আই-সি-টি-পি
(International Centre for Theoretical Physics)
প্রফেসর
আবদুস সালাম পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী। নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন বলেই যে তিনি
স্মরণীয় তা নয়। অনেক পদার্থবিজ্ঞানীই নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এ পর্যন্ত। কিন্তু
তাঁদের অনেকেরই নাম পর্যন্ত আমরা মনে করতে পারি না। কিন্তু আবদুস সালাম ছিলেন
ব্যতিক্রমী একজন। বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য তিনি যা করেছেন তার তুলনা তিনি নিজে।
বাংলাদেশ পাকিস্তান ভারত নেপাল বা শ্রীলংকার মতো উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানের
উন্নয়নে আবদুস সালামের মতো এত সাংগঠনিক কাজ আর কোন বিজ্ঞানী করেছেন বলে আমাদের
জানা নেই।
একজন লেখক যখন লেখেন - একাই লেখেন।
শিল্পী যখন ছবি আঁকেন, একাই আঁকেন। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী যখন গবেষণা করেন, একাকী
করতে পারেন না। বিজ্ঞান একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই কোন
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হলে তার খবর বিজ্ঞানের সেই শাখায় যাঁরা কাজ করেন তাঁদের রাখতে
হয়। উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীরা উন্নত দেশের বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কারের খবর
ঠিকমতো রাখতে পারেন না। উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে আসার কোন সুযোগ পান
না উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীরা। প্রত্যক্ষ সুযোগ মানে সরাসরি আলোচনা করে গবেষণা
এগিয়ে নিয়ে যাওয়া- সে তো দূরের কথা; পরোক্ষভাবেও কাজ করার সুযোগ পান না। পরোক্ষ
মানে - গবেষণাপত্র পড়ে, সেমিনার বা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বক্তৃতা শুনে বিজ্ঞানের
অগ্রগতি সম্পর্কে জানার সুযোগও তেমন হয় না তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানীদের।
প্রফেসর সালাম ভাবলেন উন্নয়নশীল
বিশ্বের বিজ্ঞানীদের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে এমন একটা গবেষণাকেন্দ্র দরকার
যেখানে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাবেন ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা,
উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞান সাধকেরা।
সালামের মতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের
বিজ্ঞানের মধ্যে বিদ্যমান বিশাল গুণগত পার্থক্যের কারণ বিবিধ। সারা পৃথিবীর মাত্র দুই থেকে তিন ভাগ মানুষ
বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়। উন্নয়নশীল দেশ
তাদের এই দুই থেকে তিন শতাংশ গবেষক তৈরির জন্য কী করছে? সোজা উত্তর হলো- কিছুই
করছে না। করতে পারছে না সংগতি নেই বলে। এটাই আশ্চর্যের যে এত কম চেষ্টা সত্ত্বেও
উন্নয়নশীল দেশে এখনো কিছু মেধাবী মানুষের জন্ম হয় যারা নিজের চেষ্টায় বড় হয়।
উন্নয়নশীল
বিশ্বে বিজ্ঞানী তৈরি না হবার প্রধান কারণগুলো হলো:
· উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার মান খুবই খারাপ।
· তার মধ্যেও যারা ভালো তারা চলে যায় সিভিল
সার্ভিসের প্রশাসনে (আই-সি-এস, বি-সি-এস, সি-এস-পি ইত্যাদি)।
· গবেষণার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই বললেই চলে।
· গবেষক নেই বলেই গবেষক তৈরি করার সুযোগ নেই।
· প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে উন্নত মানের
বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হয়তো গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে গবেষণা শিক্ষা দেয়া হবে,
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় বিশেষায়িত
প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না।
· বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হয় না বললেই চলে।
(আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর
ডিগ্রি নিয়ে বের হয়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষণা হয় না। তারা একটা
গবেষণাপত্র লেখা তো দূরের কথা, পড়েও দেখে না কোনদিন।)
· উন্নয়নশীল বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার
চেয়ে পরীক্ষা পাসের ব্যাপারটাই বেশি গুরুত্ব পায়।
প্রতিভা বিত্ত-নিরপেক্ষ নয়। অর্থাৎ ধনীদেশের প্রতিভাবান
শিক্ষার্থী আর দরিদ্রদেশের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেক দূরত্ব। ধনীদের
সামান্য মেধা থাকলে সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মেধার বিকাশের সমস্ত সুযোগ থাকে।
কিন্তু দরিদ্র দেশে মেধা থাকলেও মেধা বিকাশের সুযোগ থাকে না বললেই চলে। তাছাড়া
দরিদ্রদেশের মেধাবীদের ওপর প্রচুর সামাজিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়। দরিদ্রদেশের
একজন মেধাবী গবেষককে নিজের গবেষণার পাশাপাশি দেশের জন্য, সমাজের জন্যেও অনেককিছু
করতে হয় যার ফলে গবেষণার ক্ষতি হয়। অন্যদিকে ধনী দেশের বিজ্ঞানীকে দেশের জন্য
আলাদা করে কিছু চিন্তা করতে হয় না। ধনী ও দরিদ্রদেশের মেধার এই পার্থক্য ঘুচে
যাওয়া দরকার।
উন্নতবিশ্ব
তৃতীয় বিশ্বের মেধাবীদের জন্য বিভিন্ন রকমের বৃত্তি দিয়ে সহায়তা যে করছে না তা নয়।
কিন্তু তাতে যেটা হচ্ছে তা হলো মেধা পাচার। উন্নয়নশীল দেশের মেধা যদি আমরা
উন্নয়নশীল দেশে না রাখতে পারি তাহলে অবস্থার উন্নতি হবে কীভাবে? মেধা বিকাশের
সুযোগ তৈরি না করে আমরা তো জোর করে কাউকে ধরে রাখতে পারবো না।
তত্ত্বীয়
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার কথা ধরা যাক। গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার
জন্য কোন গবেষণাগারেরে দরকার হয় না, দামী কোন যন্ত্রপাতিরও দরকার হয় না। ফলে
উন্নয়নশীল দেশ, যেমন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, লেবানন, তুরস্ক,
আর্জেন্টিনার অনেক মেধাবীই গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার দিকে ঝোঁকে।
মেধার জোরে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পায় এবং গবেষণার জন্য যায়। উন্নত
প্রশিক্ষণ নেবার পর অনেক স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসে নিজের দেশে।
নিজেদের
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে কী হয়? শুরুতে মহা উৎসাহে গবেষণার আয়োজন করা হয়। কিন্তু
উপযুক্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। ক'দিন পরেই গবেষক বুঝতে পারেন তাঁর দরকারি বই
নেই, গবেষণাপত্র পাওয়ার সুযোগ নেই, বৈজ্ঞানিক আলোচনা করার জন্যে কোন রিসার্চ গ্রুপ
নেই, কাজের সুযোগ বা সমালোচনা কিছুই নেই। এভাবে চলতে থাকলে নতুন আইডিয়া আসে অনেক
ধীরগতিতে। নতুন আইডিয়া এলেও তা রক্ষা করা বা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। এই
মানুষগুলো নিজের দেশেই ক্রমশ একা হয়ে যায়। ফলে তাদের গবেষণা ছাড়তে হয়। আর গবেষণা
রাখতে চাইলে তাদের দেশ ছাড়তে হয়।
বৈজ্ঞানিক
গবেষণায় বিচ্ছিন্নতা বা একাকিত্ব মানেই গবেষকের মৃত্যু। চিলি আর্জেন্টিনা
পাকিস্তান বাংলাদেশ সবখানে এখনো একই অবস্থা। এই একাকিত্বের বাধা দূর করার জন্য
আবদুস সালাম আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (International
Centre for Theoretical Physics - ICTP)
প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।
ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (IAEA)
সহযোগিতায় আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠা করেছেন আবদুস সালাম বহু বছরের পরিশ্রম ও নিরলস
চেষ্টায়। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্ত পর্যন্ত অক্লান্তভাবে লবি করেছেন প্রফেসর সালাম এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার
জন্য।
১৯৬০
সালের সেপ্টেম্বরে আই-এ-ই-এ'র বার্ষিক সাধারণ সভায় পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে
আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন প্রফেসর সালাম। প্রস্তাবটি আলোচনার জন্য
গৃহীত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স সহ অনেক উন্নতদেশই এই সেন্টার
প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ওখানেই থেমে থাকে সবকিছু।
প্রকল্প আর এগোয় না। তারপর ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩ প্রতিবছরই কমিশনের বার্ষিক সাধারণ
সভায় প্রস্তাবটির অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা করার দাবি করেছেন আবদুস সালাম। তাঁর
চেষ্টায় ধীরে ধীরে অগ্রগতি হয়েছে আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে।
আবদুস
সালাম নিজেই বর্ণনা করেছেন ১৯৬২ সালের কমিশনের সভায় কী হয়েছিল। আই-সি-টি-পি
প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা শুরু হলো। দু'বছর আগে প্রস্তাবের শুরুতে ইউরোপ
আমেরিকার প্রায় সব দেশই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সবাই সহযোগিতা করবে। আই-এ-ই-এ'র
আমেরিকান প্রতিনিধি ডক্টর হ্যারি স্মিথ আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, "এসময় আরেকটি
ফিজিক্স সেন্টার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।"
চেকোশ্লোভাকিয়া,
হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সব দেশের প্রতিনিধি আমেরিকার
সাথে একমত হলেন। বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ড সব দেশই
আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে মত দিলো। ইতালি ছাড়া ইউরোপের সব দেশই বিরোধিতা
করলো এই ইনস্টিটিউট গড়ার ব্যাপারে।
জার্মানির
প্রতিনিধি বললেন, "১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট গড়ার প্রাথমিক প্রস্তাবটি আমি সমর্থন
করেছিলাম ঠিকই। ওটা ছিল আমার ব্যক্তিগত সমর্থন। এখনো ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রস্তাবটা
সমর্থন করি। আমি বিশ্বাস করি যে একদিন এই সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হবে, ভালোভাবে কাজও
করবে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে জার্মানির পক্ষে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করা সম্ভব
নয়।"
অস্ট্রেলিয়ান
প্রতিনিধি খুব বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, "থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স হলো
বিজ্ঞানের রোল্স রয়েস। উন্নয়নশীল দেশগুলো রোল্স রয়েস নিয়ে কী করবে? তাদের দরকার
গরুর গাড়ির।"
এরপর
দরিদ্র সমর্থকগোষ্ঠীর দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একে একে সমর্থন জানাতে শুরু করলেন।
আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফিলিপাইনসহ ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট
দিলেন। ১৮টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকলো। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আই-সি-টি-পি
প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিবেচনার বিল পাস হলো।
কিন্তু সেন্টারটি কোথায় হবে, খরচ আসবে কোত্থেকে সে ব্যাপারে তেমন কোন
সিদ্ধান্ত হলো না। আই-এ-ই-এ'র গভর্নরস বোর্ডের সম্মতি ছাড়া কোন কিছু করা সম্ভব নয়।
গভর্নর্স বোর্ড সিদ্ধান্তটি প্রায় ধামাচাপা দিয়ে ফেলেছিলো - কিন্তু সম্ভব হলো না
বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এর চেয়ারম্যান ডক্টর ইশরাত হোসেন উসমানির হস্তক্ষেপে।
আই-এ-ই-এ
সেন্টার গড়ার জন্য মাত্র ৫৫ হাজার ডলার দিতে রাজি হলো। আবদুস সালাম বুঝলেন এটাও এক
ধরনের কূটচাল। সবাই জানে যে মাত্র ৫৫ হাজার ডলার দিয়ে এরকম একটা আন্তর্জাতিক মানের
প্রতিষ্ঠান কয়েক মাসও চালানো সম্ভব নয়। আই-এ-ই-এ দেখতে চায় যে কেন্দ্রটি চালু হবার
সাথে সাথেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাহলে আর কেউ ভবিষ্যতে এরকম চেষ্টা করবে না।
আই-এ-ই-এ'র
প্রভাবশালী সদস্যদেশগুলো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি দেখাতে গিয়ে বললো, যে
মগজ পাচার ঠেকানোর জন্য এই কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে, দেখা যাবে এই কেন্দ্রই মগজ
পাচার বাড়িয়ে দেবে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে সবাই এই কেন্দ্রে এসে উপস্থিত হবে, তারপর
আর দেশে ফিরতে চাইবে না। কিন্তু সালাম জানেন তাঁরা ইচ্ছে করেই তাঁর প্রস্তাবের
বিকৃত অর্থ করছে। সালামের প্রস্তাবে আছে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা এই
সেন্টারে গিয়ে ছয় মাস পর্যন্ত থাকতে পারবেন গবেষণার জন্য। উন্নত বিশ্বের সাথে
উন্নয়নশীল বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক সেতু তৈরি করাই এই কেন্দ্রের উদ্দেশ্য।
ইউরোপিয়ানদের
গড়িমসি অবস্থা দেখে আবদুস সালাম পাকিস্তান সরকারকে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন এই
কেন্দ্র গড়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য। পাকিস্তানের
মাটিতে যদি এই গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা যায় বিজ্ঞান গবেষণায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে
পারবে তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটি। আবদুস সালাম প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিশ্বাসভাজন।
পাকিস্তান বিজ্ঞান কমিশনের সভায় তিনি এই প্রস্তাব পাঠালেন। বিজ্ঞান কমিশনে পাশ হয়ে
প্রস্তাবের ফাইল গেলো অর্থমন্ত্রীর টেবিলে। পাকিস্তানের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী
প্রস্তাবনার ফাইলে নোট লিখলেন, "পাকিস্তানের মাটিতে আন্তর্জাতিক কেন্দ্র করার
উদ্দেশ্য হচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ধরনের আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এদেশে এরকম
কোন কেন্দ্রের দরকার নেই। এরা গবেষণা কেন্দ্রের নামে আসলে একটা হোটেল বানাতে চায় যেন উন্নত দেশের
বিজ্ঞানীরা এদেশে এসে আরাম-আয়েস করতে পারে। আমাদের টাকায় আমরা তা করতে দিতে পারি
না।"
১৯৬২ সালের জুন মাসে আই-এ-ই-এর বোর্ড অব
ডিরেক্টর্স সিদ্ধান্ত দিলো যে সেন্টার হতে পারে। হতে পারে মানে কিন্তু হয়ে যাওয়া
নয়। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত না হলে এ প্রতিষ্ঠান গড়া সম্ভব নয়। বোর্ডের
সদস্যদের ঐকমত্য অর্জনের জন্য প্রফেসর সালাম একটি অন্যরকম কৌশল অবলম্বন করলেন।
তিনি আই-এ-ই-এ'র পরিচালক ডক্টর সিগভার্ড একলুন্ডকে রাজি করালেন একটা পরীক্ষামূলক
কনফারেন্সের আয়োজন করতে - যাতে দেখা যাবে ভবিষ্যতে আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠিত হলে তা
কীভাবে কাজ করবে।
আই-এ-ই-এ'র ডিরেক্টর সিগভার্ড একলুন্ড ও আবদুস সালাম
ইতালির
ট্রিয়েস্তের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর পল বুডিনিক এগিয়ে এলেন আবদুস সালামকে
সাহায্য করার জন্য। তিনি ইতালির সরকার ও ট্রিয়েস্তের স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে
অনুমতি আদায় করলেন ট্রিয়েস্তে কনফারেন্সটি আয়োজন করার ব্যাপারে। মাস খানেকের
মধ্যেই তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের সম্মেলন হলো ট্রিয়েস্তে। জুলিয়াস সুইঙ্গার, ইউজিন
উইগনার প্রমুখ বিজ্ঞানী সেই সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। সম্মেলনের সাফল্যে উপস্থিত সব
বিজ্ঞানীই আই-এ-ই-এ'র ডিরেক্টরদের অনুরোধ করলেন যেন প্রস্তাবিত সেন্টারটি
প্রতিষ্ঠিত হয়।
আই-এ-ই-এ'র ডিরেক্টর ডক্টর একলুন্ড ১৯৬৩
সালের মে মাসে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করলেন সেন্টার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে
সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। কমিটির সদস্যরা ছিলেন আমেরিকান প্রফেসর রবার্ট মারশ্যাক,
ব্রাজিলের প্রফেসর জে জে টিয়মনো এবং বেলজিয়ামের প্রফেসর ভ্যান হোভ। প্রফেসর সালামের
গবেষণা, কর্মতৎপরতা, পান্ডিত্য আর প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় তাত্ত্বিক
পদার্থবিজ্ঞানী মাত্রেই জানেন। কমিটির তিন সদস্যের একমত হতে সময় লাগলো না। তাঁরা
সুপারিশ করলেন যেন যত দ্রুত সম্ভব সেন্টার গড়ার কাজ শুরু করা হয়।
আই-এ-ই-এ'র কাছ থেকে আর কোন বাধা থাকলো
না। কিন্তু আই-এ-ই-এ সেন্টারের পুরো খরচ বহন করতে রাজি হলো না। তারা প্রস্তাব করলো
আই-এ-ই-এ'র সদস্যদেশের মধ্য থেকে চাঁদা তুলে সেন্টার গড়ে তোলার। ডেনমার্ক এগিয়ে
এলো কোপেনহেগেনে সেন্টার গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়ে। তুরস্ক এগিয়ে এলো আংকারাতে
প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়ে। ইতালির প্রস্তাবটা সবচেয়ে ভালো। ইতালির
ট্রিয়েস্তে সেন্টার গড়ার জন্য জায়গা ছাড়াও তিন লাখ ডলার দিতে রাজি ইতালি সরকার। যার পেছনে সক্রিয় ছিল সালামের ইটালিয়ান বন্ধু
প্রফেসর পল বুডিনিক।
১৯৬৪ সালে আই-সি-টি-পি
স্থাপিত হলো ইতালির ট্রিয়েস্তে যুগোস্লাভিয়ার সীমান্তের কাছে এড্রিয়াটিক সমুদ্রের
ধারে পাহাড়ের উপর। এক সময়ের রোমান কলোনি ট্রিয়েস্ট এখন বহুসংস্কৃতির মিলনস্থল,
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটি। উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানীরা প্রফেসর আবদুস
সালামের কাছে অবশ্যই কৃতজ্ঞ ট্রিয়েস্তে এই ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল
ফিজিক্স গড়ে তোলার জন্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রফেসর আবদুস সালাম
এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। প্রফেসর পল বুডিনিক হলেন সেন্টারের ডেপুটি
ডিরেক্টর।
১৯৬৪
সালের অক্টোবর মাস থেকে আই-সি-টি-পি'র কাজ শুরু হয়। ট্রিয়েস্তের পিয়াজা ওবারডেনের
একটা অস্থায়ী ভবন থেকে শুরু হয় সেন্টারের পথ চলা। উদ্বোধন উপলক্ষে জলি হোটেলে একটি
কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, জাপান, নরওয়ে, পাকিস্তান,
ঘানা, চিলি সব দেশ থেকেই পদার্থবিজ্ঞানীরা যোগ দেন এই সম্মেলনে।
১৯৬৪ সালে আই-সি-টি-পি'র পরিচালকের দায়িত্ব নেবার পর আবদুস সালামের কাজের
পরিধি বেড়ে গেলো আরো বহুগুণ। এমনিতেই তিনি ইম্পেরিয়েল কলেজ, জাতিসংঘের বিভিন্ন
কমিটি, পাকিস্তানের সরকারের বৈজ্ঞানিক প্রকল্প ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত খাটছেন। এর
মধ্যেই চলছে তাঁর মৌলিক গবেষণার কাজ। নতুন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের এই
প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করানোর জন্য তাঁর সময় দরকার।
ইম্পেরিয়েল কলেজ থেকে এক
বছরের ছুটি নিলেন আবদুস সালাম। ট্রিয়েস্তের একটি বদ্ধ ঘরে বসে দিনরাত কাজ করতে
করতে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন আবদুস সালাম। প্রায় সারাক্ষণই জ্বর থাকছে শরীরে।
পরীক্ষা করে দেখা গেলো তাঁর টনসিলাইটিস। লন্ডনে ফিরে তাঁর টনসিল অপারেশান করানো
হলো।
আই-সি-টি-পির প্রথম অফিস
|
আই-সি-টি-পি'র
কাজ শুরু হবার মাত্র আট নয় মাসের মধ্যেই সারা পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানীদের মনযোগ
আকর্ষণ করলো ফিজিক্স সেন্টার। রবার্ট ওপেনহেইমার খুশি হয়ে আবদুস সালামকে চিঠি লিখে
প্রশংসা জানালেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানীরা আসতে শুরু করলেন ইতালিতে। আস্তে
আস্তে তাঁদের প্রকাশনা আলোর মুখ দেখতে শুরু করলো। এক বছরের মধ্যেই উন্নত ও
উন্নয়নশীল বিশ্বের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হবার পথ
অনেকটাই তৈরি হয়ে গেলো।
আই-সি-টি-পি'র নতুন ভবনের চাবি দেখাচ্ছেন আবদুস সালাম
|
১৯৬৮
সালের মে মাসের মধ্যে সেন্টারের নতুন ভবন তৈরি হয়ে গেলো। পরের মাসব্যাপী একটা
সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে নতুন ভবনে সেন্টারের কাজ শুরু হলো। সিম্পোজিয়ামে
থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের নামকরা সব বিজ্ঞানীরা উপস্থিত ছিলেন। সারা পৃথিবী থেকে
পার্টিক্যাল ফিজিক্স, কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স, কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
রিলেটিভিটি, প্লাজমা ফিজিক্স, কসমোলজি, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, বায়োফিজিক্সের তিনশ'রও বেশি শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী এই
সিম্পোজিয়ামে যোগ দেন। পুরো চার সপ্তাহ ধরে উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীদের সাথে
উন্নত দেশের বিজ্ঞানীদের আলোচনা, বক্তৃতা, সংলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ
ঘটে। সিম্পোজিয়ামের সন্ধ্যাবেলা বসতো 'গ্র্যান্ড মাস্টার্স অব মডার্ন ফিজিক্স'
সেশান। সেখানে প্রফেসর ডিরাক, হাইজেনবার্গ, হ্যান্স বেথেসহ পদার্থবিজ্ঞানের আরো সব
গ্র্যান্ড মাস্টাররা।
শুরুতে
আই-সি-টি-পি'র তহবিলে ছিল মাত্র তিন লাখ সাতাত্তর হাজার ডলার। যার মধ্যে ৫৫ হাজার
ডলার দিয়েছিল আই-এ-ই-এ, ইতালি সরকার তিন লাখ আর ইউনেস্কো দিয়েছিল ২২ হাজার ডলার।
আবদুস সালাম ফোর্ড ফাউন্ডেশান ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির কাছ
থেকে আরো কিছু অর্থ সাহায্য আদায় করেন। এগুলো দিয়ে ১৯৬৯ সালে তিনি সেন্টারকে একটি
বহুমুখী গবেষণা-কেন্দ্রে পরিণত করেন। মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞান (elementary
particle physics), নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান (nuclear physics), প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞান (plasma physics), ও
কন্ডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স (condensed matter physics) এই
চারটি প্রধান শাখায় কাজ আরম্ভ হলো।
আই-সি-টি-পি'র
পরিচালক পদে কাজ করার জন্য আই-এ-ই-এ'র সাথে আবদুস সালামের চুক্তি হলো। বছরে চার
মাস থাকবেন লন্ডনে - ইম্পেরিয়েল কলেজে, বাকি আট মাস ট্রিয়েস্তে। পরিচালক হিসেবে
আবদুস সালামের বেতন ঠিক হলো মাসে ২২৭০ ডলার যার জন্য তাঁকে কোন আয়কর দিতে হবে না।
লন্ডন থেকে ট্রিয়েস্তের আসা-যাওয়ার বিমানভাড়াও আই-এ-ই-এ দেবে।
আবদুস সালাম প্রশাসনিক কাজ দ্রুত
সম্পন্ন করতে এবং লালফিতা মুক্ত রাখতে পছন্দ করতেন। দিনের প্রথম ভাগ তিনি নিজের
গবেষণা কাজে লাগাতেন, আর দ্বিতীয় ভাগে করতেন প্রশাসনিক কাজ। একটা বড় মাপের
আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের যে কী পরিমাণ প্রশাসনিক কাজ করতে হয় সে
ব্যাপারে আবদুস সালামের ধারণা ছিল। পাকিস্তানের সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে
তিনি অনেক কাজ দেখেছেন। কিন্তু সেখানে যে লাল-ফিতার দৌরাত্ম্য তিনি দেখেছেন তা যেন
গবেষণা কেন্দ্রে না ঘটে সে ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট।
আই-সি-টি-পির অফিসে আবদুস সালাম
প্রশাসন
চালানোর ব্যাপারে তিনি রবার্ট ওপেনহেইমারকে আদর্শ মানেন। তিনি দেখেছেন কী অসাধারণ
দক্ষতায় প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ চালাচ্ছেন ওপেনহেইমার।
প্রফেসর সালাম তাঁর সেন্টারে প্রশাসন চালাতে শুরু করলেন- প্রশাসক হিসেবে নয়,
বিজ্ঞানী হিসেবে। তিনি মনে করেন, "যদি কোন রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মনে
করেন যে প্রশাসনিক কাজ করতে করতে তিনি বিজ্ঞানী হতে পারছেন না, তাহলে বুঝতে হবে
তিনি কোন কাজের নন। একজন বোকাও প্রশাসন চালাতে পারে। যে বিজ্ঞানী প্রশাসনিক পদে
আছেন তাঁর জানা উচিত যে বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের কারণে বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যেই
তাঁকে এই পদে বসানো হয়েছে, বিজ্ঞান ছেড়ে দেয়ার জন্য নয়।" কিন্তু অনেক
বিজ্ঞানী প্রশাসনে এসে ভুলে যান সব। তখন তাঁরা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান নিজের
পদ ধরে রাখার জন্য। আবদুস সালাম সেই দলের ছিলেন না।
১৯৭০ সালে ইউনেস্কো আই-সি-টি-পি'র
পার্টনার হয় আই-এ-ই-এ'র মতো সমান অংশীদারিত্বে। গবেষণা কেন্দ্রের আরো প্রসার ঘটানো
সম্ভব হলো তাতে। গণিত, আবহাওয়া বিজ্ঞান, সামুদ্রিক বিজ্ঞান, লেসার ফিজিক্স,
এনার্জি ফিজিক্স, ফিজিক্স টিচিং ইত্যাদি সব বিষয়ে গবেষণা চালু হলো পুরোদমে।
১৯৭২ সালে আবদুস সালাম কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের সব শীর্ষবিজ্ঞানীদের নিয়ে আই-সি-টি-পিতে আয়োজন করলেন কোয়ান্টাম
মেকানিক্স সিম্পোজিয়ামের। হাইজেনবার্গ, ডিরাক, উইগনার, পিয়ের্লস- সবাই উপস্থিত
ছিলেন এই সিম্পোজিয়ামে। উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য এটা যে কতবড় সুযোগ।
১৯৭৯ সালে আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কার
পাবার পর আই-সি-টি-পি'র সম্মান মর্যাদা এবং সামর্থ্য বেড়ে গেলো বহুগুণ। সেন্টারের
তহবিল নিয়ে তেমন কোন সমস্যা নেই কারণ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন আই-সি-টি-পিতে নিয়মিত
অনুদান দিতে শুরু করেছে। আরো অনেক বৃত্তি, বিভাগ এবং গবেষণা প্রকল্প চালু হলো এই
গবেষণা কেন্দ্রে। সময়ের সাথে সাথে কেন্দ্রের গবেষণার ব্যপ্তি বেড়েছে অনেক। উন্নয়নশীল
বিশ্বের বিজ্ঞানীদের জন্য নিয়মিতভাবে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে 'আবদুস সালাম
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স'।
No comments:
Post a Comment