নোবেল পুরষ্কার
১৬৮০
সালে স্যার আইজাক নিউটন যখন মহাকর্ষ বলের সূত্র দিলেন- বলা যায় তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়। মহাবিশ্বের সবকিছুই
এক সূত্রে গাঁথা - এটা ভাবতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ঠিক কোন
সূত্রে সবকিছু গাঁথা তা তো আমরা সঠিকভাবে জানি না। তবে জানার চেষ্টা চলছে সেই তখন
থেকেই। প্রকৃতিতে বিদ্যমান বলগুলোর পারস্পরিক ঐক্যের সন্ধানে অবিরত কাজ করতে থাকেন
অনেক বিজ্ঞানী।
১৮৩০ সালে অ্যাম্পিয়ার ও মাইকেল
ফ্যারাডে বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তিকে একত্রিত করে ‘তড়িৎচৌম্বক’ এর
ধারণা দেন। এরপর ১৮৬৬ সালে ম্যাক্সওয়েল প্রতিষ্ঠা করলেন ‘তড়িৎ-চৌম্বক বল’ এর সূত্রাবলী।
মাইকেল ফ্যারাডেই প্রথম চেষ্টা করেছিলেন মহাকর্ষ বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের মধ্যে
সমন্বয় সাধনের। কিন্তু তিনি সফল হননি।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে নিউক্লিয়ার বল
আবিষ্কৃত হয় এক্স-রে, তেজষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি আবিষ্কারের পর। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উদ্ভবের পর পদার্থবিজ্ঞানে বিল্পব ঘটে গেলো। পারমাণবিক নিউক্লিয়াস
আবিষ্কৃত হলো। পরমাণুর ইলেকট্রন এবং পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রন
আবিষ্কৃত হলো। নিউক্লিয়ার তত্ত্ব থেকে সবল নিউক্লিয়ার বল (strong
nuclear force) ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল (weak nuclear force) এবং তাদের ধর্ম সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানীরা কিছু কার্যকরী মডেল দাঁড় করাতে
পেরেছেন। নিউক্লিয়ার বল মহাকর্ষ বলের চেয়ে অনেক অনেক অনেক গুণ (প্রায় 1040 গুণ) শক্তিশালী। কিন্তু
তাদের ব্যাপ্তি খুব খুব খুব কম (10-15 মিটার থেকে 10-10 মিটার)। নিউক্লিয়াসের বাইরে এই বলের কোন অস্তিত্ব থাকে
না। আর নিউক্লিয়াসের ব্যাস মাত্র 10-15 মিটার, অর্থাৎ এক মিটারের এক কোটি কোটি ভাগের এক
ভাগ। এই নিউক্লিয়ার বল নিউক্লিয়াসের ভেতর প্রোটন ও নিউট্রনকে একসাথে বেঁধে রাখে।
১৯১৬ সালে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের পর আলবার্ট আইনস্টাইন চেষ্টা শুরু করেছিলেন
মহাকর্ষ বলের সাথে অন্যান্য বলগুলোর ঐক্য খুঁজতে। ১৯১৬ থেকে ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর
আগপর্যন্ত চেষ্টা করেও আইনস্টাইন সফল হননি। ১৯৩০ সালে এনরিকো ফার্মি যখন চেষ্টা
করেন দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে- তখন আবদুস সালামের
বয়স মাত্র চার বছর।
আবদুস সালাম ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু করে
১৯৭৪ সালের মধ্যে মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করার কয়েকটি দুরুহ ধাপ অতিক্রম করতে সমর্থ
হলেন।
পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের বিটা ক্ষয় (beta
emission) ঘটায় দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় (weak
interaction) নিউক্লিয়াসের চার্জহীন নিউট্রন পজিটিভ চার্জযুক্ত
প্রোটনে রূপান্তরিত হয় আর পরমাণুর চার্জের সাম্যতা রক্ষার জন্য নিউক্লিয়াসে একটা
নেগেটিভ চার্জের ইলেকট্রন তৈরি হয়ে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসে। চার্জহীন
নিউট্রিনো নিউক্লিয়ার বলের আদানপ্রদান ঘটায়।
দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের কারণেই
নক্ষত্রগুলোতে শক্তি উৎপন্ন হয়। আমাদের প্রাকৃতিক মূল উৎস যে সূর্য, সেই সূর্যের
ভেতর যে হাইড্রোজেন আছে তা ডিউটেরিয়ামে রূপান্তরিত হয় দুর্বল পারমাণবিক
মিথষ্ক্রিয়ার ফলে। সোলার এনার্জি বা সৌরশক্তির মূল উৎসই হলো দুর্বল পারমাণবিক বল।
১৯৩৪ সালে ইটালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি দুর্বল পারমাণবিক বলের তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নিউট্রিনোর ভূমিকা খুব একটা পরিষ্কার ছিল না।
১৯৫৬ সালে নিউট্রিনোর সিমেট্রি ব্রেকিং
বা প্যারিটি ভায়োলেশান প্রমাণিত হবার পর দুর্বল পারমাণবিক বল ও তড়িৎচুম্বক বলের মধ্যে
সমন্বয়ের একটা সঠিক সম্ভাবনার পথ পাওয়া গেলো। নিউট্রিনোর প্যারিটি ভায়োলেশানের ওপর
গবেষণাপত্র লিখেও পাউলির হস্তক্ষেপে তা প্রকাশে অনেক দেরি করে ফেলেন আবদুস সালাম।
ফলে প্যারিটি ভায়োলেশান আবিষ্কারের যথার্থ কৃতিত্ব দেয়া হয়নি আবদুস সালামকে।
কিন্তু আবদুস সালাম হাল ছাড়েননি।
১৯৬০এর দশকে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও
তড়িৎচৌম্বক বলের ওপর স্বতন্ত্রভাবে কাজ হয়েছে এম-আই-টি, হার্ভার্ড আর ইম্পেরিয়েল
কলেজে। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারঅ্যাকশানের গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্বের সমন্বয়ে
সাফল্য আসে এক দশকের মধ্যেই।
গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্ব প্রথম
দিয়েছিলেন এমি নোইথার ১৯২০ এর দশকে। এই তত্ত্ব মতে প্রকৃতিতে যেখানেই সাম্যতা কাজ
করে, সেখানে অবশ্যই সাম্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদার্থ এবং শক্তির ধর্মের
সংরক্ষণশীলতার নীতিও কার্যকর থাকে। যেমন, স্থান ও কালের সাম্যতা বজায় থাকলে শক্তি,
ভরবেগ ও কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার নীতি বজায় থাকে।
একটা উদাহরণ দিলে গেইজ সিমেট্রি বা গেইজ
ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্ব বুঝতে সুবিধে হবে। মনে
করা যাক আমাকে একটা পাহাড়ে উঠতে হবে ভূমি থেকে যার উচ্চতা একশ' মিটার। যদি পাহাড়টা
সিমেট্রিক হয় অর্থাৎ সবদিক একই রকম হয় তাহলে পাহাড়টিতে আমি যেদিক দিয়েই উঠি না কেন
আমার সমান শক্তি খরচ হবে। সেই ক্ষেত্রে আমি পাহাড়ের কোন্ দিক দিয়ে উঠেছি তাতে মোট
শক্তি খরচের কোন তারতম্য হবে না। এখন পাহাড়টির সিমেট্রি যদি নষ্ট হয় তাহলে
শক্তি-ব্যয়ের সমতাও থাকবে না। এখানে পাহাড়ে ওঠার জন্য যে শক্তি খরচ হচ্ছে তা
মাধ্যাকর্ষণ বলের সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণটি গ্র্যাভিটেশান ফিল্ডের গেইজ সিমেট্রি।
আবদুস সালাম দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও
তড়িৎচৌম্বক বল একত্রীকরণে গেইজ সিমেট্রি কাজে লাগালেন। এটা করতে গিয়ে আবদুস সালাম
স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গ বা স্পনটেনিয়াসলি ব্রোকেন সিমেট্রির অবতারণা করেন।
স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গের ব্যাপারটা অবশ্য আবদুস সালামের আবিষ্কার নয়। ১৯২৮ সালে
ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ফেরোম্যাগনেটিজমের ক্ষেত্রে এই স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গের
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছিলেন।
স্বাভাবিক অবস্থায় একটি চুম্বকের উত্তর
ও দক্ষিণ এই দুই মেরু থাকে। মেরুর ভিন্নতার কারণে চুম্বক সিমেট্রিক নয়। কিন্তু
একটি দন্ডচুম্বককে গরম করতে থাকলে তার চুম্বকত্ব কমতে থাকে এবং একটা তাপমাত্রার পর
আর কোন চুম্বকত্ব অবশিষ্ট থাকে না। তখন দন্ডচুম্বকটির দুটো মেরুর ধর্মই একই রকম।
তখন কোন্টা উত্তর মেরু কোন্টা দক্ষিণ মেরু তা আলাদা করা যায় না। তার মানে ওটা
তখন সিমেট্রিক। তারপর যদি তাপমাত্রা কমতে থাকে একটা সময়ে চুম্বকত্ব ফিরে আসে এবং
সাথে সাথে তার সাম্যতা ভেঙে যায়। এরকম ব্যাপারকেই স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গ বলা হয়।
১৯৬৭ সালে সালাম তাঁর তত্ত্ব ইম্পেরিয়েল
কলেজের লেকচারে প্রকাশ করেন। সেই বছর ডিসেম্বরে স্টিভেন ওয়েনবার্গের গবেষণাপত্র
প্রথম চোখে পড়ে সালামের। সালাম দেখলেন ওয়েনবার্গও তাঁর মতোই চিন্তা করেছেন।
ওয়েনবার্গ তাঁর গবেষণাপত্রে শুধু লেপটন সংক্রান্ত হিসেবই দেখিয়েছিলেন। আবদুস সালাম
ভাবলেন আরো বিস্তৃত হিসেব করে তিনি গবেষণাপত্র লিখবেন।
মৌলিক কণাগুলোর মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া বা
ফান্ডামেন্টাল ইন্টারঅ্যাকশান ঘটে বোসন বিনিময়ের মাধ্যমে। তড়িৎচৌম্বক মিথষ্ক্রিয়ার
ক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ পার্টিক্যাল বা বিনিময় কণা হলো ফোটন। পরমাণুর কোয়ার্ক মডেল
আবিষ্কৃত হবার আগপর্যন্ত ইউকাওয়া মডেল ব্যবহার করা হতো। ইউকাওয়া মডেল অনুযায়ী
প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে যে সবল মিথষ্ক্রিয়া ঘটে তার জন্য বিনিময় কণা বলে মনে করা
হতো মেসনকে।
কোয়ার্ক মডেল অনুসারে
নিউক্লিয়াসের প্রোটন, নিউট্রন, মেসন কোয়ার্ক দ্বারা গঠিত। কোয়ার্কগুলো পরস্পর সবল
পারমাণবিক বল দ্বারা আবদ্ধ। সুতরাং সবল বল প্রাথমিক ভাবে কাজ করে কোয়ার্কগুলোর
মধ্যে। তারপর কাজ করে মেসনের মধ্যে। কোয়ার্কের মধ্যে যে মিথষ্ক্রিয়া হয় তার বিনিময়
কণা হলো গ্লুয়ন। বিনিময় কণা হিসেবে গ্লুয়ন আর ফোটন প্রায় একই রকম। উভয়েরই স্পিন
সংখ্যা ১, উভয়েই ভরহীন। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। তা হলো ফোটনের
কোন চার্জ নেই, কিন্তু গ্লুয়নের চার্জ আছে।
দুটো কোয়ার্ক পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায়
যখন পরস্পর কাছে আসতে থাকে অর্থাৎ তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমতে থাকে তখন তাদের
পারস্পরিক আকর্ষণ বলও কমতে থাকে। আবার তারা যখন পরস্পর দূরে চলে যেতে চায় তখন
তাদের মধ্যে আকর্ষণ বল বাড়তে থাকে। অন্যদিকে দুটো ইলেকট্রনের মধ্যে যে তড়িৎচৌম্বক
বল কাজ করে সেই বল ইলেকট্রন দুটোর পারস্পরিক দূরত্ব বাড়ার সাথে কমতে থাকে।
কুলম্বের সূত্র থেকে আমরা জানি এই বলের পরিমাণ তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের
বিপরীত অনুপাতিক।
যেহেতু সবল বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা
হলো গ্লুয়ন - দুটো কোয়ার্কের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বল বেড়ে গেলে বলা যায়
গ্লুয়নের পরিমাণ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোয়ার্কগুলো যতই পরস্পর দূরে সরতে থাকে গ্লুয়নের
পরিমাণ তথা সবল বলের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দুটো কোয়ার্ককে
পরস্পর বিচ্ছিন্ন করতে হলে অসীম পরিমাণ শক্তির দরকার যা কার্যত অসম্ভব। তার মানে
বিচ্ছিন্ন কোয়ার্ক পাওয়া অসম্ভব।
অন্যদিকে তিনটি কোয়ার্ক বা
কোয়ার্ক-অ্যান্টিকোয়ার্ক জোড়া যখন পরস্পরের কাছে আসে সবচেয়ে কম গ্লুয়ন বিনিময় হয়।
তখন নিউক্লিয়ার বলের পরিমাণ হয় সবচেয়ে কম। এই অবস্থাকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা
যায় অ্যাসিম্পটটিক ফ্রিডম। অর্থাৎ পরস্পরের কাছাকাছি থাকলে কোয়ার্কগুলো মুক্ত কণার
মতো কাজ করে।
দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে সকল
ফার্মিয়ন পরস্পরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে। অর্থাৎ সমস্ত কোয়ার্ক ও লেপটনের মধ্যেই
সংযোগ ঘটে যাদের স্পিন সংখ্যা ১/২। কিন্তু দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ব্যাপ্তিও সবল
নিউক্লিয়ার বলের মতো নিউক্লিয়াসের বাইরে আসে না। দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এক
ফ্লেভারের কোয়ার্ককে অন্য ফ্লেভারের কোয়ার্কে পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ নিউট্রন
প্রোটনে পরিণত হতে পারে, আর প্রোটন নিউট্রনে।
দুটো চার্জের মধ্যে তড়িৎচুম্বক বল
বিনিময়ের জন্য দরকার হয় একটি ফোটন। আবদুস সালাম, স্টিভেন ওয়েনবার্গ আর শেলডন
গ্ল্যাশো দেখালেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল বিনিময়ের জন্য দরকার হয় তিনটি চার্জ
বহনকারী গ্লুয়ন W+, W- এবং Z0 বোসন। সবল নিউক্লিয়ার বলের জন্য দরকার হয় আটটি গ্লুয়ন।
১৯৬৮
সালে শ্যালডন গ্ল্যাশো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারণা দেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার
বল আর তড়িৎচুম্বক বলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং তাদেরকে একই সূত্রে বেঁধে
ফেলা সম্ভব। স্টিভেন ওয়েনবার্গ এবং আবদুস সালাম গ্ল্যাশোর ধারণার গাণিতিক সমীকরণ
বের করেন।
দুর্বল
নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল মূলত একই রকম। কিন্তু তাদেরকে ভিন্ন মনে হয় কারণ
দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের বিনিময় কণার ভর আছে, কিন্তু তড়িৎচৌম্বক বলের বিনিময় কণার
ভর নেই। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই বল বিনিময় কণা হলো বোসন। তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে
বিনিময় কণা ফোটন যার স্থির ভর শূন্য। ফোটন আলোর বেগে চলে। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের
ক্ষেত্রে বিনিময় কণার ভর আছে। ফলে এই বোসনগুলোর বেগ দূরত্বের সাথে বদলে যায়।
দুর্বল
নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়ায় চার্জের পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ চার্জহীন নিউট্রন ধনাত্মক
চার্জযুক্ত প্রোটন বা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রনে পরিণত হয়। ফলে যে কারেন্ট
পাওয়া যায় তাকে চার্জড কারেন্ট বলা যায়। অন্যদিকে তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে
চার্জের কোন পরিবর্তন ঘটে না। ফলে এক্ষেত্রে যে কারেন্ট পাওয়া যায় তাকে নিউট্রাল
কারেন্ট বলা যায়।
ওয়েনবার্গ
ও সালামের তত্ত্ব প্রমাণ করে যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের মধ্যে
একমাত্র পার্থক্য হলো বিনিময় কণা বোসনের ভরে। তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা
ফোটন ভরহীন, কিন্তু দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা বোসনের ভর
প্রোটনের ভরের প্রায় একশ' গুণ। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের বোসনকে এ কারণে ভারী ফোটনও
বলা হয়।
আবদুস
সালাম ও স্টিভেন ওয়েনবার্গ ধারণা দেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে নিউট্রাল
কারেন্ট ও চার্জড-কারেন্ট দুটোই পাওয়া যেতে পারে। দুটো মিথষ্ক্রিয়ার বল বিনিময়
কণাগুলোকে একই পরিবারভুক্ত করে নাম দেয়া হয় W+, W- এবং Z0 বোসন। +, - এবং ০ যথাক্রমে ধনাত্মক, ঋণাত্মক এবং
নিউট্রাল চার্জড বোসন বোঝায়। তিনটাকে এক সাথে ইন্টারমিডিয়েট ভেক্টর বোসন বলা হয়।
এই ভেক্টর বোসনগুলো নিউক্লিয়াসের ভেতরে খুবই ভারী। আর সেখানেই দুর্বল মিথষ্ক্রিয়া
ঘটে। নিউক্লিয়াসের বাইরে ঘটে তড়িৎচৌম্বক মিথষ্ক্রিয়া।
আই-সি-টি-পি'র
কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশ করা তখনো সম্ভব হয়নি
সালামের। তবে ১৯৬৮ সালের মে মাসে সুইডেনের গুটেনবার্গে 'নোবেল সিম্পোসজিয়াম'এ
আবদুস সালাম তাঁর 'ইলেকট্রো-উইক ফোর্স'এর বর্ণনা দেন। নোবেল ফাউন্ডেশান প্রতি বছর
নোবেল সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে। অনেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উপস্থিত থাকেন সেই
সিম্পোজিয়ামে। আবদুস সালাম সিম্পোজিয়াম চলাকালীন সময়েও ভীষণ ব্যস্ত। কারণ
ট্রিয়েস্তে তাঁর আই-সি-টি-পি'র নতুন ভবন তৈরি হয়ে গেছে। জুন মাসে নতুন ভবনের
উদ্বোধন। সিম্পোজিয়াম থেকেও তাঁকে ইতালিতে যাওয়া আসা করতে হচ্ছে।
সিম্পোজিয়ামে
আবদুস সালামের বক্তৃতাকে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। কারণ অনেকে বুঝতেই পারেননি
তিনি আসলে কী বলতে চাচ্ছিলেন। এমনকি সিম্পোজিয়ামের আয়োজক মারি গেল-মান তাঁর সমাপনী
বক্তৃতায় সালামের প্রবন্ধের উল্লেখ পর্যন্ত করেননি।
তারপর
কেটে গেলো আরো তিন বছর। ১৯৭১ সালে আমস্টার্ডামের পার্টিক্যাল ফিজিক্স কনফারেন্সে আবদুস
সালামের বক্তৃতার পর তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী টি-হুফ্টের বক্তৃতা শুনে অবাক হয়ে গেলেন
সালাম সহ কনফারেন্সের সবাই। টি-হুফ্ট তখন মাত্র পিএইচডি'র ছাত্র। দুর্বল
নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল একত্রীকরণের একটি কার্যকরী পদ্ধতির বর্ণনা দিয়েছেন
টি-হুফ্ট। সালাম দেখলেন তাঁর তত্ত্ব কাজ করতে শুরু করেছে।
১৯৭৩ সালে যোগেশ পতির সাথে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে কোয়ার্ক-লেপটনের
একত্রীকরণের ধারণা প্রকাশ করেন আবদুস সালাম। পরে গ্র্যান্ড ইউনিফাইড থিওরি (GUT) আলাদা একটা গবেষণা-ক্ষেত্রই হয়ে ওঠে। যোগেশ পতি ছিলেন ভারতের উড়িষ্যার
মানুষ। আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক
পতি ছুটিতে ট্রিয়েস্তে এসে আবদুস সালামের সাথে গবেষণায় যোগ দেন। ১৯৭৪ সালেও যোগেশ
পতির সাথে প্রকাশিত হয় আবদুস সালামের বিখ্যাত পেপার। প্রফেসর সালাম কোয়ান্টাম
নাম্বার কালার কোয়ার্ক হিসেবে লেপটনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন তাতে। একই বছর জন
স্ট্রাথডির সাথে সুপারসিমেট্রিক কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির ওপর তাঁর বিখ্যাত পেপার
প্রকাশিত হয়।
পরীক্ষাগারে
নিউট্রাল কারেন্ট আর ভারী বোসন পাওয়া গেলেই সালাম-ওয়েনবার্গ-গ্ল্যাশোর তত্ত্ব
প্রমাণিত হয়ে যাবে। আবদুস সালাম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। বেশিদিন অপেক্ষা করতে
হলো না তাঁকে। ১৯৭৩ সালে সার্নের পরীক্ষাগারে নিউক্লিয়াস
ও নিউট্রিনোর মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়ে কোন
ধরনের চার্জ বিনিময় ছাড়াই দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়া ঘটানো সম্ভব হলো।
নিউট্রাল কারেন্টের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলো। ফার্মি ল্যাবেও একই ধরনের রেজাল্ট
পাওয়া গেলো। প্রফেসর সালামের তত্ত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হলো।
১৯৭৮ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রন এক্সিলারেটরে (SLAC) ইলেট্রন ও ডিউটেরনের মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়েও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং
তড়িৎচালক বলের সমন্বয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।
আবদুস সালাম যে নোবেল পুরষ্কার পাবেন সে
ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল। তাঁর শিক্ষক ও নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী পল ডিরাক বেশ
কয়েকবার আবদুস সালামের নাম প্রস্তাব করেছেন নোবেল কমিটির দেয়া নমিনেশানে। নোবেল
পুরষ্কারের নিয়ম অনুযায়ী নমিনেশান গোপন থাকার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীমহলে ব্যক্তিগত
যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক কিছুই জানা হয়ে যায়। আবদুস সালামের কাছে নোবেল পুরষ্কারের
গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ তিনি জানেন উন্নয়নশীল বিশ্বে নোবেল পুরষ্কারের মর্যাদা
তুলনাহীন। ইতোমধ্যেই তিনি অনেক মর্যাদাপূর্ণ পুরষ্কার পেয়ে গেছেন। ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন অ্যাটম্স ফর পিস মেডেল।
১৯৭১ সালে রবার্ট ওপেনহেইমার মেমোরিয়্যাল মেডেল, ১৯৭৭ সালে লন্ডন ইনস্টিটিউট অব
ফিজিক্সের গাথিরি মেডেল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী
স্বর্ণপদক, ১৯৭৮ সালে রোমের মেট্রেউটিক মেডেল ও রয়েল সোসাইটি অব লন্ডনের রয়েল
মেডেল, ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর আইনস্টাইন পদক।
অবশেষে ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার। আবদুস সালাম তখন লন্ডনে।
দুপুর বারোটায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির পরিচালকের অফিস থেকে ফোন
পেলেন আবদুস সালাম। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্টিভেন ওয়েনবার্গ
ও শেলডন গ্ল্যাশোর সাথে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন আবদুস সালাম।
মৌলিক কণার মধ্যে দুর্বল
পারমাণবিক বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের সমন্বয়ে দুর্বল নিউট্রাল কারেন্টের ধারণা
আবিষ্কারের কৃতিত্বও তাঁদের। স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে সালাম, ওয়েনবার্গ এবং গ্ল্যাশো
মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মৌলিক অবদান রেখেছেন। প্রকৃতির চারটি মৌলিক
বলের মধ্যে তাঁরা দুইটির সমন্বয় সাধন করেছেন। হাই-এনার্জি ফিজিক্সের স্ট্যান্ডার্ড
মডেলের কেন্দ্রে আছে সালাম-ওয়েনবার্গের ইলেকট্রো-উইক ফোর্স। পুরষ্কারের ইতিহাসে
আরেকটি নতুন মাইলফলক স্থাপিত হলো। আবদুস সালাম হলেন নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলমান
বিজ্ঞানী।
নোবেল
পুরষ্কার পাবার পর সাংবাদিকদের সাথে আবদুস সালাম
|
No comments:
Post a Comment