দু'বার - ২০০৮ সালের ৬ অক্টোবর এবং ২০০৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বুধের পাশ দিয়ে উড়ে যায় মেসেঞ্জার। প্রতিবার ২০০ কিলোমিটার উপর দিয়ে। প্রতিবার গ্রহগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় সেই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলকে কাজে লাগিয়ে মেসেঞ্জার নিজের গতি সমন্বয় করেছে।
            বুধের পাশ দিয়ে এই তিন বার যাওয়ার সময় মেসেঞ্জার বুধের প্রায় সম্পূর্ণ জায়গার ছবি তুলে নেয়। ম্যারিনার-১০ নভোযান বুধের যেসব অঞ্চলের ছবি তুলতে পারেনি - মেসেঞ্জার সেসব অঞ্চলের ছবিও তোলে। বুধ গ্রহের সম্পূর্ণ তলের ছবি তুলে পাঠায় মেসেঞ্জার।
            তারপর প্রায় দেড় বছর ধরে আশে পাশে ঘুরতে ঘুরতে ২০১১ সালের ১৮ মার্চ মেসেঞ্জার বুধের কক্ষপথে ঢুকে। মেসেঞ্জার ৩০% জ্বালানি ব্যবহার করে গতিবেগ কমিয়ে সেকেন্ডে ০.৯ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ৩২৪০ কিলোমিটারে নামিয়ে নিয়ে আসে। প্রচন্ড গতির বুধের গতির তুলনায় মেসেঞ্জারের এই গতি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। বুধের কক্ষপথে ঢুকার জন্য মেসেঞ্জার সময় নেয় ১৪ মিনিট। কক্ষপথের সবচেয়ে নিচুবিন্দুতে গিয়ে নভোযানে কিছু স্বয়ংক্রিয় পরিচ্ছন্নতাও চালানো হয়।
            এক বছর ধরে মেসেঞ্জার বুধের চারপাশে একটা ডিম্বাকৃতি কক্ষপথে ঘুরেছে। ঘুরতে ঘুরতে কখনো একেবারে দুই শ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে আবার কখনো চলে গেছে ১৫,১৯৩ কিলোমিটার দূরে।
বুধের কক্ষপথে মেসেঞ্জার নভোযানের গতিপথ

শুরুতে পরিকল্পনা ছিল মেসেঞ্জার বুধের কক্ষপথে বারো মাস ঘুরবে। এই বারো মাসে মেসেঞ্জার বুধের দুইটি সম্পূর্ণ দিন পর্যবেক্ষণ করেছে। বুধের এক দিন সমান পৃথিবীর ১৭৬ দিন বা বুধের দুই বছর। প্রথম ১৭৬ দিনে বিভিন্ন কোণ থেকে বুধের ছবি সংগ্রহ করেছে। পরের ১৭৬ দিনে মেসেঞ্জার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলো করে।
            বুধের বিষুব-রেখা বরাবর নভোযানের কক্ষপথ ৮০ ডিগ্রি কোণ করে ছিল। গড়ে প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় মেসেঞ্জার বুধের চারপাশে দুই বার ঘুরেছে। মেসেঞ্জার বুধের ১০০% জায়গার রঙিন ছবি তুলে পাঠায়। ম্যারিনার-১০ যেসব জায়গা দেখতে পায়নি মেসেঞ্জার তার পুরোটাই কভার করতে পেরেছে। বুধের উপরিতলের উপাদান পরীক্ষা করে দেখেছে। জলবায়ু পরীক্ষা করে দেখেছে। ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বা চৌম্বকক্ষেত্র পরীক্ষা করে দেখেছে। মেসেঞ্জার প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় আট ঘন্টা ধরে ডাটা পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। মেসেঞ্জার বুধের দরকারি তথ্যগুলো পাঠায় - তারপর সেগুলোর ভিত্তিতে মেসেঞ্জারের পরবর্তী ধাপগুলো হিসেব করা সহজ হয়।


মেসেঞ্জারের দশ বছরের পরিসংখ্যান

            মেসেঞ্জার যখন বুধের চারপাশে ঘুরছিল তখন সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ ও রেডিয়েশান/বিকিরণ আস্তে আস্তে নভোযানের কক্ষপথ পরিবর্তন করে দিচ্ছিলো। প্রতি সৌরবছর পর পর বা প্রতি ৮৮ দিন পর পর নভোযান থামিয়ে তার কক্ষপথ ঠিক করে নিতে হয়েছে।
            শুরুতে পরিকল্পনা ছিল মেসেঞ্জার বুধের কক্ষপথে শুধু এক বছর ঘুরবে। কিন্তু যখন এক বছর পরেও মেসেঞ্জার নভোযানের কর্মদক্ষতা একটুও কমেনি এবং নিয়মিত ছবি ও তথ্য পাঠাতে পারছিল তখন নাসা কর্তৃপক্ষ মেসেঞ্জারের মিশন সম্প্রসারণ করে আরো এক বছরের জন্য। ক্রমে সেটা বাড়তে বাড়তে চার বছরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত চার বছর ধরে মেসেঞ্জার বুধের চারপাশে ঘুরেছে।
            মেসেঞ্জার বুধের কক্ষপথে ১২৩২ দিন ছিল যা বুধের মোট সাত দিনের সমান। এই সময়ের মধ্যে বুধের চারপাশে ৩,৩০৮ বার ঘুরেছে মেসেঞ্জার।
            ২০১৫ সালের মার্চের শেষে মেসেঞ্জার নভোযান বুধের পিঠে আছড়ে পড়ে। তারপর থেকে মেসেঞ্জারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
            ২০০৪ সালের আগস্টে পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণের পর থেকে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত এই দশ বছরে ১২৮৮ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে, বুধ, শুক্র ও পৃথিবীর পাশ দিয়ে উড়ে গেছে ছয় বার, সূর্যের চার পাশে ঘুরেছে ২৯ বার। মেসেঞ্জারের গড় গতিবেগ ছিল ঘন্টায় এক লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৮৫ কিলোমিটার। দশ বছরে দুই লক্ষ ৫৫ হাজার ৮৫৮টি ছবি পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। সাড়ে তিন কোটিবার লেসার শট নিয়েছে মেসেঞ্জার। দশ টেরাবাইট ডাটা পাঠিয়েছে মেসেঞ্জার এই দশ বছরে।
            দেখা যাক মেসেঞ্জার কীভাবে দেখেছে বুধ গ্রহকে।

মেসেঞ্জার থেকে দেখা বুধ




No comments:

Post a Comment

Latest Post

The Rituals of Corruption

  "Pradip, can you do something for me?" "Yes, Sir, I can." "How can you say you'll do it without even know...

Popular Posts